পেশাগত কারণে আমাকে দেশের অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখকের রচনারই অনুলিখন করতে হয়েছে বিভিন্ন সময়। তাদের মধ্যে যে দু-একজন লেখকের লেখার অনুলিখন করতে গিয়ে কখনো ক্লান্ত বোধ করিনিÑমাহবুব উল্লাহ তাদের অন্যতম। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, ইতিহাসের মতো জটিল বিষয়ও তার কলমে ছন্দ ও গন্ধময় হয়ে উঠেছে। সহজ শব্দের সুললিত বাক্যবিন্যাসে নিজের সমাজ-চেতনা ও দার্শনিক শক্তিকে লেখালেখিতে উপজীব্য করে তোলার এই সহজাত শৈল্পিক ক্ষমতাতেই তিনি আর দশজনের চেয়ে ব্যতিক্রম। প্রগতি ও সমাজবদলের তার স্বকীয় চিন্তাকে তুলে ধরতে গিয়ে তার লেখার ধারায় কখনো কখনো কাব্যিক আভাস মেলে। স্যারের ‘আমার জীবন, আমার সংগ্রাম’ গ্রন্থেও তার কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। এর প্রতিটি পৃষ্ঠার সহজ, সাবলীল পাঠ অন্য পৃষ্ঠায় টেনে নিয়ে যায় অবলীলায়। কোনো ঘটনার ঐতিহাসিক বর্ণনা স্থান, কাল, পাত্র অতিক্রম করেও যে অনন্য সাহিত্যিক দ্যোতনায় ভাস্বর হতে পারে, এই বইয়ে স্যার দেখিয়েছেন ইতিহাসকে মানুষের ভাষায়, মানুষের অনুভূতিতে রূপান্তরিত করে।
আক্ষরিক অর্থেই বইটি বিগত ছয় দশকেরও অধিকজুড়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইতিহাসের নির্মোহ, প্রাজ্ঞ ও যথার্থ পর্যবেক্ষণ এবং অনুধ্যানে একজন অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক, সমাজচিন্তক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক হিসেবে বর্ষীয়ান এক জ্ঞানতাপসের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার রঙিন আলোর বিচ্ছুরণ। বইটির শিরোনাম থেকে একটি ব্যক্তিগত জীবন কাহিনি মনে হলেও মূলত বাংলাদেশের রাষ্ট্রগঠন, রাজনৈতিক উত্থানপতন এবং বাঙালির স্বতন্ত্র চেতনার দীর্ঘ অভিযাত্রার এক ঐতিহাসিক দলিল এটি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঐতিহাসিক বাস্তবতা বোঝার জন্য শুধু ঘটনাপঞ্জি যথেষ্ট নয়; বরং একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বোধ, সৎ ও নির্মোহ বিশ্লেষণ দীর্ঘ এবং গভীরভাবে অনুভূত। সেদিক থেকে এই বইটি শতভাগ নির্ভরযোগ্য। নির্মেদ, নিরপেক্ষ ও পরিমিতিবোধে লেখকের সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে।
শৈশবের অধ্যায় থেকেই বইটির বর্ণনাশৈলী পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখে। নোয়াখালীর তিতাহাজরার গ্রামীণ পরিবেশ, পারিবারিক সংগ্রাম, শিক্ষকদের কঠোর সততা, ব্রিটিশ আমলের চিকিৎসাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাÑসবকিছু এমন সরলভাবে বিধৃত হয়েছে, যেন পাঠকের সামনে সময়ের ছবি ভাসছে। ভাষা আন্দোলনের প্রথম ঝলক, ছাত্র মিছিলের স্লোগান, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’Ñইতিহাসের এই অধ্যায়গুলো তিনি দেখেছেন এক শিশু-চোখে, কিন্তু বর্ণনা করেছেন গভীর বোধ ও উপলব্ধির সঙ্গে।
ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্র ইউনিয়নের পুনর্গঠন, এনএসএফের সন্ত্রাস, মেনন মতিয়া বিভক্তিÑপ্রতিটি অধ্যায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক বাস্তবতায় লেখকের নিখাদ তারুণ্যদীপ্ত দেশপ্রেম ও ত্যাগের সাক্ষী। তেমনি ছয় দফা আন্দোলনের উত্তাল সময়, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার উত্তেজনা, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের রণনীতি’র সুললিত বর্ণনা থেকে পরিষ্কার কীভাবে জাতীয় রাজনীতি আদর্শিক ধারা বিচ্যুত হয়ে অর্থ ও পেশিনির্ভর হয়ে পড়েছে।
এই আত্মজীবনীতে সবচেয়ে উজ্জ্বল অংশ হলোÑসমাজের সাধারণ মানুষের প্রতি লেখকের পূর্ণ আস্থা ও গভীর মমত্ববোধ। তিনি বারবার বলেছেন, একটি রাষ্ট্রের প্রকৃত শক্তি তার জনগণ। জনগণকে বাদ দিয়ে কোনো উন্নয়ন, কোনো রাজনীতি, কোনো রাষ্ট্রতত্ত্বÑকিছুই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, রাজনৈতিক বিচ্যুতি, নৈতিকতার সংকটÑতাঁর ভাষায় এগুলো শুধু রাজনৈতিক ব্যর্থতা নয়, একটি জাতির মানসিক বিবর্তনের ব্যর্থতা। এই বিশ্লেষণ পাঠককে ভাবতে বাধ্য করেÑকাঙ্ক্ষিত সমাজ ধারণে বর্তমান রাজনীতির ব্যর্থতা। অতীতের বর্ণনায় সমাজের বৈষম্য, শ্রেণিগত বিভাজন, অবিচারের চিত্র এসেছেÑসেগুলো আজকের দিনেও সমধিক প্রাসঙ্গিক। লেখক যথার্থই বলেছেন, ইতিহাস যেন কখনোই পুরোপুরি পেছনে পড়ে যায় না। তার পুনরাবৃত্তি আমাদের বর্তমানকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়।
তরুণ প্রজন্ম যারা বাংলাদেশের রাজনীতি, রাষ্ট্র ও সমাজকে নতুন চোখে দেখতে চায়Ñতাদের জন্য এটি একটি অপরিহার্য বই। কারণ এখানে তারা পড়বে ইতিহাস, অভিজ্ঞতা, সংগ্রামÑআর একই সঙ্গে এক চিন্তাশীল মানুষের বাস্তব উপলব্ধি।
মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ নিয়ে লেখকের সতর্ক ও তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ বইটির সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং অংশগুলোর মধ্যে পড়ে। লেখক তৎপরভাবে দেখিয়েছেন কীভাবে স্বপ্ন ও বাস্তবতার মধ্যে সংঘাত ঘটছে; কীভাবে সংগ্রামের পরও রাষ্ট্রের গঠন ও প্রশাসনিক কাঠামোতে নতুনভাবে অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও বৈষম্য তৈরি হয়। স্বাধীনতার পর বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রভাব দীর্ঘ মেয়াদে জাতির উন্নয়নকে কীভাবে প্রভাবিত করেছেÑএসব অধ্যায়ে লেখকের বিশ্লেষণ পাঠকের চিন্তার উদ্রেক করতে বাধ্য।
বইয়ের সবচেয়ে শক্তিশালী দিকগুলোর একটি হলোÑব্যক্তিগত বর্ণনার সঙ্গে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসকে প্রাসঙ্গিকরণ। লেখকের কারাবাস, আত্মগোপন, আন্দোলনে অংশগ্রহণÑএসব ঘটনা শুধু ব্যক্তিগত কষ্ট নয়; এগুলো একটি জাতির সংগ্রাম ও ব্যক্তিরাষ্ট্রীয় সম্পর্ককে বোঝায়। পাঠক এই অংশগুলো পড়ে সহজভাবে উপলব্ধি করতে পারেন যে ইতিহাস শুধু রাজনীতিবিদের রচনায় সীমাবদ্ধ নয়; এটি সাধারণ মানুষের দুর্বিষহ আত্মত্যাগ, সমর্থন ও ঐক্যের ওপর গড়া।
বইটি বর্তমান প্রজন্মের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আজকের যুবসমাজ যারা সামাজিক নৈতিকতা, রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা ও নাগরিক অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, তাদের জন্য এই গ্রন্থ শিক্ষা, অনুপ্রেরণা ও বাস্তব নির্দেশনামূলক। লেখক দেখিয়েছেন কীভাবে আদর্শিক রাজনীতি সময়ের চাপ ও ভাঙনের মধ্য দিয়ে টিকে থাকতে পারে এবং কখন তা হাল ছেড়ে দেয়। রাজনৈতিক চেতনায় সারল্য ও নৈতিকতার ছাপ রেখেও জাতিরাষ্ট্রের গুণগত পরিবর্তন সম্ভবÑএই প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতটিও বইয়ে স্পষ্ট। বইটি তরুণদের হাতে দিলেই তারা বুঝতে পারবে কীভাবে ইতিহাসের ভেতরে কৃত কিছু ভুল ও সঠিক সিদ্ধান্ত ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করে।
তথ্যভিত্তিক উপস্থাপনায় লেখক প্রতিটি জটিল ঘটনার পেছনে সূত্র ও প্রেক্ষাপট টেনেছেন; ফলে পাঠক সহজেই বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করতে পারেন। এ কারণে গবেষক এবং ইতিহাসপাগল পাঠক গ্রন্থটিকে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র হিসেবে গ্রহণ করবেন। ভাষার গতি তথ্য ও বর্ণনা সমন্বয়ে অপূর্ব ভারসাম্য বজায় রেখেছে।
লেখার শেষাংশে লেখক বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক আন্দোলন ও নাগরিক প্রতিবাদের প্রসঙ্গ তুলেছেন। ২০১৮-২৪ সময়ের সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন, নাগরিক চেতনায় ওঠা প্রশ্নÑএসব নিয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ পাঠকের মনে একটি সুস্পষ্ট প্রশ্ন তোলে : আমরা কি শিখেছি, নাকি ইতিহাসকে পুনরাবৃত্তিতে ঠেলে দিচ্ছি? এই প্রশ্নের উত্তরে পাঠক নিজের অবস্থান ও দায়িত্ব নিয়ে ভাবতে বাধ্য হবেন। পরিবর্তন ঘটাতে শিক্ষাব্যবস্থা, নাগরিক অংশগ্রহণ ও নৈতিক নেতৃত্বে বিনিয়োগ জরুরিÑলেখকের এই উপলব্ধিতে প্রকৃতপক্ষে সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন ঘটেছে।
সবশেষে, এই গ্রন্থটি পাঠ্য-উপকরণ হওয়ার পাশাপাশি সংগ্রহযোগ্যও। এটি গবেষণামূলক মূল্যবান দলিল, একটি বৌদ্ধিক পরিস্থিতি এবং ঐতিহাসিক প্রাসঙ্গিকতার সংকলন। পাঠক, গবেষক, শিক্ষক এবং ছাত্রÑপ্রত্যেকেরই এই বই থেকে নতুন ধারণা, অনুপ্রেরণা ও গবেষণার পর্যাপ্ত রসদ রয়েছে।
কোনো জাতির সঠিক অগ্রযাত্রায় প্রকৃত ইতিহাস জানার বিকল্প নেই। কেননা জাতির সঠিক দার্শনিক ভিত্তি গঠনে ইতিহাস পাঠ অপরিহার্য। এদিক থেকে ‘আমার জীবন, আমার সংগ্রাম’Ñবইটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও সময়োচিত। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রচিন্তায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করার পক্ষে অনেক তাত্ত্বিক যে ধারার কথা বলেছেন, তার বহু পথনির্দেশ রয়েছে এ বইয়ে। যারা বাংলাদেশের রাজনীতি, ইতিহাস এবং সামাজিক চেতনা নিয়ে আন্তরিকভাবে আগ্রহীÑতাদের জন্য এই গ্রন্থটি অবশ্যপাঠ্য হবে বলেই আমার বিশ্বাস।
লেখক : সাংবাদিক, কবি

