বাংলাদেশে কয়েক দিন ধরে একটি বিষয় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে, আর তা হলো—তুরস্কের গোয়েন্দা সংস্থা নাকি বাংলাদেশে সক্রিয় হয়ে বড় ধরনের রাজনৈতিক নাশকতার পরিকল্পনা করছে। আলোচনা ছড়ানোর ধরন, ব্যবহৃত ভাষা এবং যেসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এ ধরনের বক্তব্য বাজারে ছড়াচ্ছে, তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড বিশ্লেষণ করলে সহজেই বোঝা যায়—এটি ভিত্তিহীন গুজব ছাড়া আর কিছু নয়। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, হঠাৎ করে তুরস্কের গোয়েন্দা সংস্থা ও তাদের কথিত তৎপরতা নিয়ে এমন গুজব ছড়ানো হচ্ছে কেন?
বাংলাদেশের জনগণের কাছে এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আসন্ন নির্বাচন এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বেগম জিয়ার অসুস্থতার বিষয়টি। এর বাইরে, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ-তুরস্ক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করার মতো বড় কোনো ঘটনা ঘটেনি। তাহলে হঠাৎ করে তুরস্কের গোয়েন্দা সংস্থাকে ঘিরে নানা কল্পিত গল্প কেন বাজারে ছাড়া হচ্ছে?
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, এটি নিছক গুজব হলেও এর পেছনে গুজবকারীদের উদ্দেশ্য ব্যাপক এবং সুদূরপ্রসারী। এই গুজব ছড়ানোর নেপথ্যের উদ্দেশ্য কী—তা আলোচনা করা প্রয়োজন, যাতে করে গুজবের প্রভাব মোকাবিলা করা যায়।
সামরিক সক্ষমতা, শিক্ষা, কূটনীতি ও অর্থনৈতিক শক্তির সমন্বয়ে তুরস্ক আজ আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক অঙ্গনে এক প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বিশেষ করে সামরিক দক্ষতা ও কূটনৈতিক সক্ষমতার কারণে দেশটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজের অবস্থানকে আরো সুদৃঢ় করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশটি দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে গড়ে তুলেছে ঘনিষ্ঠ, বিশ্বাসযোগ্য, ও কৌশলগত সম্পর্ক। দুই দেশের মধ্যে হওয়া সামরিক ও অর্থনৈতিক চুক্তি তাদের সহযোগিতাকে আরো সুদৃঢ় করেছে। প্রতিরক্ষা খাতে তুরস্ক পাকিস্তানকে আধুনিক অস্ত্র, উন্নত ড্রোন প্রযুক্তি এবং সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করছে। এসব সহযোগিতার ফলে পাকিস্তানের সামরিক সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি বছরের মে মাসে পাকিস্তান-ভারত উত্তেজনার সময় এমন দাবি উঠে যে, পাকিস্তান তুরস্কের তৈরি ড্রোন ব্যবহার করে ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। (দ্য হিন্দু, মে ২০২৫) শুধু তাই নয়—তুরস্ক ও পাকিস্তান এখন যৌথভাবে সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনের দিকেও এগিয়ে যাচ্ছে। এটি বাস্তবায়িত হলে দুই দেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা আরো শক্তিশালী ও দীর্ঘমেয়াদি হবে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় তুরস্কের প্রভাব বাড়বে। (আর্মি রিকগনিশন গ্রুপ, জানুয়ারি ২০২৫)
তুরস্কের যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ভারসাম্যপূর্ণ এবং শক্তিশালী হলেও নিজের কৌশলগত স্বার্থ রক্ষা করতে তুরস্ক বদ্ধপরিকর। যেমন : এই বছর আমেরিকা যখন ভারতকে অ্যাপাচি হেলিকপ্টার সরবরাহ করছিল, তখন আমেরিকাকে তুরস্ক তার আকাশসীমা ব্যবহার করতে অনুমতি দেয়নি। (ডিফেন্স সিকিউরিটি এশিয়া, নভেম্বর ২০২৫) বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত যেহেতু তুরস্ক-পাকিস্তান সামরিক সম্পর্ককে ভালোভাবে নেয়নি, তাই ভারতের সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধিকে তুরস্ক দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হিসেবে দেখেছে।
এমনকি, তুরস্ক আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নানা ফোরামে ভারত কর্তৃক কাশ্মীরের মুসলমানদের নির্যাতনের নিন্দা জানিয়ে আসছে। এসব কারণে তুরস্কের সঙ্গে ভারতের টানাপোড়েনপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান।

তাহলে প্রশ্ন ওঠে, বাংলাদেশের বিষয়টি কেন আলোচনায় এসেছে? এর কারণ হলো বাংলাদেশের বর্তমান সরকার তুরস্কের সঙ্গে সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। গত অক্টোবরে বাংলাদেশের বিমানবাহিনীর প্রধান তুরস্ক সফর করে বিমানবাহিনীকে আধুনিকায়ন ও শক্তিশালী করার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ তুরস্ক থেকে কিছু সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করেছে এবং ভবিষ্যতে দুই দেশের মধ্যে সামরিক চুক্তি সম্পাদনের জোর আলোচনা চলছে।
১৭ বছরে ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যেভাবে হস্তক্ষেপ করেছে এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে, তা বিবেচনা করলে সহজে বোঝা যায় যে, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে তুরস্কের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে ইতিবাচকভাবে দেখবে না। পাশাপাশি ভারত চাইবে না যে, তার দুই পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী (বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান) সামরিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠুক। অন্যদিকে, চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে ভারত পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে যেভাবে উপস্থাপন করতে পারে, তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে ওই একইভাবে উপস্থাপন করতে পারছে না। কারণ হলো, পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক গভীর এবং শক্তিশালী।
এ কারণেই ভারতের লক্ষ্য হলো—বাংলাদেশ ও তুরস্কের ক্রমোন্নত সম্পর্ককে আরো শক্তিশালী হতে না দেওয়া। পাকিস্তান-তুরস্ক সম্পর্ক যেমন দৃঢ় হয়েছে, ভারত স্বাভাবিকভাবেই চাইবে না যে, বাংলাদেশও ভারতের প্রভাববলয় থেকে বের হয়ে তুরস্কের মতো ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের সহযোগিতায় সামরিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠুক। এই জন্য শুধু বর্তমান সরকারই নয়, ভবিষ্যতের কোনো সরকারও যেন তুরস্কের সঙ্গে সামরিক বা কৌশলগত সহযোগিতা বাড়াতে না পারে—এই দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ‘তুরস্ক বাংলাদেশে গুপ্তচরবৃত্তি করছে’ বা ‘রাজনৈতিক নাশকতার পরিকল্পনা করছে’—এ ধরনের গুজব পরিকল্পিতভাবে ছড়ানো হচ্ছে। এই গুজবের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা তারেক রহমানকে জড়ানো হয়েছে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো—আগামী নির্বাচনে যদি বিএনপি সরকার গঠন করে, তাহলে ওই সরকার যেন তুরস্কের সঙ্গে চলমান সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা, বিশেষ করে সম্ভাব্য চুক্তিগুলো আর এগিয়ে নিতে আগ্রহী না হয়।
তাহলে বাংলাদেশকে কী করতে হবে? বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো—তুরস্কের সঙ্গে সামরিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো জোরদার করা। দ্বিপক্ষীয় কূটনীতিকে পাবলিক ডিপ্লোমেসি পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে, যাতে জনগণ থেকে শুরু করে বেসরকারি খাত—সবাই এই সম্পর্কের সুফল পেতে পারে। তুরস্কের এবং বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে যৌথ গবেষণা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী বিনিময় এবং একাডেমিক সহযোগিতা তৈরি করতে হবে। এতে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব ও জ্ঞানের ভিত্তি আরো শক্তিশালী হবে। বাংলাদেশ ও তুরস্কের মধ্যে সাংস্কৃতিক মিল অত্যন্ত গভীর। এই মিলগুলো সামনে এনে দুই দেশের সাংস্কৃতিক উৎসব, সাহিত্য-সংগীতবিনিময় এবং যৌথ সাংস্কৃতিক আয়োজন নিয়মিত করতে হবে। প্রয়োজন হলে ‘বাংলাদেশ-তুরস্ক মৈত্রী কেন্দ্র’ স্থাপন করা যেতে পারে, যেমন—বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী কেন্দ্র রয়েছে। তুরস্ক চিকিৎসা প্রযুক্তি, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা এবং মেডিক্যাল ট্যুরিজমে অনেক উন্নতি করেছে। বাংলাদেশে যৌথ হাসপাতাল স্থাপন, মেডিকেল ট্রেনিং ও মেডিকেল প্রযুক্তি বিনিয়োগ নিশ্চিত করলে বাংলাদেশের জনগণও কম খরচে উন্নত চিকিৎসা পাবে, এতে ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে। বাংলাদেশ-তুরস্কের মধ্যে ভিসা সহজীকরণ এবং ব্যবসায়ী, ছাত্র এবং রোগীদের জন্য বিশেষ ভিসা সুবিধা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা—সবক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়।
ভারতের বলয় থেকে বের হয়ে ফিলিস্তিন এবং জাতিসংঘের স্বীকৃত সব স্বাধীন রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে। সম্পর্কের ক্ষেত্রটি যত বিস্তৃত হবে, বাংলাদেশ ততই নিরাপদ হবে। একটি রাষ্ট্রের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা কমিয়ে বহুপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে তুললে—বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো দেশ সহজে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না, রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত চাপের মুখে পড়বে না, গণতন্ত্র এবং জাতীয় নিরাপত্তা আরো দৃঢ় হবে।
লেখক : গবেষক


সালাম মুর্শেদীর বাড়ি দখলে নিতে সরকারকে হাইকোর্টের নির্দেশ
নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা খাতে ব্যয় বাড়ছে ৪০০ কোটি টাকা
দুই যুগেও পূর্ণতা পায়নি পায়রাবন্দের রোকেয়া স্মৃতি কমপ্লেক্স