স্মরণকালের মধ্যে স্বস্তির ঈদ উদ্যাপিত হয়েছে এবার। ফ্যাসিবাদী শাসনে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ঈদ কাটত ভয় আর আতঙ্কের মধ্যে। আওয়ামী শাসকশ্রেণির কতিপয় লুটেরা ছাড়া কাউকে ঈদের আনন্দ স্পর্শ করেনি গত দেড় দশকে। ঘরমুখো মানুষের সীমাহীন ভোগান্তি, রমজানে নিত্যপণ্যের মূল্যে নৈরাজ্য ও বিদ্যুতের দুঃসহ ভেল্কি নিয়েই বিগত বছরগুলোয় ঈদ উদ্যাপন করতে হয়েছে অসহায় মানুষকে। এসব ক্ষেত্রেই এবার ছিল ব্যতিক্রম। তবে অতীতের মতো এবারও সড়কে মৃত্যুর অনেকগুলো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বহু পরিবারকে ঈদ আনন্দের পরিবর্তে স্বজন হারানোর মাতমের মধ্য দিয়ে কাটাতে হয়েছে।
অস্থির চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর খেসারত দিতে হয়েছে সাধারণ নাগরিকদের। প্রায় প্রতিটি দুর্ঘটনাতেই চালকদের বেপরোয়া ভাব, অসতর্কতা, দ্রুতগতিতে গাড়ি চালনা ও ট্রাফিক আইন না মানায় বেঘোরে প্রাণ দিতে হয়েছে নানা বয়সের বহু মানুষকে। এমনকি গোটা পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
কয়েকটি দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করলে মৃত্যুর ঘটনাগুলোকে কোনোভাবে সড়ক দুর্ঘটনা বলে লঘু করে দেখার সুযোগ নেই। অধিকাংশ ঘটনায় এককভাবে চালক দায়ী। আবার কোনোটিতে সড়কে অব্যবস্থাপনাই দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। পুলিশের দায়িত্ব সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। তারা সেই কাজ না করে নির্লিপ্ত বা নির্বিকার ভূমিকায় থাকলে কিংবা চাঁদাবাজিতে ব্যস্ত থাকলে সড়কে শৃঙ্খলা থাকে না এবং পরিণতিতে বেঘোরে মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়।
অবশ্য এবারে বিগত বছরগুলোর তুলনায় ঈদের ছুটিতে সড়কে প্রাণহানির সংখ্যা কমেছে, যদিও প্রতিটি প্রাণই অমূল্য। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাকে এমন পর্যায়ে উন্নীত করা জরুরি যেন জীবন হাতে নিয়ে পরিবহনে চড়তে না হয় এবং মানুষ যাতে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানোর নিশ্চয়তা পায়।
প্রাথমিক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, এবার পবিত্র ঈদুল ফিতরের ছুটির দিনগুলোয় সড়ক দুর্ঘটনায় ৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। সবচেয়ে আলোচিত দুর্ঘটনা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের লোহাগাড়ার জাঙ্গালিয়ায়। ঈদের ছুটিতে ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে সেখানে তিনটি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ১৬ জনের এবং আহত হয়েছেন ২১ জন।
সর্বশেষ ঈদের এক দিন পর গত বুধবার সকাল ৭টায় বাস ও মাইক্রোবাসের সংঘর্ষে দুই দম্পতিসহ এক পরিবারের ১১ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এর আগে ঈদের দিন সোমবার সকাল সাড়ে ৭টায় বাস ও মিনিবাসের সংঘর্ষে মারা যান পাঁচ তরুণ। ঈদের পরদিন মঙ্গলবার দুটি মাইক্রোবাস উল্টে গিয়ে আহত হন ৯ পর্যটক। জাঙ্গালিয়া এলাকায় দুর্ঘটনার শিকার হওয়া আহত ও নিহত ব্যক্তিদের বেশিরভাগ কক্সবাজারগামী পর্যটক। ঈদের ছুটিতে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সমুদ্রসৈকতে ঘুরতে যাচ্ছিলেন তারা।
লোহাগাড়ায় চুনতি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য শুরু হওয়ার পর থেকে মাজার টেক এলাকা পর্যন্ত মহাসড়কের দেড় কিলোমিটার অংশ জাঙ্গালিয়া এলাকা নামে পরিচিত। সড়কের দুই পাশের অভয়ারণ্যের গাছপালার সৌন্দর্য যাত্রীদের মুগ্ধ করে। তবে এই অংশ পরিণত হয়েছে মৃত্যুফাঁদে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞ, হাইওয়ে পুলিশ ও সড়ক বিভাগের প্রকৌশলীদের বরাতে বলা হচ্ছে, সরু সড়ক, লবণপানি, বিপজ্জনক বাঁক, অদক্ষ বেপরোয়া চালক ও সচেতনতামূলক ব্যবস্থা না থাকার কারণে সেখানে বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে।
লোহাগাড়ার ভয়াবহ দুর্ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনা পাওয়া যায় প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায়। কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামগামী রিলাক্স পরিবহনের দ্রুতগতির যাত্রীবাহী একটি বাস চুনতি জাঙ্গালিয়া এলাকার মহাসড়কের একটি বাঁকে আসে। তখন চালক ‘হার্ড ব্রেক’ করতে গেলে বাসটির সামনের অংশ ঘুরে মহাসড়কে আড়াআড়ি হয়ে যায়। এ সময় বিপরীত দিক থেকে আসা কক্সবাজারগামী দ্রুতগতির একটি মাইক্রোবাসের সঙ্গে বাসটির সংঘর্ষ হয়। মুহূর্তেই কক্সবাজারগামী দ্রুতগতির আরেকটি মাইক্রোবাস দুর্ঘটনাকবলিত মাইক্রোবাসটিকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। এতে ১০ জন নিহত হন। আহত হয়েছেন তিনজন। নিহত ব্যক্তিরা সবাই মাইক্রোবাসের যাত্রী ছিলেন। ঈদের ছুটিতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কক্সবাজার যাচ্ছিলেন তারা। এই একটি দুর্ঘটনার চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, রিলাক্স পরিবহনের বাসটির চালকই ভয়াবহ ট্র্যাজেডির জন্য দায়ী। বাঁকের আগেই গতি নিয়ন্ত্রণ করলে হার্ড ব্রেকের ফলে বাসটি রাস্তায় আড়াআড়িভাবে উল্টে যেত না। পরের দুটি মাইক্রোবাস হয়তো ঘটনার আকস্মিকতায় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল না। পরিণামে একাধিক পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
পৃথিবীর প্রধান কোনো পর্যটন কেন্দ্রের মহাসড়ক এতটা অনিরাপদ কি না, তা নিয়ে সংশয়ের যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ রয়েছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের বিপজ্জনক বাঁকগুলো সোজা করে চার লেনে উন্নীত করার গল্প শোনা যাচ্ছে কয়েক দশক ধরে। দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থানে প্রয়োজনীয় সম্প্রসারণ এবং ওভারপাসের প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও তা বাস্তবায়নের মুখ না দেখায় এভাবে মৃত্যুর মিছিল দেখতে হচ্ছে।
এদিকে ৩ এপ্রিল যশোর-বেনাপোল রোডের পুলেরহাটে মোটরসাইকেলে স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে খুলনার বাসায় ফেরার পথে লোকাল বাসের চাকায় প্রাণ যায় একটি পরিবারের তিনজনের। পুলেরহাট বাজারের ওপর সড়কটি তখন মোটামুটি ফাঁকাই ছিল। অথচ বাসটি পেছন থেকে মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেয়। এখানে বাসচালককেই দায় দিচ্ছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
শুধু চট্টগ্রাম বা যশোর নয়, ঈদের ছুটির মধ্যে অনেক জেলায় ফাঁকা সড়ক-মহাসড়কে ঘটেছে দুর্ঘটনা, হতাহতের সংখ্যাও কম নয়; যদিও পরিসংখ্যান বলছে, এবারের ঈদে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বিগত দুই বছরের তুলনায় প্রায় ৮০ শতাংশ কমে এসেছে। ২০২৪ সালে ঈদুল ফিতরের ছুটিতে সড়কে ৩৯৯টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৪০৭ জন। একই বছর জুনে উদ্যাপিত ঈদুল আজহার ছুটিতে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৫৮ জন নিহত এবং এক হাজার ৮৪০ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছিল বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। তার আগের বছর ২০২৩ সালের ঈদুল ফিতরের ছুটিতে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩২৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী কিছুটা হলেও স্বস্তির জায়গা আছে। কিন্তু যে পরিবারের ১১ জন কিংবা আরেক পরিবারের তিন সদস্যই একসঙ্গে সড়কে খুনের শিকার হয়েছে, তাদের কাছে কোনো পরিসংখ্যানেরই কি মূল্য আছে?
যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ৬ হাজার ৩৫৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৫৪৩ জন প্রাণ হারিয়েছে এবং ১২ হাজার ৬০৮ জন আহত হয়েছে। ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে সড়কে দুর্ঘটনা বেড়েছিল ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ, মৃত্যু বেড়েছিল ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ, আর আহতের সংখ্যা বেড়েছিল ১৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশে ৫৯৬টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৫৭৮ জন। আহত হন কমপক্ষে ১ হাজার ৩২৭ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছে ৭৮ নারী ও ৮৭ শিশু। আর জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ৬২১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬০৮ জনের নিহত হওয়ার তথ্য দিয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানায়, ওই মাসে অন্তত ১ হাজার ১০০ জন আহত হন। নিহতের মধ্যে রয়েছে ৭২ নারী, ৮৪ শিশু। ২৭১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হন ২৬৪ জন, যা মোট নিহত মানুষের ৪৩ দশমিক ৪২ শতাংশ।
দুর্ঘটনার ধরনের মধ্যে দুই যানবাহনের সংঘর্ষের ঘটনা যেমন রয়েছে, তেমনি সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষকেও পিষে মারার ঘটনা ঘটছে। সড়কের নিরাপত্তার জন্য ২০১৮ সালে যে আইন করেছিল সরকার, তাও বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না একশ্রেণির মালিক ও শ্রমিকের বিরোধিতার কারণে। বাস্তবে সড়কে সরকার তথা বিআরটিএ ও হাইওয়ে পুলিশের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করছে স্বার্থান্বেষী মহল, যার মধ্যে একশ্রেণির মালিক ও শ্রমিকনেতাও আছেন। জুলাই বিপ্লবের পর এ পরিস্থিতির খানিকটা উন্নতি হয়েছে বটে, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আগের মতো সড়ক নৈরাজ্য বিদ্যমান।
সড়ক-মহাসড়কগুলো নিরাপদ করার জন্যে অন্তর্বর্তী সরকারের বিশেষ কোনো উদ্যোগ আছে কি না, তা স্পষ্ট হওয়া জরুরি। মহাসড়কগুলোয় দূরপাল্লার বাস থেকে শুরু করে মালবাহী ট্রাক-কাভার্ডভ্যান যেন দানব। আর গণপরিহন-সিএনজিচালিত অটোগুলোও মুহূর্তে প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে। যেকোনো সময় বাস-ট্রাক-সিএনজিচালিত অটোরিকশা যে কাউকে চাপা দিতে পারে, সংঘর্ষ ঘটতে পারে দুই যানবাহনের মধ্যেও—এমন আতঙ্ক-শঙ্কা নিয়েই জনগণকে রাস্তায় নামতে হয়। যেতে হয় কর্মস্থলে, নানা গন্তব্যে।
একসময় দুর্ঘটনার জন্য সড়ক-মহাসড়কের রোড ডিভাইডার না থাকাকে দায়ী করা হতো। বর্তমানে অধিকাংশ সড়ক-মহাসড়কে রোড ডিভাইডার বসানো হয়েছে। এখন যানবাহন একদিকে চলার কথা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, উল্টোদিক থেকেও যানবাহন চলে। ফলে একই লেনে দ্রুতগামী দুটি যানবাহনের মধ্যে প্রায়ই মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া ধীরগতির গাড়ি রাস্তার মাঝ বরাবর চলার কারণে পেছন থেকে দ্রুতগতির যানবাহন রংসাইড দিয়ে ওভারটেক করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে। কখনো কখনো ওভারটেক করতে গিয়ে পেছন থেকে ধাক্কা দেওয়ার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে।
একই লেনে দ্রুত গতির বাস-ট্রাকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অযান্ত্রিক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা, কিংবা কম গতির যান্ত্রিক বাহন লেগুনা, নসিমন ও করিমনও চলে। এতে দুর্ঘটনা ঘটে সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া মহাসড়কের পাশে মার্কেট ও দোকানপাট থাকায় সেখানে জটলা তৈরি হয়। অনেক সময় সেসব দোকানপাটের সামনে চালকরা গাড়ি পার্কিং করেন। পার্কিংয়ের গাড়িগুলোও বড় ধরনের জটলার কারণ হয়ে ওঠে। আর সেই জটলা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে দ্রুতগামী দূরপাল্লার বাস-ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের কারণে। এর বাইরে আরো একটি বড় কারণ হলো, ওসব দোকানপাট ও সড়কের পাশে বসা হাটবাজারগুলোয় ছোট যানবাহন ও মানুষের জটলা। সড়কের একপাশ থেকে অন্যপাশে যাতায়াতের জন্য আন্ডারপাস বা ফুটওভার ব্রিজ থাকলেও তা অসচেতন মানুষ ব্যবহার করে কমই। ফলে মহাসড়ক পারাপারে পথচারীদের হঠাৎ দৌড় দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। তখনই তারা দুর্ঘটনার কবলে পড়েন।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে কয়েকবার দেশে জোরালো আন্দোলন হলেও বেপরোয়া ও অদক্ষ চালক এবং ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মহাসড়কে থামানো যাচ্ছে না ইজিবাইক, থ্রি-হুইলার ও নসিমন-করিমনের মতো ছোট ছোট বাহন। সার্ভিস লেন না থাকায় ছোট যানবাহনের মহাসড়কে চলাচল এবং বিপজ্জনক সড়ক-বাঁক প্রাণহানি ঘটাচ্ছে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

