ড. মো. আদনান আরিফ সালিম
স্যাটায়ার, মিম আর ট্রল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় স্ক্রল করতে গেলে ইদানীং এর বাইরে খুব বেশি বিষয় মনে হয় আর দৃষ্টিগোচর হয় না। ওদিকে বাংলা কিংবা ইংরেজির বিশেষ একটি রূপ চোখে পড়ে তাদের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে। আপনি যদি আগে থেকে এই শব্দবন্ধগুলোর সঙ্গে পরিচিত না হন, তবে আপনার পক্ষে বোঝা সম্ভব না তারা আসলে কী বলতে চাইছে। হঠাৎ করেই আপনাদের চোখে পড়তে পারে ‘অরা’ (Aura) শব্দটি। কিন্তু এটি যে ব্যক্তিত্বের পরিমাপ হিসেবে কেউ কতটা ‘কুল’ বা ‘আনকুল’ তা বোঝায়, সেটি অনুমান করা অন্যদের জন্য বেশ কঠিন। একইভাবে আপনি অনুমানও করতে পারবেন না ‘বেইজড’ (Based) শব্দটি কোনো ব্যক্তির নিজের মতামত বা অবস্থান বজায় রাখার বিষয়টিকে তুলে ধরছে।
ধরুন আপনার চোখে পড়ল ‘ব্রাহ্’ (Bruh) শব্দটি, যা মূলত হতচকিত হয়ে ওঠা বোঝাতে লেখা হয়েছে। কিন্তু তার মূল অর্থ ‘ব্রাদার’ বা ভাই। এটি আবার বিরক্তির প্রকাশ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। যেমন : ‘ধুর্বাল এইডা কি কর্লা, ব্রাহ’। একইভাবে তারা ‘বাসিন’ (Bussin) শব্দটি দিয়ে বোঝাচ্ছে দুর্দান্ত অর্থ। যেমন : ‘মোজাম্মেলের ভুঁড়িটা যা হয়েছে না! এক্কেরে বাসিন!’ বাংলাতে আমরা কাউকে ঠকানো অর্থে টুপি পরানো কথাটি কমবেশি ব্যবহৃত হতে দেখেছি। জেন-জি ওটাকে পাল্টে দিয়েছে সরাসরি ‘ক্যাপ’ (Cap) শব্দটির মাধ্যমে মিথ্যা বুঝিয়ে। কেউ মিথ্যা বললে জেন-জি তাকে ‘ক্যাপ’ বা ‘ক্যাপিং’ হিসেবে ধরে।
বিশ্ব যখন বদলে যাচ্ছে, আপনার চারপাশের চিরচেনা জগতের ভাষাগুলোও এভাবে পাল্টে যাবে কেউ কি ভেবেছিলেন? এতদিন জেনে এসেছিলেন ‘কুক’ (Cook) মানে রান্না করা কিন্তু এটাই যখন বিব্রত বা অস্বস্তিবোধ অর্থে বোঝায়, তখন আপনার করণীয় কী? একইভাবে ‘ডেলুলু’ (Delulu), ‘ড্রিপ’ (Drip), ‘এরা’ (Era), ‘ফ্লেক্স’ (Flex), ‘গ্লো আপ’ (Glow-Up), ‘গোট’ (GOAT), ‘আই ওয়াই কে ওয়াই কে’ (Iykyk), ‘লিট’ (Lit), ‘ওকে বুমার’ (OK Boomer), ‘পুকি’ (Pookie), ‘রেড ফ্ল্যাগ’ (Red flag), ‘রিজ’ (Rizz), ‘সিম্প’ (Simp), ‘স্কিবিডি’ (Skibidi), ‘সাস’ (Sus), কিংবা ‘টি’ (Tea) সম্পর্কে আগের জেনারেশনের মানুষের জানা থাকার কথা নয়। তাই যোগাযোগের ক্ষেত্রে দূরত্ব তৈরি হতেই পারে।
রাজনীতির প্রাথমিক এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হচ্ছে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ। এই বিষয়গুলো না জেনেই যদি কেউ রাজনীতির মাঠে নেমে পড়ে, তাহলে সমস্যার জায়গাটা কোথায় তৈরি হচ্ছে? কিছুই না, সে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিয়ে চিৎকার করে বলতে পারে ‘হায়রে হায় বাংলাদেশ। হায়রে বাঙালি জাতি। একটা লোক জীবনে-যৌবনে কারাগারে কাটিয়ে ফাঁসির মঞ্চে গিয়ে বাঙালিকে শিখিয়েছে...। ওদিকে তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বলা যায় ওখানেই খতম। তারপর সে যতগুলো জায়গায় চিৎকার করেছে, সেগুলো জেন-জি গ্রহণ করেছে মিম এলিমেন্ট হিসেবে। আর এটার সর্বশেষ সংস্করণ চোখে পড়ে ফেসবুকের একটা ট্রল পেজের ফটোকার্ডের বিজ্ঞাপনে। সেখানে লেখা ‘ফজু পাগলা ঘি। কুত্তার পেটে হজম হওয়া দেশের প্রথম ঘি। সোজা আঙুলে উঠে আসে সহজে’।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের এই বিষয়টাকে জেন-জির ভাষায় বোঝাতে পারলে কেউ বিরক্ত হতো না। বরং জাতির জন্ম হিসেবে গৌরবের এই বিষয়টাকে জেন-জি গর্বের সঙ্গেই গ্রহণ করত। কারণ তারা মুক্তিযুদ্ধকে তাদের হৃদয়ে ধারণ করে অনেক উচ্চস্থান দিয়ে। তাই তারা কাউকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যবসা করতে দেখলে চরম বিরক্ত হয়। ওদিকে কেউ যদি নিজের অতীত কৃতকর্মের কথা অস্বীকারের উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে, তাদেরও পছন্দ করে না জেন-জি। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে জীবনবাজি রেখে রাজপথে থাকা জেন-জি জুলাই আগস্টের অভ্যুত্থানকেও একইভাবে হৃদয়ে ধারণ করে। কিন্তু কেউ এটাকে নিয়ে ব্যবসা করতে চাইলে তাদেরও মুক্তিযুদ্ধের ব্যবসায়ীদের মতোই ঘৃণাভরে ছুড়ে ফেলছে তারা।
বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে এটাকে একটা সাধারণ উদাহরণ হিসেবে নিতে পারেন। বাংলাদেশের পাশাপাশি আশপাশের দেশগুলোয় চোখ রাখতে বুঝতে পারবেন এমন ঘটনা প্রতিদিন হরহামেশা ঘটছে। আর প্রতাপশালী রাজনীতিবিদদের চোখের পলকে পুরো কার্টুনের মতো হাস্যরসাত্মক চরিত্রে পরিণত হতে হয়েছে। আর এ জন্যই জেন-জির ভাষা বুঝতে না পারলে তারা যেই হোক তাদের রাজনীতি বিশ্বের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে। এটা শুধু বাংলাদেশ না, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তবতা। যেমন : রাহুল গান্ধীর মতো রাজনীতিবিদকে সবাই চিনে ‘গুডবাই! খতম! গ্যায়া! টা টা! বাই বাই!’ হিসেবে। মমতা ব্যানার্জিকে চিনে ‘শুট্যিয়ে লাল করে দেবো’ কিংবা ‘হাম্বা, কম্বা, বুম্মা’ কবিতার আবৃত্তিকার হিসেবে।
বুমার রাজনীতিবিদরা এমনিতেই হারিয়ে যাবেন। বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত এসব ভদ্রলোক কিংবা ভদ্রমহিলারা মাঝেমধ্যে দু-একটা টেলিভিশনে গিয়ে অহেতুক চিৎকার দিয়ে নিজেরাই ট্রলের শিকার হন। তারপর তাদের নিয়ে তৈরি সেই ট্রলগুলো ফেসবুক কিংবা ইউটিউবে ঘুরে ঘুরে ভাইরাল হয়। এ জন্যই রাজনীতির অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি যারা এখনো নতুন জেনারেশনের ভাষা বুঝতে পারছেন না, সেটা তাদের জন্য ভয়াবহ লজ্জাজনক হয়ে উঠছে। রাজনীতির মাঠে আগুণ ঝরা বক্তব্য দেওয়া মানুষগুলোও এখন দুশ্চিন্তায় আছেন কখন কাকে কোন ট্রল কিংবা মিমের শিকার হতে হয়।
সুলেখক সুবাইল বিন আলম এ জন্যই বলেছেন, ‘বাংলাদেশে এখন রাজনীতি করে বেঁচেবর্তে থাকতে হলে সব দলের প্রতিটি রাজনীতিবিদকেই জেন-জির ভাষায় কথা বলতে হবে।’ তিনি অনেকগুলো যুক্তি দিয়েছিলেন, যা সংক্ষিপ্ত পরিসরে লেখা কঠিন। এগুলোর প্রায় প্রতিটি বক্তব্য আমার চিন্তার সঙ্গে পুরোপুরি মিলে গিয়েছিল। তখন আমরা খেয়াল করে দেখি বাংলাদেশের বেশির ভাগ রাজনীতিবিদের এই কমনসেন্স নেই, কী প্রচার করতে হবে আর কোন জিনিস নিয়ে বাড়াবাড়ি করা যাবে না। অবশ্যই এর মূল কারণ তারা জেন-জির ভাষা বুঝতে পারেন না।
ডলি সায়ন্তনী নামের জনৈক গায়িকার একটা গান ছিল ‘জ্বলন্ত সিগারেট হাতে ধরা। রঙচটা জিনসের প্যান্ট পরা...’। বাংলাদেশের রাজনীতির আইকনদের বোঝানোর জন্য সেটা ওই সময়ের একটা ট্রেন্ড হিসেবে ধরলে এগুলোকে জেন-জি এখন ঘৃণাভরে ছুড়ে ফেলেছে। আর সেটা বুঝতে না পারলে রাজনীতিতে বহুমুখী ক্ষতির মধ্যে পড়তে হবে। যেমন ধরেন, লজ্জাজনক হলেও সত্য, ডাকসু ইলেকশনের মধ্যে উত্তেজনাবশত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস একটা বেয়াদবি করে ফেলছেন। ছাত্ররাজনীতি কিংবা দেশের সাধারণ রাজনীতিতে এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু এটাকে বাহবা দিয়ে মাথায় তোলার কোনো বিষয় ছিল না। আর সেটা করতে গিয়ে অনলাইন অ্যাকটিভিস্টদের অনেকেই বিপাকে পড়েছেন।
গণেশ চন্দ্র রায় সাহসের এই ভিডিও প্রচারের আগে খেয়াল করা উচিত ছিল এ সময়েই ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল পুরোটা আলাপনে কতটা নম্র, ভদ্র ও বিনয়ী ছিল সেদিকে। যদি রাজনীতিবিদরা জেন-জির ভাষা বুঝতেন, তাহলে গণেশের বেয়াদবিকে প্রশ্রয় না দিয়ে সেটির জন্য সরি বলে রাকিবুলের ভিডিওটাকে ফোকাস করতেন। এতে করে জেন-জি ক্ষেপে যেত না। উল্টো রাকিবুল যেভাবে করজোড়ে মাফ চাচ্ছিল ভিসির কাছে, সেটাকেই হাসিমুখে গ্রহণ করে সাহসের বেয়াদবির কথা হয়তো ভুলে যেত।
আমি বর্তমান প্রজন্মের অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের থেকে জেনেছি ফেসবুকে রিলস দেখতে গেলে সেখানে জাকির খানের প্রচুর ভিডিও চোখে পড়ে। তার চাপা ভাঙা ফেস কাটিং, আউটলুক আর এক্সপ্রেশন দেখামাত্র জেন-জি ক্ষেপে যাচ্ছে। ওদিকে যুবদল নেতা নয়নের নানা জোকারির বিশেষ করে ‘যমুনারে যমুনা, আমরা কিন্তু যামুনা’ ভিডিও তারা বেশ হাসিমুখে গ্রহণ করেছে। কিন্তু তারা বিরক্ত বরকতউল্লা বুলুর মূত্রত্যাগ, মির্জা আব্বাসের নানা বক্তব্য কিংবা আরেক বর্ষীয়ান নেতা হাবিবুর রহমান হাবিবের ‘জিহ্বা কাইট্যা কালা কুত্তা দিয়া খাওয়ামু’ ভিডিও নিয়ে। একইভাবে রুমিন ফারহানার দেওয়া সেই ‘আগেই ভালো ছিলাম, ১৫ বছর যা হয়নি, এখন তাই হচ্ছে, ফকিন্নির বাচ্চা কিংবা ডাকাতের মতো চেহারা টাইপের ভিডিওগুলো নিয়ে জেন-জি যাচ্ছেতাইভাবে ট্রল করছে। মেয়েদের পাশাপাশি অনেক ছেলেও চোখের উপরে-নিচে বিশ্রীভাবে কাজল দিয়ে ভিডিও বানিয়ে তাকে ভ্যাঙাচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের জেন-জির এই বোধ ও বোধির জায়গাটা বুঝতে হবে। বোঝার চেষ্টা করতে হবে তাদের ভাষা। নাহলে তাদের ভুলভাল আচরণে মনের অগোচরেই হররোজ নিজের ঝুলি থেকে ভোট কেটে যাবে হুড়মুড় করে। কারণ এখনকার দিনে মিছিল আর পোস্টারিং করে ভোটব্যাংক তৈরি হয় না। বরং রাস্তায় নেতানেত্রীদের দাঁত ক্যালানে ছবিযুক্ত বড় বড় ব্যানার-পোস্টার দেখলে চরম জেন-জি ঘৃণা করে। তারা আগ্রহভরে দেখে রিলস। তারপর রিল লাইফ আর রিয়েল লাইফের একটা অদ্ভুত কম্বো তৈরি করেছে নিজেদের টিকে থাকার জন্য। আর সেই রিল প্লাস অথবা রিল ভার্সাস রিয়েল লাইফের এই কম্বোকে যারা প্রতিনিধিত্ব করবে জেন-জি তাদের আপন মনে করছে। তাই এখানে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন দলের বিপরীতে ব্যক্তি এবং জেনারেশনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
নিজ দলের নেতাকর্মীদেরও অবলীলায় ট্রল করা যায় জেন-জি সেটা অবলীলায় করে দেখাচ্ছে। কারণ তারা কোনো দলের কিংবা মতাদর্শের নয় বরং একটা জেনারেশনের প্রতিনিধিত্ব করে যারা নিজের মা-বাবার কোনো বক্তব্য শুনলে চোখ বন্ধ করে মেনে না নিয়ে বরং অনেকগুলো প্রশ্ন করে। তারাই রাজনীতিবিদদের মধ্যে যারা এখনো নব্বইয়ের দশকেই আটকে আছেন, তাদের জন্য অপেক্ষা করছে চরম দুর্দিন। কারণ এখনকার প্রেজেন্টেশন এবং রাজনীতিতে ভাষা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এ জন্যই ‘হায়রে হায় বাঙালি জাতি’ না করে বর্তমান প্রজন্মের ভাষায় মুক্তিযুদ্ধ এবং আমাদের জাতীয় অর্জনগুলো বর্ণনা করতে হবে।
ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ গল্প ও বয়ানগুলো গ্রহণ করার জন্য মুখিয়ে থাকে জেন-জি। আপনারা তাদের সামনে যদি তুলে ধরেন দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন কিংবা মুক্তিযুদ্ধের মেদমুক্ত প্রকৃত ইতিহাস, তারা আপনাদের বক্তব্য গ্রহণ করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। আমি তাদের সামনে শর্মিলা বোসের ‘ডেড রেকনিং’ কিংবা সাঈদ ফেরদৌসের ‘পার্টিশন অ্যাজ বর্ডার মেকিং’ নিয়ে আলোচনা করে দেখেছি। তাদের সামনে ইফতেখার ইকবালের ‘The Ben-gal Delta : Ecology, State and Social Change, 1840–1943’ নিয়ে কথা বলেছি। নয়নিকা মুখার্জির ‘The Spectral Wound : Sexual Violence, Public Memories, and the Bangladesh War of 1971’ নিয়ে অনেক গল্প বলেছি। এমনকি তাজ হাশমীর ‘Pakistan As A Peasant Utopia : The Communalization Of Class Politics In East Bengal, 1920-1947’ থেকেও প্রচুর কথা বলে দেখেছি। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করেছি তারা অপার মুগ্ধতা নিয়ে ইতিহাসের এই বিষয়গুলো উপভোগ করছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে বিএনপি কিংবা জামায়াতের অনেক নেতাই গণমাধ্যমে কথা বলছেন। কিন্তু কখনো দেখেছেন বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমেদ, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মাহদী আমিন কিংবা জামায়াতের শিশির মনির অথবা মির্জা গালিবকে নিয়ে কেউ ট্রল করছে? পারতপক্ষে সেটি চোখে পড়বে না। অন্যদিকে সালাহউদ্দিন আহমেদের হাঁটা, চেয়ারে বসা, কথা বলার স্টাইল—এগুলোকে পর্যন্ত উচ্ছ্বাসের সঙ্গে উদযাপন করছে জেন-জি। আর সেখানে দলীয় আদর্শের তুলনায় অ্যাপ্রোচ আর স্টাইলটাই মুখ্য হয়ে উঠেছে জেন-জির কাছে। কিন্তু এরাই ফজলুর রহমান, রুমিন ফারহানা, হাবিবুর রহমান হাবিব, মির্জা আব্বাস, শফিকুর রহমান কিংবা ব্যারিস্টার ফুয়াদকে ট্রল করছে অবলীলায়। ওদিকে বয়োবৃদ্ধ নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্য আর ভাষাকেও জেনজি আগ্রহ নিয়ে গ্রহণ করছে।
বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ‘যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে’ শীর্ষক কবিতার আবৃত্তি কীভাবে অনেকের হৃদয়ে দোলা দিয়ে গেছে। রাজনৈতিক নেতা হয়েও হাবিব উন নবী খান সোহেলের কবিতা আবৃত্তি তরুণরা কীভাবে উপভোগ করেছে, সেটাও চোখে পড়ার মতো। একইভাবে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তার পোষা বিড়ালের ছবি আপলোড করলে সেটাতে লাভ আর লাইকের বন্যা দেখা দেয়। ওদিকে এই অভিন্ন ব্যক্তিই চার্লি কার্ককে সমবেদনা জানাতে গেলে হাহার বন্যায় ভেসে যায়। মূলত যেসব নেতা তাদের বক্তব্য আর কাজকর্মে জেন-জিকে কানেক্ট করতে পারছেন, তারা টিকে যাচ্ছেন, বাকিরা পড়ছেন বিপাকে।
জেন-জিরা কারো বিরুদ্ধে বিষোদগার চরম ঘৃণা করে। কারণ তাদের হাতে অন্যের গিবত শোনার মতো অফুরান সময় নেই। তারা কারো মুখে অন্যের ব্যাপারে অহেতুক সত্য-মিথ্যা গল্প শোনার বদলে নিজের গল্প তৈরি করতে চায়। আর তারা সেই সব গল্প শুনতে চায় যেখানে নিজেকেও কানেক্ট করা যায়। এ জন্যই ভোটের রাজনীতি করতে চাইলে জেন-জির সঙ্গে কানেকশন তৈরি করার দায়িত্বটা রাজনীতিবিদদের ওপরেই বর্তায়। কিন্তু সেটি না করে কেউ যদি ‘হায়রে হায় বাংলাদেশ। হায়রে হায় বাঙালি জাতি’ বলে নাকি কান্না জুড়ে দেয়, কিংবা চিৎকার-চেঁচামিচি আর গালাগালের মাধ্যমে জেনারেশনের সঙ্গে কানেকশন কাটার চেষ্টা করে, তার ফল হবে আত্মঘাতী। জেন-জি তাকে রাজনীতির মাঠ থেকে সরাসরি ফটোকার্ডে ঘিয়ের বিজ্ঞাপনের লোগো বানিয়ে দিয়ে লিখবে ‘কুত্তার পেটে হজম হওয়া দেশের প্রথম ঘি। সোজা আঙুলে উঠে আসে সহজে’। হ্যাহ! হ্যা!! অ্যাটাই বাস্তব।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
স্যাটায়ার, মিম আর ট্রল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় স্ক্রল করতে গেলে ইদানীং এর বাইরে খুব বেশি বিষয় মনে হয় আর দৃষ্টিগোচর হয় না। ওদিকে বাংলা কিংবা ইংরেজির বিশেষ একটি রূপ চোখে পড়ে তাদের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে। আপনি যদি আগে থেকে এই শব্দবন্ধগুলোর সঙ্গে পরিচিত না হন, তবে আপনার পক্ষে বোঝা সম্ভব না তারা আসলে কী বলতে চাইছে। হঠাৎ করেই আপনাদের চোখে পড়তে পারে ‘অরা’ (Aura) শব্দটি। কিন্তু এটি যে ব্যক্তিত্বের পরিমাপ হিসেবে কেউ কতটা ‘কুল’ বা ‘আনকুল’ তা বোঝায়, সেটি অনুমান করা অন্যদের জন্য বেশ কঠিন। একইভাবে আপনি অনুমানও করতে পারবেন না ‘বেইজড’ (Based) শব্দটি কোনো ব্যক্তির নিজের মতামত বা অবস্থান বজায় রাখার বিষয়টিকে তুলে ধরছে।
ধরুন আপনার চোখে পড়ল ‘ব্রাহ্’ (Bruh) শব্দটি, যা মূলত হতচকিত হয়ে ওঠা বোঝাতে লেখা হয়েছে। কিন্তু তার মূল অর্থ ‘ব্রাদার’ বা ভাই। এটি আবার বিরক্তির প্রকাশ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। যেমন : ‘ধুর্বাল এইডা কি কর্লা, ব্রাহ’। একইভাবে তারা ‘বাসিন’ (Bussin) শব্দটি দিয়ে বোঝাচ্ছে দুর্দান্ত অর্থ। যেমন : ‘মোজাম্মেলের ভুঁড়িটা যা হয়েছে না! এক্কেরে বাসিন!’ বাংলাতে আমরা কাউকে ঠকানো অর্থে টুপি পরানো কথাটি কমবেশি ব্যবহৃত হতে দেখেছি। জেন-জি ওটাকে পাল্টে দিয়েছে সরাসরি ‘ক্যাপ’ (Cap) শব্দটির মাধ্যমে মিথ্যা বুঝিয়ে। কেউ মিথ্যা বললে জেন-জি তাকে ‘ক্যাপ’ বা ‘ক্যাপিং’ হিসেবে ধরে।
বিশ্ব যখন বদলে যাচ্ছে, আপনার চারপাশের চিরচেনা জগতের ভাষাগুলোও এভাবে পাল্টে যাবে কেউ কি ভেবেছিলেন? এতদিন জেনে এসেছিলেন ‘কুক’ (Cook) মানে রান্না করা কিন্তু এটাই যখন বিব্রত বা অস্বস্তিবোধ অর্থে বোঝায়, তখন আপনার করণীয় কী? একইভাবে ‘ডেলুলু’ (Delulu), ‘ড্রিপ’ (Drip), ‘এরা’ (Era), ‘ফ্লেক্স’ (Flex), ‘গ্লো আপ’ (Glow-Up), ‘গোট’ (GOAT), ‘আই ওয়াই কে ওয়াই কে’ (Iykyk), ‘লিট’ (Lit), ‘ওকে বুমার’ (OK Boomer), ‘পুকি’ (Pookie), ‘রেড ফ্ল্যাগ’ (Red flag), ‘রিজ’ (Rizz), ‘সিম্প’ (Simp), ‘স্কিবিডি’ (Skibidi), ‘সাস’ (Sus), কিংবা ‘টি’ (Tea) সম্পর্কে আগের জেনারেশনের মানুষের জানা থাকার কথা নয়। তাই যোগাযোগের ক্ষেত্রে দূরত্ব তৈরি হতেই পারে।
রাজনীতির প্রাথমিক এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হচ্ছে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ। এই বিষয়গুলো না জেনেই যদি কেউ রাজনীতির মাঠে নেমে পড়ে, তাহলে সমস্যার জায়গাটা কোথায় তৈরি হচ্ছে? কিছুই না, সে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিয়ে চিৎকার করে বলতে পারে ‘হায়রে হায় বাংলাদেশ। হায়রে বাঙালি জাতি। একটা লোক জীবনে-যৌবনে কারাগারে কাটিয়ে ফাঁসির মঞ্চে গিয়ে বাঙালিকে শিখিয়েছে...। ওদিকে তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বলা যায় ওখানেই খতম। তারপর সে যতগুলো জায়গায় চিৎকার করেছে, সেগুলো জেন-জি গ্রহণ করেছে মিম এলিমেন্ট হিসেবে। আর এটার সর্বশেষ সংস্করণ চোখে পড়ে ফেসবুকের একটা ট্রল পেজের ফটোকার্ডের বিজ্ঞাপনে। সেখানে লেখা ‘ফজু পাগলা ঘি। কুত্তার পেটে হজম হওয়া দেশের প্রথম ঘি। সোজা আঙুলে উঠে আসে সহজে’।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের এই বিষয়টাকে জেন-জির ভাষায় বোঝাতে পারলে কেউ বিরক্ত হতো না। বরং জাতির জন্ম হিসেবে গৌরবের এই বিষয়টাকে জেন-জি গর্বের সঙ্গেই গ্রহণ করত। কারণ তারা মুক্তিযুদ্ধকে তাদের হৃদয়ে ধারণ করে অনেক উচ্চস্থান দিয়ে। তাই তারা কাউকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যবসা করতে দেখলে চরম বিরক্ত হয়। ওদিকে কেউ যদি নিজের অতীত কৃতকর্মের কথা অস্বীকারের উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে, তাদেরও পছন্দ করে না জেন-জি। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে জীবনবাজি রেখে রাজপথে থাকা জেন-জি জুলাই আগস্টের অভ্যুত্থানকেও একইভাবে হৃদয়ে ধারণ করে। কিন্তু কেউ এটাকে নিয়ে ব্যবসা করতে চাইলে তাদেরও মুক্তিযুদ্ধের ব্যবসায়ীদের মতোই ঘৃণাভরে ছুড়ে ফেলছে তারা।
বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে এটাকে একটা সাধারণ উদাহরণ হিসেবে নিতে পারেন। বাংলাদেশের পাশাপাশি আশপাশের দেশগুলোয় চোখ রাখতে বুঝতে পারবেন এমন ঘটনা প্রতিদিন হরহামেশা ঘটছে। আর প্রতাপশালী রাজনীতিবিদদের চোখের পলকে পুরো কার্টুনের মতো হাস্যরসাত্মক চরিত্রে পরিণত হতে হয়েছে। আর এ জন্যই জেন-জির ভাষা বুঝতে না পারলে তারা যেই হোক তাদের রাজনীতি বিশ্বের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে। এটা শুধু বাংলাদেশ না, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তবতা। যেমন : রাহুল গান্ধীর মতো রাজনীতিবিদকে সবাই চিনে ‘গুডবাই! খতম! গ্যায়া! টা টা! বাই বাই!’ হিসেবে। মমতা ব্যানার্জিকে চিনে ‘শুট্যিয়ে লাল করে দেবো’ কিংবা ‘হাম্বা, কম্বা, বুম্মা’ কবিতার আবৃত্তিকার হিসেবে।
বুমার রাজনীতিবিদরা এমনিতেই হারিয়ে যাবেন। বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত এসব ভদ্রলোক কিংবা ভদ্রমহিলারা মাঝেমধ্যে দু-একটা টেলিভিশনে গিয়ে অহেতুক চিৎকার দিয়ে নিজেরাই ট্রলের শিকার হন। তারপর তাদের নিয়ে তৈরি সেই ট্রলগুলো ফেসবুক কিংবা ইউটিউবে ঘুরে ঘুরে ভাইরাল হয়। এ জন্যই রাজনীতির অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি যারা এখনো নতুন জেনারেশনের ভাষা বুঝতে পারছেন না, সেটা তাদের জন্য ভয়াবহ লজ্জাজনক হয়ে উঠছে। রাজনীতির মাঠে আগুণ ঝরা বক্তব্য দেওয়া মানুষগুলোও এখন দুশ্চিন্তায় আছেন কখন কাকে কোন ট্রল কিংবা মিমের শিকার হতে হয়।
সুলেখক সুবাইল বিন আলম এ জন্যই বলেছেন, ‘বাংলাদেশে এখন রাজনীতি করে বেঁচেবর্তে থাকতে হলে সব দলের প্রতিটি রাজনীতিবিদকেই জেন-জির ভাষায় কথা বলতে হবে।’ তিনি অনেকগুলো যুক্তি দিয়েছিলেন, যা সংক্ষিপ্ত পরিসরে লেখা কঠিন। এগুলোর প্রায় প্রতিটি বক্তব্য আমার চিন্তার সঙ্গে পুরোপুরি মিলে গিয়েছিল। তখন আমরা খেয়াল করে দেখি বাংলাদেশের বেশির ভাগ রাজনীতিবিদের এই কমনসেন্স নেই, কী প্রচার করতে হবে আর কোন জিনিস নিয়ে বাড়াবাড়ি করা যাবে না। অবশ্যই এর মূল কারণ তারা জেন-জির ভাষা বুঝতে পারেন না।
ডলি সায়ন্তনী নামের জনৈক গায়িকার একটা গান ছিল ‘জ্বলন্ত সিগারেট হাতে ধরা। রঙচটা জিনসের প্যান্ট পরা...’। বাংলাদেশের রাজনীতির আইকনদের বোঝানোর জন্য সেটা ওই সময়ের একটা ট্রেন্ড হিসেবে ধরলে এগুলোকে জেন-জি এখন ঘৃণাভরে ছুড়ে ফেলেছে। আর সেটা বুঝতে না পারলে রাজনীতিতে বহুমুখী ক্ষতির মধ্যে পড়তে হবে। যেমন ধরেন, লজ্জাজনক হলেও সত্য, ডাকসু ইলেকশনের মধ্যে উত্তেজনাবশত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস একটা বেয়াদবি করে ফেলছেন। ছাত্ররাজনীতি কিংবা দেশের সাধারণ রাজনীতিতে এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু এটাকে বাহবা দিয়ে মাথায় তোলার কোনো বিষয় ছিল না। আর সেটা করতে গিয়ে অনলাইন অ্যাকটিভিস্টদের অনেকেই বিপাকে পড়েছেন।
গণেশ চন্দ্র রায় সাহসের এই ভিডিও প্রচারের আগে খেয়াল করা উচিত ছিল এ সময়েই ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল পুরোটা আলাপনে কতটা নম্র, ভদ্র ও বিনয়ী ছিল সেদিকে। যদি রাজনীতিবিদরা জেন-জির ভাষা বুঝতেন, তাহলে গণেশের বেয়াদবিকে প্রশ্রয় না দিয়ে সেটির জন্য সরি বলে রাকিবুলের ভিডিওটাকে ফোকাস করতেন। এতে করে জেন-জি ক্ষেপে যেত না। উল্টো রাকিবুল যেভাবে করজোড়ে মাফ চাচ্ছিল ভিসির কাছে, সেটাকেই হাসিমুখে গ্রহণ করে সাহসের বেয়াদবির কথা হয়তো ভুলে যেত।
আমি বর্তমান প্রজন্মের অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের থেকে জেনেছি ফেসবুকে রিলস দেখতে গেলে সেখানে জাকির খানের প্রচুর ভিডিও চোখে পড়ে। তার চাপা ভাঙা ফেস কাটিং, আউটলুক আর এক্সপ্রেশন দেখামাত্র জেন-জি ক্ষেপে যাচ্ছে। ওদিকে যুবদল নেতা নয়নের নানা জোকারির বিশেষ করে ‘যমুনারে যমুনা, আমরা কিন্তু যামুনা’ ভিডিও তারা বেশ হাসিমুখে গ্রহণ করেছে। কিন্তু তারা বিরক্ত বরকতউল্লা বুলুর মূত্রত্যাগ, মির্জা আব্বাসের নানা বক্তব্য কিংবা আরেক বর্ষীয়ান নেতা হাবিবুর রহমান হাবিবের ‘জিহ্বা কাইট্যা কালা কুত্তা দিয়া খাওয়ামু’ ভিডিও নিয়ে। একইভাবে রুমিন ফারহানার দেওয়া সেই ‘আগেই ভালো ছিলাম, ১৫ বছর যা হয়নি, এখন তাই হচ্ছে, ফকিন্নির বাচ্চা কিংবা ডাকাতের মতো চেহারা টাইপের ভিডিওগুলো নিয়ে জেন-জি যাচ্ছেতাইভাবে ট্রল করছে। মেয়েদের পাশাপাশি অনেক ছেলেও চোখের উপরে-নিচে বিশ্রীভাবে কাজল দিয়ে ভিডিও বানিয়ে তাকে ভ্যাঙাচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের জেন-জির এই বোধ ও বোধির জায়গাটা বুঝতে হবে। বোঝার চেষ্টা করতে হবে তাদের ভাষা। নাহলে তাদের ভুলভাল আচরণে মনের অগোচরেই হররোজ নিজের ঝুলি থেকে ভোট কেটে যাবে হুড়মুড় করে। কারণ এখনকার দিনে মিছিল আর পোস্টারিং করে ভোটব্যাংক তৈরি হয় না। বরং রাস্তায় নেতানেত্রীদের দাঁত ক্যালানে ছবিযুক্ত বড় বড় ব্যানার-পোস্টার দেখলে চরম জেন-জি ঘৃণা করে। তারা আগ্রহভরে দেখে রিলস। তারপর রিল লাইফ আর রিয়েল লাইফের একটা অদ্ভুত কম্বো তৈরি করেছে নিজেদের টিকে থাকার জন্য। আর সেই রিল প্লাস অথবা রিল ভার্সাস রিয়েল লাইফের এই কম্বোকে যারা প্রতিনিধিত্ব করবে জেন-জি তাদের আপন মনে করছে। তাই এখানে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন দলের বিপরীতে ব্যক্তি এবং জেনারেশনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
নিজ দলের নেতাকর্মীদেরও অবলীলায় ট্রল করা যায় জেন-জি সেটা অবলীলায় করে দেখাচ্ছে। কারণ তারা কোনো দলের কিংবা মতাদর্শের নয় বরং একটা জেনারেশনের প্রতিনিধিত্ব করে যারা নিজের মা-বাবার কোনো বক্তব্য শুনলে চোখ বন্ধ করে মেনে না নিয়ে বরং অনেকগুলো প্রশ্ন করে। তারাই রাজনীতিবিদদের মধ্যে যারা এখনো নব্বইয়ের দশকেই আটকে আছেন, তাদের জন্য অপেক্ষা করছে চরম দুর্দিন। কারণ এখনকার প্রেজেন্টেশন এবং রাজনীতিতে ভাষা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এ জন্যই ‘হায়রে হায় বাঙালি জাতি’ না করে বর্তমান প্রজন্মের ভাষায় মুক্তিযুদ্ধ এবং আমাদের জাতীয় অর্জনগুলো বর্ণনা করতে হবে।
ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ গল্প ও বয়ানগুলো গ্রহণ করার জন্য মুখিয়ে থাকে জেন-জি। আপনারা তাদের সামনে যদি তুলে ধরেন দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন কিংবা মুক্তিযুদ্ধের মেদমুক্ত প্রকৃত ইতিহাস, তারা আপনাদের বক্তব্য গ্রহণ করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। আমি তাদের সামনে শর্মিলা বোসের ‘ডেড রেকনিং’ কিংবা সাঈদ ফেরদৌসের ‘পার্টিশন অ্যাজ বর্ডার মেকিং’ নিয়ে আলোচনা করে দেখেছি। তাদের সামনে ইফতেখার ইকবালের ‘The Ben-gal Delta : Ecology, State and Social Change, 1840–1943’ নিয়ে কথা বলেছি। নয়নিকা মুখার্জির ‘The Spectral Wound : Sexual Violence, Public Memories, and the Bangladesh War of 1971’ নিয়ে অনেক গল্প বলেছি। এমনকি তাজ হাশমীর ‘Pakistan As A Peasant Utopia : The Communalization Of Class Politics In East Bengal, 1920-1947’ থেকেও প্রচুর কথা বলে দেখেছি। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করেছি তারা অপার মুগ্ধতা নিয়ে ইতিহাসের এই বিষয়গুলো উপভোগ করছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে বিএনপি কিংবা জামায়াতের অনেক নেতাই গণমাধ্যমে কথা বলছেন। কিন্তু কখনো দেখেছেন বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমেদ, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মাহদী আমিন কিংবা জামায়াতের শিশির মনির অথবা মির্জা গালিবকে নিয়ে কেউ ট্রল করছে? পারতপক্ষে সেটি চোখে পড়বে না। অন্যদিকে সালাহউদ্দিন আহমেদের হাঁটা, চেয়ারে বসা, কথা বলার স্টাইল—এগুলোকে পর্যন্ত উচ্ছ্বাসের সঙ্গে উদযাপন করছে জেন-জি। আর সেখানে দলীয় আদর্শের তুলনায় অ্যাপ্রোচ আর স্টাইলটাই মুখ্য হয়ে উঠেছে জেন-জির কাছে। কিন্তু এরাই ফজলুর রহমান, রুমিন ফারহানা, হাবিবুর রহমান হাবিব, মির্জা আব্বাস, শফিকুর রহমান কিংবা ব্যারিস্টার ফুয়াদকে ট্রল করছে অবলীলায়। ওদিকে বয়োবৃদ্ধ নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্য আর ভাষাকেও জেনজি আগ্রহ নিয়ে গ্রহণ করছে।
বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ‘যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে’ শীর্ষক কবিতার আবৃত্তি কীভাবে অনেকের হৃদয়ে দোলা দিয়ে গেছে। রাজনৈতিক নেতা হয়েও হাবিব উন নবী খান সোহেলের কবিতা আবৃত্তি তরুণরা কীভাবে উপভোগ করেছে, সেটাও চোখে পড়ার মতো। একইভাবে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তার পোষা বিড়ালের ছবি আপলোড করলে সেটাতে লাভ আর লাইকের বন্যা দেখা দেয়। ওদিকে এই অভিন্ন ব্যক্তিই চার্লি কার্ককে সমবেদনা জানাতে গেলে হাহার বন্যায় ভেসে যায়। মূলত যেসব নেতা তাদের বক্তব্য আর কাজকর্মে জেন-জিকে কানেক্ট করতে পারছেন, তারা টিকে যাচ্ছেন, বাকিরা পড়ছেন বিপাকে।
জেন-জিরা কারো বিরুদ্ধে বিষোদগার চরম ঘৃণা করে। কারণ তাদের হাতে অন্যের গিবত শোনার মতো অফুরান সময় নেই। তারা কারো মুখে অন্যের ব্যাপারে অহেতুক সত্য-মিথ্যা গল্প শোনার বদলে নিজের গল্প তৈরি করতে চায়। আর তারা সেই সব গল্প শুনতে চায় যেখানে নিজেকেও কানেক্ট করা যায়। এ জন্যই ভোটের রাজনীতি করতে চাইলে জেন-জির সঙ্গে কানেকশন তৈরি করার দায়িত্বটা রাজনীতিবিদদের ওপরেই বর্তায়। কিন্তু সেটি না করে কেউ যদি ‘হায়রে হায় বাংলাদেশ। হায়রে হায় বাঙালি জাতি’ বলে নাকি কান্না জুড়ে দেয়, কিংবা চিৎকার-চেঁচামিচি আর গালাগালের মাধ্যমে জেনারেশনের সঙ্গে কানেকশন কাটার চেষ্টা করে, তার ফল হবে আত্মঘাতী। জেন-জি তাকে রাজনীতির মাঠ থেকে সরাসরি ফটোকার্ডে ঘিয়ের বিজ্ঞাপনের লোগো বানিয়ে দিয়ে লিখবে ‘কুত্তার পেটে হজম হওয়া দেশের প্রথম ঘি। সোজা আঙুলে উঠে আসে সহজে’। হ্যাহ! হ্যা!! অ্যাটাই বাস্তব।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
৭ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
৭ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
৮ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
১ দিন আগে