অর্থনৈতিক সংকট ও তরুণ প্রজন্ম

সাদিয়া সুলতানা রিমি
প্রকাশ : ২৩ জুলাই ২০২৫, ০৯: ৪১
প্রতীকী ছবি

একটি দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তার যুবশক্তির ওপর, তাদের কর্মদক্ষতা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং সমাজের প্রতি তাদের অবদানের ওপর। অথচ যখনই অর্থনৈতিক মন্দা বা সংকট আসে, প্রথমেই আঘাত আসে এই তরুণদের ওপর, যারা সবেমাত্র নিজেদের কর্মজীবন শুরু করার স্বপ্ন দেখছে। এ বিষয়টি শুধু অর্থনীতির একটি সমস্যা নয়, এটি একটি গভীর সামাজিক এবং মানবিক সংকট, যা আমাদের সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করতে হবে।

অর্থনৈতিক সংকট বলতে আমরা সাধারণত বুঝি একটি দেশের অর্থনীতিতে মন্দা, উচ্চ বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি, উৎপাদন হ্রাস, বিনিয়োগে স্থবিরতা এবং আর্থিক বাজারের অস্থিতিশীলতা। ২০১৯ সালের কোভিড এবং এর পরপরই ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংকট তৈরি করে। থেমে যায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অগ্রগতির চাকা। এ ছাড়া অপর্যাপ্ত সরকারি নীতি, অপরিকল্পিত ব্যয়, উচ্চ করের হার, বিনিয়োগের জন্য অনুকূল পরিবেশের অভাবও অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করতে পারে। আর্থিক খাতের দুর্বলতা, যেমনÑব্যাংক খাতের অস্থিরতা বা ঋণখেলাপি বৃদ্ধি, সংকটকে আরো ত্বরান্বিত করে। এসব সংকটের সবচেয়ে বড় শিকার হয় তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে যারা সদ্য উচ্চশিক্ষা শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে চাইছে। তাদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হয়ে আসে এবং বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো আরো প্রকট হয়। অর্থনৈতিক মন্দার সময় কোম্পানিগুলো নতুন নিয়োগ কমিয়ে দেয়, কর্মী ছাঁটাই করে।

বিজ্ঞাপন

উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে আন্ডার-এমপ্লয়মেন্ট একটি সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর অর্থ হলো, তারা তাদের যোগ্যতার তুলনায় নিম্নমানের কাজ করতে বাধ্য হয়। এতে শুধু তার ব্যক্তিগত হতাশা বাড়ে না, বরং দেশের মানবসম্পদেরও অপচয় হয়। শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে শ্রমবাজারের চাহিদার মধ্যে অমিলও একটি বড় সমস্যা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা অনেক সময় আধুনিক শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা প্রদানে ব্যর্থ হয়, যার ফলে তরুণরা শ্রমবাজারে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত হতে পারে না।

অর্থনৈতিক সংকটের সময় নতুন ব্যবসা শুরু করার ঝুঁকি বেড়ে যায়, যার ফলে তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা কমে যায়। মূলধন সংগ্রহ করা এবং বাজারে প্রবেশ করা কঠিন হয়ে পড়ে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, দীর্ঘমেয়াদি বেকারত্ব বা অনিশ্চিত কর্মসংস্থান তরুণদের মধ্যে মানসিক চাপ, হতাশা এবং উদ্বেগের কারণ হতে পারে। এটি তাদের সামগ্রিক সুস্থ জীবনযাপনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং সমাজের স্থিতিশীলতাকেও হুমকির মুখে ফেলে।

এই পরিস্থিতি দেশের মেধা পাচারেও ভূমিকা পালন করছে। দেশ বঞ্চিত হয় মেধাবীদের উদ্ভাবনী অবদান থেকে।

এই জটিল সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিল্প এবং সমাজের প্রতিটি স্তরের সমন্বিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে অবশ্যই শ্রমবাজারের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের চাহিদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করতে হবে। গতানুগতিক ডিগ্রির বাইরে গিয়ে তরুণদের আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষতা যেমনÑডাটা অ্যানালাইসিস, ডিজিটাল মার্কেটিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মেশিন লার্নিং, ব্লকচেইন প্রযুক্তি, কোডিং এবং সাইবার সিকিউরিটিতে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এই দক্ষতাগুলো চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য অত্যাবশ্যক।

সরকার এবং বেসরকারি খাত মিলে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে হাতে-কলমে শিক্ষার সুযোগ বাড়াতে পারে।

আমাদের সমাজে শুধু চাকরিজীবী তৈরি করার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন তৈরি করতে হবে। তাদের সে স্বপ্ন পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে তরুণদের সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারের উচিত তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ এবং সরকারি প্রণোদনার ব্যবস্থা করা। স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমকে শক্তিশালী করতে ইনকিউবেটর এবং এক্সিলারেটর প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে, যা নতুন উদ্যোগগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে সহায়তা করবে।

অভিজ্ঞ উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে তরুণদের জন্য মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম চালু করা, যাতে তারা ব্যবসা শুরু করার এবং পরিচালনার কৌশল শিখতে পারে। ফ্রিল্যান্সিং এবং গিগ ইকোনমি তরুণদের জন্য অসীম সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। সরকার ডিজিটাল অবকাঠামো যেমনÑদ্রুতগতির ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমের সম্প্রসারণ করে গ্রামীণ এলাকাতেও ডিজিটাল কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পারে। ফ্রিল্যান্সারদের জন্য আইনি সহায়তা, ট্যাক্স সুবিধা এবং সঠিক প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে সহায়তা করা উচিত। অনলাইন মার্কেটপ্লেস এবং ই-কমার্সের বিস্তারও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়ক হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত