সাঈদ বদিউল
বিপুল জনগোষ্ঠীর এই বাংলাদেশে সবার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যথেষ্ট কঠিনসাধ্য। ফলে বিপুলসংখ্যক দক্ষ ও অদক্ষ কর্মীকে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে অন্য দেশে অভিবাসিত হতে হয়। এছাড়া কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বিদেশ বিশেষ করে উন্নত দেশে যাওয়া বা অভিবাসিত হতে পারাকে সফল ব্যবসা বা সম্মানজনক চাকরির মতো সফলতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশেষ করে আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশে যাওয়াকে অনেকে বিরাট সফলতা বলে মনে করে থাকেন। এই ধারণা যে শুধু গ্রামাঞ্চল বা স্বল্পশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ তা নয়, শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গিও প্রায় একই রকম। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্রছাত্রী এ দেশ থেকে উন্নত দেশগুলোতে যাচ্ছে এবং শিক্ষা সমাপ্তির পর সেসব দেশে কর্মে নিয়োজিত হচ্ছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের একটি অংশ অধিক উপার্জন ও উন্নত জীবনের আশায় সমৃদ্ধ দেশগুলোতে পাড়ি জমাচ্ছেন। এই অভিবাসনের মাধ্যমে দেশের মানুষ একদিকে যেমন কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়, তেমনি বৈদেশিক মুদ্রা বা রেমিট্যান্স পাঠানোর মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে অবদান রাখারও সুযোগ পায়।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এটি দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখে। রেমিট্যান্স বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস, যা নিট বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পের চেয়েও অধিক। বাংলাদেশের জিডিপিতে রেমিট্যান্সের অবদান প্রায় ৬-৭ শতাংশ। আমরা যদি গত দুই দশকের রেমিট্যান্স প্রবাহ লক্ষ করি তাহলে দেখব, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ধারাবাহিকভাবে এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০০১-২০০২ সালে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স ছিল ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এটা ক্রমান্বয়ে বেড়ে ২০২৩-২০২৪ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে (তথ্যসূত্র : বাংলাদেশ ব্যাংক)। আর এ তথ্য প্রমাণ করে যে, রেমিট্যান্সের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা ক্রমবর্ধমান ও ব্যাপক।
রেমিট্যান্স আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান খাত হলেও আমরা খুব বেশি সংখ্যক দেশ থেকে রেমিট্যান্স আহরণ করতে পারছি না। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, কাতার, ওমান, কুয়েত, সিঙ্গাপুর ও ইতালি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উল্লেখযোগ্য উৎস।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোই ছিল বাংলাদেশিদের জন্য কর্মসংস্থানের প্রধান গন্তব্য। এর বাইরে মালয়েশিয়াতেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি কর্মী কাজ করে। প্রথাগত বাজার হিসেবে পরিচিত এ দেশগুলোতে ননস্কিলড বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানের সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান ইত্যাদি দেশ ইতোমধ্যে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ স্থগিত করেছে। সিন্ডিকেট দুর্নীতি ইত্যাদি অভিযোগের কারণে মালয়েশিয়াও বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে। এর প্রভাবে ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে অভিবাসী কর্মীদের বহির্গমন প্রায় ২২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়া তথা ট্র্যাডিশনাল বা ননস্কিলড শ্রমবাজারের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো ও তুলনামূলক অধিক আয়ের দেশে বৈদেশিক কর্মসংস্থান বাড়ানোর লক্ষ্যে নতুন বা বিকল্প বাজার খুঁজে বের করা আমাদের জন্য অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছে। যদিও বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য নতুন বাজার ধরার প্রচেষ্টায় সফলতা খুব আশাব্যঞ্জক নয়। গুটিকতক দেশ যেমনÑইতালি, রোমানিয়া, পোল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ইত্যাদি দেশে কিছু বৈদেশিক কর্মসংস্থান হলেও ইতালি ছাড়া বাকি দেশগুলোতে কর্মসংস্থানের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য নয়।
গত শতাব্দীর আশির দশকের শেষাংশে ইতালিতে বাংলাদেশিদের অভিবাসন শুরু হলেও নব্বই দশকে ইতালিতে বাংলাদেশিদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। মূলত কর্মী সংকটের কারণেই ইতালিতে বাংলাদেশি কর্মীরা কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়। প্রাথমিক পর্যায়ের কর্মীরাই সে দেশে কর্মসংস্থানের ভিত্তি স্থাপন করে। এই প্রাথমিক কর্মীদের মাধ্যমে ইতালিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটে আরো বহু বাংলাদেশি কর্মীর। তারা সেখানে সুনামের সঙ্গে চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা ধরনের কর্মে নিয়োজিত থেকে ইতালির অর্থনীতিকে সুসংহত করতে সহায়তা করছেন। ফলে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে ইতালি যেমন আস্থা পেয়েছে তেমনি উন্নত জীবনযাপন ও অধিক আয়ের সুযোগের কারণে বাংলাদেশি কর্মীরাও ইতালিতে কর্মসংস্থানের জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠেন। পারস্পরিক এই আগ্রহের কারণে বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মী ইতালিতে অভিবাসিত হয়েছে এবং প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশে পাঠাচ্ছেন।
ইউরোপের আরো অনেক দেশের মতো ইতালিতেও কিছু কিছু কাজের ক্ষেত্রে কর্মী সংকট রয়েছে, যা তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নৈতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে কৃষি, নির্মাণ, পর্যটন, উৎপাদনমুখী শিল্প, হোটেল, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি ক্ষেত্রে দেশটির শ্রমসংকট রয়েছে। অর্থনীতিকে চাঙা করতে হলে এই শ্রমসংকট দূর করা আবশ্যক। আর এই কর্মীপ্রবাহ বৃদ্ধির জন্য ইতালি সরকার বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ইতালি আরো সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ বৃদ্ধির চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশি কর্মীদের কঠোর পরিশ্রম, তারুণ্য ও ইতালীয় সমাজে একীভূত হওয়ার সক্ষমতাটি ইতালির জনগণ ও কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রশংসিত ও স্বীকৃত। ফলে শুধু ইতালি নয়, ইতালির পথ ধরে আরো অনেক দেশে বাংলাদেশিদের জন্য কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
ইতালি যখন বৈদেশিক কর্মসংস্থানের একটি অন্যতম সম্ভাবনাময় গন্তব্য হয়ে উঠেছে, তখন নানা অপতৎপরতায় এ শ্রমবাজারটি সংকটে পড়তে যাচ্ছে। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য হওয়ায় বিপুল সংখ্যক কর্মী ইতালিতে কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে অভিবাসন প্রত্যাশী হওয়ায় একে পুঁজি করে নানা ধরনের দালালচক্র ও অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠেছে, যারা প্রতিনিয়ত জাল নথিপত্র তৈরি করে কর্মসংস্থান প্রত্যাশিতদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে এবং সেই প্রতারণা আড়াল করার উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝে তারা বিবিধ কৌশলে ও উসকানি দিয়ে আবেদনকারী ও সাধারণ জনগণকে সংগঠিত করে ইতালি দূতাবাস, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে প্রতিরোধ, প্রতিবাদ, অবস্থান কর্মসূচি ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করে বা পরোক্ষভাবে মদত দিয়ে থাকে। এ ধরনের কর্মসূচির খবর সামাজিক যোগাযোগ ও অন্যান্য মিডিয়ার মাধ্যমে দ্রুত বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে যা বাংলাদেশিদের জন্য ইতালির শ্রমবাজারকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। আর এ ধরনের অপতৎপরতা কেবল ইতালি নয়, সম্ভাবনাময় অন্য শ্রমবাজারগুলোতেও প্রভাব ফেলছে। তাছাড়া এ ধরনের কর্মকাণ্ডের ফলে বিদেশে বাংলাদেশিদের জন্য কেবল কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাচ্ছে তা নয়, এটা দুনিয়াব্যাপী বাংলাদেশি পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস করার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশিদের আত্মসম্মানেও আঘাত হানছে। বাংলাদেশে এ ধরনের পরিস্থিতি যাতে না ঘটে সে বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। কেননা এ ধরনের ঘটনা চলতে থাকলে ইতালি ও পশ্চিমা দেশগুলো শ্রম সরবরাহের জন্য বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।
বৈদেশিক শ্রমবাজার যেহেতু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লাইফ লাইন, তাই এ বাজার সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণে সরকারকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। অভিবাসন প্রক্রিয়ায় অনিয়ম বিচিত্র ও বহুমুখী। জাল বা ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে অর্থ লেনদেন, বিদেশে কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিপুল অংকের টাকা লেনদেন ও আত্মসাৎ, অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ উপায়ে অভিবাসনে উদ্বুদ্ধ করে টাকা লেনদেন, প্রতারণা ও কর্মীর জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলা ইত্যাদি। বাংলাদেশ থেকে অবৈধ পথে অভিবাসন বা অভিবাসনের চেষ্টা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে বাংলাদেশিদের সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা প্রদান করছে। এ অবৈধ কার্যক্রমগুলো রোধকল্পে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, দপ্তরসমূহ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা এবং কার্যকর ভূমিকা গ্রহণসহ ব্যাপক জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ ছাড়া এ ধরনের অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ করা সম্ভব নয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সমাজতত্ত্ব বিশ্লেষক
বিপুল জনগোষ্ঠীর এই বাংলাদেশে সবার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যথেষ্ট কঠিনসাধ্য। ফলে বিপুলসংখ্যক দক্ষ ও অদক্ষ কর্মীকে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে অন্য দেশে অভিবাসিত হতে হয়। এছাড়া কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বিদেশ বিশেষ করে উন্নত দেশে যাওয়া বা অভিবাসিত হতে পারাকে সফল ব্যবসা বা সম্মানজনক চাকরির মতো সফলতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশেষ করে আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশে যাওয়াকে অনেকে বিরাট সফলতা বলে মনে করে থাকেন। এই ধারণা যে শুধু গ্রামাঞ্চল বা স্বল্পশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ তা নয়, শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গিও প্রায় একই রকম। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্রছাত্রী এ দেশ থেকে উন্নত দেশগুলোতে যাচ্ছে এবং শিক্ষা সমাপ্তির পর সেসব দেশে কর্মে নিয়োজিত হচ্ছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের একটি অংশ অধিক উপার্জন ও উন্নত জীবনের আশায় সমৃদ্ধ দেশগুলোতে পাড়ি জমাচ্ছেন। এই অভিবাসনের মাধ্যমে দেশের মানুষ একদিকে যেমন কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়, তেমনি বৈদেশিক মুদ্রা বা রেমিট্যান্স পাঠানোর মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে অবদান রাখারও সুযোগ পায়।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এটি দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখে। রেমিট্যান্স বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস, যা নিট বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পের চেয়েও অধিক। বাংলাদেশের জিডিপিতে রেমিট্যান্সের অবদান প্রায় ৬-৭ শতাংশ। আমরা যদি গত দুই দশকের রেমিট্যান্স প্রবাহ লক্ষ করি তাহলে দেখব, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ধারাবাহিকভাবে এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০০১-২০০২ সালে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স ছিল ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এটা ক্রমান্বয়ে বেড়ে ২০২৩-২০২৪ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে (তথ্যসূত্র : বাংলাদেশ ব্যাংক)। আর এ তথ্য প্রমাণ করে যে, রেমিট্যান্সের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা ক্রমবর্ধমান ও ব্যাপক।
রেমিট্যান্স আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান খাত হলেও আমরা খুব বেশি সংখ্যক দেশ থেকে রেমিট্যান্স আহরণ করতে পারছি না। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, কাতার, ওমান, কুয়েত, সিঙ্গাপুর ও ইতালি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উল্লেখযোগ্য উৎস।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোই ছিল বাংলাদেশিদের জন্য কর্মসংস্থানের প্রধান গন্তব্য। এর বাইরে মালয়েশিয়াতেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি কর্মী কাজ করে। প্রথাগত বাজার হিসেবে পরিচিত এ দেশগুলোতে ননস্কিলড বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানের সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান ইত্যাদি দেশ ইতোমধ্যে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ স্থগিত করেছে। সিন্ডিকেট দুর্নীতি ইত্যাদি অভিযোগের কারণে মালয়েশিয়াও বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে। এর প্রভাবে ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে অভিবাসী কর্মীদের বহির্গমন প্রায় ২২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়া তথা ট্র্যাডিশনাল বা ননস্কিলড শ্রমবাজারের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো ও তুলনামূলক অধিক আয়ের দেশে বৈদেশিক কর্মসংস্থান বাড়ানোর লক্ষ্যে নতুন বা বিকল্প বাজার খুঁজে বের করা আমাদের জন্য অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছে। যদিও বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য নতুন বাজার ধরার প্রচেষ্টায় সফলতা খুব আশাব্যঞ্জক নয়। গুটিকতক দেশ যেমনÑইতালি, রোমানিয়া, পোল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ইত্যাদি দেশে কিছু বৈদেশিক কর্মসংস্থান হলেও ইতালি ছাড়া বাকি দেশগুলোতে কর্মসংস্থানের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য নয়।
গত শতাব্দীর আশির দশকের শেষাংশে ইতালিতে বাংলাদেশিদের অভিবাসন শুরু হলেও নব্বই দশকে ইতালিতে বাংলাদেশিদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। মূলত কর্মী সংকটের কারণেই ইতালিতে বাংলাদেশি কর্মীরা কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়। প্রাথমিক পর্যায়ের কর্মীরাই সে দেশে কর্মসংস্থানের ভিত্তি স্থাপন করে। এই প্রাথমিক কর্মীদের মাধ্যমে ইতালিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটে আরো বহু বাংলাদেশি কর্মীর। তারা সেখানে সুনামের সঙ্গে চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা ধরনের কর্মে নিয়োজিত থেকে ইতালির অর্থনীতিকে সুসংহত করতে সহায়তা করছেন। ফলে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে ইতালি যেমন আস্থা পেয়েছে তেমনি উন্নত জীবনযাপন ও অধিক আয়ের সুযোগের কারণে বাংলাদেশি কর্মীরাও ইতালিতে কর্মসংস্থানের জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠেন। পারস্পরিক এই আগ্রহের কারণে বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মী ইতালিতে অভিবাসিত হয়েছে এবং প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশে পাঠাচ্ছেন।
ইউরোপের আরো অনেক দেশের মতো ইতালিতেও কিছু কিছু কাজের ক্ষেত্রে কর্মী সংকট রয়েছে, যা তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নৈতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে কৃষি, নির্মাণ, পর্যটন, উৎপাদনমুখী শিল্প, হোটেল, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি ক্ষেত্রে দেশটির শ্রমসংকট রয়েছে। অর্থনীতিকে চাঙা করতে হলে এই শ্রমসংকট দূর করা আবশ্যক। আর এই কর্মীপ্রবাহ বৃদ্ধির জন্য ইতালি সরকার বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ইতালি আরো সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ বৃদ্ধির চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশি কর্মীদের কঠোর পরিশ্রম, তারুণ্য ও ইতালীয় সমাজে একীভূত হওয়ার সক্ষমতাটি ইতালির জনগণ ও কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রশংসিত ও স্বীকৃত। ফলে শুধু ইতালি নয়, ইতালির পথ ধরে আরো অনেক দেশে বাংলাদেশিদের জন্য কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
ইতালি যখন বৈদেশিক কর্মসংস্থানের একটি অন্যতম সম্ভাবনাময় গন্তব্য হয়ে উঠেছে, তখন নানা অপতৎপরতায় এ শ্রমবাজারটি সংকটে পড়তে যাচ্ছে। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য হওয়ায় বিপুল সংখ্যক কর্মী ইতালিতে কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে অভিবাসন প্রত্যাশী হওয়ায় একে পুঁজি করে নানা ধরনের দালালচক্র ও অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠেছে, যারা প্রতিনিয়ত জাল নথিপত্র তৈরি করে কর্মসংস্থান প্রত্যাশিতদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে এবং সেই প্রতারণা আড়াল করার উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝে তারা বিবিধ কৌশলে ও উসকানি দিয়ে আবেদনকারী ও সাধারণ জনগণকে সংগঠিত করে ইতালি দূতাবাস, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে প্রতিরোধ, প্রতিবাদ, অবস্থান কর্মসূচি ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করে বা পরোক্ষভাবে মদত দিয়ে থাকে। এ ধরনের কর্মসূচির খবর সামাজিক যোগাযোগ ও অন্যান্য মিডিয়ার মাধ্যমে দ্রুত বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে যা বাংলাদেশিদের জন্য ইতালির শ্রমবাজারকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। আর এ ধরনের অপতৎপরতা কেবল ইতালি নয়, সম্ভাবনাময় অন্য শ্রমবাজারগুলোতেও প্রভাব ফেলছে। তাছাড়া এ ধরনের কর্মকাণ্ডের ফলে বিদেশে বাংলাদেশিদের জন্য কেবল কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাচ্ছে তা নয়, এটা দুনিয়াব্যাপী বাংলাদেশি পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস করার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশিদের আত্মসম্মানেও আঘাত হানছে। বাংলাদেশে এ ধরনের পরিস্থিতি যাতে না ঘটে সে বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। কেননা এ ধরনের ঘটনা চলতে থাকলে ইতালি ও পশ্চিমা দেশগুলো শ্রম সরবরাহের জন্য বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।
বৈদেশিক শ্রমবাজার যেহেতু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লাইফ লাইন, তাই এ বাজার সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণে সরকারকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। অভিবাসন প্রক্রিয়ায় অনিয়ম বিচিত্র ও বহুমুখী। জাল বা ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে অর্থ লেনদেন, বিদেশে কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিপুল অংকের টাকা লেনদেন ও আত্মসাৎ, অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ উপায়ে অভিবাসনে উদ্বুদ্ধ করে টাকা লেনদেন, প্রতারণা ও কর্মীর জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলা ইত্যাদি। বাংলাদেশ থেকে অবৈধ পথে অভিবাসন বা অভিবাসনের চেষ্টা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে বাংলাদেশিদের সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা প্রদান করছে। এ অবৈধ কার্যক্রমগুলো রোধকল্পে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, দপ্তরসমূহ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা এবং কার্যকর ভূমিকা গ্রহণসহ ব্যাপক জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ ছাড়া এ ধরনের অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ করা সম্ভব নয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সমাজতত্ত্ব বিশ্লেষক
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
১১ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
১১ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
১১ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
১ দিন আগে