পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা সংকট-বিষয়ক তিন দিনের আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। ১০টি রাজনৈতিক দলের দশজন নেতা ছাড়াও এ কনফারেন্সে আরো ছিলেন প্রায় ৪০টি দেশের সরকারের প্রতিনিধি, দাতা সংস্থার প্রতিনিধি, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, দেশ-বিদেশ থেকে আগত রোহিঙ্গা নেতৃত্বসহ সংশ্লিষ্ট প্রায় হাজার খানেক মানুষ।
প্রথম দিনের প্রোগ্রামে বেশ কিছু রোহিঙ্গার মুখে তাদের দুঃখগাথা শুনেছি। মনটা খুবই খারাপ হয়েছে। তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই মুখে একই আলাপ—‘সমস্যার টেকসই সমাধান চাই, নিরাপদে দেশে ফিরতে চাই, আর কখনো যেন রিফিউজি হতে না হয়।’
একজন বললেন, তার দাদি তিনবার রিফিউজি হয়েছেন, এখনো বাংলাদেশেই আছেন এবং তার ধারণা রিফিউজি অবস্থাতেই তার মৃত্যু হবে।
সম্মেলনে কয়েকজন রোহিঙ্গা খুবই সুরেলা কণ্ঠে তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, তাদের দেশ, তাদের সংস্কৃতি এবং তাদের মানুষ নিয়ে দুর্দান্ত কিছু গান গাচ্ছিলেন। প্রতিটা গানেই প্রায় একই সুর, একই কান্না—‘কবে ফিরব আমার নিজের দেশে?’
কনফারেন্সের দ্বিতীয় দিন সবচেয়ে বড় ইভেন্ট ছিল প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য। তিনি রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে সাত দফা প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।
একটা আনন্দময় সেশন ছিল চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে। সেখানে একাধিক বক্তা সরাসরি বলছিলেন চীনকে যুদ্ধরত বাহিনীগুলোকে অস্ত্র সহায়তা দেওয়া বন্ধ করতে হবে। তাহলে পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে। চীনা রাষ্ট্রদূত অবশ্য এই আলাপটা এড়িয়ে গিয়েছিলেন প্রতিবারই।
তৃতীয় দিনের প্রোগ্রাম ছিল রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন। আমরা ৯ নম্বর ও ৪ নম্বর ক্যাম্পে অবস্থিত একটি হাসপাতাল (ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল), একটি খাদ্যপণ্য বিতরণ কেন্দ্র এবং একটি প্রশিক্ষণ ও উৎপাদন কেন্দ্র পরিদর্শন করি।
৯ নম্বর ক্যাম্পের ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালটি বর্ডার এলাকার এক-দেড় কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত। এখানে স্থল বর্ডার। নাফ নদী এখানে শুরু হয়নি। কর্তৃপক্ষ তাদের ফ্যাসিলিটি ঘুরিয়ে দেখান। রোহিঙ্গা বাংলাদেশি নির্বিশেষে এখানে বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সেখানে উপস্থিত কিছু রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে আলাপ করে জানলাম, চিকিৎসার মান ভালো। খরচ না থাকার কারণে ঢাকা থেকেও নাকি এলাকায় ফিরে এখানে সিজার করান কেউ কেউ। কিন্তু এখন তাদের কার্যক্রম সীমিত থেকে সীমিত হয়ে যাচ্ছে। ডিসেম্বর নাগাদ নতুন ফান্ডের ব্যবস্থা না হলে হাসপাতাল প্রায় অকার্যকর হয়ে যাবে।
৪ নম্বর ক্যাম্পের খাদ্যপণ্য বিতরণ কেন্দ্র থেকে জনপ্রতি মাসে ১১ কেজি করে চালসহ, ডাল, তেল, নুন, মাছ, সবজি ইত্যাদি প্রদান করা হয়। এখানে একটা বেশ উন্নত ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম দেখলাম। শরণার্থী পরিচয়পত্র স্ক্যান করে একেক আইডিতে কতটুকু নেওয়া হয়েছে, কতটুকু ব্যালেন্স আছে, সহজে ম্যানেজ করা যায়। এখানকার ইনচার্জ জানালেন, খাদ্য সহায়তার ৭০ ভাগ আমেরিকার সহায়তানির্ভর। ডিসেম্বর থেকে ট্রাম্প প্রশাসন সেই সহায়তা পুরোটাই বন্ধ করে দিতে পারে। ভেজিটেবল অয়েল ছাড়া এখানকার সব খাদ্যপণ্য সাধারণত বাংলাদেশের বাজার থেকে সরবরাহ করা হয়।
রোহিঙ্গাদের অটোমোবাইল থেকে শুরু করে আইইএলটিএস প্রশিক্ষণ দেওয়ার সম্ভবত ১৫টি সেন্টার আছে। সেখানেও কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হলো। একজন আইইএলটিএস গ্র্যাজুয়েট (৬.৫ স্কোর) আমাদের সঙ্গে বেশ চোস্ত ইংরেজিতে আলাপও করলেন। টেকনিক্যাল ট্রেনিংগুলো মিয়ানমারের কারিকুলাম অনুযায়ী হয়।
প্রোডাকশন প্ল্যান্টে কেবল রোহিঙ্গা নারীদের জন্য আন্ডার গার্মেন্ট, স্বাস্থ্যসহায়তা পণ্য ও কিছু কারুপণ্য তৈরি করা হয়। কোনো পণ্যই খোলাবাজারে বিক্রি করা হয় না। বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি নেই। সেজন্য উৎপাদন সীমিত রাখা হয়। কারুপণ্যগুলো এবারের কনফারেন্সের মতো বিভিন্ন প্রোগ্রামে স্যুভেনির হিসেবে দেওয়া হয়।
সামগ্রিকভাবে যতটুকু বুঝলাম, রোহিঙ্গা ইস্যুর দ্রুত সমাধান না হলে এই ক্যাম্পগুলো রোহিঙ্গাদের জন্য একটা নরক হয়ে উঠতে বেশি সময় নেবে না। তখন এটা আমাদের দেশের জন্যও হয়ে উঠবে একটা টাইম বোমা।
এরই মধ্যে ক্যাম্পের পরিবেশ খুবই দূষিত—মারামারি, দলাদলি, খুন ও ধর্ষণের ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। শরণার্থীদের নিজেদের মধ্যেই এসব অপরাধ হচ্ছে। শুনেছি প্রায় প্রতিদিনই ১০-১৫টা ধর্ষণের অভিযোগ আসে। ১৫ লাখ মানুষের একটা দলকে (অল্প এলাকায় অনেক লোক অর্থে) নিরাপত্তা দেওয়া যেকোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য কঠিন। সন্ধ্যার পর সেটা অসম্ভব হয়ে যায়। এমনকি সেসময় ক্যাম্পগুলোয় অস্ত্র নিয়ে চাঁদাবাজি, মারামারি এবং অস্ত্র প্রশিক্ষণের অভিযোগও শোনা যায়। শরণার্থীদের কোনো গঠনমূলক ও উৎপাদনমূলক কাজে যুক্ত না করলে পরিস্থিতি দ্রুত আরো বীভৎস হবে, বলা বাহুল্য।
আপৎকালে ডোনারদের সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে, রোহিঙ্গাদের উৎপাদিত পণ্য ‘মেড বাই রোহিঙ্গা রিফিউজিস’ ব্র্যান্ডিং করে বিদেশে বিক্রি করে তাদের জীবনমান অন্তত কিছুটা উন্নত করা সম্ভব। আর আলটিমেট সমাধান, তাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন এবং আবার যেন রিফিউজি হতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
তবে সেটা খুবই চ্যালেঞ্জিং নিশ্চয়। কিন্তু এর ব্যর্থতার যে ফলাফল, সেটা সহ্য করা আরো অসম্ভব হবে নিশ্চয়।
যেকোনো সমস্যার একটা আর্থিক দিক নিশ্চয় আছে। অনেকে বলেন, চীন এ এলাকার সব গ্রুপের কাছে অস্ত্র বেচা বন্ধ করলে সমাধান হবে। আমার মনে হয়, টাকার জোগান থাকলে অস্ত্র কেউ না কেউ নিশ্চয় জোগান দেবে। কাজেই টাকার সোর্স বন্ধ করা প্রথম কাজ।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে মাদকের বিশাল ব্যবসা। এটা বছরে তিন থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকারও বেশি হতে পারে। ইয়াবা ও আইসের প্রধান সোর্স এই সীমান্ত। এই নারকো অর্থনীতির এ মুহূর্তের বড় বেনিফিশিয়ারি হলো আরাকান আর্মি (যেহেতু সীমান্ত অঞ্চলের বড় অংশ এখন তাদের দখলে)। আরসা ও জান্তা বাহিনীও কিছু ভাগ পায়। বাংলাদেশ অংশে স্থানীয় প্রভাবশালীরা এবং সরকার ও প্রশাসনের অংশ সবসময় এ নারকো অর্থনীতির মাধ্যম ও সুবিধাভোগী ছিল। অভ্যুত্থানের পরও আছে। লোক বদল হয়েছে কেবল।
এই মাদক ব্যবসা যদি অন্তত ৫০ ভাগও বন্ধ করা যায়, তাহলেও অন্তত আরাকান অঞ্চলে যুদ্ধ-দুর্দশা অনেকাংশে কমবে। পাশাপাশি এ অঞ্চলে চায়নার অস্ত্র ব্যবসা বন্ধ করাতে হবে। তবে ইতোমধ্যে চীন বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে। অন্যদিকে তারা সমর্থন বৃদ্ধি করেছে জান্তা সরকারের প্রতি।
শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সমস্যা ব্যবহার করে নোবেল পুরস্কার জিততে চেয়েছিলেন। আর নিজের দলের লোকদের ব্যবসার ক্ষেত্র নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। নারকটিক্স অর্থনীতির বিকাশ করেছিলেন, সুবিধা নিয়েছিলেন। ফলাফল রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের কোনো সম্ভাবনা, সুযোগই তৈরি হয়নি। এবার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, আমরা যদি নারকো বা মাদক অর্থনীতির ফাঁদ থেকে মুক্ত হয়ে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান যাত্রা শুরু করতে পারি, তবে এর সমাধান অনেকটা সহজ হতে পারে।
রোহিঙ্গা সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান নিশ্চয়ই সম্ভব। এখানে রোহিঙ্গাদেরই সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখতে হবে। সঙ্গে লাগবে আমাদের সবার সর্বোত্তম সমর্থন, সর্বোচ্চ সহায়তা।
আমরাও একসময় রোহিঙ্গাদের মতো রাষ্ট্রবিহীন ছিলাম। আমাদের সরকার ও রাষ্ট্রও আমাদের গুম করত, খুন করত, আমাদের সম্পদ লুট করত। আমাদের সাধারণ জনগণের কোনো অধিকার ছিল না।
ষোলো বছর আমরা হাসিনার বিরুদ্ধে লড়েছি; পারিনি। শেষমেষ যখন আমরা সব এক হলাম, আমরা সব মজলুম যখন সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূরত্ব-বিভেদ দূর করে একসঙ্গে এলাম, ঐক্যবদ্ধ হলাম, তখনই সফল হলাম। তখনই হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন।
রোহিঙ্গাদেরও সব ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে দাঁড়াতে হবে দেশে ফেরার বিষয়ে। তাহলেই তারা ফিরে পাবে নিজ দেশ, নিজ ভিটামাটি।
লেখক : জয়েন্ট সেক্রেটারি জেনারেল, বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন


‘শিবির নাছিরের’ পতনের পর দখলে নেন বড় সাজ্জাদ