ডাকসু নির্বাচন ও ছাত্ররাজনীতি

রাজু আলীম
প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২৫, ১০: ২২
রাজু আলীম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়। যার জন্মলগ্নেই মিশে আছে রাজনৈতিক আন্দোলন ও নবজাগরণের ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে যখন ঢাকাকে পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশের রাজধানী করা হয়েছিল, তখন এ অঞ্চলের মুসলিম সমাজে এক নতুন শিক্ষাগত ও রাজনৈতিক জাগরণের সূচনা হয়। কিন্তু ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে গেলে সৃষ্ট রাজনৈতিক ক্ষোভ প্রশমিত করতে করতে ১৯১২ সালে ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন। এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ব্যারিস্টার রবার্ট নাথানের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ১৯২১ সালের ১ জুলাই প্রায় ৬০০ একর জমিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে একটি আবাসিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠা এই শিক্ষালয় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ নামে খ্যাতি লাভ করে। শুরুতে কলা, বিজ্ঞান ও আইন অনুষদ, ১২টি বিভাগ এবং তিনটি আবাসিক হল (ঢাকা হল, জগন্নাথ হল ও সলিমুল্লাহ মুসলিম হল) নিয়ে এর পথচলা শুরু হয়েছিল। একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের হাতিয়ার হিসেবে তৈরি হলেও, এই প্রতিষ্ঠানটিই পরে রাজনৈতিক সচেতনতার কেন্দ্রে পরিণত হয় এবং একটি নতুন জাতির অভ্যুত্থানের ভিত্তি স্থাপন করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এই প্রতিষ্ঠানটির গণতান্ত্রিক চেতনাকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছিল। ১৯২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ’ বা (ডুসু) নামে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পরে ১৯৫৩-৫৪ শিক্ষাবর্ষে এর নাম হয় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ’ বা ডাকসু।

বিজ্ঞাপন

১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে ডাকসু এবং সামগ্রিকভাবে ছাত্ররাজনীতি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের পথ প্রশস্ত করে। মূলত তৎকালীন ডাকসুর ভিপি তোফায়েল আহমেদকে আহ্বায়ক গঠিত সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে এবং আন্দোলনের গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়। এই ১১ দফা ছিল শুধু ছাত্রদের দাবি-দাওয়া নয়, বরং পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বায়ত্তশাসন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার এক পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা। এই কর্মসূচির ভিত্তিতেই ছাত্র-জনতা এক হয়ে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিশেষ করে ২০ জানুয়ারি ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামানের শহীদ হওয়ার ঘটনা আন্দোলনকে এক নতুন মাত্রা দেয় এবং এর ফলে গণআন্দোলন রূপ নেয় মহান গণঅভ্যুত্থানে। এই গণঅভ্যুত্থানের তীব্রতা এতটাই প্রবল ছিল, আইয়ুব খান তার ক্ষমতা ত্যাগ করতে এবং গোলটেবিল বৈঠকে বসতে বাধ্য হন। এই আন্দোলন প্রমাণ করে, তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার মুখে ছাত্রসমাজই জাতিকে পথ দেখাতে সক্ষম হয়েছিল এবং একটি নতুন রাজনৈতিক ইতিহাসের সূচনা করেছিল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও ডাকসুর ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ তৎকালীন ডাকসুর ভিপি আ স ম আবদুর রব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় হাজার হাজার ছাত্র-জনতার সামনে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করেন। এটি ছিল স্বাধীনতার প্রথম আনুষ্ঠানিক ঘোষণাগুলোর মধ্যে অন্যতম, যা বাঙালির হৃদয়ে নতুন করে সাহস আর সংগ্রামের প্রেরণা জাগিয়েছিল। এমনই সব ঐতিহাসিক ঘটনার কারণে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রতিরোধের কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় গেরিলা বাহিনীর একটি বড় অংশই ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, যারা সরাসরি রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ডাকসুর মতো একটি ছাত্র সংসদের নেতৃত্বের কারণেই এমন একটি শক্তিশালী ছাত্রসমাজ তৈরি হয়েছিল, যা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল।

১৯৭৩ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশে প্রতিবছর ডাকসু নির্বাচনের কথা বলা হলেও, বাস্তবে তা কখনো নিয়মিত ছিল না। ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনে ডাকসু এবং ছাত্ররাজনীতির ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ধারক। এই আন্দোলনকে সফল করার পেছনে ছাত্রদের দৃঢ়তা এবং ঐক্যই ছিল প্রধান চালিকাশক্তি। তৎকালীন সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দীর্ঘ ৯ বছরের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে যখন মূল রাজনৈতিক দলগুলো দ্বিধাবিভক্ত ও আপসের পথে ছিল, তখন ছাত্রসমাজই প্রতিরোধের মশাল হাতে তুলে নেয়। ১৯৮৭ সালে নূর হোসেনের আত্মত্যাগের পর থেকেই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন নতুন মাত্রা পায় এবং ১৯৯০ সালের ১০ অক্টোবর পুলিশের গুলিতে ডা. শামসুল আলম খান মিলনের শহীদ হওয়ার পর তা গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এ ঘটনার পরপরই ডাকসুসহ ২২টি ছাত্রসংগঠন একত্র হয়ে গঠন করে ‘সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য’। গণআন্দোলনের এই পর্যায়ে ছাত্রদের দৃঢ় অবস্থান ও আপসহীন মনোভাবের কাছে এরশাদ সরকার টিকতে পারেনি। অবশেষে, ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগের ঘোষণা দিতে বাধ্য হন এবং ৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে তার স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। এই আন্দোলনের মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়েছিল, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্রসমাজ শুধু একটি অংশ নয়, বরং সংকটের মুহূর্তে তারা একটি শক্তিশালী ও সিদ্ধান্তমূলক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।

১৯৯০ সালের পর থেকে প্রায় তিন দশক ধরে ডাকসু নির্বাচন বন্ধ ছিল। এই দীর্ঘ বিরতির কারণ হিসেবে ক্ষমতাসীন দলগুলোর ছাত্রসংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে বিরোধীদের বিজয়ের আশঙ্কাই প্রধানত দায়ী বলে মনে করা হয়। এ সময় ছাত্ররাজনীতিতে ‘লেজুড়বৃত্তি’র প্রভাব ব্যাপক আকার ধারণ করে, যেখানে ছাত্রসংগঠনগুলো স্বায়ত্তশাসন হারিয়ে মূল রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন হিসেবে কাজ করতে শুরু করে। এই পরিস্থিতি ক্যাম্পাসে দখলদারি, চাঁদাবাজি এবং সহিংসতাকে উৎসাহিত করে। শিক্ষাঙ্গনের স্বাভাবিক পরিবেশ ব্যাহত হয় এবং মেধার পরিবর্তে পেশিশক্তি প্রাধান্য লাভ করে। শিক্ষার্থীরা নিজেদের অধিকারের কথা বলার জন্য একটি বৈধ ফোরাম থেকে বঞ্চিত হয়, যার ফলে তাদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ জমা হতে থাকে। অবশেষে, ২৮ বছরের প্রতীক্ষার পর ২০১৯ সালের ১১ মার্চ বহু প্রতীক্ষিত ডাকসু নির্বাচন হয়। তবে এই নির্বাচনটি শুরু থেকেই বিভিন্ন অভিযোগ ও বিতর্কের জন্ম দেয়। ভোট কারচুপি, অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ভোটদানে বাধা, প্রার্থীদের ওপর হামলা এবং ব্যালট বাক্স নিয়ে লুকোচুরির মতো নানা অভিযোগ ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি অবশ্য তাদের প্রতিবেদনে জানায় যে নির্বাচনে কোনো কারচুপির ঘটনা ঘটেনি। তাদের মতে, রোকেয়া হলে যে ব্যালট বাক্স নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল, তা ছিল ‘ব্যালট-বাক্স’ ও ‘ব্যালট পেপার রক্ষিত ট্রাঙ্কের’ মধ্যে একটি ভুল বোঝাবুঝি, যা কিছু গণমাধ্যম ও অভিযোগকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ছড়িয়েছিলেন। অন্যদিকে, ডাকসু নির্বাচনের ভিপি পদে বিজয়ী নুরুল হক নুর এই প্রতিবেদনকে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ছাত্রলীগ কোনো সদস্য পদেও জয়ী হতে পারত না। ২০১৯ সালের নির্বাচনের ফল ছিল একধরনের মিশ্র বার্তা। যেখানে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নুর ভিপি নির্বাচিত হন, সেখানে সাধারণ সম্পাদকসহ অন্যান্য প্রায় সব পদে জয়লাভ করে ছাত্রলীগ। এই ফলটি ছিল একধরনের দ্বৈততা, যা একদিকে শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিবাদী মনোভাবের প্রকাশ ঘটায়, অন্যদিকে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে প্রচলিত দলীয় রাজনৈতিক শক্তির নিয়ন্ত্রণের কথাও তুলে ধরে। এই নির্বাচন গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবনের পরিবর্তে দেশের জাতীয় নির্বাচনের ত্রুটিগুলোকেই যেন প্রতিফলিত করেছিল, যা ছাত্ররাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উত্থাপন করে।

২০০০ সালের পর থেকে নতুনভাবে আলোচনায় আসে ছাত্রদলের রাজনীতিও। সংগঠনটি ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই ছাত্ররাজনীতির অন্যতম প্রধান শক্তি হিসেবে পরিচিত। ৮০-এর দশক এবং ৯০-এর দশকে তারা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অংশ ছিল। বর্তমানে তারা নতুন প্রজন্মের রাজনীতি গড়ে তুলতে সাংগঠনিক কার্যক্রমে মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করছে।

২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়েছে। এই পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেও। এই গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের ছাত্ররাজনীতিতে প্রথম বৃহৎ নির্বাচনি আয়োজন হিসেবে ২০২৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচন কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিবিড়ভাবে কাজ করছে। সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করতে তিনটি পৃথক কমিটি গঠিত হয়েছে, যারা বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন, সাবেক ডাকসু নেতা, রাজনীতিবিদ এবং সাংবাদিকদের সঙ্গে ধারাবাহিক মতবিনিময় করছে। ২০১৯ সালের নির্বাচনের বিতর্ক এড়াতে এবার প্রথমবারের মতো হলের বাইরে ছয়টি পৃথক কেন্দ্রে ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে নতুন এই রাজনৈতিক পরিবেশে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের সংশয় ও আলোচনাও বিদ্যমান। সাবেক ডাকসু ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না মন্তব্য করেছেন, ২০২৪ সালের সংগ্রামÑবৃহৎ গণঅভ্যুত্থানের পরÑএবারের ডাকসু নির্বাচন, জাতীয় রাজনীতির গতিপ্রকৃতিতে সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে।

তবে বর্তমানে ছাত্ররাজনীতিতে নতুন উদ্দীপনা দেখা গেলেও, অতীতের লেজুড়বৃত্তির তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে অনেকেই এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন এবং ছাত্ররাজনীতি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার দাবিও উঠেছে। এই দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতিতে ২০২৫ সালের ডাকসু নির্বাচন শুধু একটি ক্যাম্পাস নির্বাচন নয়, বরং এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের একটি বড় পরীক্ষা। এটি দেখিয়ে দেবে, ছাত্রসমাজ কি দলীয় লেজুড়বৃত্তির চক্র থেকে বেরিয়ে এসে একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারবে, নাকি আবার মূলধারার রাজনীতির ছায়ায় নিজেদের বিলীন করে দেবে। এই নির্বাচনের ফল বাংলাদেশের পরবর্তী রাজনৈতিক গতিপথের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করবে।

লেখক : কবি, সাংবাদিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত