ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিভিন্ন সংঘাতের সমাধান করার চেষ্টা করছেন। এসব সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে তিনি মৌলিক কিছু সিদ্ধান্ত এবং উদ্যোগ গ্রহণ করেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ট্রাম্পের জন্য কৌশলগত দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। এ জন্য তিনি তিন বছর ধরে চলা এই যুদ্ধ বন্ধে কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ট্রাম্পের এই শান্তি পরিকল্পনার লক্ষ্য রাশিয়াকে প্রভাবিত করা, ইইউর ক্ষমতা সীমিত করা এবং ইউক্রেনকে ভূখণ্ডগত বড় ধরনের ছাড় দিতে বাধ্য করা।
ট্রাম্প এই যুদ্ধের অবসান ঘটানোকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা ব্লকের মধ্যে তার অবস্থান শক্তিশালী করার এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল উপায় হিসেবে দেখেছিলেন। এই লক্ষ্যে ট্রাম্প এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আলাস্কায় বৈঠক করেন। কিন্তু তাদের এই বৈঠকটি ব্যর্থ বলে মনে করা হয়। কারণ ইউক্রেন নিয়ে পুতিনের সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছানো সহজ হবেÑএমনটি কখনোই মনে হয়নি।
অন্যদিকে, হোয়াইট হাউসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ট্রাম্পের প্রথম বৈঠকটি উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। ফলে এই বৈঠকে কোনো অগ্রগতি অর্জিত হয়নি। বৈঠকের ফলকে জেলেনস্কি ও ইউক্রেনের জন্য কৌশলগত এবং ঐতিহাসিক ভুল হিসেবে দেখা হয়েছিল। কয়েক মাস পর জেলেনস্কি আবার হোয়াইট হাউসে আসেন এবং তার বক্তব্য ও অবস্থান আগের থেকে একেবারেই ভিন্ন ছিল। কিন্তু তারপরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ২০২৬ সালে ইউক্রেন-রাশিয়া শান্তিচুক্তি দেখতে পাবেÑএমন কোনো নিশ্চয়তা এখনো পাওয়া যায়নি।
এ ঘটনাবলির পর ট্রাম্প রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে তার ২৮ দফা শান্তি পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন এবং তিনি দাবি করেন, তার এই শান্তি পরিকল্পনা যুদ্ধরত দুই দেশের উভয়ের কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে। তবে এই শান্তি প্রক্রিয়া চলার মধ্যেই রাশিয়া এবং ইউক্রেন কৃষ্ণ সাগরে একে অন্যের সামরিক সম্পদে হামলা অব্যাহত রেখেছে। এই উত্তেজনা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র শান্তি আলোচনার প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং ট্রাম্পের প্রতিনিধিদল ক্রেমলিনে পুতিনের সঙ্গে দেখা করেছে।
ট্রাম্পের এই উদ্যোগের মূল কথা হলো, তার প্রচারণার কৌশলগত নীতি ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ বা ‘আমেরিকাকে আবার মহান করা’র ওপর ভিত্তি তৈরি করা। ট্রাম্প মনে করেন, তার ২৮ দফা পরিকল্পনার আওতায় উভয় পক্ষকে আলোচনার টেবিলে আনা সম্ভব হলে তা ইইউ, ইউক্রেন এমনকি রাশিয়ান ফেডারেশনের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রকে যথেষ্ট সুবিধা দেবে। ট্রাম্পের এই উদ্যোগ মার্কিন কূটনীতিকদের নজরদারির আওতায় ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মধ্যে আলোচনার সীমা এবং নীতিনির্ধারণ করবে।
তবে, ট্রাম্প প্রশাসন বা মার্কিন রাজনৈতিক এজেন্ডার মূল লক্ষ্য হলো চীন। চীন ও রাশিয়ার মধ্যে বর্তমানের মৈত্রির সম্পর্ককে নড়বড়ে ফেলার টার্গেট রয়েছে ট্রাম্পের। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে ইউক্রেনের ওপর চাপ প্রয়োগ করে রাশিয়াকে ছাড় দেওয়ার মাধ্যমে চীনের ব্যাপারে রাশিয়ার নীতি পরিবর্তন করাতে চান ট্রাম্প। এ ক্ষেত্রে ট্রাম্পের আমেরিকা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে প্রাথমিক বিজয়ী বলে মনে হচ্ছে, কারণ পুতিন ইতোমধ্যেই ট্রাম্পের ২৮ দফা শান্তিচুক্তি নিয়ে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
রাশিয়া প্যান-শ্লাভিজমের কাঠামোর মধ্যে পশ্চিমাদের সঙ্গে তার ঐতিহাসিক সংঘাত বজায় রেখেছে। অতএব, পুতিনের ক্ষমতায় থাকার সময় সোভিয়েত-পরবর্তী মহাকাশে রাশিয়ার আধিপত্য পুনরুদ্ধারের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়েছিল এবং ইউরেশিয়ানিজম ছিল তার সাম্রাজ্যবাদী লক্ষ্য বাস্তবায়নের প্রাথমিক হাতিয়ার। এ ক্ষেত্রে পুতিনের দুটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য : ‘ইউক্রেনের অস্তিত্ব নেই’ এবং ‘রাশিয়ার সীমানা কোথাও শেষ হয় না’।
পুতিনের শাসনামলে তার পররাষ্ট্রনীতিতে একটি অপ্রতিরোধ্য জাতীয়তাবাদী বক্তৃতা গুরুত্ব পেয়েছিল এবং ইউরেশিয়ানিজমকে এর বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। এই অর্থে, সাবেক সোভিয়েত দেশগুলো তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে বৈচিত্র্য আনতে শুরু করেছিল এবং চীন, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ ছিল আলোচনার টেবিলে তাদের প্রধান বিকল্প।
ইউক্রেনে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের ফলে রাশিয়ান পক্ষ মার্কিন প্রস্তাবের প্রতি প্রাথমিক ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে। তবে, ট্রাম্পের প্রস্তাব শুধু ইউক্রেন এবং ইউরোপের ওপর কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে না, বরং এটি রাশিয়াকে মার্কিন নিয়ন্ত্রণে একটি আঞ্চলিক-শক্তির মর্যাদা গ্রহণ করার জন্যও চাপ দেওয়ার একটি কৌশল। ট্রাম্পের প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য হলো দীর্ঘ মেয়াদে রুশ-চীনা অংশীদারত্বকে দুর্বল করা।
এই কাঠামোর মধ্যে ব্যতিক্রমী অভিনেতা হিসেবে কাজ করেছে তুরস্ক। প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান তার ভারসাম্যপূর্ণ নীতি বজায় রেখেছেন এবং ইস্তাম্বুলে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক আয়োজন করেছেন, যেখানে ইউক্রেন, রাশিয়া এবং পশ্চিমা প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তুরস্ক শুধু ইউক্রেনের যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ থেকে নিজেকে দূরে রাখছে না, বরং তার সুসজ্জিত সামরিক সক্ষমতাকে ইউরোপের ভবিষ্যতের জন্য একটি সম্ভাব্য নিরাপত্তা গ্যারান্টার হিসেবেও তুলে ধরেছে।
এছাড়া, তুরস্কের বাস্তববাদী পররাষ্ট্রনীতি মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে সিরিয়ায় ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জন করেছে। যার ফলে প্রভাবশালী এই দেশটি তার প্রতিবেশী অঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে বিবেচিত ও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। অধিকন্তু, উভয় দেশ থেকে অভিবাসীদের আতিথেয়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে তুরস্কের ভূমিকা ইউক্রেন এবং রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সুবিধা দিয়ে থাকে।
রাশিয়ার আগ্রাসনের সময় ইউক্রেনের পতাকা ইইউ, তুরস্ক, দক্ষিণ ককেশাস, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য স্থানে রাস্তায় প্রদর্শিত হয়েছিল, যা ইউক্রেনের প্রতি ব্যাপক মানসিক সমর্থনের ইঙ্গিত দেয়। তবে, ইউক্রেনের দুটে দাবিÑরাশিয়ার সৈন্য তার ভূখণ্ড থেকে সম্পূর্ণ প্রত্যাহার এবং ন্যাটো সদস্যপদ লাভ করা পূরণ হবে কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা এখনো পাওয়া যায়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ট্রাম্পের ২৮ দফা পরিকল্পনার প্রতি ইউক্রেনও ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে।
ইউরোপের অনেক দেশেরই মস্কোর ওপর জ্বালানিনির্ভরতা এবং ওয়াশিংটনের ওপর সামরিক নির্ভরতা রয়েছে। এ কারণে, ইউক্রেনের যুদ্ধকে ইউরোপের অভ্যন্তরে রাশিয়ার জ্বালানিনির্ভরতা থেকে মুক্ত হওয়ার এবং এই মহাদেশে মার্কিন সামরিক আধিপত্য হ্রাস করার একটি ঐতিহাসিক সুযোগ হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সামনে ইইউ নেতাদের উপস্থিতি তাদের নতুন করে মার্কিন আধিপত্য গ্রহণের প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
কিন্তু তা সত্ত্বেও ইইউ ট্রাম্পের ২৮ দফার বিরুদ্ধে তাদের ২৪ দফা পাল্টা প্রস্তাব ঘোষণা করেছে। তবে, রাশিয়া ইইউর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ট্রাম্প বৃহত্তর পশ্চিমা ব্লকের মধ্যে মার্কিন সামরিক প্রাধান্য মেনে নিতে ইইউ নেতাদের চাপ দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে ইউক্রেন শুধু পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। ট্রাম্পের ২৮ দফা কাঠামোতে ইউক্রেনকে সম্ভবত তার সামরিক সক্ষমতা সীমিত করতে হবে এবং অন্যান্য ছাড়ের মধ্যে ‘তার সংবিধানে ন্যাটোতে যোগদান না করার’ কথা উল্লেখ করতে হবে।
যুদ্ধের অবসান ঘটলেও রাশিয়া তার অহংকারী নীতির কারণে নিজের ‘সোভিয়েত-পরবর্তী’ উচ্চাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করবে না। তবে, ট্রাম্প প্রশাসন দক্ষিণ ককেশাস এবং মধ্য এশিয়াকেও একটি কৌশলগত ইউনিট হিসেবে বিবেচনা করে। এই প্রেক্ষাপটে, এই অঞ্চলের তুর্কিক দেশগুলোর প্রতি পুতিনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা সম্ভবত তার এজেন্ডায় থাকবে। একই সঙ্গে, তুর্কিক দেশগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ এবং এই রাষ্ট্রগুলো তাদের সংস্থার কাঠামোর মধ্য থেকে রাশিয়ান যেকোনো সম্ভাব্য সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে।
পরিশেষে এ কথা বলা যায়, ট্রাম্পের ২৮ দফা শান্তি পরিকল্পনা এবং এ ব্যাপারে রাশিয়ার প্রাথমিক ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে স্থায়ী শান্তির নিশ্চয়তা দেয় না। তবে, এই চুক্তির মাধ্যমে ন্যাটোতে ইউক্রেনের যোগদানের পথ যে কার্যকরভাবে বন্ধ হয়ে যাবে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
ডেইলি সাবাহ থেকে ভাষান্তর : মোতালেব জামালী

