শাপলার স্মৃতি আজও কাঁদায়

মুহাম্মাদুল্লাহ খান আরমান
প্রকাশ : ০৫ মে ২০২৫, ১০: ৫৯

২০১৩ সালে আমি হাটহাজারী মাদরাসায় ফতওয়া বিভাগে পড়ি। আল্লামা শাহ আহমদ শফি (রহ.)-এর নেতৃত্বে ঢাকা অবরোধের ঘোষণা আসার পর স্থির থাকতে পারিনি। আম্মার অনুমতি নিয়ে রওনা দিই ঢাকার উদ্দেশে। ৪ মে রাতে হাটহাজারী থেকে হানিফ বাসে করে ৫ মে ভোরে কাঁচপুর ব্রিজের সামনে আসতেই দেখি পুরো ব্রিজ লোকে-লোকারণ্য। যেন সফেদ ঢেউয়ের স্রোত।

বিজ্ঞাপন

কাঁচপুর থেকে রওনা দিই ঢাকা অভিমুখে। মিছিল আর স্লোগানে তখন রাজপথ প্রকম্পিত। ধীরে ধীরে সামনে এগোতে থাকি। তখনো বিশেষ কোনো সমাবেশের কথা আমরা জানতাম না। দুপুরের দিকে হঠাৎ ঘোষণা আসে, সবাইকে শাপলা চত্বর যেতে হবে, সেখানে মহাসমাবেশ হবে। আমরা বিশাল এক মিছিল নিয়ে শাপলা চত্বরের দিকে যাই। সেখানে পৌঁছাতে আসরের নামাজের সময় হয়ে যায়। শাপলায় পৌঁছে দেখি লাখো মানুষের উপস্থিতি। চারদিকে মানুষ আর মানুষ। টুপি আর টুপি।

আসরের পর ঘোষণা এলো, আওয়ামী লীগের ওই সময়ের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ বলেছেন, সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে হেফাজতকে ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে। হেফাজত নেতারা স্টেজ থেকে সেই হুমকি উড়িয়ে দিলেন। সেখানে অবস্থানরত আন্দোলনকারীদের মনোভাব ছিল, দাবি না মানা পর্যন্ত আমরা রাজপথ ছাড়ব না। সন্ধ্যা নেমে এলো, এশা পার হলো। আস্তে আস্তে শাপলা চত্বরের দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকে। হেফাজতের সমাবেশ লাইভ সম্প্রচার করতে থাকা দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভিকে সেখান থেকে সরে যেতে বলা হলো। লাইভ সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গেল। সাংবাদিকদের সরিয়ে দেওয়া হলো।

রাত ১২টা। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় শাপলা চত্বর ও আশপাশের এলাকা অন্ধকার। সেখানে অবস্থানরত লক্ষাধিক তৌহিদি জনতা সময় অতিবাহিত করছে অজানা আশঙ্কায়। এদের মধ্যে অনেকেই রাজপথে ও ফুটপাতে ঘুমিয়ে পড়েছেন। কেউ বিভিন্ন বিল্ডিংয়ের সিঁড়িতে বসে আছেন। আবার অনেকে ইবাদতে মশগুল। আবার ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনিতে অনেকে রাজপথ প্রকম্পিত করে রেখেছেন। এরই মধ্যে শোনা যাচ্ছে যৌথবাহিনী হামলা করে শাপলা চত্বর খালি করবে। তবুও সবাই অবিচল। আপন জায়গা থেকে কেউ নড়ছেন না। আমিরের নির্দেশ ছাড়া কেউ নড়বেন না।

রাত ১টা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। ঝড়-বৃষ্টি আসবে মনে হচ্ছে। উপস্থিত সবাই দুহাত তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে কাঁদছেন আল্লাহর সাহায্য ও রহমত কামনা করে। হঠাৎ চোখ পড়ল স্টেজের দিকে। দেখলাম আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.)-কে। তিনিও দুহাত তুলে হাউমাউ করে কাঁদছেন। বৃষ্টি থেমে গেল।

রাত ২টা ৩০ মিনিটে শুরু হয় যৌথবাহিনীর হামলা। ঘুমন্ত ও ইবাদতরত নিরস্ত্র জনতার ওপর শুরু হয় র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবি ও সশস্ত্র আওয়ামী ক্যাডারদের গুলিবৃষ্টি। সঙ্গে রাবার বুলিট, রায়টকার, সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার শেল ও জলকামানের মুহুর্মুহু আক্রমণ। গুলির শব্দে চারদিক প্রকম্পিত। নিরস্ত্র মানুষের ওপর চলছে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। ইতিহাসের পাতায় এক জঘন্য অধ্যায় রচনা করতে নরপশুরা যেন মরিয়া। জনতার তাজা রক্ত ছাড়া মনে হয় তাদের তৃষ্ণা মিটবে না। এ জন্য যার কাছে যা অস্ত্র আছে, তা দিয়ে দাড়ি-টুপিওয়ালাদের শরীর ঝাঁজরা করতে সবাই সচেষ্ট। গ্রেনেডের বিকট শব্দে কয়েকবার কান ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। দেয়ালের ভেতর থেকে গেটের ফাঁক দিয়ে বাইরের দৃশ্য স্বচক্ষে দেখেছি। পুলিশ ও র‌্যাব সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে নির্বিচারে গুলি করছে। শাপলা চত্বরের আশপাশে অনেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন গুলিবিদ্ধ হয়ে।

আত্মরক্ষার্থে সোনালী ব্যাংকের সামনে একটি দেয়ালের পেছনে আশ্রয় নিলাম। সেখানেও রক্ষা নেই। এত বেশি টিয়ার শেল নিক্ষেপ করা হয়েছে, দেয়ালের ভেতরেও নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। দেয়ালের ওপর দিয়ে গুলি এসে সোনালী ব্যাংক ভবনেও লাগছে। গুলিবিদ্ধ অনেকে আশপাশে মুমূর্ষু অবস্থায় কাতরাচ্ছেন। অসংখ্য নিথর দেহ আশপাশে পড়ে আছে। অনেকের সাদা পোশাক তাজা রক্তে রঞ্জিত। নিথর দেহের ভাইগুলো শহীদ হয়েছেন, নাকি বেঁচে আছেন, সে তথ্য আজও অজানা।

এরই মধ্যে দেয়ালের ভেতরের অংশটা পুলিশের দৃষ্টিগোচর হয়। সেখানে আত্মগোপন করা চার-পাঁচ শ আন্দোলনকারী আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে সেখান থেকে দেয়াল টপকে পালাতে শুরু করেন। আমিও পালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। তারকাঁটার লোহার অ্যাঙ্গেল ধরে দেয়াল টপকাতে গিয়ে আঙুল কেটে দেয়ালের ভেতরেই পড়ে যাই। কিছুটা গভীর থেকে কেটে যাওয়ায় আঙুল থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। সাদা পাঞ্জাবির অনেকটাই রক্তে লাল হয়ে যায়। এক পুলিশ সদস্যকে আক্রমণ করতে করতে অশ্লীল ভাষায় গালি দিতে শুনলাম।

৫ মে অতিবাহিত হয়েছে এক যুগ হতে চলেছে। সে রাতের দুঃসহ স্মৃতি এখনো মনকে বিষণ্ণ করে রাখে। সব সময় তাড়িয়ে বেড়ায়। ঘুমের মধ্যেও গুলির শব্দ শুনতে পাই। মাঝে মাঝে শহীদ ও আহত ভাইদের রক্তাক্ত ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তখন নিজের অজান্তেই চোখ থেকে অশ্রু ঝরে। কান্না থামাতে পারি না। সে রাতের কথা ভুলতে পারি না। ভোলা সম্ভবও নয়। সে স্মৃতি হারানোরও নয়। আমাদের রক্ত বৃথা যাবে না। শহীদের রক্ত কখনো বৃথা যায় না। আগেও যায়নি, এখনো যাবে না। শহীদের খুনে রক্তিম রাত আমাদের জন্য সোনালি প্রভাতের বার্তা নিয়ে আসবে। দয়ালু মেহেরবান আল্লাহর কাছে এটাই আমাদের চাওয়া। এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : মুফতি ও মুহাদ্দিস

জামিয়াতুল মানহাল আল কওমিয়া, উত্তরা, ঢাকা

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত