অলিউল্লাহ নোমান
সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলা হয় গ্রেট ব্রিটেনকে। টেমস নদীর তীরে সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গ্রেট ব্রিটেনের সংসদ ভবন। হাজারো দর্শনার্থী প্রতিদিন এখানে আসেন সংসদীয় গণতন্ত্রের এই সিম্বল দেখতে, যদিও রাজা বা রানিকে মনে করা হয় জাতীয় ঐক্যের প্রতীক।
রাজতন্ত্রের ছায়ায় এমন সুন্দর গণতন্ত্র কল্পনাও করা যায় না। গণতন্ত্রের প্রতিটি উপাদান এখানে বিদ্যমান রয়েছে। মানুষের প্রতি মানুষের সম্মান, আইনের প্রতি নাগরিকদের শ্রদ্ধাবোধ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার নিরন্তর চেষ্টা রয়েছে এখানে। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর তার ছেলে চার্লস এখন রাজা।
২০১২ সালের ডিসেম্বর থেকে ব্রিটেনে স্থায়ীভাবেই আছি। অনেক সরকারের উত্থান-পতন দেখেছি। ইউরোপ থেকে ব্রিটেনের বের হয়ে আসার বিষয়টি ছিল অনেক জটিল। মানুষের ভোট কীভাবে জটিল অবস্থাকে সহজ করে দিয়েছে সেটাও উপলব্ধি করেছি। গত ১২ বছরে ব্রিটেনে তিনটি গণভোট হয়েছে। এর মধ্যে একটি গণভোট একেবারেই স্থানীয় পর্যায়ে। একটি গণভোট ছিল রাজ্যভিত্তিক। আর একটি গণভোট ছিল দেশজুড়ে (চারটি রাজ্যে)।
এক
প্রথম গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নে। ২০১৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর পুরো বিশ্বের নজর ছিল স্কটল্যান্ডে। নানা প্রশ্ন তখন বিশ্বজুড়ে। গ্রেট ব্রিটেন থেকে কি একটি রাজ্য বিচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে—এমন প্রশ্ন তখন গণমাধ্যমজুড়ে। ১৮ সেপ্টেম্বরের এই গণভোট ছিল ব্রিটেনের জন্য অগ্নিপরীক্ষা। তখন আমার যুক্তরাজ্যের বয়স মাত্র পৌনে দুই বছর। স্কটল্যান্ডের গণভোট নিয়ে মানুষের মধ্যে টানটান উত্তেজনা দেখতে পাচ্ছিলাম। যুক্তরাজ্য থেকে বের হয়ে পুরোপুরি স্বাধীনতার দাবি উঠেছিল দেশটিতে। আমার ধারণা ছিল গণভোটে যারাই বিজয়ী হোক প্রতিপক্ষের খবর আছে! স্বাধীনতার পক্ষে বিজয়ী হলে পরাজিতদের বলা হবে স্বাধীনতার শত্রু; আর স্বাধীনতার বিপক্ষের দাবি বিজয়ী হলে অন্যদের বলা হবে বিচ্ছিন্নতাবাদী। সুতরাং যে পক্ষই জিতুক স্কটল্যান্ডে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে একটা স্থায়ী অস্থিরতা ও অশান্তি লেগে থাকবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে এটা হওয়াই স্বাভাবিক।
শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হলো। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে কৌতূহলী মানুষ ভোট দেখতেও গিয়েছিলেন। আমিও ভোট দেখতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর যাওয়া হয়নি। ভোটের সপ্তাহ খানেক আগে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ (তখন তিনি ব্রিটেনের রানি) খোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে স্কটল্যান্ডের বিভিন্ন শহর প্রদক্ষিণ করলেন। স্বাধীনতার পক্ষে-বিপক্ষে কিছুই বললেন না কখনো, শুধু হাত নাড়লেন মানুষের উদ্দেশে। নাগরিকের ভোটের অধিকারের প্রতি রানি সম্মান দেখালেন। কেউ কেউ তখন মনে করেছিলেন স্বাধীনতার আগে রানি স্কটল্যান্ডে শেষ ভ্রমণ করলেন। কেউ কেউ বললেন, রানির এই ভ্রমণ ভোটারের মনে প্রভাব ফেলবে। ব্রিটেনে থাকার পক্ষে কিছুটা হলেও আগ্রহ তৈরি করবে। কারণ রানির প্রতি সর্বস্তরের মানুষের রয়েছে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
সন্ধ্যায় থেকে ভোটের ফলাফল ঘোষণা দেখার অপেক্ষায় সবাই। চূড়ান্ত ফলাফলে স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি পরাজিত হয়েছিল। স্বাধীনতার পক্ষে ৪৪ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট পড়ে। ৫৫ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট পড়ে স্বাধীনতার বিপক্ষে। সবাই ফলাফল মেনে নিয়ে ঘরে চলে গেলেন। কারো মধ্যে কোনো রকমের উত্তেজনা দেখা যায়নি আর। সব স্বাভাবিক। স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে আর টুঁ শব্দটিও এখন পর্যন্ত শোনা যায়নি। স্কটিশ ন্যাশন সবাই এক। স্বাধীনতার কোনো পক্ষ-বিপক্ষ বিবাদ নেই। স্কটল্যান্ড ব্রিটেনের অঙ্গরাজ্য হিসেবে বহাল আছে। কেন্দ্রীয় সরকারকেও এ নিয়ে কারো পক্ষে বা বিপক্ষে পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। যদিও ভাষা, মুদ্রা সবই তাদের পৃথক। ব্রিটেনের মুদ্রার নাম পাউন্ড, অথচ স্কটল্যান্ডের মুদ্রার নাম হচ্ছে স্টারলিং। শুধু পররাষ্ট্রনীতি ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় ছাড়া বাকি সবই স্কটিশ পার্লামেন্টের আইন দ্বারা চলে। তারপরও দেশটির বেশিরভাগ মানুষ ঐক্যবদ্ধ ব্রিটেনের সঙ্গে থেকে যাওয়ার পক্ষে মতামত দিলেন।
দুই
দ্বিতীয় গণভোট ছিল আরো জটিল বিষয়। ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে, নাকি থাকবে না—এ প্রশ্ন সামনে রেখে হয়েছিল গণভোট। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসার দাবি উঠেছিল জনগণের একটি বড় অংশের পক্ষ থেকে। দীর্ঘদিন থেকে এ দাবিতে গণমাধ্যমে লেখালেখি। ডেভিড ক্যামেরন তখন প্রধানমন্ত্রী। দ্বিতীয়বার জাতীয় নির্বাচনের আগে তিনি ওয়াদা করলেন, বিজয়ী হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার প্রশ্নে গণভোট দেবেন। নির্বাচনী ইশতেহারে এটাই ছিল মূল আলোচনার বিষয়। তখন আমি ব্রিটেনের ভোটার। তার দল কনজারভেটিভ পার্টি এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বিজয়ী হয়। যখন এই ওয়াদা করেন, তখন ছিল কোয়ালিশন সরকার। লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশন করে সরকার গঠন করতে হয়েছিল তাকে প্রথমবার। লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টিকে দিতে হয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ একাধিক মন্ত্রিত্ব। দ্বিতীয়বার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর ওয়াদা অনুযায়ী গণভোট দিতে হবে। বিজয়ের প্রথম বছরেই ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার প্রশ্নে গণভোট দিলেন ক্যামেরন, যদিও তার বিভিন্ন বক্তব্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছিলেন। গণভোটে বিজয়ী হয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার পক্ষের সমর্থকরা। তিনি কালবিলম্ব করলেন না, ভোটের পরের দিন পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন।
২০১৬ সালের ২৩ জুন অনুষ্ঠিত এই গণভোটে জয়-পরাজয়ের ব্যবধান ছিল খুবই সামান্য। ৪৮ দশমিক ১১ শতাংশ মানুষ ভোট দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে। ৫১ দশমিক ৮৯ শতাংশ মানুষ ভোট দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসার পক্ষে।
তখনো মনে করেছিলাম, জয়-পরাজয় যেদিকেই হোক ব্রিটেন স্থায়ী একটি রাজনৈতিক জটিলতায় প্রবেশ করছে। ব্রেক্সিটের পক্ষে-বিপক্ষে দ্বন্দ্ব লেগেই থাকবে। ইউরোপে থাকার পক্ষে-বিপক্ষের দ্বন্দ্ব থাকবে সমাজে। কিন্তু ভোটের পর দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রায়ের প্রতি সবার শ্রদ্ধা। ভোটের পরের দিন থেকে ব্রেক্সিটের পক্ষ-বিপক্ষ বলে আর কিছুই থাকল না—সবাই এক।
এবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বোঝাপড়ার মাধ্যমে বের হয়ে আসার পালা। ডেভিড ক্যামেরনের পর তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (কট্টরপন্থি হিসেবে পরিচিত) থেরেসা মে দলীয় প্রধান মনোনীত হলেন। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন তেরেসা। কিন্তু সংসদে ব্রেক্সিট চুক্তির বিল আর তিনি পাস করতে পারছেন না। এ নিয়ে টালমাটাল অবস্থা। কনজারভেটিভের ২৫ জনের বেশি এমপি ব্রেক্সিট বিলের বিপক্ষে। লেবার পার্টি ও লিবড্যাম এবং স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির এমপিরা একাট্টা। তখন সংসদ অধিবেশনগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতাম। একপর্যায়ে তিনি পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে অনুরোধ করেন রানিকে। তার ধারণা ছিল ব্রেক্সিট বিল হবে ইস্যু। মানুষ কনজারভেটিভকে তখন ভোট দেবে, বিজয়ী হয়ে নির্বিঘ্নে ব্রেক্সিট বিল পাস করে নেবেন। কিন্তু হিতে বিপরীত হলো। তার দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি ভোটে। আরো বিপাকে পড়ে গেলেন তিনি। নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের একটি আঞ্চলিক দলের সঙ্গে সমঝোতা করে সরকার গঠন করতে হয়েছিল তাকে। এই সরকার এসেও ব্রেক্সিট বিল আর পাস করতে পারছিল না। একপর্যায়ে তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন। তার দলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন দলীয় প্রধান নির্বাচিত হলেন। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে তিনিও ব্রেক্সিট বিল পাস করাতে ব্যর্থ হলেন সংসদে। তখন সংসদ অধিবেশনগুলোয় দেখতাম, বরিস জনসন বারবার বলতেন, ‘আসুন, আমরা পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন দিই। জনগণ কী চায় সেটা যাচাই করি।’ কিন্তু লেবার পার্টি, লিবড্যামসহ অন্য দলগুলো তখন বিরোধিতা করত। একপর্যায়ে সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন হলো। এই নির্বাচনে প্রধান ইস্যু ছিল ব্রেক্সিট। বরিস জনসনের প্রচারণা ছিল তিনটি শব্দে। গণভোটে বিজয়ী হয়েছিল ব্রিটেন ইউরোপ থেকে বের হয়ে আসার পক্ষে। সুতরাং তার প্রচারণা ছিল—‘গেট ব্রেক্সিট ডান।’ এই তিন শব্দের প্রচারণায় বিপুল বিজয় পায় কনজারভেটিভ। অনেকেই তখন ধারণা করেছিলেন চার্চিলের পর বরিস জনসন হবেন আরেকজন স্মরণীয় নেতা। প্রথম অধিবেশনেই ব্রেক্সিট বিল পাস হয় তখন। এরপর এ নিয়ে আর কোনো বিরোধী ব্রিটেনে নেই। কারো মুখে শোনা যায় না, কে ব্রেক্সিটের পক্ষের শক্তি, আর কে বিপক্ষের শক্তি।
তিন
টাওয়ার হেমলেট্স লন্ডনের একটি স্থানীয় সরকারের একক ইউনিট, অর্থাৎ একটি বারৌ বা কাউন্সিল। এই কাউন্সিলে নির্বাহী মেয়র পদ্ধতির স্থানীয় সরকার। জনগণের সরাসরি ভোটে মেয়র নির্বাচিত হন। কিন্তু তখন প্রশ্ন উঠেছিল নির্বাহী পদ্ধতি থেকে বের হয়ে আসবে। শুধু কাউন্সিলরদের ভোট দেবে জনগণ। বিজয়ী কাউন্সিলররা ভোট দিয়ে নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে মেয়র বানাবেন। এই পদ্ধতি রয়েছে ব্রিটেনের অনেক স্থানীয় সরকারে। এই প্রশ্নে শুধু টাওয়ার হেমলেট্সে গণভোট হয়। গণভোটে নির্বাহী পদ্ধতির (সরাসরি ভোটে মেয়র) পক্ষ বিজয়ী হয়।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কথা বলেন সবাই, কিন্তু যখনই রাষ্ট্রীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে গণভোটের কথা বলা হয়, তখন অনেকে নাক সিটকান। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে গণভোটের বিধান যুক্ত করেছিলেন। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনে গণভোটের কথা বলা হয়েছিল এতে। শেখ হাসিনা ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েমের সময় সংবিধান থেকে গণভোটের বিধান উঠিয়ে দিলেন। ৩৬ জুলাই বিপ্লবের পর বিভিন্ন ইস্যুতে গণভোটের প্রশ্ন সামনে এসেছিল। শেখ হাসিনার তৈরি করা বিদ্যমান সংবিধান ফেলে দিয়ে নতুন সংবিধানের প্রশ্নে গণভোট হওয়া দরকার।
সংসদীয় গণতন্ত্রের নামে দেশে স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই পদ্ধতির পরিবর্তে আবারো রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের প্রশ্নেও একটি গণভোট হওয়া প্রয়োজন। মানুষের ক্ষমতায়ন ও গণতন্ত্র যদি লক্ষ্য হয়, তাহলে দলীয় মতামত নয়, জনগণের মতামতকেই প্রাধান্য দিতে হবে। জনগণের সরাসরি অভিমত দেওয়ার একটাই পদ্ধতি। গণভোট।
সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলা হয় গ্রেট ব্রিটেনকে। টেমস নদীর তীরে সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গ্রেট ব্রিটেনের সংসদ ভবন। হাজারো দর্শনার্থী প্রতিদিন এখানে আসেন সংসদীয় গণতন্ত্রের এই সিম্বল দেখতে, যদিও রাজা বা রানিকে মনে করা হয় জাতীয় ঐক্যের প্রতীক।
রাজতন্ত্রের ছায়ায় এমন সুন্দর গণতন্ত্র কল্পনাও করা যায় না। গণতন্ত্রের প্রতিটি উপাদান এখানে বিদ্যমান রয়েছে। মানুষের প্রতি মানুষের সম্মান, আইনের প্রতি নাগরিকদের শ্রদ্ধাবোধ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার নিরন্তর চেষ্টা রয়েছে এখানে। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর তার ছেলে চার্লস এখন রাজা।
২০১২ সালের ডিসেম্বর থেকে ব্রিটেনে স্থায়ীভাবেই আছি। অনেক সরকারের উত্থান-পতন দেখেছি। ইউরোপ থেকে ব্রিটেনের বের হয়ে আসার বিষয়টি ছিল অনেক জটিল। মানুষের ভোট কীভাবে জটিল অবস্থাকে সহজ করে দিয়েছে সেটাও উপলব্ধি করেছি। গত ১২ বছরে ব্রিটেনে তিনটি গণভোট হয়েছে। এর মধ্যে একটি গণভোট একেবারেই স্থানীয় পর্যায়ে। একটি গণভোট ছিল রাজ্যভিত্তিক। আর একটি গণভোট ছিল দেশজুড়ে (চারটি রাজ্যে)।
এক
প্রথম গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নে। ২০১৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর পুরো বিশ্বের নজর ছিল স্কটল্যান্ডে। নানা প্রশ্ন তখন বিশ্বজুড়ে। গ্রেট ব্রিটেন থেকে কি একটি রাজ্য বিচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে—এমন প্রশ্ন তখন গণমাধ্যমজুড়ে। ১৮ সেপ্টেম্বরের এই গণভোট ছিল ব্রিটেনের জন্য অগ্নিপরীক্ষা। তখন আমার যুক্তরাজ্যের বয়স মাত্র পৌনে দুই বছর। স্কটল্যান্ডের গণভোট নিয়ে মানুষের মধ্যে টানটান উত্তেজনা দেখতে পাচ্ছিলাম। যুক্তরাজ্য থেকে বের হয়ে পুরোপুরি স্বাধীনতার দাবি উঠেছিল দেশটিতে। আমার ধারণা ছিল গণভোটে যারাই বিজয়ী হোক প্রতিপক্ষের খবর আছে! স্বাধীনতার পক্ষে বিজয়ী হলে পরাজিতদের বলা হবে স্বাধীনতার শত্রু; আর স্বাধীনতার বিপক্ষের দাবি বিজয়ী হলে অন্যদের বলা হবে বিচ্ছিন্নতাবাদী। সুতরাং যে পক্ষই জিতুক স্কটল্যান্ডে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে একটা স্থায়ী অস্থিরতা ও অশান্তি লেগে থাকবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে এটা হওয়াই স্বাভাবিক।
শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হলো। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে কৌতূহলী মানুষ ভোট দেখতেও গিয়েছিলেন। আমিও ভোট দেখতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর যাওয়া হয়নি। ভোটের সপ্তাহ খানেক আগে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ (তখন তিনি ব্রিটেনের রানি) খোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে স্কটল্যান্ডের বিভিন্ন শহর প্রদক্ষিণ করলেন। স্বাধীনতার পক্ষে-বিপক্ষে কিছুই বললেন না কখনো, শুধু হাত নাড়লেন মানুষের উদ্দেশে। নাগরিকের ভোটের অধিকারের প্রতি রানি সম্মান দেখালেন। কেউ কেউ তখন মনে করেছিলেন স্বাধীনতার আগে রানি স্কটল্যান্ডে শেষ ভ্রমণ করলেন। কেউ কেউ বললেন, রানির এই ভ্রমণ ভোটারের মনে প্রভাব ফেলবে। ব্রিটেনে থাকার পক্ষে কিছুটা হলেও আগ্রহ তৈরি করবে। কারণ রানির প্রতি সর্বস্তরের মানুষের রয়েছে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
সন্ধ্যায় থেকে ভোটের ফলাফল ঘোষণা দেখার অপেক্ষায় সবাই। চূড়ান্ত ফলাফলে স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি পরাজিত হয়েছিল। স্বাধীনতার পক্ষে ৪৪ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট পড়ে। ৫৫ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট পড়ে স্বাধীনতার বিপক্ষে। সবাই ফলাফল মেনে নিয়ে ঘরে চলে গেলেন। কারো মধ্যে কোনো রকমের উত্তেজনা দেখা যায়নি আর। সব স্বাভাবিক। স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে আর টুঁ শব্দটিও এখন পর্যন্ত শোনা যায়নি। স্কটিশ ন্যাশন সবাই এক। স্বাধীনতার কোনো পক্ষ-বিপক্ষ বিবাদ নেই। স্কটল্যান্ড ব্রিটেনের অঙ্গরাজ্য হিসেবে বহাল আছে। কেন্দ্রীয় সরকারকেও এ নিয়ে কারো পক্ষে বা বিপক্ষে পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। যদিও ভাষা, মুদ্রা সবই তাদের পৃথক। ব্রিটেনের মুদ্রার নাম পাউন্ড, অথচ স্কটল্যান্ডের মুদ্রার নাম হচ্ছে স্টারলিং। শুধু পররাষ্ট্রনীতি ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় ছাড়া বাকি সবই স্কটিশ পার্লামেন্টের আইন দ্বারা চলে। তারপরও দেশটির বেশিরভাগ মানুষ ঐক্যবদ্ধ ব্রিটেনের সঙ্গে থেকে যাওয়ার পক্ষে মতামত দিলেন।
দুই
দ্বিতীয় গণভোট ছিল আরো জটিল বিষয়। ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে, নাকি থাকবে না—এ প্রশ্ন সামনে রেখে হয়েছিল গণভোট। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসার দাবি উঠেছিল জনগণের একটি বড় অংশের পক্ষ থেকে। দীর্ঘদিন থেকে এ দাবিতে গণমাধ্যমে লেখালেখি। ডেভিড ক্যামেরন তখন প্রধানমন্ত্রী। দ্বিতীয়বার জাতীয় নির্বাচনের আগে তিনি ওয়াদা করলেন, বিজয়ী হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার প্রশ্নে গণভোট দেবেন। নির্বাচনী ইশতেহারে এটাই ছিল মূল আলোচনার বিষয়। তখন আমি ব্রিটেনের ভোটার। তার দল কনজারভেটিভ পার্টি এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বিজয়ী হয়। যখন এই ওয়াদা করেন, তখন ছিল কোয়ালিশন সরকার। লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশন করে সরকার গঠন করতে হয়েছিল তাকে প্রথমবার। লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টিকে দিতে হয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ একাধিক মন্ত্রিত্ব। দ্বিতীয়বার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর ওয়াদা অনুযায়ী গণভোট দিতে হবে। বিজয়ের প্রথম বছরেই ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার প্রশ্নে গণভোট দিলেন ক্যামেরন, যদিও তার বিভিন্ন বক্তব্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছিলেন। গণভোটে বিজয়ী হয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার পক্ষের সমর্থকরা। তিনি কালবিলম্ব করলেন না, ভোটের পরের দিন পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন।
২০১৬ সালের ২৩ জুন অনুষ্ঠিত এই গণভোটে জয়-পরাজয়ের ব্যবধান ছিল খুবই সামান্য। ৪৮ দশমিক ১১ শতাংশ মানুষ ভোট দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে। ৫১ দশমিক ৮৯ শতাংশ মানুষ ভোট দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসার পক্ষে।
তখনো মনে করেছিলাম, জয়-পরাজয় যেদিকেই হোক ব্রিটেন স্থায়ী একটি রাজনৈতিক জটিলতায় প্রবেশ করছে। ব্রেক্সিটের পক্ষে-বিপক্ষে দ্বন্দ্ব লেগেই থাকবে। ইউরোপে থাকার পক্ষে-বিপক্ষের দ্বন্দ্ব থাকবে সমাজে। কিন্তু ভোটের পর দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রায়ের প্রতি সবার শ্রদ্ধা। ভোটের পরের দিন থেকে ব্রেক্সিটের পক্ষ-বিপক্ষ বলে আর কিছুই থাকল না—সবাই এক।
এবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বোঝাপড়ার মাধ্যমে বের হয়ে আসার পালা। ডেভিড ক্যামেরনের পর তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (কট্টরপন্থি হিসেবে পরিচিত) থেরেসা মে দলীয় প্রধান মনোনীত হলেন। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন তেরেসা। কিন্তু সংসদে ব্রেক্সিট চুক্তির বিল আর তিনি পাস করতে পারছেন না। এ নিয়ে টালমাটাল অবস্থা। কনজারভেটিভের ২৫ জনের বেশি এমপি ব্রেক্সিট বিলের বিপক্ষে। লেবার পার্টি ও লিবড্যাম এবং স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির এমপিরা একাট্টা। তখন সংসদ অধিবেশনগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতাম। একপর্যায়ে তিনি পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে অনুরোধ করেন রানিকে। তার ধারণা ছিল ব্রেক্সিট বিল হবে ইস্যু। মানুষ কনজারভেটিভকে তখন ভোট দেবে, বিজয়ী হয়ে নির্বিঘ্নে ব্রেক্সিট বিল পাস করে নেবেন। কিন্তু হিতে বিপরীত হলো। তার দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি ভোটে। আরো বিপাকে পড়ে গেলেন তিনি। নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের একটি আঞ্চলিক দলের সঙ্গে সমঝোতা করে সরকার গঠন করতে হয়েছিল তাকে। এই সরকার এসেও ব্রেক্সিট বিল আর পাস করতে পারছিল না। একপর্যায়ে তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন। তার দলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন দলীয় প্রধান নির্বাচিত হলেন। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে তিনিও ব্রেক্সিট বিল পাস করাতে ব্যর্থ হলেন সংসদে। তখন সংসদ অধিবেশনগুলোয় দেখতাম, বরিস জনসন বারবার বলতেন, ‘আসুন, আমরা পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন দিই। জনগণ কী চায় সেটা যাচাই করি।’ কিন্তু লেবার পার্টি, লিবড্যামসহ অন্য দলগুলো তখন বিরোধিতা করত। একপর্যায়ে সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন হলো। এই নির্বাচনে প্রধান ইস্যু ছিল ব্রেক্সিট। বরিস জনসনের প্রচারণা ছিল তিনটি শব্দে। গণভোটে বিজয়ী হয়েছিল ব্রিটেন ইউরোপ থেকে বের হয়ে আসার পক্ষে। সুতরাং তার প্রচারণা ছিল—‘গেট ব্রেক্সিট ডান।’ এই তিন শব্দের প্রচারণায় বিপুল বিজয় পায় কনজারভেটিভ। অনেকেই তখন ধারণা করেছিলেন চার্চিলের পর বরিস জনসন হবেন আরেকজন স্মরণীয় নেতা। প্রথম অধিবেশনেই ব্রেক্সিট বিল পাস হয় তখন। এরপর এ নিয়ে আর কোনো বিরোধী ব্রিটেনে নেই। কারো মুখে শোনা যায় না, কে ব্রেক্সিটের পক্ষের শক্তি, আর কে বিপক্ষের শক্তি।
তিন
টাওয়ার হেমলেট্স লন্ডনের একটি স্থানীয় সরকারের একক ইউনিট, অর্থাৎ একটি বারৌ বা কাউন্সিল। এই কাউন্সিলে নির্বাহী মেয়র পদ্ধতির স্থানীয় সরকার। জনগণের সরাসরি ভোটে মেয়র নির্বাচিত হন। কিন্তু তখন প্রশ্ন উঠেছিল নির্বাহী পদ্ধতি থেকে বের হয়ে আসবে। শুধু কাউন্সিলরদের ভোট দেবে জনগণ। বিজয়ী কাউন্সিলররা ভোট দিয়ে নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে মেয়র বানাবেন। এই পদ্ধতি রয়েছে ব্রিটেনের অনেক স্থানীয় সরকারে। এই প্রশ্নে শুধু টাওয়ার হেমলেট্সে গণভোট হয়। গণভোটে নির্বাহী পদ্ধতির (সরাসরি ভোটে মেয়র) পক্ষ বিজয়ী হয়।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কথা বলেন সবাই, কিন্তু যখনই রাষ্ট্রীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে গণভোটের কথা বলা হয়, তখন অনেকে নাক সিটকান। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে গণভোটের বিধান যুক্ত করেছিলেন। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনে গণভোটের কথা বলা হয়েছিল এতে। শেখ হাসিনা ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েমের সময় সংবিধান থেকে গণভোটের বিধান উঠিয়ে দিলেন। ৩৬ জুলাই বিপ্লবের পর বিভিন্ন ইস্যুতে গণভোটের প্রশ্ন সামনে এসেছিল। শেখ হাসিনার তৈরি করা বিদ্যমান সংবিধান ফেলে দিয়ে নতুন সংবিধানের প্রশ্নে গণভোট হওয়া দরকার।
সংসদীয় গণতন্ত্রের নামে দেশে স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই পদ্ধতির পরিবর্তে আবারো রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের প্রশ্নেও একটি গণভোট হওয়া প্রয়োজন। মানুষের ক্ষমতায়ন ও গণতন্ত্র যদি লক্ষ্য হয়, তাহলে দলীয় মতামত নয়, জনগণের মতামতকেই প্রাধান্য দিতে হবে। জনগণের সরাসরি অভিমত দেওয়ার একটাই পদ্ধতি। গণভোট।
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
১১ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
১১ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
১২ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
১ দিন আগে