আনুগত্যের পরীক্ষায় ভারতের মুসলমান

নাবিয়া খান
প্রকাশ : ২৭ মে ২০২৫, ০৯: ৩৭

ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের পেহেলগামে গত ২২ এপ্রিল পর্যটকদের ওপর হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর থেকে দেশটির বিভিন্ন স্থানে মুসলিমবিদ্বেষী ঘৃণাসূচক অনেক ঘটনা ঘটেছে।

পেহেলগাম হামলা-পরবর্তী দুই সপ্তাহে সারা ভারতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণাসূচক ১৮৪টি ঘটনা তালিকাভুক্ত করেছে দিল্লিভিত্তিক নাগরিক অধিকার সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রটেকশন অব সিভিল রাইটস। এসব ঘটনার প্রায় অর্ধেকগুলোয়ই মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণাসূচক বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। অন্য ঘটনাগুলোয় ভয়ভীতি প্রদর্শন, হয়রানি, শারীরিক লাঞ্ছনা, বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর, হুমকি প্রদান, গালাগাল ও তিনজনকে হত্যার ঘটনা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

১৮৪টি ঘটনার মধ্যে শতাধিক ঘটনাই পেহেলগাম হামলাকে ইস্যু করে ঘটানো হয়েছে বলে জানিয়েছে সংগঠনটি। এসব ঘটনা আগের মতো সাধারণ মুসলিমবিদ্বেষী সহিংসতার চেয়েও অনেক বেশি ভয়ানক রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করেছে, যা ভারতের মুসলমানদের জন্য পরিস্থিতিকে আরো বিপজ্জনক করে তুলবে।

ভারত পেহেলগাম হামলার জন্য পাকিস্তান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে দায়ী করে ৭ মে দেশটির কয়েকটি স্থানে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। নরেন্দ্র মোদির সরকার এই সামরিক অভিযানের নাম দেয় ‘অপারেশন সিঁদুর’। কিন্তু পাকিস্তান ভারতের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান এবং ৯ মে ভারতে পাল্টা হামলা করে। পাল্টাপাল্টি এই হামলাকে কেন্দ্র করে চিরবৈরী দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হলেও শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপে দুই দেশই যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়।

এরপর পরিস্থিতি শান্ত হলেও পেহেলগাম হামলাকে ইস্যু করে ভারতে মুসলমানদের হুমকি, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা অনেক বেড়ে যায়। এতে বড় ভূমিকা রাখে কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলো। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুসলিমবিরোধী ঘৃণাসূচক বক্তব্য-বিবৃতি প্রচার করতে থাকে। তারা ভারতের মুসলমানদের ‘বহিরাগত’, ‘অনুপ্রবেশকারী’ ও ‘বিশ্বাসঘাতক’ অভিহিত করে সামাজিক উত্তেজনা তৈরিতে ইন্ধন জোগায়।

অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরের নিরাপত্তা ব্যর্থতার জন্য সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর পরিবর্তে পাকিস্তানে পরিচালিত অপারেশন সিঁদুরকে উপজীব্য করে ভারতের মুসলমানদের দেশপ্রেম নিয়েও প্রশ্ন তোলা হতে থাকে। অথচ ভারতের মুসলমানরা সবাই পেহেলগাম হামলার নিন্দা করেছেন।

ঐতিহাসিকভাবেই যখনই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক বা কূটনৈতিক কোনো সংকট বা সংঘাত সৃষ্টি হয়, তখনই ভারতের মুসলমানদের এর জন্য সামাজিক, রাজনৈতিক ও মানসিকভাবে এর মূল্য দিতে হয়। এখন ভারতে যা ঘটছে, তা ব্যতিক্রম বা নতুন কিছু নয়, মুসলিমবিরোধী প্রচারণাই ধারাবাহিকতা মাত্র।

লেখক হোসেইন হায়দারি সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আইকে বলেছেন, ‘যুগ যুগ ধরে ভারতের বিপুলসংখ্যক মানুষ দেশটির মুসলমানদের পাকিস্তানি হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোকে তারা ‘মিনি পাকিস্তান’ বলে। যখনই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কোনো ক্রিকেট ম্যাচ হয়, তখনই ভারতের মুসলমানদের পাকিস্তানের সমর্থক আখ্যা দিয়ে নানা ধরনের বিদ্রুপ করা হয়; বলা হয়, ‘তোমরা পাকিস্তানে চলে যাও।’

তিনি আরো বলেন, ‘মোটকথা, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে কোনো ধরনের উত্তেজনা হলেই ভারতে দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমানদের যতভাবে সম্ভব হেনস্তা করা হয়। ভারতের মুসলমানদের কাছে এসব নতুন কোনো বিষয় নয়। এর কারণ হচ্ছে, ভারতে মুসলিমবিরোধী বৈষম্যমূলক আচরণের একটি সাংস্কৃতিক কাঠামো অনেক আগে থেকেই তৈরি হয়ে আছে।’

বর্তমানে এ ধরনের পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। সম্প্রতি হরিয়ানা রাজ্যের আম্বালা এলাকায় উগ্রপন্থি কতিপয় হিন্দু ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান দিয়ে মুসলমানদের দোকানপাটে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে সুসংগঠিতভাবে মুসলমানদের ওপর হামলা এবং তাদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করছে। তাদের এই আগ্রাসী আচরণ দিন দিনই আরো ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। মুসলমানদের ওপর হামলা এবং তাদের সম্পদের ক্ষতিসাধন করেই থেমে থাকছে না উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা, বরং রাষ্ট্রীয়ভাবেই ভারতের মুসলমানদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হচ্ছে নতুন নতুন আইন তৈরি করে। এসব আইনের কারণে ভারতের মুসলমানদের নাগরিকত্বের ধারণাই পাল্টে দেওয়া হচ্ছে। যুগ যুগ ধরে ভারতে বসবাস করা মুসলিম পরিবারগুলোর নাগরিকত্বকে সন্দেহের আবর্তে ফেলা দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে। এখন মুসলমানদের প্রমাণ করতে হবে, তারা আসলেই ভারতের নাগরিক কি না।

আর এই পরিস্থিতি হঠাৎ করে তৈরি হয়নি; বরং মুসলমানদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে বছরের পর বছর ধরে গভীর পরিকল্পনার মাধ্যমে। ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী শাসকগোষ্ঠী দেশটির মুসলমানদের বিরুদ্ধে এটি একটি আদর্শিক লড়াই হিসেবে গ্রহণ করেছে অনেক আগে থেকে। এটাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে এই বিতর্ক ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি টেলিভিশন বিতর্ক, রাজনৈতিক বক্তব্য, হোয়াটসঅ্যাপ ম্যাসেজ ও অনলাইন প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে মুসলমানদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়েছে সুপরিকল্পিতভাবে।

পেহেলগাম হামলার পর এটা আরো বেশি চাঙা করা হয়েছে সারা ভারতে। এখন প্রতিদিনই মুসলমানদের দেশের প্রতি তাদের আনুগত্যের প্রমাণ দিতে হচ্ছে। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যেকোনো সংঘাতই ভারতের মুসলমানদের নতুন করে অনানুষ্ঠানিক পরীক্ষার মুখে ফেলে। এ সম্পর্কে বিশ্লেষক সারা আখতার সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আইকে বলেন, ‘এখন মুসলমানদের কেবল ভারতকে সমর্থন করলেই হবে না, তাদের পাকিস্তানের নিন্দাও করতে হবে। আমরা প্রতিনিয়ত অসংখ্য ভিডিও দেখি, যেখানে সাংবাদিকরা ভারতের এবং অধিকৃত কাশ্মীরের মুসলমানদের মুখের কাছে মাইক্রোফোন নিয়ে পাক-ভারত সংঘাত সম্পর্কে তাদের মন্তব্য জানতে চান। এটা মোটেও দেশপ্রেমের পরিচয় নয়, বরং মুসলমানদের হয়রানি ও টার্গেটে পরিণত করার একটা চেষ্টা মাত্র।’

জাতীয়তাবাদী এই চেতনাকে কার্যত মুসলমানদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করার একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। একটি মানদণ্ড তৈরি করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে একজন মুসলমান তাদের কাছে ‘গ্রহণযোগ্য’ কি না, সেটা নির্ধারণ করা হবে। এর মাধ্যমে একটা স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হচ্ছে—যদি তুমি কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের কাছে ‘গ্রহণযোগ্য’ একজন মুসলিম হতে চাও, তাহলে তোমাকে তাদের নির্ধারণ করা মানদণ্ড মেনে চলতে হবে। অন্যথায় তুমি হবে পাকিস্তানের সমর্থক, একজন সন্ত্রাসী বা এর চেয়েও খারাপ কিছু। চাপিয়ে দেওয়ার এই চেষ্টার বিরুদ্ধে যারাই যাবে, তাদের হুমকি, হয়রানি, মারধর ও অন্যান্য সহিংসতার শিকার হতে হবে।

সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটা হচ্ছে তা হলো, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটিও করছে না। বিরোধী দলগুলো মুসলমানদের ঘৃণাসূচক বক্তব্য প্রদান ও হয়রানি করার ক্রমবর্ধমান এই প্রবণতাকে এড়িয়ে চলছে। এসব দল মনে করে, তারা এসব নিয়ে কথা বললে জনগণ তাদেরও সন্দেহ করবে। এমনকি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর দিক থেকেও তারা সন্দেহের চোখে থাকবেন।

এ ধরনের পরিস্থিতিই ভারতে মুসলিমবিরোধী ঘৃণাসূচক বক্তব্য-বিবৃতিকে একটি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আইনকেও কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে কৌশলে। সবকিছুই করা হচ্ছে দেশপ্রেমের তকমা লাগিয়ে। চলতি মাসের প্রথম দিকে স্থানীয় এক সাংবাদিক এক মুসলিমকে ‘পাকিস্তানি’ আখ্যা দিয়ে তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার পর ওই মুসলিম মনের দুঃখে আত্মহত্যা করেন। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর কথিত ওই সাংবাদিক পালিয়ে যান।

ভারতের মুসলমানরা রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত কি না, সেটি এখন বড় প্রশ্ন নয়; বরং এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে—ভারত তার মুসলিম নাগরিকদের দেশপ্রেম ও সীমাহীন আনুগত্যের পরীক্ষা ও সন্দেহের আবর্তে না ফেলে দেশের প্রকৃত নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করবে কি না। যে গণতন্ত্র ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকদের আনুগত্যের পরীক্ষা নেয়, সেটা কোনোভাবেই প্রকৃত গণতন্ত্র হতে পারে না। কিন্তু ভারতে এখন সেই গণতন্ত্রই চলছে। এই গণতন্ত্রে দেশটির মুসলমানদের তাদের আনুগত্যের পরীক্ষা দিয়ে যেতেই হবে। হুমকির মুখেই থাকবে তাদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা।

লেখক : ভারতীয় কবি ও গবেষক

মিডল ইস্ট আই থেকে অনুবাদ : মোতালেব জামালী

বিষয়:

কাশ্মীর
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত