প্রতিবেশীর আগ্রাসী অবস্থান ও নিরাপত্তা সংকট

ব্রি জে (অব.) এইচ আর এম রোকন উদ্দিন
প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০২৫, ০৯: ৪৬

দেড় দশক ধরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতা এক ধরনের বিদেশি পৃষ্ঠপোষকতার ছায়ায় পরিচালিত হয়েছে—যার প্রধান উৎস ছিল প্রতিবেশী ভারত। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সাল থেকে টানা ১৬ বছর ক্ষমতায় ছিল এবং এ সময় ভারতের সঙ্গে এমন একটি সম্পর্ক তৈরি হয়, যেখানে বাংলাদেশের স্বার্থ বারবার বিসর্জন দিয়ে ভারতীয় স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এ সরকারের পররাষ্ট্রনীতি ছিল কার্যত ভারতের প্রতি সম্পূর্ণরূপে নতজানু। এই পৃষ্ঠপোষকতা শুধু রাজনৈতিক ছিল না; এটি ছিল কৌশলগত ও নিরাপত্তাভিত্তিক। ট্রানজিট, বন্দর ব্যবহার, বাণিজ্য, যোগাযোগ এবং নিরাপত্তা সহযোগিতার নামে বাংলাদেশ এমন সব চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে, যা একতরফাভাবে ভারতের স্বার্থ রক্ষা করেছে। এসবের মধ্যে গঙ্গার পানিবণ্টন, তিস্তা চুক্তি অনিষ্পন্ন থাকা, সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের নীরবতা ও ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার মতো বিষয়গুলো সবচেয়ে বেশি আলোচিত।

উদ্বেগজনক চুক্তিগুলোর একটি হলো চট্টগ্রামের মিরসরাই-সীতাকুণ্ড অর্থনৈতিক অঞ্চলে ভারতকে ৯০০ একর জমি ইজারা দেওয়া। এই চুক্তির মাধ্যমে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চলে বিদেশি রাষ্ট্রের উপস্থিতি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যা সরাসরি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। শেখ হাসিনা সরকারের হঠাৎ পতন ভারতের জন্য ছিল এক বিপর্যয়কর ধাক্কা। যে সরকার এতদিন তাদের রাজনৈতিক ও কৌশলগত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সহযোগী ছিল, সেই সরকারের পতন তারা সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। ফলে, হাসিনার পতনের পর থেকেই ভারতের নীতিতে ব্যাপক কৌশলগত পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। ভারত এখন বাংলাদেশের নতুন সরকার ও জনগণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপপ্রচার, বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানো এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অপচেষ্টা শুরু করেছে। বিশেষভাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস—যিনি সাহসিকতার সঙ্গে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও অঞ্চলভিত্তিক সমতা নিয়ে কথা বলেন, তাকে লক্ষ্য করে বিভ্রান্তিকর প্রচার চালানো হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

এ ছাড়া সীমান্তে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর কার্যক্রম আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিলেট সীমান্তে সেনা এবং বিএসএফ সদস্যদের উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে, আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করে বেআইনিভাবে সীমান্ত চিহ্নিতকরণ ও কাঁটাতারের বেড়া বসানো হচ্ছে এবং সীমান্তজুড়ে ফ্লাড লাইট বসিয়ে জনগণের গোপনীয়তা, ফসল ও পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করা হচ্ছে। এমনকি লালমনিরহাট সীমান্তে ভারতীয় বিমান সম্পদ মোতায়েনের খবরও প্রকাশ্যে এসেছে, যা একপ্রকার প্রতিরক্ষা ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিরুদ্ধে সরাসরি হুমকি। এর পাশাপাশি ‘পুশ ইন’ কৌশলের মাধ্যমে ভারত থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশ ঘটানো হচ্ছে, যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সামাজিক কাঠামো দুর্বল করতে পারে। একই সঙ্গে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা বন্ধ করে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে।

ভূকৌশলগতভাবে দুটি অঞ্চলের নিরাপত্তা এখন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে : শিলিগুড়ি করিডোর এবং ফেনী অঞ্চল। শিলিগুড়ি করিডোর বা ‘চিকেনস নেক’ ভারতের মূল ভূখণ্ড ও উত্তর-পূর্ব সাতটি রাজ্যের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি শহরের আশপাশে অবস্থিত এই করিডোর। এটি উত্তরে ভুটান, পশ্চিমে নেপাল, দক্ষিণে বাংলাদেশ এবং সামান্য দূরে উত্তর-পূর্বে চীনের চুম্বি ভ্যালি দ্বারা পরিবেষ্টিত। এটি ভারতের মূল ভূখণ্ডকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের (আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল প্রদেশ) সঙ্গে সংযুক্ত করে। শিলিগুড়ি করিডোরের দৈর্ঘ্য ৬০ কিলোমিটার ও প্রস্থ ২২ কিলোমিটার। এটিই একমাত্র ভূমিপথ, যা ভারতের মূল ভূখণ্ডকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত রাখে। সড়ক, রেল, গ্যাস পাইপলাইন, বিদ্যুৎ পরিবহন ইত্যাদি সব মূল পরিকাঠামো এই করিডোর দিয়েই চলে। কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিদ্রোহ অথবা বিদেশি হস্তক্ষেপ এই পথকে অচল করে দিলে উত্তর-পূর্ব ভারত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে। চীনের চুম্বি ভ্যালি এই করিডোরের খুব কাছেই অবস্থিত। সামান্য আগ্রাসন করেই চীন এই করিডোর বন্ধ করতে সক্ষম—এটি ভারতের জন্য একটি বড় কৌশলগত হুমকি। বাংলাদেশ সীমান্তেও নজরদারি ও সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যদি আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। ভারত সরকার করিডোরের সুরক্ষায় সড়ক, রেল ও সেনাবাহিনীর উপস্থিতি জোরদার করেছে। এই অঞ্চল বিচ্ছিন্ন হলে ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ভেঙে পড়বে।

একইভাবে, ফেনী অঞ্চলের সংকীর্ণ অংশ যদি ভারতের দ্বারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তাহলে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের সঙ্গে মূল বাংলাদেশের সংযোগ বিঘ্নিত হতে পারে। ফেনী জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত, চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। এর উত্তর-পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পশ্চিমে নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলা দ্বারা আবদ্ধ। এই করিডোর বিশেষ একটি আকারে ‘ফেনী-বেলোনিয়া ফিঙ্গার’ নামে পরিচিত, যা বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে ভারতের ত্রিপুরায় ঢুকে যায় এবং প্রায় চারদিকে ভারতীয় ভূখণ্ডে ঘেরা থাকে। এটি আনুমানিক ১৬ কিমি দৈর্ঘ্য এবং চার থেকে ছয়  কিমি প্রস্থের একটি অতিসংকীর্ণ ভূমিভাগ, যা ভারতের মধ্যে প্রবেশ করেছে। এই করিডোরটি বাংলাদেশের ফেনী সদর উপজেলার উত্তরে, বেলোনিয়া শহরের আশপাশে অবস্থিত। এই করিডোর একটি ভূরাজনৈতিক ‘চিকেনস নেক’ হিসেবে গণ্য—কারণ এটি ফেনী ও ফেনী সদরকে ভারতের বৃহত্তর ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করে রাখে, একইভাবে সংযোগ বজায় রাখে এখানে অর্থনৈতিক ও সামরিক গতিপ্রবাহ। একদিকে এটি বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে দুভাগে বিভক্ত না করে অব্যাহত রাখে, অন্যদিকে এর সংকীর্ণতা সীমান্ত নিরাপত্তার কঠিন চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।

ফেনী করিডোর শুধু একটি ভৌগোলিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও সীমান্ত নিরাপত্তার এক গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জিং এলাকা। সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী, আধুনিক প্রযুক্তি এবং দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক সংহতির মাধ্যমে করিডোরের নিরাপত্তাব্যবস্থা টেকসই রাখা হচ্ছে। সংকীর্ণতা ও ভূখণ্ডের বিশেষ আকৃতির কারণে দ্রুত প্রতিক্রিয়া এবং উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন বাহিনী মোতায়েন জরুরি। মাদক ও মানব পাচারের ঝুঁকি বেশি, তাই সীমান্তে গোপন নজরদারি এবং স্থানীয় তথ্যভিত্তিক অভিযান চালানো হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা বা বিদেশি প্ররোচনার সুযোগে এই করিডোরটি ঝুঁকিতে পড়তে পারে—তাই কৌশলগত গুরুত্ব বাড়ছে।

এই বাস্তবতায় বাংলাদেশের জন্য এখন সময় এসেছে দ্রুত ও কৌশলগতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার।

প্রথমত, এমন সব চুক্তি—যেগুলো দেশের স্বার্থের পরিপন্থী এবং গোপনে বা একতরফাভাবে করা হয়েছে, তা অবিলম্বে বাতিল করা উচিত। বিশেষভাবে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৯০০ একর জমি ভারতকে দেওয়ার চুক্তি বাতিল করা জরুরি, কারণ এটি ভবিষ্যতের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।

দ্বিতীয়ত, সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। শুধু সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ওপর নির্ভর না করে বিশেষ বাহিনী মোতায়েন করতে হবে। স্থানীয় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ‘জনগণ-সেনা-প্রশাসন’ সমন্বিত নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তুলতে হবে।

তৃতীয়ত, লালমনিরহাট বিমানবন্দরকে আধুনিকায়ন করতে হবে, যাতে এটি উত্তরাঞ্চলের একটি কৌশলগত বাণিজ্যিক ও প্রতিরক্ষা ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। পাশাপাশি কক্সবাজার ও টেকনাফ অঞ্চলেও নজরদারি এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীল অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে।

চতুর্থত, সাহসী ও সক্রিয় কূটনৈতিক তৎপরতা গড়ে তুলতে হবে। ভারতের সীমান্ত লঙ্ঘন, অনুপ্রবেশ, হত্যা ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ জাতিসংঘ, ওআইসি ও অন্যান্য ফোরামে উপস্থাপন করতে হবে। শুধু দক্ষিণ এশিয়ার গণ্ডিতে না থেকে মধ্যপ্রাচ্য, আসিয়ান, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার সঙ্গে কৌশলগত বন্ধুত্ব জোরদার করতে হবে।

পঞ্চমত, আমরা আমাদের প্রতিবেশী পরিবর্তন করতে পারব না, কিন্তু প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের ধরন আমরা পরিবর্তন করতে পারি। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে পরাধীনতা নয়—এই হোক আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক হতে হবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সমতা ও আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে।

ষষ্ঠত, শিলিগুড়ি ও ফেনী করিডোরের ভৌগোলিক সংবেদনশীলতা এবং কৌশলগত গুরুত্ব বিবেচনায় এ দুই এলাকায় একটি শক্তিশালী ও স্থায়ী সেনা উপস্থিতি নিশ্চিত করা অত্যন্ত আবশ্যক। এখানে স্থায়ী বা অগ্রসর সামরিক স্থাপনা গড়ে তোলা শুধু সীমান্ত সুরক্ষা ও কার্যকর নজরদারির জন্যই নয়, বরং যেকোনো নিরাপত্তা হুমকি, সীমান্ত লঙ্ঘন বা ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার মুহূর্তে দ্রুত ও সুনির্দিষ্ট প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করার জন্যও অপরিহার্য। এই সংকীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ করিডোরগুলোয় প্রতিক্রিয়ায় সামান্য বিলম্বও বড় বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে—এ কারণে সশস্ত্র বাহিনীর উপস্থিতি একদিকে যেমন একটি কার্যকর প্রতিরোধব্যবস্থা, অন্যদিকে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য একটি প্রস্তুত সক্ষমতা হিসেবেও কাজ করে।

সবশেষে, জাতীয় নিরাপত্তা শুধু সেনাবাহিনীর একক দায়িত্ব নয়—এটি প্রত্যেক সচেতন নাগরিকের সম্মিলিত দায়িত্ব। আমাদের তরুণসমাজ, সাংবাদিক, গবেষক, শিক্ষক ও পেশাজীবীদের উচিত দেশপ্রেমের ভিত্তিতে, তথ্যনির্ভর এবং কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গিতে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা। এই অস্থির ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ আর নিষ্ক্রিয় থাকার বিলাসিতা দেখাতে পারে না। এখন সময় হয়েছে সাহসী, স্বতন্ত্র ও দেশপ্রেমভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতি গড়ে তোলার, যা আমাদের ভৌগোলিক অখণ্ডতা, অর্থনৈতিক স্বার্থ ও সাংস্কৃতিক মর্যাদা রক্ষা করবে। এই হোক জাতীয় জাগরণের মুহূর্ত—আমরা প্রতিবাদ করব না শুধু আত্মরক্ষার জন্য, বরং আত্মমর্যাদা ও সম্মানের ভিত্তিতে বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত