আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

নিরাপত্তা হুমকি ও প্রস্তুতি : প্রতিরক্ষা আধুনিকায়ন

ব্রি জে (অব.) এইচ আর এম রোকন উদ্দিন

নিরাপত্তা হুমকি ও প্রস্তুতি : প্রতিরক্ষা আধুনিকায়ন
ব্রি. জে. (অব.) রোকন উদ্দিন

বাংলাদেশ আজ তার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদী শাসনের পর অন্তর্বর্তী সরকার তিনটি মৌলিক দায়িত্ব নিয়ে ক্ষমতায় আসে প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, জুলাই বিপ্লবসংক্রান্ত অপরাধীদের বিচার এবং একটি অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন আয়োজন। সরকার ইতোমধ্যে তাদের প্রাথমিক অঙ্গীকারের উল্লেখযোগ্য অংশ পূরণ করেছে এবং দেশ এখন সাধারণ নির্বাচন ও জুলাই চার্টারসংক্রান্ত গণভোটের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতির দিকে গেলেও দেশের চারপাশে নিরাপত্তা পরিবেশ ক্রমশ অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। ভারত এখন প্রকাশ্য এবং গোপনÑউভয় উপায়ে বাংলাদেশকে চাপে রাখছে। লালমনিরহাট ও ‘চিকেন নেক’ এলাকায় সেনা ও বিমানসম্পদ মোতায়েনের মাধ্যমে বিস্তৃত সামরিক অবস্থান তৈরি করেছে, যা বাংলাদেশের জন্য সরাসরি ভূরাজনৈতিক উদ্বেগ তৈরি করছে। একই সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে নাশকতা, সীমান্ত ও পার্বত্যাঞ্চলে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে উসকে দেওয়া এবং বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক নেটওয়ার্ককে পৃষ্ঠপোষকতা করাÑএসবই সাম্প্রতিক সময়ে তীব্রতর হয়েছে। সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশও অব্যাহত রয়েছে, যা জনসংখ্যাগত ভারসাম্য, স্থানীয় অর্থনীতি এবং নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

দক্ষিণ সীমান্তে মিয়ানমারের চলমান গৃহযুদ্ধ, বিশেষত আরাকান আর্মির সশস্ত্র তৎপরতা ও স্থিতিশীলতাকে নতুন করে হুমকির মধ্যে ফেলেছে। রোহিঙ্গা ইস্যু বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘমেয়াদি মানবিক সংকট, যা এখন জটিল নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। মাদক ব্যবসা, অপরাধীচক্র, মানবপাচার, চরমপন্থা অনুপ্রবেশের ঝুঁকি এবং মানবিক চাপÑসব মিলিয়ে জাতীয় নিরাপত্তার ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলছে। বহুমুখী এ সংকটের মাঝে সবচেয়ে উদ্বেগজনক ঘাটতি রয়ে গেছে দেশের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই, সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকীকরণ প্রায় স্থবির হয়ে আছে। গত ১৬ বছর ধরে স্বৈরাচারী শাসনের অধীন আধুনিকায়নের নামে ছিল কেবল প্রচার। বাস্তবে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর বেশিরভাগ অস্ত্র, যান, জাহাজ ও বিমান পুরোনো, অপ্রতিযোগিতামূলক এবং প্রযুক্তিগতভাবে অপ্রাসঙ্গিক থেকে গেছে। সাম্প্রতিক অন্তর্বর্তী সরকারও প্রতিরক্ষা আধুনিকীকরণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ফলে নিরাপত্তা পরিবেশ দ্রুত পরিবর্তিত হলেও আমাদের সামরিক প্রস্তুতি সেই গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি।

বিজ্ঞাপন

প্রতিরক্ষা আধুনিকীকরণ কেন অপরিহার্য

কোনো জাতি স্থায়ী রাজনৈতিক স্থিতি বজায় রাখতে পারে না শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ক্ষমতা ছাড়া। সামরিক শক্তি শুধু যুদ্ধের অস্ত্র নয়; এটি সার্বভৌমত্ব, ভূখণ্ডের অখণ্ডতা, কূটনৈতিক অবস্থান এবং জাতীয় মর্যাদার রক্ষাকবচ। দক্ষিণ এশিয়ার জটিল ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশকে তার অবস্থান রক্ষায় উন্নত প্রতিরক্ষা ক্ষমতা অপরিহার্য। আধুনিকায়নের প্রয়োজনীয়তা তিনটি মূল কারণে আজ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে :

বহিরাগত সামরিক চাপ

ভারতের উত্তর সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন, যুদ্ধাস্ত্রের সমাবেশ, হেলিকপ্টার ও UAV টহল—এগুলো সুস্পষ্ট কৌশলগত সংকেত। বাংলাদেশকেও সমান শক্তিশালী প্রতিরোধ সক্ষমতা তৈরি করতে হবে।

হাইব্রিড যুদ্ধ ও গোপন নাশকতা

পার্বত্যাঞ্চল ও সীমান্তে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীকে উৎসাহিত করা, উপ-রাষ্ট্রীয় নেটওয়ার্ককে ব্যবহার করা, তথ্যযুদ্ধÑএসবই আধুনিক হাইব্রিড যুদ্ধের অংশ, যা মোকাবিলায় উন্নত গোয়েন্দা নজরদারি, সাইবার নিরাপত্তা ও সন্ত্রাস দমনের সক্ষমতা প্রয়োজন।

দক্ষিণ সীমান্ত ও সামুদ্রিক সংকট

মিয়ানমারের অস্থিতিশীলতা, আরাকান আর্মির তৎপরতা, রোহিঙ্গা সংকটÑএসব মোকাবিলায় আরো শক্তিশালী নৌ-সামরিক উপস্থিতি, উপকূলীয় নজরদারি এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়া সক্ষম বাহিনী অপরিহার্য।

সশস্ত্র বাহিনীর বর্তমান সক্ষমতার ঘাটতি

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী

প্রধান যুদ্ধ ট্যাংকের বড় অংশই Type-59/69 (১৯৫০-৬০ দশকের ডিজাইন), উন্নত MBT-এর ঘাটতি প্রকট। সাঁজোয়া যান ও APC অনেকটাই পুরোনো মডেল। দীর্ঘপাল্লার নির্ভুল আর্টিলারি ও MLRS পর্যাপ্ত নয়। আধুনিক মধ্যপাল্লার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই। আর্মি অ্যাভিয়েশন দুর্বল, আক্রমণাত্মক হেলিকপ্টার নেই।

বাংলাদেশ নৌবাহিনী

নৌবহর প্রধানত পুরোনো মিসাইল বোট ও টহল জাহাজের ওপর নির্ভরশীল। সাবমেরিন সক্ষমতা সীমিত, নীল জলে প্রতিরোধ শক্তি গড়ার মতো নয়। ASW, সামুদ্রিক নজরদারি ও মাইন কাউন্টারমেজার চরম ঘাটতিতে।

বাংলাদেশ বিমান বাহিনী

ফাইটার জেট বহর মূলত F-7 এবং পুরোনো MiG-29 আধুনিক যুদ্ধের জন্য যথেষ্ট নয়। ৪.৫ প্রজন্মের মালটিরোল যুদ্ধবিমান নেই। AEW&C এবং মধ্যপাল্লার বিমান প্রতিরক্ষা পর্যাপ্ত নয়। ড্রোন ও ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সক্ষমতায় ঘাটতি প্রকট।

সমন্বিত প্রতিরক্ষা আধুনিকীকরণ রোডম্যাপ

আধুনিকায়ন হতে হবে ধাপে ধাপে, সমন্বিত, দীর্ঘমেয়াদি কৌশল ভিত্তিক। বাংলাদেশ বর্তমানে জটিল, বহুমাত্রিক নিরাপত্তা সংকটে ঘেরা। উত্তরে ভারতের আগ্রাসী সামরিক অবস্থান এবং হাইব্রিড অপারেশন, সীমান্ত ও পার্বত্যাঞ্চলে ভারত সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সক্রিয়তা এবং বিভিন্ন ধরনের নাশকতা দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাকে চ্যালেঞ্জ করছে। দক্ষিণে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ, আরাকান আর্মির আক্রমণাত্মক কার্যকলাপ এবং রোহিঙ্গা সংকট নিরাপত্তাকে আরো জটিল করেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় সশস্ত্র গোষ্ঠী, মানবপাচারকারী ও মাদকচক্রের আধিপত্য আজ জাতীয় নিরাপত্তার একটি পূর্ণাঙ্গ হুমকিতে পরিণত হয়েছে। সেই সঙ্গে তথ্যযুদ্ধ, সাইবার আক্রমণ, অনলাইন উসকানি এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিÑসব মিলিয়ে বাংলাদেশ আজ ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ নিরাপত্তা পরিবেশের মধ্যে রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে স্পষ্ট যে, একটি পুরোনো ও সীমিত সক্ষমতার প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দিয়ে ভবিষ্যতের হুমকি মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে দ্রুতগতিতে আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর এবং যৌথ সমন্বিত কাঠামোয় পুনর্গঠন করতে হবে। এ কৌশলপত্র ২০২৫ থেকে ২০৪০ সালের মধ্যে সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকীকরণের তিনটি ধাপÑতাৎক্ষণিক (০-৩ বছর), মধ্যমেয়াদি (৩-৭ বছর) এবং দীর্ঘমেয়াদি (৭০১৫ বছর) উপস্থাপন করে।

প্রথম ধাপের মূল লক্ষ্য দ্রুত সক্ষমতা বৃদ্ধি। সেনাবাহিনীকে জরুরি ভিত্তিতে আধুনিক প্রধান যুদ্ধ ট্যাংক (যেমন T-90MS বা VT-4) সংগ্রহ করতে হবে। কারণ বর্তমানে ব্যবহৃত Type-59/69 সিরিজ আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে কার্যত অপ্রাসঙ্গিক। অন্তত ১৫০-২০০ আধুনিক মেইন ব্যাটেল ট্যাংক (MBT) সংগ্রহ করলে দেশের ভূস্থল প্রতিরক্ষা কাঠামোয় মৌলিক পরিবর্তন আসবে। পাশাপাশি আধুনিক সাঁজোয়া যান ও পদাতিক যুদ্ধযান (IFV) সংগ্রহ করা জরুরি, যা পাহাড়ি ও সীমান্ত অঞ্চলে অপারেশনে অধিক গতিশীলতা, সুরক্ষা এবং আগ্রাসী ক্ষমতা প্রদান করবে। সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় ঘাটতি মধ্যপাল্লার বিমান প্রতিরক্ষা। SPYDER-MR, LY-80 বা NASAMS-এর মতো আধুনিক মিসাইল প্রতিরক্ষাব্যবস্থা স্থাপন করা ছাড়া দেশের আকাশসীমা নিরাপদ রাখা সম্ভব নয়। আক্রমণাত্মক হেলিকপ্টার স্কোয়াড্রন গঠনও এই পর্যায়ে অত্যন্ত প্রয়োজন। কারণ Mi-35M, T-129 বা AH-1Z শ্রেণির আর্মড হেলিকপ্টার সীমান্ত সংকটে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার জন্য অপরিহার্য। একই সঙ্গে ড্রোন ও কাউন্টার ড্রোন সক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি করতে হবে। কারণ, আধুনিক হাইব্রিড যুদ্ধের প্রধান উপাদান এখন UAV। MALE UAV সংগ্রহের পাশাপাশি জ্যামার, লেজার ইন্টারসেপ্টর ও মোবাইল অ্যান্টি-ড্রোন সিস্টেম মোতায়েন করতে হবে।

নৌবাহিনীর ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক প্রয়োজন আধুনিক গাইডেড মিসাইল ফ্রিগেট সংগ্রহ। এগুলো Anti-Ship, Anti-Air ও Anti-SubmarineÑতিন ক্ষেত্রেই যুদ্ধক্ষমতা বাড়াবে। বঙ্গোপসাগরের অর্থনৈতিক অঞ্চল, সামুদ্রিক সম্পদ এবং সমুদ্রপথ সুরক্ষার জন্য এটি অপরিহার্য। সাবমেরিন প্রতিরোধ সক্ষমতা জোরদার করতে ASW হেলিকপ্টার ও করভেটের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। পুরো উপকূলজুড়ে একটি সমন্বিত উপকূলীয় রাডার নেটওয়ার্ক স্থাপন করলে সামুদ্রিক পরিস্থিতির ওপর রিয়েল টাইম নজরদারি সম্ভব হবে।

বিমান বাহিনীর সবচেয়ে বড় ঘাটতি আধুনিক যুদ্ধবিমান। অন্তত দুই স্কোয়াড্রন ৪.৫-জেনারেশন মাল্টিরোল জেট (যেমন Rafale, Gripen-E বা J-10C) সংগ্রহ করা এ পর্যায়ে অগ্রাধিকার হতে হবে। এসব প্ল্যাটফর্ম AESA রাডার, স্ট্যান্ড-অফ অস্ত্র, BVR যুদ্ধক্ষমতা ও ইলেকট্রনিক যুদ্ধ দক্ষতার মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশগুলোর বিমানশক্তির সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখবে। পাশাপাশি C-295 বা C-390-এর মতো ট্যাকটিক্যাল ট্রান্সপোর্ট বিমান সংগ্রহ করলে দ্রুত সেনা মোতায়েন, লজিস্টিকস ও দুর্যোগ মোকাবিলায় বড় পরিবর্তন আসবে।

দ্বিতীয় ধাপের সময়সীমা ৩ থেকে ৭ বছর। এই পর্যায়ে সশস্ত্র বাহিনীর কাঠামোগত সংস্কার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর মধ্যে সমন্বিত যোগাযোগ, পরিকল্পনা ও অপারেশন পরিচালনার জন্য একটি যৌথ কমান্ড কাঠামো গঠন অপরিহার্য। এটি স্থল, সমুদ্র ও আকাশ প্রতিরক্ষাকে একক অপারেশনাল প্ল্যাটফর্মে এনে সামরিক দক্ষতা বহুগুণ বাড়াবে। একই সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের প্রতিরক্ষায় ২০০-৩০০ কিলোমিটার রেঞ্জের উপকূলীয় অ্যান্টি-শিপ মিসাইল ব্যাটারি মোতায়েন করতে হবে, যা সমুদ্রসীমাকে কৌশলগতভাবে সুরক্ষিত করবে। এ পর্যায়ে Airborne Early Warning & Control (AEW&C) ও দীর্ঘপাল্লার Unmanned Aerial Vehicle (UAV) সংগ্রহ বিশেষভাবে প্রয়োজন। কারণ এগুলো আকাশ ও সমুদ্র উভয় ক্ষেত্রেই আগাম সতর্কতা, সীমান্ত নজরদারি এবং যুদ্ধক্ষেত্র পর্যবেক্ষণে মূল ভূমিকা রাখবে।

সামরিক শিল্প সম্প্রসারণও মধ্যমেয়াদি লক্ষ্যগুলোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিদেশি প্রতিরক্ষা কোম্পানির সঙ্গে যৌথ উৎপাদন প্রকল্প চালু করে ড্রোন, সাঁজোয়া যান, গোলাবারুদ, ছোট নৌযান এবং ইলেকট্রনিক সিস্টেম দেশেই তৈরি করা যেতে পারে। বিশেষ বাহিনীর সাইবার, ISR এবং ইলেকট্রনিক যুদ্ধ সক্ষমতা আধুনিকীকরণও এ পর্যায়ে অপরিহার্য। আধুনিক বিশেষ বাহিনী এখন ড্রোন স্কোয়াড, সাইবার টিম এবং টার্গেটিং প্রযুক্তিনির্ভর। বাংলাদেশকেও সে মানে উন্নীত করতে হবে।

তৃতীয় ধাপ ৭ থেকে ১৫ বছর সময়সীমায় বিস্তৃত, যেখানে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা কাঠামোকে পূর্ণাঙ্গ আঞ্চলিক শক্তির মানে উন্নীত করা লক্ষ্য। এ পর্যায়ে একটি নীল জলে সক্ষম নৌবাহিনী গঠন অপরিহার্য, যাতে কমপক্ষে ৬-৮টি আধুনিক ফ্রিগেট, ২-৩টি Landing Platform Dock (LPD) এবং একটি উন্নত সাবমেরিন স্কোয়াড্রন থাকবে। এটি বাংলাদেশকে বঙ্গোপসাগরে শক্তি প্রক্ষেপণকারী রাষ্ট্রে পরিণত করবে। একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে ড্রোন, ট্রেনার বিমান, হালকা জেট এবং ভবিষ্যতে মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান যৌথভাবে উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। এর সঙ্গে সীমান্ত নিরাপত্তা একটি একীভূত কমান্ডের অধীন আনতে হবে, যাতে ভারত, মিয়ানমার ও উপকূলÑতিন সেক্টরের তথ্য এবং অভিযান একত্রে পরিচালিত হয়।

সবশেষে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা গবেষণাকে আধুনিক প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে পুনর্গঠন করা জরুরি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) চালিত অস্ত্রব্যবস্থা, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার, ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি, প্রিসিশন গাইডেড অ্যামুনিশন এবং হাইপারসনিক গবেষণায় বিনিয়োগ ভবিষ্যতের যুদ্ধক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সুরক্ষিত রাখবে। বৃহৎ এ রূপান্তর বাস্তবায়নের জন্য প্রতিরক্ষা বাজেটকে ধীরে ধীরে জিডিপি ২ শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত করতে হবে। ডিফেন্স বন্ড প্রবাসীদের জন্য চালু করা যেতে পারে। বিদেশি প্রতিরক্ষা ক্রয়ে অফসেট প্রযুক্তি হস্তান্তর নিশ্চিত করতে হবে। বাস্তবায়নের জন্য প্রতিরক্ষা, অর্থ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও তিন বাহিনীর সমন্বিত কমিটি গঠন করতে হবে। বাংলাদেশের সামনে আজ যে হুমকিগুলোÑভারতীয় চাপ, মিয়ানমারের অস্থিরতা, রোহিঙ্গা সংকট, হাইব্রিড যুদ্ধ, সাইবার আক্রমণ এবং সীমান্ত অস্থিতিশীলতা সবকিছু মিলিয়ে এটি জাতীয় নিরাপত্তার সবচেয়ে কঠিন সময়। সুতরাং রাজনীতি নয়, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। একটি আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর ও সমন্বিত সশস্ত্র বাহিনীই ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে নিরাপদ, মর্যাদাবান ও সার্বভৌম রাখতে সক্ষম হবে।

অর্থায়নের বাস্তবসম্মত পথ

প্রতিরক্ষা বাজেট ধীরে ধীরে জিডিপির ২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি। প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ডিফেন্স বন্ড চালু। অফসেট চুক্তির মাধ্যমে দেশীয় শিল্পে উৎপাদন। দ্বৈত ব্যবহারযোগ্য প্রযুক্তি বিনিয়োগ।

জাতীয় নিরাপত্তা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার

আজকের বাংলাদেশ এমন এক পরিবেশে দাঁড়িয়ে, যেখানে রাজনৈতিক পরিবর্তন অপেক্ষাকৃত সহজ কিন্তু সার্বভৌমত্ব রক্ষা কঠিন। রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা, নির্বাচন বা দলীয় হিসাব-নিকাশের ঊর্ধ্বে উঠে রাষ্ট্রকে প্রথমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ভারতের সামরিক চাপ, মিয়ানমারের অস্থিতিশীলতা, হাইব্রিড যুদ্ধ, অবৈধ অনুপ্রবেশ, রোহিঙ্গা সংকটÑসব মিলিয়ে বাংলাদেশের জন্য এখন বহুমাত্রিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আধুনিক, প্রযুক্তিসমৃদ্ধ, দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীল সশস্ত্র বাহিনী থাকা কোনো বিলাসিতা নয়। এটি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষার পূর্বশর্ত। যদি আমরা সীমান্ত রক্ষা করতে চাই, জনগণকে নিরাপদ রাখতে চাই আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে চাই, তাহলে প্রতিরক্ষা আধুনিকীকরণ আজ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া অপরিহার্য। কেবল তখনই আগামী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ, শক্তিশালী ও সম্মানজনক বাংলাদেশ নিশ্চিত করা সম্ভব।

hrmrokan@hotmail.com

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর

খুঁজুন