সারোয়ার তুষার
ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানের পর ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কে নতুন বাঁকবদল লক্ষ করা যাচ্ছে। ভারতীয় মিডিয়া থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারক পর্যায় পর্যন্ত বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতির ব্যাপারে অত্যন্ত নেতিবাচক প্রচারণায় লিপ্ত। স্রেফ ভুল তথ্য নয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সচেতন মিথ্যা তথ্য বা অপতথ্য তারা প্রচার করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থানকে ভারত কোন দৃষ্টিতে দেখে, তা এসব প্রচারণা থেকে আঁচ করা যায়।
এর মধ্যে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম, সুশীলসমাজ এবং রাজনৈতিক পরিসরে সম্প্রতি আরেকটি বিশেষ আলোচনা বেশ জায়গা করে নিয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন কবে হবেÑ এই প্রশ্নে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বেশ উচ্চকিত। এমনকি সম্প্রতি ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী পর্যন্ত মন্তব্য করেছেন, নির্বাচিত সরকার না এলে বাংলাদেশের সঙ্গে নাকি ভারতের সম্পর্ক ‘স্বাভাবিক’ হবে না।
বলাবাহুল্য, ভারতের এ অবস্থান একই সঙ্গে রহস্যজনক ও কৌতুকপ্রদ। কারণ বাংলাদেশে গত তিনটি জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু না হওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের আগে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে এসে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য করেছিলেন। দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত একপেশে ও অবৈধ ওই নির্বাচন বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল বয়কট করেছিল।
২০২৪ সালের নির্বাচন যেন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, সে জন্য আওয়ামী লীগকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছু চাপ প্রয়োগ করেছিল। এর পেছনে এ অঞ্চলে তাদের ভূরাজনৈতিক বিবেচনাই ছিল প্রধান। তবু বাংলাদেশের মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিল, দীর্ঘ এক দশক পর এবার হয়তো তারা ভোট দিতে পারবে। কিন্তু সেবারও বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে দিল্লিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইন্ডিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২+২ সামিটে বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘কনটেইন’ করেছে বলে জোর গুঞ্জন আছে।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ বিনাভোটে অবৈধ কায়দায় ক্ষমতায় থাকলেই ভারত ও আমেরিকার স্বার্থ রক্ষিত হবে বলে ইন্ডিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশকে ‘নিরাপত্তা উদ্বেগ’ (সিকিউরিটি কনসার্ন) হিসেবে হাজির করে ভারত। ফলে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পিছু হটতে দেখেছি। এ নিয়ে ভারতের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিও বাংলাদেশের সমাজে ন্যায্য ক্ষোভ রয়েছে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘কনটেইন’ করতে পারাকে ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা তাদের বড় কূটনৈতিক ‘অর্জন’ হিসেবে দেখে থাকে।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বাইরে সবপক্ষই জঙ্গি বা মৌলবাদীÑএই প্রচারণা ও ভাবমূর্তি ইন্ডিয়ায় কতটা প্রবল, তা বোঝানোর জন্য একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ইন্ডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এ এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যার শিরোনামটা এমন : ‘Bangladesh Elections tug of War : Islamic Fundamentalism vs Democracy’; ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো কেন আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন বয়কট করেছে, তা বুঝতে না চেয়ে, উল্টো দাবি করা হয় আওয়ামী লীগের অধীনে যেনতেন উপায়ে একটা ডামি নির্বাচন করে ফেলাই (খোদ আওয়ামী লীগাররা গত নির্বাচনকে ‘ডামি নির্বাচন’ বলে থাকেন) ‘গণতন্ত্র’। আর যারা তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের দাবিতে এ ধরনের তামাশার নির্বাচনের বিরোধিতা করেছে তারা নাকি ‘ইসলামিক মৌলবাদী’। অর্থাৎ, আওয়ামী লীগের নির্বাচন ডাকাতির বিরোধিতা করলে যে কেউই ‘ইসলামিক মৌলবাদী’। এ যুক্তিপ্রণালি মোতাবেক সুষ্ঠু নির্বাচনপন্থি ও ফ্যাসিবাদবিরোধী একজন বাংলাদেশি হিন্দু নাগরিকও ‘ইসলামিক মৌলবাদী’।
বাংলাদেশে নির্বাচনীব্যবস্থা ভারতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হস্তক্ষেপে ভেঙে পড়েছে। এ কথা সত্য, নির্বাচন মাত্রই গণতন্ত্র নয়। তবু পাঁচ বছর অন্তর অন্তর নির্বাচনের অনিবার্যতা অস্বীকারের সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগকে স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় রাখতে বদ্ধপরিকর ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্ট বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি তার স্মৃতিকথা Coalition Years-এ কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই লিখেছেন ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার জন্য ভারতের হয়ে তিনি কী ভূমিকা রেখেছিলেন। তবু ২০০৮ সালের নির্বাচন মোটাদাগে সুষ্ঠু নির্বাচনই ছিল। মানুষ অন্তত ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন।
অতীত বাস্তবতা আমলে নিলে দেখা যায়, ভারত বরাবরই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বিকাশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এ কারণেই চব্বিশের অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে ভারতের হঠাৎ আগ্রহ সন্দেহ না করে উপায় নেই। নির্বাচনের জন্য চাপ প্রয়োগ করে ভারত বাংলাদেশের সংস্কার কার্যক্রম তথা গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাকে বানচাল করতে চায় কি নাÑ এমন প্রশ্ন তোলা যৌক্তিক।
গণতান্ত্রিক সংস্কার ছাড়া নির্বাচন মূলত ‘নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র’ ছাড়া আর কিছু নয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন করেছে। তারা প্রতিবেদন পেশ করা শুরু করেছে। প্রাপ্ত সুপারিশগুলো যাচাই-বাছাই করে এবং অংশীজনের মতো নিয়ে গণঅভ্যুত্থানের একটি চার্টার তৈরির কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ চার্টারই হতে পারে পরবর্তী নির্বাচিত গণপরিষদ বিতর্কের ভিত্তি দলিল।
বাতিল অবস্থায় টিকে থাকা বিদ্যমান সংবিধানের মাধ্যমেই বাংলাদেশে অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কাজেই নতুন একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করা গণঅভ্যুত্থানের প্রধান দাবি।
ভারত বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বিকাশ স্তব্ধ করতে চায়, সংস্কারহীন নির্বাচন আয়োজনের দাবির মাধ্যমে ভারত মূলত তার সে বাসনাই খোলাসা করেছে। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়িয়ে গেলে দক্ষিণ এশিয়ায় রোলমডেল ও স্বাভাবিক নেতৃত্বে পরিণত হবে। ভারতের শাসকগোষ্ঠীর জন্য তা বিরাট এক দুঃস্বপ্ন। যে কারণে গত জানুয়ারির আগে তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের বিরোধিতা করেছে; জুলাই অভ্যুত্থানের পর তারা রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কারের বিরোধিতা করছে একই কারণে। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে দিল্লির বাংলাদেশবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিকল্পনার সঙ্গে কোনো কোনো বৃহৎ রাজনৈতিক দলের অভ্যুত্থান-পরবর্তী অবস্থানের গভীর মিল লক্ষ করা যাচ্ছে।
আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, অভ্যুত্থানের পর ভারতকে হঠাৎই বিএনপির প্রতি বেশ নমনীয় ও দরদি দেখা যাচ্ছে। বিএনপিকে এতকাল ভারত রক্ষণশীল ও ইসলামি মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবেই বিবেচনা করে এসেছে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশÑএ দুটি দল মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ, ভারতীয় পত্রপত্রিকায় এমনই ছিল প্রচারণা। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে ‘পাকিস্তানি চর’ বলাই ছিল রেওয়াজ। ইদানীং দেখা যাচ্ছে জিয়াউর রহমানকে দেশপ্রেমিক, মুক্তিযোদ্ধা, সাহসী ও সৎ ইত্যাদি খেতাবে তারা ভূষিত করছে। ভূষিত খেতাবগুলোয় ভুল নেই, তবে খেতাব প্রদানের নিয়ত সুবিধার নয়।
দিল্লির এই হঠাৎ বিএনপিপ্রীতি নিরীহ কোনো ব্যাপার নয়। তাদের মুখে বিএনপি আর অন্তরে আওয়ামী লীগ। আমরা আশা করব বিএনপির নেতৃত্ব দিল্লির পাতা ফাঁদে পা দেবে না। ভুলে গেলে চলবে না, দিল্লির ফরমায়েশেই এখানে তিন তিনটি বিতর্কিত, একতরফা ও ডামি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। যার দরুন বিএনপি দীর্ঘ দুই দশক ক্ষমতার বাইরে থাকতে বাধ্য হয়েছে।
ভারতীয় সেনাপ্রধান বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘অনির্বাচিত’ তকমা দিয়ে ভারতীয় শাসকশ্রেণির বাংলাদেশ সম্পর্কিত মনোভাব পুনর্ব্যক্ত করেছেন মাত্র। প্রথমত, বর্তমান সরকার বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা কর্তৃক মনোনীত সরকার। এ সরকারের রয়েছে গণঅভ্যুত্থানের সর্বোচ্চ ম্যান্ডেট। গণসম্মতিই গণতন্ত্রের সারকথা। বর্তমান সরকার গঠনের ব্যাপারে বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ গণসম্মতি ছিল। বর্তমান সরকারের কোনো ভুল থাকলে অবশ্যই সমালোচনা করতে হবে। কিন্তু এ সরকারকে কোনোভাবেই জনসম্মতিহীন অর্থে ‘অনির্বাচিত’ সরকার বলা যায় না। দ্বিতীয়ত, ‘নির্বাচিত সরকার ছাড়া সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না’ বলার মধ্য দিয়ে ভারতীয় সেনাপ্রধান বুঝিয়ে দিলেন বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের অস্বাভাবিক সম্পর্ক চলছে। গণঅভ্যুত্থানে পতিত একটি দলকে অন্ধ সমর্থন করতে গিয়ে ভারতীয় শাসকশ্রেণি আবারও বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
যৌক্তিক সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশে নির্বাচন হবে। তার আগে হতে হবে কাঠামোগত ও সাংবিধানিক সংস্কার। বাংলাদেশের নির্বাচন প্রশ্নে ভারতের অতি আগ্রহ সন্দেহের চোখে দেখা দরকার। মাত্র এক বছর আগে যারা সক্রিয়ভাবে বিরোধিতা করে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন বানচাল করেছে এবং আওয়ামী লীগকে ডামি নির্বাচন আয়োজনে সহায়তা করেছে, তাদের এই হঠাৎ নির্বাচনপ্রীতি খুব সহজ ব্যাপার নয়।
তড়িঘড়ি করে ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে রাজনৈতিক দলগুলো ভারতের টোপ গিলবে না, বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ তা প্রত্যাশা করে।
নির্বাচনের ব্যাপারে দিল্লির অতি আগ্রহ উছিলা মাত্র। স্বনির্ভর ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের উত্থানের বিরোধিতার দিকেই দিল্লির মূল নজর। চব্বিশের জানুয়ারিতে অর্থবহ নির্বাচন না চাওয়া আর জুলাইয়ে এসে সংস্কার না চাওয়া, একই সূত্রে গাঁথা। দিল্লির পরোক্ষ উপনিবেশ হয়ে থাকার জন্য স্বাধীন বাংলাদেশের আবির্ভাব ঘটেনি।
লেখক : লেখক ও চিন্তক
যুগ্ম আহ্বায়ক, জাতীয় নাগরিক কমিটি
ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানের পর ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কে নতুন বাঁকবদল লক্ষ করা যাচ্ছে। ভারতীয় মিডিয়া থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারক পর্যায় পর্যন্ত বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতির ব্যাপারে অত্যন্ত নেতিবাচক প্রচারণায় লিপ্ত। স্রেফ ভুল তথ্য নয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সচেতন মিথ্যা তথ্য বা অপতথ্য তারা প্রচার করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থানকে ভারত কোন দৃষ্টিতে দেখে, তা এসব প্রচারণা থেকে আঁচ করা যায়।
এর মধ্যে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম, সুশীলসমাজ এবং রাজনৈতিক পরিসরে সম্প্রতি আরেকটি বিশেষ আলোচনা বেশ জায়গা করে নিয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন কবে হবেÑ এই প্রশ্নে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বেশ উচ্চকিত। এমনকি সম্প্রতি ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী পর্যন্ত মন্তব্য করেছেন, নির্বাচিত সরকার না এলে বাংলাদেশের সঙ্গে নাকি ভারতের সম্পর্ক ‘স্বাভাবিক’ হবে না।
বলাবাহুল্য, ভারতের এ অবস্থান একই সঙ্গে রহস্যজনক ও কৌতুকপ্রদ। কারণ বাংলাদেশে গত তিনটি জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু না হওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের আগে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে এসে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য করেছিলেন। দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত একপেশে ও অবৈধ ওই নির্বাচন বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল বয়কট করেছিল।
২০২৪ সালের নির্বাচন যেন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, সে জন্য আওয়ামী লীগকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছু চাপ প্রয়োগ করেছিল। এর পেছনে এ অঞ্চলে তাদের ভূরাজনৈতিক বিবেচনাই ছিল প্রধান। তবু বাংলাদেশের মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিল, দীর্ঘ এক দশক পর এবার হয়তো তারা ভোট দিতে পারবে। কিন্তু সেবারও বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে দিল্লিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইন্ডিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২+২ সামিটে বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘কনটেইন’ করেছে বলে জোর গুঞ্জন আছে।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ বিনাভোটে অবৈধ কায়দায় ক্ষমতায় থাকলেই ভারত ও আমেরিকার স্বার্থ রক্ষিত হবে বলে ইন্ডিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশকে ‘নিরাপত্তা উদ্বেগ’ (সিকিউরিটি কনসার্ন) হিসেবে হাজির করে ভারত। ফলে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পিছু হটতে দেখেছি। এ নিয়ে ভারতের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিও বাংলাদেশের সমাজে ন্যায্য ক্ষোভ রয়েছে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘কনটেইন’ করতে পারাকে ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা তাদের বড় কূটনৈতিক ‘অর্জন’ হিসেবে দেখে থাকে।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বাইরে সবপক্ষই জঙ্গি বা মৌলবাদীÑএই প্রচারণা ও ভাবমূর্তি ইন্ডিয়ায় কতটা প্রবল, তা বোঝানোর জন্য একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ইন্ডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এ এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যার শিরোনামটা এমন : ‘Bangladesh Elections tug of War : Islamic Fundamentalism vs Democracy’; ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো কেন আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন বয়কট করেছে, তা বুঝতে না চেয়ে, উল্টো দাবি করা হয় আওয়ামী লীগের অধীনে যেনতেন উপায়ে একটা ডামি নির্বাচন করে ফেলাই (খোদ আওয়ামী লীগাররা গত নির্বাচনকে ‘ডামি নির্বাচন’ বলে থাকেন) ‘গণতন্ত্র’। আর যারা তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের দাবিতে এ ধরনের তামাশার নির্বাচনের বিরোধিতা করেছে তারা নাকি ‘ইসলামিক মৌলবাদী’। অর্থাৎ, আওয়ামী লীগের নির্বাচন ডাকাতির বিরোধিতা করলে যে কেউই ‘ইসলামিক মৌলবাদী’। এ যুক্তিপ্রণালি মোতাবেক সুষ্ঠু নির্বাচনপন্থি ও ফ্যাসিবাদবিরোধী একজন বাংলাদেশি হিন্দু নাগরিকও ‘ইসলামিক মৌলবাদী’।
বাংলাদেশে নির্বাচনীব্যবস্থা ভারতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হস্তক্ষেপে ভেঙে পড়েছে। এ কথা সত্য, নির্বাচন মাত্রই গণতন্ত্র নয়। তবু পাঁচ বছর অন্তর অন্তর নির্বাচনের অনিবার্যতা অস্বীকারের সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগকে স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় রাখতে বদ্ধপরিকর ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্ট বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি তার স্মৃতিকথা Coalition Years-এ কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই লিখেছেন ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার জন্য ভারতের হয়ে তিনি কী ভূমিকা রেখেছিলেন। তবু ২০০৮ সালের নির্বাচন মোটাদাগে সুষ্ঠু নির্বাচনই ছিল। মানুষ অন্তত ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন।
অতীত বাস্তবতা আমলে নিলে দেখা যায়, ভারত বরাবরই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বিকাশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এ কারণেই চব্বিশের অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে ভারতের হঠাৎ আগ্রহ সন্দেহ না করে উপায় নেই। নির্বাচনের জন্য চাপ প্রয়োগ করে ভারত বাংলাদেশের সংস্কার কার্যক্রম তথা গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাকে বানচাল করতে চায় কি নাÑ এমন প্রশ্ন তোলা যৌক্তিক।
গণতান্ত্রিক সংস্কার ছাড়া নির্বাচন মূলত ‘নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র’ ছাড়া আর কিছু নয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন করেছে। তারা প্রতিবেদন পেশ করা শুরু করেছে। প্রাপ্ত সুপারিশগুলো যাচাই-বাছাই করে এবং অংশীজনের মতো নিয়ে গণঅভ্যুত্থানের একটি চার্টার তৈরির কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ চার্টারই হতে পারে পরবর্তী নির্বাচিত গণপরিষদ বিতর্কের ভিত্তি দলিল।
বাতিল অবস্থায় টিকে থাকা বিদ্যমান সংবিধানের মাধ্যমেই বাংলাদেশে অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কাজেই নতুন একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করা গণঅভ্যুত্থানের প্রধান দাবি।
ভারত বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বিকাশ স্তব্ধ করতে চায়, সংস্কারহীন নির্বাচন আয়োজনের দাবির মাধ্যমে ভারত মূলত তার সে বাসনাই খোলাসা করেছে। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়িয়ে গেলে দক্ষিণ এশিয়ায় রোলমডেল ও স্বাভাবিক নেতৃত্বে পরিণত হবে। ভারতের শাসকগোষ্ঠীর জন্য তা বিরাট এক দুঃস্বপ্ন। যে কারণে গত জানুয়ারির আগে তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের বিরোধিতা করেছে; জুলাই অভ্যুত্থানের পর তারা রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কারের বিরোধিতা করছে একই কারণে। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে দিল্লির বাংলাদেশবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিকল্পনার সঙ্গে কোনো কোনো বৃহৎ রাজনৈতিক দলের অভ্যুত্থান-পরবর্তী অবস্থানের গভীর মিল লক্ষ করা যাচ্ছে।
আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, অভ্যুত্থানের পর ভারতকে হঠাৎই বিএনপির প্রতি বেশ নমনীয় ও দরদি দেখা যাচ্ছে। বিএনপিকে এতকাল ভারত রক্ষণশীল ও ইসলামি মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবেই বিবেচনা করে এসেছে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশÑএ দুটি দল মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ, ভারতীয় পত্রপত্রিকায় এমনই ছিল প্রচারণা। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে ‘পাকিস্তানি চর’ বলাই ছিল রেওয়াজ। ইদানীং দেখা যাচ্ছে জিয়াউর রহমানকে দেশপ্রেমিক, মুক্তিযোদ্ধা, সাহসী ও সৎ ইত্যাদি খেতাবে তারা ভূষিত করছে। ভূষিত খেতাবগুলোয় ভুল নেই, তবে খেতাব প্রদানের নিয়ত সুবিধার নয়।
দিল্লির এই হঠাৎ বিএনপিপ্রীতি নিরীহ কোনো ব্যাপার নয়। তাদের মুখে বিএনপি আর অন্তরে আওয়ামী লীগ। আমরা আশা করব বিএনপির নেতৃত্ব দিল্লির পাতা ফাঁদে পা দেবে না। ভুলে গেলে চলবে না, দিল্লির ফরমায়েশেই এখানে তিন তিনটি বিতর্কিত, একতরফা ও ডামি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। যার দরুন বিএনপি দীর্ঘ দুই দশক ক্ষমতার বাইরে থাকতে বাধ্য হয়েছে।
ভারতীয় সেনাপ্রধান বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘অনির্বাচিত’ তকমা দিয়ে ভারতীয় শাসকশ্রেণির বাংলাদেশ সম্পর্কিত মনোভাব পুনর্ব্যক্ত করেছেন মাত্র। প্রথমত, বর্তমান সরকার বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা কর্তৃক মনোনীত সরকার। এ সরকারের রয়েছে গণঅভ্যুত্থানের সর্বোচ্চ ম্যান্ডেট। গণসম্মতিই গণতন্ত্রের সারকথা। বর্তমান সরকার গঠনের ব্যাপারে বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ গণসম্মতি ছিল। বর্তমান সরকারের কোনো ভুল থাকলে অবশ্যই সমালোচনা করতে হবে। কিন্তু এ সরকারকে কোনোভাবেই জনসম্মতিহীন অর্থে ‘অনির্বাচিত’ সরকার বলা যায় না। দ্বিতীয়ত, ‘নির্বাচিত সরকার ছাড়া সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না’ বলার মধ্য দিয়ে ভারতীয় সেনাপ্রধান বুঝিয়ে দিলেন বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের অস্বাভাবিক সম্পর্ক চলছে। গণঅভ্যুত্থানে পতিত একটি দলকে অন্ধ সমর্থন করতে গিয়ে ভারতীয় শাসকশ্রেণি আবারও বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
যৌক্তিক সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশে নির্বাচন হবে। তার আগে হতে হবে কাঠামোগত ও সাংবিধানিক সংস্কার। বাংলাদেশের নির্বাচন প্রশ্নে ভারতের অতি আগ্রহ সন্দেহের চোখে দেখা দরকার। মাত্র এক বছর আগে যারা সক্রিয়ভাবে বিরোধিতা করে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন বানচাল করেছে এবং আওয়ামী লীগকে ডামি নির্বাচন আয়োজনে সহায়তা করেছে, তাদের এই হঠাৎ নির্বাচনপ্রীতি খুব সহজ ব্যাপার নয়।
তড়িঘড়ি করে ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে রাজনৈতিক দলগুলো ভারতের টোপ গিলবে না, বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ তা প্রত্যাশা করে।
নির্বাচনের ব্যাপারে দিল্লির অতি আগ্রহ উছিলা মাত্র। স্বনির্ভর ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের উত্থানের বিরোধিতার দিকেই দিল্লির মূল নজর। চব্বিশের জানুয়ারিতে অর্থবহ নির্বাচন না চাওয়া আর জুলাইয়ে এসে সংস্কার না চাওয়া, একই সূত্রে গাঁথা। দিল্লির পরোক্ষ উপনিবেশ হয়ে থাকার জন্য স্বাধীন বাংলাদেশের আবির্ভাব ঘটেনি।
লেখক : লেখক ও চিন্তক
যুগ্ম আহ্বায়ক, জাতীয় নাগরিক কমিটি
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
২১ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
২১ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
২১ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
২ দিন আগে