শতবর্ষী ভবনে গেঁথে আছে জিয়ার স্মৃতি

জমির উদ্দিন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ৩১ মে ২০২৫, ১১: ১৪

চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানা এলাকার সার্কিট হাউসে রক্তাক্ত ইতাহাসের সাক্ষী হয়ে আছে শতবর্ষী একটি ভবন। সামনে গিয়ে দাঁড়ালে বোঝার উপায় নেই সেখানেই ঘটেছিল নারকীয় এক হত্যাকাণ্ড। গত বৃহস্পতিবার বিকালে সরেজমিন দেখা যায়, লাল টাইলসের ছাদ, উঁচু জানালা, প্রাচীন কারুকাজ- সব মিলিয়ে ভবনটি যেন স্থাপত্যের নিদর্শন। অথচ এর ভেতরেই গেঁথে আছে ১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোররাতে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হওয়ার করুণ স্মৃতি।

ভবনটির নাম এখন জিয়া স্মৃতি জাদুঘর। একে ঘিরেই প্রতি বছর ৩০ মে শাহাদাতবার্ষিকীতে চট্টগ্রামে বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়। বছরের অন্য সময়ও অনেক দর্শনার্থী সেখানে ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড়ান।

বিজ্ঞাপন

ভবনটি ব্রিটিশ আমলে ১৯১৩ সালে সার্কিট হাউস হিসেবে নির্মাণ করা হয়। তখন এর ব্যবহারে ছিল জেলা প্রশাসন ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের যাতায়াত। স্বাধীনতার পরও এটি ব্যবহৃত হয় সরকারি গেস্ট হাউস হিসেবে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের মে মাসে চট্টগ্রামে রাজনৈতিক সফরে এসে এই ভবনের ৪ নম্বর কক্ষে অবস্থান করেন। ৩০ মে ভোররাতে সেনা কর্মকর্তাদের একটি অংশ সেখানে হামলা চালায়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই জিয়ার মৃত্যু হয়। ওই ঘটনার পর ভবনটি দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়।

১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর সিদ্ধান্ত হয়, ভবনটিকে জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষণ করা হবে। দুই বছর পর ভবনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্মৃতি জাদুঘর’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। পরে এটি জাতীয় জাদুঘরের আওতায় নেওয়া হয়।

জাদুঘরে ঢুকেই প্রথমে চোখে পড়ে শহীদ জিয়ার বিশাল প্রতিকৃতিতে। এরপর শুরু হয় ১৭টি গ্যালারির পরিক্রমা। প্রতিটি গ্যালারি সাজানো হয়েছে তার শৈশব, সেনাজীবন, মুক্তিযুদ্ধ, রাষ্ট্রপতি পদে দায়িত্ব পালন, রাজনৈতিক দর্শন ও নিহত হওয়ার ঘটনার দলিল ও নিদর্শন দিয়ে।

একটি গ্যালারিতে রাখা আছে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের সেই ট্রান্সমিটারটি, যেখান থেকে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করা হয়। গ্যালারির পাশে তথ্যবোর্ডে লেখা রয়েছেÑ ‘আমি মেজর জিয়া বলছি, শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।’ ওই ঘোষণার শব্দগুলো এখন জাদুঘরের দেয়ালে গেঁথে রাখা।

আরেকটি গ্যালারিতে রাখা আছে শহীদ জিয়ার ব্যবহৃত মাইক, পোশাক, টেবিল ঘড়ি, কলম ও পকেট ডায়েরি। হত্যাপরবর্তী কক্ষে দেখা যায় বিছানা, বুলেটের গর্তযুক্ত দেয়াল এবং উদ্ধারকৃত আলামতের বিবরণ।

এই জাদুঘরে প্রতিদিনই কেউ না কেউ এসে দাঁড়ান ইতিহাসের কাছে। ঢাকার একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা আসিফ ইকবাল ছুটির দিনে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এসেছেন জাদুঘরটি দেখতে। তিনি বললেন, ‘ছেলেমেয়েদের শুধু বইয়ে ইতিহাস পড়িয়ে লাভ নেই। এখানে এসে চোখের সামনে দেখা যায় একটি সময় কেমন ছিল।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী রাফিয়া সুলতানা বলেন, ‘আমরা অনেকেই জিয়াউর রহমানকে রাজনৈতিক চরিত্র হিসেবেই জানি। কিন্তু এখানে এসে বুঝলাম, তার জীবন বহু পরতে বাঁধা ছিল। এই জাদুঘরে বাস্তবতার ছোঁয়া আছে।’

মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ছালেহ উদ্দিন বলেন, ‘অনেকে আজ ইতিহাস ভুলে গেছে। কিন্তু এই ভবন বলে দেয়, কীভাবে এক রাতেই ইতিহাস বদলে যায়। জিয়ার রাজনৈতিক ভূমিকা আলাদা কিন্তু ইতিহাস হিসেবে তাকে অস্বীকার করা যায় না।’

তবে অনেক দর্শনার্থী জাদুঘরের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে অসন্তুষ্ট। কয়েকটি প্রদর্শনীর গ্লাসে ধুলা জমে আছে, আলোর ব্যবস্থা অনেক জায়গায় কাজ করে না আর তথ্যবোর্ডের লেখা অস্পষ্ট হয়ে গেছে অনেক জায়গায়। কেউ কেউ বলছেন, এখানে অডিও গাইড বা ভার্চুয়াল ট্যুর সিস্টেম চালু হলে জাদুঘরটি আরো জীবন্ত হয়ে উঠতে পারত।

জিয়া স্মৃতি জাদুঘরের কিউরেটর অর্পিতা দাশগুপ্তা আমার দেশকে বলেন, ‘পুরো জাদুঘরের অবস্থা খারাপ। আমরা এসব বিষয়ে সরকারকে জানিয়েছি। সংস্কারের প্রস্তাবনা দিয়েছি। সরকার অনুমোদন বা বাজেট দিলে আমরা সংস্কারকাজ শুরু করব।’

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত