ব্রি জে. রোকন উদ্দিন (অব)
দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা, হাইব্রিড যুদ্ধের নতুন হুমকি এবং কৌশলগত অনিশ্চয়তার এই সময়ে বাংলাদেশকে অবশ্যই তার প্রতিরক্ষা কাঠামো, ভূমিকা ও আধুনিকায়নের ধরন নতুনভাবে মূল্যায়ন করতে হবে।
প্রতিরক্ষা সংস্কার এখন আর বিলাসিতা নয়, এটি একটি কৌশলগত প্রয়োজন। তবে এই সংস্কার যেন জাতীয় নিরাপত্তাকে দুর্বল না করে, সশস্ত্র বাহিনীর পেশাদারিত্ব অক্ষুণ্ণ রাখে এবং রাজনৈতিক বা বিদেশি হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকে, সেই নিশ্চয়তা প্রদান করেই এগোতে হবে।
প্রতিরক্ষা সংস্কারে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার দিক এখানে তুলে ধরা হলো:
১. সুস্পষ্ট কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সংস্কারের মূল ভিত্তি হওয়া উচিত একটি সুনির্দিষ্ট, ভবিষ্যৎমুখী ও সার্বিক প্রতিরক্ষা কৌশল। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করা বাংলাদেশ এখন আর দুর্বল রাষ্ট্র নয়, বরং একাধিক ফ্রন্টে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম একটি উদীয়মান শক্তি। এই বাস্তবতা মাথায় রেখে প্রতিরক্ষা নীতি নির্ধারণ করতে হবে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, আঞ্চলিক অনিশ্চয়তা ও বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় রেখে।
রোহিঙ্গা সংকট, সীমান্তে গোলাগুলি, ভারতের সঙ্গে নদী ও জলসীমা নিয়ে বিরোধ, বঙ্গোপসাগরে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা—এসব বিষয় ভবিষ্যতের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ। সাইবার যুদ্ধ, গুজব ও তথ্যযুদ্ধ এবং সন্ত্রাসবাদের আধুনিক রূপ ইতোমধ্যে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে ফেলেছে, যেগুলো প্রতিরক্ষা কৌশলের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা একান্ত প্রয়োজন।
কৌশলগত পরিকল্পনা ছাড়া প্রতিরক্ষা বাজেটের অপচয়, অস্ত্র কেনায় অনিয়ম এবং মানবসম্পদের সঠিক ব্যবহার ব্যাহত হতে পারে। তাই একটি দীর্ঘমেয়াদি ‘ডিফেন্স ভিশন’ প্রণয়ন করা যেতে পারে, যেটি ধাপে ধাপে বাহিনীর কাঠামো, প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ ও কূটনৈতিক সক্ষমতা গঠনের রূপরেখা দেবে।
২. বেসামরিক-সামরিক ভারসাম্য
গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ হলো সশস্ত্র বাহিনীর বেসামরিক তত্ত্বাবধানের অধীন থাকা, তবে সেই তত্ত্বাবধান হতে হবে গঠনমূলক ও পেশাদার, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়। সংবিধানের ৬১-৬৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে, রাষ্ট্রপতির অধীন সশস্ত্র বাহিনী পরিচালিত হলেও বাস্তবে তদারকির দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকার পালন করে। এই ব্যবস্থাকে কার্যকর রাখতে হলে প্রয়োজন দক্ষ, অরাজনৈতিক ও প্রতিরক্ষা-সচেতন বেসামরিক প্রশাসন।
সামরিক বাহিনীর মধ্যে রাজনৈতিক পক্ষপাত, আদেশের বাইরে মোতায়েন, বা ‘বিশেষ অনুগত’ চিহ্নিতকরণ বাহিনীর শৃঙ্খলা ও ঐক্য ভেঙে দিতে পারে। এর ফলস্বরূপ বাহিনী রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে বিভক্ত হয়ে পড়ে, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক। তাই প্রতিরক্ষা সংস্কারে এমন নীতিমালা থাকতে হবে, যা বাহিনীর অরাজনৈতিক পরিচয় রক্ষা করে এবং রাজনৈতিক সরকারের অবস্থান অতিক্রম না করে কার্যকর সমন্বয় স্থাপন করে।
৩. প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা ও সততা
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাতে স্বচ্ছতা ও সততা প্রতিষ্ঠা না করা গেলে বাহিনী দুর্বল, অনুপ্রবেশযোগ্য ও ভেতর থেকে ক্ষয়প্রাপ্ত হবে। প্রতিরক্ষা বাজেটের এক বিশাল অংশ অস্ত্র ক্রয়, অবকাঠামো উন্নয়ন ও বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয় হয়, যেখানে প্রভাবশালী ঠিকাদার, মধ্যস্থতাকারী ও রাজনীতিবিদদের জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে। এজন্য স্বাধীন প্রতিরক্ষা নিরীক্ষা ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, যা সংসদের কাছে রিপোর্ট করবে এবং দুর্নীতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
সামরিক ক্রয় প্রক্রিয়াকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নিয়ম ও প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের ভিত্তিতে পরিচালিত করতে হবে। অস্ত্র ও প্রযুক্তি কেনার সময় কোনো দেশের প্রভাব বা কমিশনের বদলে কৌশলগত প্রয়োজন ও কার্যকারিতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রতিটি বাহিনীতে আচরণবিধি ও পেশাগত নৈতিকতার গাইডলাইন তৈরি করে তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে, বিশেষত উচ্চপদস্থ অফিসারদের ক্ষেত্রে, যাতে কেউ দায়িত্বের অপব্যবহার না করে এবং বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
৪. সাংবিধানিক ও আইনি কাঠামো
প্রতিরক্ষা সংস্কার অবশ্যই সংবিধানের সীমার মধ্যে পরিচালিত হতে হবে, যাতে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামো ও সামরিক বাহিনীর পেশাদারিত্ব অক্ষুণ্ণ থাকে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৬১, ৬২ ও ৬৩ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির অধীন সশস্ত্র বাহিনীর অবস্থান স্পষ্ট করা হয়েছে। তবে কার্যত প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও মোতায়েনের সিদ্ধান্ত আসে নির্বাহী শাখা থেকে। এই দ্বৈত কাঠামো স্পষ্ট ব্যাখ্যা ও আইনি প্রটোকলের মাধ্যমে পরিচালিত না হলে রাজনৈতিক অপব্যবহারের ঝুঁকি থেকে যায়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তা (Aid to Civil Power) বা অবকাঠামো নির্মাণে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করার প্রবণতা বেড়েছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড সংবিধান ও প্রতিরক্ষা আইনের আওতায় নির্ধারিত সময়ে ও স্পষ্ট ম্যানডেটের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়া জরুরি। দীর্ঘ মেয়াদে এই ধরনের কাজ বাহিনীর মূল যুদ্ধ প্রস্তুতি ব্যাহত করতে পারে, পাশাপাশি বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে এবং বেসামরিক জনগণের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে। প্রয়োজনীয় হলে একটি ‘ডিফেন্স রিফর্ম আইন’ প্রণয়ন করে সামরিক ও বেসামরিক কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ও সীমাবদ্ধতা স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা যেতে পারে। এটি নিশ্চিত করবে যেকোনো ধরনের বাহিনীর মোতায়েন বা ভূমিকা সম্প্রসারণ নির্দিষ্ট নিয়ম, সময়সীমা ও তদারকি কাঠামোর আওতায় হবে।
৫. সক্ষমতা বৃদ্ধি
বর্তমান ও ভবিষ্যৎ যুদ্ধক্ষেত্র কেবল অস্ত্রের নয়, বরং চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধ, সাইবার আক্রমণ ও তথ্যযুদ্ধের মাঠে রূপ নিচ্ছে। এ বাস্তবতায় বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা উন্নয়নের জন্য বহুমাত্রিক প্রস্তুতি প্রয়োজন। সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর মধ্যে যুগোপযোগী সমন্বয়, মডার্নাইজেশন পরিকল্পনা এবং বাহিনীর দ্রুত মোতায়েন সক্ষমতা গড়ে তোলা দরকার। দেশীয় প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তোলা এখন আর বিলাসিতা নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক আত্মনির্ভরতার গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (BMTF) এবং নৌ ও বিমানবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিটগুলোকে যৌথভাবে R&D ও উৎপাদনে সংযুক্ত করা যেতে পারে।
সাইবার কমান্ড ইউনিট, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সেল ও বিশেষ ড্রোন ইউনিট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তথ্যযুদ্ধের মোকাবিলায় সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। মিলিটারি একাডেমিগুলোয় আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পাঠ্যক্রম, কৌশলগত নেতৃত্ব উন্নয়ন, ভাষা শিক্ষা এবং বিদেশি প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম চালু করা উচিত। অভ্যন্তরীণ নেতৃত্ব উন্নয়ন, সিনিয়র অফিসারদের যুদ্ধ প্রস্তুতি, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা ও জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলায় দক্ষ করে তুলতে বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা উচিত। এই সক্ষমতা উন্নয়ন হবে ব্যালেন্সড, রিয়ালিস্টিক ও কৌশলগতভাবে চিন্তাশীল, যাতে বাহিনী একদিকে আধুনিক হয়, অন্যদিকে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ে জড়িয়ে না পড়ে।
৬. হুমকি মূল্যায়ন
একটি জাতির প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা তখনই কার্যকর হয়, যখন তা বাস্তবভিত্তিক হুমকির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের জন্য এই হুমকি চিহ্নিত করতে হবে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় দিক থেকে। আগে মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলি, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে উগ্রবাদীদের তৎপরতা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদ—সবই অভ্যন্তরীণ হুমকির অংশ। এসবের জন্য কাউন্টার ইনসারজেন্সি ট্রেনিং, স্থানীয় গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়া বাহিনী গড়ে তোলা আবশ্যক। সাইবার আক্রমণ, ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তি ও তথ্যবিকৃতি বর্তমানে এক নতুন ধরনের যুদ্ধ, যেখানে শত্রু চোখে দেখা যায় না, কিন্তু ক্ষতি করে ভেতর থেকে। এজন্য সাইবার গোয়েন্দা বিভাগ, জাতীয় সাইবার কমান্ড ও সাইবার ওয়ারফেয়ার ইউনিট গঠন জরুরি।
বঙ্গোপসাগরে ভারতের ও চীনের উপস্থিতি, ট্রানজিট নিয়ে কৌশলগত দ্বন্দ্ব এবং চীনা অর্থনৈতিক করিডোর প্রসার—সবই মেরিটাইম থ্রেট অ্যাসেসমেন্টের অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। নৌবাহিনীর জন্য সার্বক্ষণিক নজরদারি, স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণ ও গভীর সমুদ্র টহল ক্ষমতা উন্নয়নের সময় এসেছে। হুমকিগুলোর পর্যালোচনার জন্য একটি ‘জাতীয় নিরাপত্তা মূল্যায়ন কেন্দ্র (NSAC)’ স্থাপন করা যেতে পারে, যেখানে সামরিক, বেসামরিক ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সমন্বিতভাবে কাজ করবে।
৭. অংশীদারিত্ব ও পরামর্শভিত্তিক প্রক্রিয়া
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সংস্কার সফল করতে হলে এটি যেন কেবল মন্ত্রণালয় বা সামরিক সদর দপ্তরের গোপন কক্ষে তৈরি নির্দেশনা না হয়। বরং এটি হতে হবে একটি জাতীয় পরামর্শভিত্তিক প্রক্রিয়া, যেখানে সব স্তরের অংশীদারদের মতামত ও অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত হয়। সশস্ত্র বাহিনীর সিনিয়র নেতৃত্ব, যারা বাস্তব অভিজ্ঞতা, ইউনিট কমান্ড ও অপারেশন পরিচালনার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ, তাদের মতামতকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মূল্যায়ন করা জরুরি। অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা দেশের ইতিহাস, বিভিন্ন যুদ্ধ ও শান্তিরক্ষা মিশনের অভিজ্ঞতা বহন করেন। তাদের অন্তর্ভুক্তি বর্তমান বাহিনীকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বাস্তবসম্মত দিকনির্দেশনা দিতে পারে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক, একাডেমিশিয়ান ও গবেষকদের কৌশলগত চ্যালেঞ্জ, আধুনিক যুদ্ধনীতি ও আন্তর্জাতিক সামরিক কাঠামো সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে। সরকারের উচিত দেশীয় থিংক ট্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা গবেষণা কেন্দ্র এবং স্বীকৃত সামরিক বিশ্লেষকদের সঙ্গে স্থায়ী পরামর্শ কাঠামো গঠন করা।
৮. বিদেশি প্রভাব ও অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ
বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশকে কৌশলগত আত্মনির্ভরতা বজায় রাখতে হবে। প্রতিরক্ষা সংস্কারের নামে বিদেশি শক্তির দখলদারি বা নির্ভরতামূলক চুক্তি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। সামরিক প্রশিক্ষণ, যৌথ মহড়া বা প্রযুক্তি সহযোগিতা—সবই গুরুত্বপূর্ণ; তবে প্রতিটি ক্ষেত্রে দরকার জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা। কোন দেশের সঙ্গে কী পরিমাণ সহযোগিতা হচ্ছে, তার মানদণ্ড অবশ্যই নির্ধারিত ও পর্যবেক্ষণযোগ্য হওয়া উচিত। কোনো বিদেশি সংস্থা বা রাষ্ট্র যাতে আমাদের গোয়েন্দা তথ্য, কমিউনিকেশন সিস্টেম, অথবা বাহিনীর মোতায়েন পরিকল্পনায় হস্তক্ষেপ করতে না পারে, সেজন্য প্রতিটি সহযোগিতা চুক্তিতে রেডলাইন বা শর্ত থাকতে হবে।
অস্ত্র বা প্রযুক্তি কেনার সময় বাংলাদেশ যেন ‘ডিপ্লয়মেন্ট শর্ত’, ‘নিয়ন্ত্রণ সুবিধা’ বা ‘পরিদর্শক নিযুক্তি’র মতো বিদেশি নিয়ন্ত্রণমূলক শর্তে না পড়ে, এটি নিশ্চিত করতে হবে। কিছু তথাকথিত এনজিও বা গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘রক্ষা সংস্কারের নামে তথ্য আহরণ’ করে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাকে সরবরাহ করছে—এমন অভিযোগ মাঝে মাঝে উঠে আসে। সরকারকে এসব নিয়ন্ত্রিত, নিবন্ধিত ও পর্যালোচনাধীন রাখতে হবে। সংক্ষেপে, আমাদের প্রতিপাদ্য হওয়া উচিত—‘সহযোগিতা হোক সম্মানের ভিত্তিতে, আধিপত্য নয়।’
৯. ধাপে ধাপে এবং অভিযোজনযোগ্য পদ্ধতি
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাত একটি সুগঠিত, ঐতিহ্যবাহী ও নিয়মানুবর্তী কাঠামো। এমন প্রতিষ্ঠানে হঠাৎ পরিবর্তন চাপিয়ে দিলে তা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তাই সংস্কার প্রক্রিয়া হতে হবে ধাপে ধাপে, পরীক্ষামূলক ও অভিযোজনযোগ্য। সংস্কার পরিকল্পনাগুলো প্রথমে প্রয়োগভিত্তিক পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে পরীক্ষা করা যেতে পারে। প্রতিরক্ষা কাঠামোর সংস্কার কখনোই এককালীন ফাইলচালিত সিদ্ধান্ত হতে পারে না। এটি হতে হবে বাস্তব অভিজ্ঞতা ও চালনাভিত্তিক, যেখানে পর্যবেক্ষণ, পুনর্মূল্যায়ন ও সংশোধন হবে একটি অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া।
রাজনৈতিক পরিবর্তন, অর্থনৈতিক চাপে পরিবর্তন বা আঞ্চলিক সংকট—এসব মাথায় রেখে সংস্কার নীতিতে ফ্লেক্সিবিলিটি ও কনটিনজেন্সি প্ল্যান থাকা জরুরি। বাহিনীর মধ্যে জ্ঞান হস্তান্তর, নতুন নেতৃত্বকে প্রস্তুতকরণ এবং নীতিগত ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে প্রতি স্তরে প্রয়োজন দক্ষ ও প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ উন্নয়ন।
প্রতিরক্ষা সংস্কার মানে কেবল অস্ত্র কেনা কিংবা পদ সৃষ্টি করা নয়। এটি হলো জাতীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ও জনগণের প্রতি সশস্ত্র বাহিনীর অঙ্গীকার রক্ষা করা। আজ যখন ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল নতুন প্রতিযোগিতার মঞ্চ হয়ে উঠছে, তখন বাংলাদেশের চাই একটি পেশাদার, আত্মনির্ভর ও কৌশলগতভাবে স্বাধীন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। কিন্তু এ সংস্কার হতে হবে জ্ঞানভিত্তিক, দূরদর্শী ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পরিবেশে। ইতিহাস, বাস্তবতা ও জাতীয় স্বার্থের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই প্রতিরক্ষা সংস্কারের পথচলা নির্ধারিত হওয়া উচিত। এমন একটি বাহিনী গড়তে হবে, যা শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যতের বাংলাদেশকেও রক্ষা করতে পারবে।
দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা, হাইব্রিড যুদ্ধের নতুন হুমকি এবং কৌশলগত অনিশ্চয়তার এই সময়ে বাংলাদেশকে অবশ্যই তার প্রতিরক্ষা কাঠামো, ভূমিকা ও আধুনিকায়নের ধরন নতুনভাবে মূল্যায়ন করতে হবে।
প্রতিরক্ষা সংস্কার এখন আর বিলাসিতা নয়, এটি একটি কৌশলগত প্রয়োজন। তবে এই সংস্কার যেন জাতীয় নিরাপত্তাকে দুর্বল না করে, সশস্ত্র বাহিনীর পেশাদারিত্ব অক্ষুণ্ণ রাখে এবং রাজনৈতিক বা বিদেশি হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকে, সেই নিশ্চয়তা প্রদান করেই এগোতে হবে।
প্রতিরক্ষা সংস্কারে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার দিক এখানে তুলে ধরা হলো:
১. সুস্পষ্ট কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সংস্কারের মূল ভিত্তি হওয়া উচিত একটি সুনির্দিষ্ট, ভবিষ্যৎমুখী ও সার্বিক প্রতিরক্ষা কৌশল। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করা বাংলাদেশ এখন আর দুর্বল রাষ্ট্র নয়, বরং একাধিক ফ্রন্টে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম একটি উদীয়মান শক্তি। এই বাস্তবতা মাথায় রেখে প্রতিরক্ষা নীতি নির্ধারণ করতে হবে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, আঞ্চলিক অনিশ্চয়তা ও বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় রেখে।
রোহিঙ্গা সংকট, সীমান্তে গোলাগুলি, ভারতের সঙ্গে নদী ও জলসীমা নিয়ে বিরোধ, বঙ্গোপসাগরে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা—এসব বিষয় ভবিষ্যতের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ। সাইবার যুদ্ধ, গুজব ও তথ্যযুদ্ধ এবং সন্ত্রাসবাদের আধুনিক রূপ ইতোমধ্যে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে ফেলেছে, যেগুলো প্রতিরক্ষা কৌশলের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা একান্ত প্রয়োজন।
কৌশলগত পরিকল্পনা ছাড়া প্রতিরক্ষা বাজেটের অপচয়, অস্ত্র কেনায় অনিয়ম এবং মানবসম্পদের সঠিক ব্যবহার ব্যাহত হতে পারে। তাই একটি দীর্ঘমেয়াদি ‘ডিফেন্স ভিশন’ প্রণয়ন করা যেতে পারে, যেটি ধাপে ধাপে বাহিনীর কাঠামো, প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ ও কূটনৈতিক সক্ষমতা গঠনের রূপরেখা দেবে।
২. বেসামরিক-সামরিক ভারসাম্য
গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ হলো সশস্ত্র বাহিনীর বেসামরিক তত্ত্বাবধানের অধীন থাকা, তবে সেই তত্ত্বাবধান হতে হবে গঠনমূলক ও পেশাদার, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়। সংবিধানের ৬১-৬৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে, রাষ্ট্রপতির অধীন সশস্ত্র বাহিনী পরিচালিত হলেও বাস্তবে তদারকির দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকার পালন করে। এই ব্যবস্থাকে কার্যকর রাখতে হলে প্রয়োজন দক্ষ, অরাজনৈতিক ও প্রতিরক্ষা-সচেতন বেসামরিক প্রশাসন।
সামরিক বাহিনীর মধ্যে রাজনৈতিক পক্ষপাত, আদেশের বাইরে মোতায়েন, বা ‘বিশেষ অনুগত’ চিহ্নিতকরণ বাহিনীর শৃঙ্খলা ও ঐক্য ভেঙে দিতে পারে। এর ফলস্বরূপ বাহিনী রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে বিভক্ত হয়ে পড়ে, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক। তাই প্রতিরক্ষা সংস্কারে এমন নীতিমালা থাকতে হবে, যা বাহিনীর অরাজনৈতিক পরিচয় রক্ষা করে এবং রাজনৈতিক সরকারের অবস্থান অতিক্রম না করে কার্যকর সমন্বয় স্থাপন করে।
৩. প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা ও সততা
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাতে স্বচ্ছতা ও সততা প্রতিষ্ঠা না করা গেলে বাহিনী দুর্বল, অনুপ্রবেশযোগ্য ও ভেতর থেকে ক্ষয়প্রাপ্ত হবে। প্রতিরক্ষা বাজেটের এক বিশাল অংশ অস্ত্র ক্রয়, অবকাঠামো উন্নয়ন ও বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয় হয়, যেখানে প্রভাবশালী ঠিকাদার, মধ্যস্থতাকারী ও রাজনীতিবিদদের জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে। এজন্য স্বাধীন প্রতিরক্ষা নিরীক্ষা ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, যা সংসদের কাছে রিপোর্ট করবে এবং দুর্নীতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
সামরিক ক্রয় প্রক্রিয়াকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নিয়ম ও প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের ভিত্তিতে পরিচালিত করতে হবে। অস্ত্র ও প্রযুক্তি কেনার সময় কোনো দেশের প্রভাব বা কমিশনের বদলে কৌশলগত প্রয়োজন ও কার্যকারিতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রতিটি বাহিনীতে আচরণবিধি ও পেশাগত নৈতিকতার গাইডলাইন তৈরি করে তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে, বিশেষত উচ্চপদস্থ অফিসারদের ক্ষেত্রে, যাতে কেউ দায়িত্বের অপব্যবহার না করে এবং বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
৪. সাংবিধানিক ও আইনি কাঠামো
প্রতিরক্ষা সংস্কার অবশ্যই সংবিধানের সীমার মধ্যে পরিচালিত হতে হবে, যাতে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামো ও সামরিক বাহিনীর পেশাদারিত্ব অক্ষুণ্ণ থাকে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৬১, ৬২ ও ৬৩ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির অধীন সশস্ত্র বাহিনীর অবস্থান স্পষ্ট করা হয়েছে। তবে কার্যত প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও মোতায়েনের সিদ্ধান্ত আসে নির্বাহী শাখা থেকে। এই দ্বৈত কাঠামো স্পষ্ট ব্যাখ্যা ও আইনি প্রটোকলের মাধ্যমে পরিচালিত না হলে রাজনৈতিক অপব্যবহারের ঝুঁকি থেকে যায়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তা (Aid to Civil Power) বা অবকাঠামো নির্মাণে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করার প্রবণতা বেড়েছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড সংবিধান ও প্রতিরক্ষা আইনের আওতায় নির্ধারিত সময়ে ও স্পষ্ট ম্যানডেটের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়া জরুরি। দীর্ঘ মেয়াদে এই ধরনের কাজ বাহিনীর মূল যুদ্ধ প্রস্তুতি ব্যাহত করতে পারে, পাশাপাশি বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে এবং বেসামরিক জনগণের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে। প্রয়োজনীয় হলে একটি ‘ডিফেন্স রিফর্ম আইন’ প্রণয়ন করে সামরিক ও বেসামরিক কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ও সীমাবদ্ধতা স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা যেতে পারে। এটি নিশ্চিত করবে যেকোনো ধরনের বাহিনীর মোতায়েন বা ভূমিকা সম্প্রসারণ নির্দিষ্ট নিয়ম, সময়সীমা ও তদারকি কাঠামোর আওতায় হবে।
৫. সক্ষমতা বৃদ্ধি
বর্তমান ও ভবিষ্যৎ যুদ্ধক্ষেত্র কেবল অস্ত্রের নয়, বরং চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধ, সাইবার আক্রমণ ও তথ্যযুদ্ধের মাঠে রূপ নিচ্ছে। এ বাস্তবতায় বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা উন্নয়নের জন্য বহুমাত্রিক প্রস্তুতি প্রয়োজন। সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর মধ্যে যুগোপযোগী সমন্বয়, মডার্নাইজেশন পরিকল্পনা এবং বাহিনীর দ্রুত মোতায়েন সক্ষমতা গড়ে তোলা দরকার। দেশীয় প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তোলা এখন আর বিলাসিতা নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক আত্মনির্ভরতার গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (BMTF) এবং নৌ ও বিমানবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিটগুলোকে যৌথভাবে R&D ও উৎপাদনে সংযুক্ত করা যেতে পারে।
সাইবার কমান্ড ইউনিট, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সেল ও বিশেষ ড্রোন ইউনিট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তথ্যযুদ্ধের মোকাবিলায় সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। মিলিটারি একাডেমিগুলোয় আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পাঠ্যক্রম, কৌশলগত নেতৃত্ব উন্নয়ন, ভাষা শিক্ষা এবং বিদেশি প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম চালু করা উচিত। অভ্যন্তরীণ নেতৃত্ব উন্নয়ন, সিনিয়র অফিসারদের যুদ্ধ প্রস্তুতি, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা ও জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলায় দক্ষ করে তুলতে বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা উচিত। এই সক্ষমতা উন্নয়ন হবে ব্যালেন্সড, রিয়ালিস্টিক ও কৌশলগতভাবে চিন্তাশীল, যাতে বাহিনী একদিকে আধুনিক হয়, অন্যদিকে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ে জড়িয়ে না পড়ে।
৬. হুমকি মূল্যায়ন
একটি জাতির প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা তখনই কার্যকর হয়, যখন তা বাস্তবভিত্তিক হুমকির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের জন্য এই হুমকি চিহ্নিত করতে হবে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় দিক থেকে। আগে মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলি, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে উগ্রবাদীদের তৎপরতা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদ—সবই অভ্যন্তরীণ হুমকির অংশ। এসবের জন্য কাউন্টার ইনসারজেন্সি ট্রেনিং, স্থানীয় গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়া বাহিনী গড়ে তোলা আবশ্যক। সাইবার আক্রমণ, ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তি ও তথ্যবিকৃতি বর্তমানে এক নতুন ধরনের যুদ্ধ, যেখানে শত্রু চোখে দেখা যায় না, কিন্তু ক্ষতি করে ভেতর থেকে। এজন্য সাইবার গোয়েন্দা বিভাগ, জাতীয় সাইবার কমান্ড ও সাইবার ওয়ারফেয়ার ইউনিট গঠন জরুরি।
বঙ্গোপসাগরে ভারতের ও চীনের উপস্থিতি, ট্রানজিট নিয়ে কৌশলগত দ্বন্দ্ব এবং চীনা অর্থনৈতিক করিডোর প্রসার—সবই মেরিটাইম থ্রেট অ্যাসেসমেন্টের অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। নৌবাহিনীর জন্য সার্বক্ষণিক নজরদারি, স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণ ও গভীর সমুদ্র টহল ক্ষমতা উন্নয়নের সময় এসেছে। হুমকিগুলোর পর্যালোচনার জন্য একটি ‘জাতীয় নিরাপত্তা মূল্যায়ন কেন্দ্র (NSAC)’ স্থাপন করা যেতে পারে, যেখানে সামরিক, বেসামরিক ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সমন্বিতভাবে কাজ করবে।
৭. অংশীদারিত্ব ও পরামর্শভিত্তিক প্রক্রিয়া
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সংস্কার সফল করতে হলে এটি যেন কেবল মন্ত্রণালয় বা সামরিক সদর দপ্তরের গোপন কক্ষে তৈরি নির্দেশনা না হয়। বরং এটি হতে হবে একটি জাতীয় পরামর্শভিত্তিক প্রক্রিয়া, যেখানে সব স্তরের অংশীদারদের মতামত ও অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত হয়। সশস্ত্র বাহিনীর সিনিয়র নেতৃত্ব, যারা বাস্তব অভিজ্ঞতা, ইউনিট কমান্ড ও অপারেশন পরিচালনার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ, তাদের মতামতকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মূল্যায়ন করা জরুরি। অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা দেশের ইতিহাস, বিভিন্ন যুদ্ধ ও শান্তিরক্ষা মিশনের অভিজ্ঞতা বহন করেন। তাদের অন্তর্ভুক্তি বর্তমান বাহিনীকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বাস্তবসম্মত দিকনির্দেশনা দিতে পারে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক, একাডেমিশিয়ান ও গবেষকদের কৌশলগত চ্যালেঞ্জ, আধুনিক যুদ্ধনীতি ও আন্তর্জাতিক সামরিক কাঠামো সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে। সরকারের উচিত দেশীয় থিংক ট্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা গবেষণা কেন্দ্র এবং স্বীকৃত সামরিক বিশ্লেষকদের সঙ্গে স্থায়ী পরামর্শ কাঠামো গঠন করা।
৮. বিদেশি প্রভাব ও অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ
বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশকে কৌশলগত আত্মনির্ভরতা বজায় রাখতে হবে। প্রতিরক্ষা সংস্কারের নামে বিদেশি শক্তির দখলদারি বা নির্ভরতামূলক চুক্তি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। সামরিক প্রশিক্ষণ, যৌথ মহড়া বা প্রযুক্তি সহযোগিতা—সবই গুরুত্বপূর্ণ; তবে প্রতিটি ক্ষেত্রে দরকার জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা। কোন দেশের সঙ্গে কী পরিমাণ সহযোগিতা হচ্ছে, তার মানদণ্ড অবশ্যই নির্ধারিত ও পর্যবেক্ষণযোগ্য হওয়া উচিত। কোনো বিদেশি সংস্থা বা রাষ্ট্র যাতে আমাদের গোয়েন্দা তথ্য, কমিউনিকেশন সিস্টেম, অথবা বাহিনীর মোতায়েন পরিকল্পনায় হস্তক্ষেপ করতে না পারে, সেজন্য প্রতিটি সহযোগিতা চুক্তিতে রেডলাইন বা শর্ত থাকতে হবে।
অস্ত্র বা প্রযুক্তি কেনার সময় বাংলাদেশ যেন ‘ডিপ্লয়মেন্ট শর্ত’, ‘নিয়ন্ত্রণ সুবিধা’ বা ‘পরিদর্শক নিযুক্তি’র মতো বিদেশি নিয়ন্ত্রণমূলক শর্তে না পড়ে, এটি নিশ্চিত করতে হবে। কিছু তথাকথিত এনজিও বা গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘রক্ষা সংস্কারের নামে তথ্য আহরণ’ করে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাকে সরবরাহ করছে—এমন অভিযোগ মাঝে মাঝে উঠে আসে। সরকারকে এসব নিয়ন্ত্রিত, নিবন্ধিত ও পর্যালোচনাধীন রাখতে হবে। সংক্ষেপে, আমাদের প্রতিপাদ্য হওয়া উচিত—‘সহযোগিতা হোক সম্মানের ভিত্তিতে, আধিপত্য নয়।’
৯. ধাপে ধাপে এবং অভিযোজনযোগ্য পদ্ধতি
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাত একটি সুগঠিত, ঐতিহ্যবাহী ও নিয়মানুবর্তী কাঠামো। এমন প্রতিষ্ঠানে হঠাৎ পরিবর্তন চাপিয়ে দিলে তা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তাই সংস্কার প্রক্রিয়া হতে হবে ধাপে ধাপে, পরীক্ষামূলক ও অভিযোজনযোগ্য। সংস্কার পরিকল্পনাগুলো প্রথমে প্রয়োগভিত্তিক পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে পরীক্ষা করা যেতে পারে। প্রতিরক্ষা কাঠামোর সংস্কার কখনোই এককালীন ফাইলচালিত সিদ্ধান্ত হতে পারে না। এটি হতে হবে বাস্তব অভিজ্ঞতা ও চালনাভিত্তিক, যেখানে পর্যবেক্ষণ, পুনর্মূল্যায়ন ও সংশোধন হবে একটি অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া।
রাজনৈতিক পরিবর্তন, অর্থনৈতিক চাপে পরিবর্তন বা আঞ্চলিক সংকট—এসব মাথায় রেখে সংস্কার নীতিতে ফ্লেক্সিবিলিটি ও কনটিনজেন্সি প্ল্যান থাকা জরুরি। বাহিনীর মধ্যে জ্ঞান হস্তান্তর, নতুন নেতৃত্বকে প্রস্তুতকরণ এবং নীতিগত ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে প্রতি স্তরে প্রয়োজন দক্ষ ও প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ উন্নয়ন।
প্রতিরক্ষা সংস্কার মানে কেবল অস্ত্র কেনা কিংবা পদ সৃষ্টি করা নয়। এটি হলো জাতীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ও জনগণের প্রতি সশস্ত্র বাহিনীর অঙ্গীকার রক্ষা করা। আজ যখন ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল নতুন প্রতিযোগিতার মঞ্চ হয়ে উঠছে, তখন বাংলাদেশের চাই একটি পেশাদার, আত্মনির্ভর ও কৌশলগতভাবে স্বাধীন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। কিন্তু এ সংস্কার হতে হবে জ্ঞানভিত্তিক, দূরদর্শী ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পরিবেশে। ইতিহাস, বাস্তবতা ও জাতীয় স্বার্থের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই প্রতিরক্ষা সংস্কারের পথচলা নির্ধারিত হওয়া উচিত। এমন একটি বাহিনী গড়তে হবে, যা শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যতের বাংলাদেশকেও রক্ষা করতে পারবে।
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
১৩ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
১৩ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
১৪ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
২ দিন আগে