স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ-ভারত প্রথম সম্মুখযুদ্ধের অজানা কথা

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মুহম্মদ মুজিবুর রহমান
প্রকাশ : ২৭ মার্চ ২০২৫, ১২: ৫০

সময়টি ছিল ১৯৮২ সালের মার্চের মাঝামাঝি । জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসন জারির কয়েক দিন আগের ঘটনা। পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান দুষ্কৃতিবিরোধী অভিযান ‘Operation Pouncing Tiger’ তখন তুঙ্গে।

আমি তখন নবীন ক্যাপ্টেন হিসেবে বান্দরবান জেলার রুমা গ্যারিসনে মোতায়েনরত ২৪ ইস্ট বেঙ্গলে কর্মরত। ভারতের প্রচ্ছন্ন মদতে তথাকথিত ‘শান্তিবাহিনী’র দুষ্কৃতকারীদের অপতৎপরতা তখন বেশ জোরেশোরে চলছিল। সীমান্তের অপর পাড়ে স্থাপিত ঘাঁটিগুলো থেকে এসে তারা স্থানীয় জনগণের ওপর নানা ধরনের নিপীড়ন, চাঁদাবাজি, অপহরণ, ছিনতাই ও ডাকাতির পাশাপাশি প্রায়ই নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছিল।

বিজ্ঞাপন

p-11

দেশমাতৃকার সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষার মূল দায়িত্বে নিয়োজিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও তাই দুষ্কৃতকারীদের সমূলে ধ্বংস ও স্থানীয় জনগণের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য বেশ সক্রিয় ছিল। এমনই এক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে ‘দুর্জয় চব্বিশ’-এর একটি অনন্যসাধারণ টহল অভিযানে আমি শামিল হই। অনন্যসাধারণ এজন্য যে, সামরিক ভাষায় উদ্ভূত ঘটনাটি ‘Being a tactical-level engagement, it had a profound effect at the strategic level,’ অর্থাৎ এর প্রভাব পড়েছিল সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে।

পটভূমি

রুমা জোনের দায়িত্বপূর্ণ এলাকা বান্দরবান জেলার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ভারত (মিজোরাম) ও মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক সীমারেখা পর্যন্ত এ অঞ্চল বিস্তৃত ছিল। এ অঞ্চলে তখনো কোনো যৌথ সার্ভে হয়নি বলে ওই সময় ওই দুদেশের সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমানা অচিহ্নিত ছিল। ফলে এই অঞ্চলে কোনো দেশেরই কোনো সীমান্তরক্ষী বা বর্ডার গার্ড মোতায়েন ছিল না। র‌্যাংখিয়াং ও থেগা রেঞ্জ দুটির উচ্চতা তিন হাজার ফুটের কম নয়। এ দুটির মাঝামাঝি অপেক্ষাকৃত নিচু উপত্যকা এলাকা দিয়ে আঁকাবাঁকা পথে বয়ে গেছে খরস্রোতা র‌্যাংখিয়াং খাল। অসংখ্য পাহাড়ি ঝরনা ও ‘ছড়া’ দুপাশের পাহাড়গুলো থেকে এসে পড়েছে ওই খালটিতে। এমনই একটির সঙ্গমস্থল ‘উল্লুছরিমুখ’ এলাকায় আন্তর্জাতিক সীমারেখা থেকে প্রায় আট কিলোমিটার ভেতরে ছিল ঘটনাস্থলটি ।

অভিযান পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি

গোয়েন্দা সূত্রে খবর আসে, ভারতের মিজোরাম সীমান্তে তৎপর একদল শান্তিবাহিনী নিয়মিতভাবে উল্লুছরিমুখ এলাকায় বসবাসরত ছয়-সাতটি তঞ্চঙ্গ্যা চাকমা পরিবারের মাধ্যমে রুমা বাজার থেকে খাদ্য ও রসদপত্র সংগ্রহ করে থাকে। বস্তুত রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকায় অনুমোদন ছাড়া কোনো ধরনের বসতি স্থাপন করা বেআইনি। Counter Insurgency Operations-এর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো দুষ্কৃতকারীদের জনবিচ্ছিন্ন ও জীবিকা-সরবরাহ থেকে বঞ্চিত করা।

সেই উদ্দেশ্যে রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকা থেকে উল্লিখিত শান্তিবাহিনী সমর্থক (Sympathizer) গোষ্ঠীকে উৎখাত করে রুমার নিকটবর্তী স্থানে পুনর্বাসন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এ লক্ষ্যে ব্রিগেড সদরের অনুমোদনক্রমে রুমা থেকে একটি দীর্ঘমেয়াদি টহল পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক মেজর কামরুল আলমকে দলনেতা এবং আমাকে দলের উপনেতা করে মোট ৬৫ জনের একটি টহলদল গঠন করা হয়।

মেডিকেল সাপোর্ট প্রদানের জন্য ডাক্তার ক্যাপ্টেন গোলাপকেও টহলে শামিল করা হয়। দলে আরো ছিলেন দুই জেসিও এবং অন্যান্য পদবির ৬০ সৈনিক। একটি প্লাটুনের প্রাপ্য সব হাতিয়ার ছাড়াও দলটিতে একটি ক্ষুদ্র মর্টার ডিটাচমেন্ট, প্রয়োজনীয় মেডিকেল ও প্রশাসনিক গ্রুপ এবং ১০ ‘পোর্টার’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রত্যেকে পর্যাপ্ত অ্যামোনিশন, হ্যান্ডগ্রেনেড ও পিঠে বহনযোগ্য প্যাকে ব্যক্তিগত পোশাকাদি বহন করছিল। পুরো টহলটি এক সপ্তাহের রসদে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল।

p-12

যাত্রা শুরু

১৬ মার্চ ১৯৮২, মঙ্গলবার, ভোর ৬টায় আমরা রুমা থেকে যাত্রা শুরু করি। সন্ধ্যার আগেই আমরা মুন্নমপাড়া নামক বোম্ উপজাতি-অধ্যুষিত একটি পাড়ায় পৌঁছাই এবং এর সন্নিকটে রাতযাপনের সিদ্ধান্ত নেই। বস্তুত এ পাড়াটিই ছিল এ এলাকার সর্বশেষ জনবসতি! পরদিন আমরা আবার পথচলা শুরু করি। ২ হাজার ৮০০ ফুটের কাছাকাছি উচ্চতার র‌্যাংখিয়াং রেঞ্জ অতিক্রম করা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। কোনো সুস্পষ্ট পাহাড়ি পথ নেই, তার ওপর কিছু কিছু স্থানে চলার পথ এমনই খাড়া যে ২০-২৫ ফুট উচ্চতা আমাদের বাঁশ অথবা মোটা রশি ব্যবহার করে বাদুড়ঝোলা হয়ে উঠতে হয়েছিল!

বেইজ-ক্যাম্প স্থাপন

সন্ধ্যার কিছু পর আমরা র‌্যাংখিয়াং খালের পশ্চিম পাশে একটি টিলায় পৌঁছালাম এবং সেখানে বেইজ-ক্যাম্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।

পরিকল্পনা চূড়ান্তকরণ

রাতে আমাদের উপ-দলনেতাদের নিয়ে আসন্ন অভিযানের কার্যপদ্ধতি চূড়ান্ত করতে বসলাম। সিদ্ধান্ত হলো আমাদের পুরো টহল দলটিকে তিন ভাগে ভাগ করা হবে। ২৫ জনের একটি চৌকস দল আমার নেতৃত্বে ‘স্ট্রাইকিং গ্রুপ’ হিসেবে ভোর হওয়ার আগেই টার্গেট এলাকাটিকে ঘিরে ফেলবে এবং আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে ওই বসতি এলাকার সবাইকে এক জায়গায় একত্র করে এলাকাটি তন্নতন্ন করে তল্লাশি করবে। সবকিছু ঠিক থাকলে এলাকাটিকে বাস-অনুপযোগী করে ও ‘সিম্পেথাইজার’ গ্রুপটিকে সঙ্গে নিয়ে আমরা বেইজ-ক্যাম্পে ফিরব এবং পরে সবাই একত্রভাবে রুমায় প্রত্যাবর্তন করব।

২০ জনের দ্বিতীয় গ্রুপটি সুবেদার নাজিম উদ্দিন, বীর প্রতীকের নেতৃত্বে লক্ষ্যবস্তুর উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত উল্লুছড়ি খালের মুখে একটি ‘ব্লকিং পজিশন’ তৈরি করবে। প্রয়োজনে স্ট্রাইকিং গ্রুপকে যেকোনো ধরনের সহায়তা প্রদানের জন্যও প্রস্তুত থাকবে। অবশিষ্ট ২০ জনের তৃতীয় দলটি মূলত প্রশাসনিক। এ দলটি দলাধিনায়ক মেজর কামরুলের অধীনে বেইজ-ক্যাম্প এলাকায় থেকেই অভিযানটি নিয়ন্ত্রণ করবে। এ দল একটি অস্থায়ী হেলিপ্যাডও তৈরি করবে। জরুরি মেডিকেল সহায়তা প্রদানের জন্য আমার দলের সঙ্গে একজন ‘মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট’ সংযুক্ত করা হয়।

রাত ৩টায় যাত্রার সময় নির্ধারণ করা হয় এবং সে অনুসারে সবার ঘড়ি সমন্বয় করা হয়।

লক্ষ্যবস্তু অভিমুখে যাত্রা

১৮ই মার্চ ১৯৮২, রোজ বৃহস্পতিবার নির্ধারিত সময়েই আমরা সবকটি দল বেইজ-ক্যাম্প ত্যাগ করি। মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় হলেও পার্বত্য এই এলাকায় তখনও শীতের আমেজ কিছুটা ছিল।

সন্দেহজনক আগুন!

ভোর আনুমানিক সাড়ে ৪টায় আমরা যখন শেষের একটি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে র‌্যাংখিয়াং খালের দিকে নামছিলাম (বেইজ-ক্যাম্প থেকে প্রায় ২.৫ কিলোমিটার), তখন অনেকটা হঠাৎ করেই আমি সামনে নিচের সমভূমি এলাকায় একটি উন্মুক্ত আলো দেখতে পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমি টহলদলকে থামতে ও কাভার নিতে সংকেত দিলাম। দেখলাম, আমার কাছ থেকে প্রায় ১৫০ গজ দূরে পাহাড়টির পাদদেশে খড়কুটো জ্বালিয়ে কে একজন শীত নিবারণের চেষ্টা করছে! আগুনের আবছায়ায় লোকটির চেহারা বা অন্যান্য বিবরণ মোটেই বোঝা যাচ্ছিল না।

আরো সুস্পষ্টভাবে বোঝার জন্য টহলকে ওই অবস্থানে থাকার জন্য ইশারা করে আমি একা অতি সন্তর্পণে নিচের দিকে নামতে লাগলাম। যেহেতু আমি কেবল একজন লোকের অবয়ব দেখতে পাচ্ছিলাম, তাই ধরে নিয়েছিলাম, সে ওই ‘সিম্পেথাইজার’ গ্রুপের একজন হবে, কোনো কাজে বেরিয়েছে। আমি সন্তর্পণেই টিলাটির পাদদেশে একটি ছোট্ট ঝোপের পেছনে পৌঁছালাম, আমার কাছ থেকে ব্যক্তিটির দূরত্ব তখন ৫০ গজের মতো হবে।

ওই অবস্থান থেকেই আমি ব্যক্তিটিকে চ্যালেঞ্জ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমাকে সতর্ক করল, যদি ব্যক্তিটি সশস্ত্র হয় ও ফায়ার করে? কাভার নেওয়া জরুরি বিবেচনায় আশেপাশে নজর দিতেই আমার ডান দিকে কেবল ১০ কদম দূরে একটি বিশালকায় ‘গামারী’ গাছ দেখতে পেলাম। কালবিলম্ব না করে ওই গাছের পেছনে আড় নেওয়ার জন্য আমি কয়েক লাফে সেদিকে গেলাম।

সংঘর্ষ

কে জানত ওইখানে আমার জন্য বড় ধরনের একটা বিস্ময় অপেক্ষা করছিল! গাছের আড়াল থেকে যেই না আমি অগ্নিকুণ্ডের পাশের ব্যক্তিটির দিকে অস্ত্র তাক্ করব, তখন অতিশয় বিস্ময়ে দেখলাম গাছটির পেছনে কিঞ্চিৎ ডানে কেবল পাঁচ-ছয় গজ তফাতে বাঁশ-ছন দিয়ে তৈরি একটি অস্থায়ী ছাউনি এবং তারই ডান কোনায় দণ্ডায়মান জলপাই রঙের ইউনিফর্ম পড়া সশস্ত্র এক ব্যক্তি! বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সে সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে আছে, তার কাঁধে একটি এসএলআর অস্ত্র ঝোলানো! আবছা অন্ধকার ও গাছটির কারণে ওই ব্যক্তি বা ছাউনিটিকে আগে দেখা যায়নি।

বিস্ময়ের ঘোর কেটে যেতেই ওই ব্যক্তি মুহূর্তে তার রাইফেলটি কাঁধ থেকে হাতে নামিয়ে আমার দিকে ওঠানোর চেষ্টা করল। আমি তো প্রস্তুতই ছিলাম। তৎক্ষণাৎ আমার এসএমজিটি মোটামুটি তার দিক করে ট্রিগার টিপলাম। জলপাই রঙের ইউনিফর্ম, অস্ত্র ও ছাউনির ধরন দেখে ধরেই নিয়েছিলাম এরা শান্তিবাহিনী। আমার অস্ত্র থেকে একটিমাত্র গুলি বের হলো এবং সেন্ট্রিটি চিৎকার দিয়ে অস্ত্রসহ মাটিতে পড়ে গেল। এর পরপরই সমস্ত বনভূমি যেন হঠাৎই জেগে উঠল—চারদিকে চিৎকার, দৌড়াদৌড়ি ও ফায়ারিংয়ের আওয়াজ শুরু হলো!

অগ্নিকুণ্ডের কাছ থেকে একটি এলএমজি ক্ষণে ক্ষণে বার্স্ট ফায়ার করতে লাগল। অন্যান্য দিক থেকেও ক্ষুদ্রাস্ত্রের ফায়ারিংয়ের আওয়াজ আসছিল। আমি দেখলাম সামনের ছাউনিটির ভেতর থেকে বেশ কয়েকজন লোক বের হয়ে দৌড়ে আসে পাশের গাছগুলোর পেছনে অবস্থান নিচ্ছে।

এদের কয়েকজন আমার অবস্থান আন্দাজ করে সময় সময় ফায়ারও করছে। আমি সম্পূর্ণ একা, আমার সৈনিকরা বেশ দূরে, যোগাযোগেরও কোনো উপায় নেই। মৃত্যু থেকে কয়েক সেকেন্ড দূরে মনে হলো নিজেকে। মনে মনে মহান আল্লাহ্কে স্মরণ করলাম। চারদিকেই এলোপাতাড়ি ফায়ার চলছিল। টিলার ওপর থেকে আসা কিছু গুলির শব্দ আমার সৈনিকদের অংশগ্রহণের জানানও দিচ্ছিল। আমি শঙ্কিত ছিলাম যেন দুদিকের ক্রসফায়ারে না পড়ে যাই। ভাগ্যিস দুপক্ষের উঁচু ও নিচু ভূমিবিন্যাসের কারণে ‘প্লাঞ্জিং’ ফায়ার হচ্ছিল। তা ছাড়া আমার অবস্থানটি কিছুটা ডান দিকে হওয়ায় আমি অনেকটা নিরাপদ ছিলাম।

p-13

তবে নতুন এক বিপদের সম্মুখীন হচ্ছিলাম আমি। এতক্ষণ গামারী গাছটি স্নেহময়ী মায়ের মতো আমাকে তার পেছনে লুকিয়ে রেখে সামনে থেকে আসা সব আঘাত নিজের গায়ে নিচ্ছিল (পরে গাছের গায়ে মোট ১৬টি গুলির চিহ্ন শনাক্ত করেছিলাম)। ছাউনির আশপাশের গাছের পেছনে অবস্থান নেওয়া সশস্ত্র ব্যক্তিরা এরই মধ্যে আমার অবস্থান ঠাহর করতে পেরে নিজেদের কৌশলগতভাবে পুনর্বিন্যাস করছিল। তাদের কয়েকজন আমার ডান পাশ বা Flank উন্মুক্ত করার প্রয়াসে ক্রমেই ডান দিকে সরে যাচ্ছিল। বিপদ আসন্ন দেখে শেষ রক্ষা হিসেবে আমার হ্যান্ডগ্রেনেডের কথা মনে হলো।

কালবিলম্ব না করে আমি একটির সেফটি পিন খুলে সঙ্গে সঙ্গে ছাউনির পশ্চাৎ ভাগে নিক্ষেপ করলাম। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে গ্রেনেডটি প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হলে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়! হিন্দিতে ‘আরে মার দিয়া রে, মার দিয়া... ভাগো, ভাগো...’ এ ধরনের চিৎকার করতে করতে বেশ কয়েকজন গাছের পেছন থেকে বের হয়ে উল্টো দিকে র‌্যাংখিয়াং খাল অভিমুখে দৌড়াতে লাগল। ছাউনির ভেতর থেকে আহত কয়েকজনের গোঙানির শব্দও শুনতে পেলাম। হিন্দি কথা শুনে একটু অবাকই হলাম, কেননা এতক্ষণ পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল যে প্রতিপক্ষ শান্তিবাহিনীর একটি দল। এখন মনে হচ্ছে, তারা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের কোনো দল। যাই হোক, পরিস্থিতি কিছুটা অনুকূলে দেখে আমি উচ্চ স্বরে টিলার ওপরে অবস্থানরত আমার সৈনিকদের ডাকলাম, ‘তোমরা নিচে নেমে এসো এবং ফায়ারিং করতে থাকো।’ এ সময় পলায়নরত বিপক্ষদলের একজন আমার বাংলা কথা শুনে চিৎকার করে উঠল, ‘বিডিআর, বিডিআর... ইয়ে বিডিআর হ্যায়।’ বুঝতে পারলাম, এরাও এতক্ষণ আমাদের কোনো সন্ত্রাসী দল (সম্ভবত মিজো) ভেবেছিল।

এর কিছুক্ষণ পর যে স্থানে অগ্নিকুণ্ডটি ছিল, তারই নিকটবর্তী একটি পতিত গাছের আড়াল থেকে কে একজন মিশ্র ইংরেজি-হিন্দিতে চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘Stop fire, stop fire...কই অফিসার হ্যায়? Please ask your men to stop fire....we are friends, we are friends!’ সে এ কথা বারবার আওড়াতে থাকল এবং দেখলাম, গাছটির পেছন থেকে হাত বের করে সে একটি সাদা রুমাল নাড়াচ্ছে। বুঝলাম প্রতিপক্ষ অস্ত্রবিরতি চাচ্ছে। প্রত্যুত্তরে আমি চিৎকার করে আদেশ করলাম, ‘Stop running, halt where you are and drop your arms. ... ছব্‌লোগ হাতিয়ার ঢাল্ দো.. ..ওয়ার্না ফায়ার জারি রাহে গা।’

দেখলাম, এতে কয়েকজন থেমে গেল এবং অস্ত্র ফেলে দিয়ে দুহাত উঁচুতে ওঠাল। আমি আমার সৈনিকদের ফায়ার বন্ধ করতে বললাম। অতঃপর আমি রুমাল-ওঠানো ব্যক্তিকে বেরিয়ে সামনে আসতে বললাম। কিছুক্ষণ পর গাছের পেছন থেকে দীর্ঘকায় ও সুদর্শন এক ব্যক্তি বেরিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগল। এরই মধ্যে আমার কিছু লোকজনও আমার দুপাশে অবস্থান নিয়েছিল। আমি তাদের আমাকে কাভার করতে বলে এসএমজিটি রেডি পজিশনে নিয়ে আমিও গাছের আড় থেকে বেরিয়ে ওই ব্যক্তির দিকে এগিয়ে গেলাম।

কয়েক কদম ব্যবধান রেখেই তাকে থামতে বলে তার পরিচয় জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, তার নাম মেজর ভাণ্ডারী (পুরো নাম মোহনচাঁদ ভাণ্ডারী), তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসার। তার ব্যাটালিয়ন ৭ম গারওয়াল রেজিমেন্টটি মিজোরামে মোতায়েনরত এবং সে পারভা বাজারে মোতায়েনরত একটি কোম্পানির অধিনায়ক। কী কারণে তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা আন্তর্জাতিক সীমান্তের কাছে টহলে বেরিয়েছিলেন। তাদের খাবার পানি শেষ হয়ে যাওয়ায় তারা পানি তল্লাশে পথ ভুল করে এই খালপাড়ে চলে এসেছিল। তারা বুঝতে পারেনি যে তারা বাংলাদেশের ভেতরে এসেছে।

আমি অবশ্য মেজরের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করিনি। কারণ হচ্ছে, এ এলাকায় আন্তর্জাতিক সীমরেখাটি একটি সুস্পষ্ট রিজলাইনের ওপর দিয়ে গেছে, যা সহজেই চেনা যায়। তার সঙ্গে যে ম্যাপটি ছিল, তাও আমাদের অনুরূপ একটি সামরিক ম্যাপ, যা ব্যবহারে পথ ভুল করার কথা নয়। তা ছাড়া এই সংঘর্ষস্থলটি বাংলাদেশের প্রায় সাত-আট কিলোমিটার ভেতরে, তাও আবার র‌্যাংখিয়াং খাল পার হয়ে পশ্চিম পাড়ে! পরবর্তী সময়ে অবশ্য বিশ্বাসযোগ্য কিছু সূত্র থেকে জানা গিয়েছিল, ভারতীয় এ টহলটি তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে পূর্বপ্রস্তুতি নিয়েই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মিজো বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সন্ধানে ও শান্তিবাহিনী সন্ত্রাসীদের সাহায্য করতে প্রবেশ করেছিল।

অস্ত্রবিরতি ও হতাহতদের উদ্ধার

আমি মেজর ভাণ্ডারীকে তার সব সৈনিককে এলাকার মাঝখানের অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার একটি জায়গায় জড়ো করতে বললাম। এরই মধ্যে আমার লোকজন তাদের অস্ত্রগুলো সংগ্রহ করে একস্থানে জড়ো করেছিল। আমি মেজরকে তার লোক দিয়ে দ্রুত হতাহতদের সন্ধান ও উদ্ধার করতে বললে তিনি আমার সৈন্যদের পিছু সরাতে অনুরোধ করেন। তার সৈনিকদের আশঙ্কা আমরা আবার ফায়ার শুরু করতে পারি। আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম, আমার আদেশ ছাড়া কেউ ফায়ার করবে না। তবে একটু পেছালে আমাদেরই সুবিধা হয় বিবেচনায় আমি আমার সৈন্যদের একটু উঁচু ভূমিতে অবস্থান নিতে নির্দেশ দিলাম।

একজন জেসিওর নেতৃত্বে ভারতীয় সৈনিকদের কয়েকজন তখন উদ্ধার কাজে লেগে গেল। বিভিন্ন স্থান থেকে হতাহত পাঁচ সৈনিককে উদ্ধার করে তারা উন্মুক্ত স্থানে নিয়ে এলো। দেখা গেল, তাদের মধ্যে একজনের এরই মধ্যে মৃত্যু হয়েছে। সম্ভবত তিনি সেই প্রথম প্রহরী। বাকি চারজনের দেহে বিভিন্ন মাত্রার আঘাত, তবে একজনের অবস্থা গুরুতর (পরে তিনিও মারা যান)। আহত সবাই ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। আমি মেজরকে দ্রুত তার মেডিকেল টিমকে কাজে নামাতে বললে তিনি জানান, তার সঙ্গে কোনো মেডিকেল টিম নেই। আমি তখন আমাদের মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টের সহায়তা অফার করলে তিনি তা কৃতজ্ঞতাসহ গ্রহণ করেন। মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট তখন আহত সবাইকে মরফিয়া ইনজেকশনসহ প্রয়োজনীয় প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করেন।

ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ

সংঘর্ষ শুরুর সময় থেকে এ পর্যন্ত প্রায় আধা ঘণ্টা অতিক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু এর মধ্যে আমি বেইজ-ক্যাম্প বা অন্য কারো সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারিনি। অবশ্য বুদ্ধিমান অপারেটর নিজ থেকেই ফায়ারিং শুরু হওয়ার খবর বেইজ-ক্যাম্পকে জানিয়েছিল, তবে আমার হদিস কী, তা জানার জন্য সবাই খুব উৎকণ্ঠিত ছিলেন। ঘটনা শুরুর পরপরই মেজর কামরুল সুবেদার নাজিমকে তার ব্লকিং পজিশন ছেড়ে আমাকে সাহায্য করার জন্য ঘটনাস্থলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। অবশেষে আমি যখন মেজর কামরুলের সঙ্গে ওয়ারলেসে কথা বলি ও বিস্তারিত জানাই, ততক্ষণে সুবেদার নাজিম আমার অবস্থানে পৌঁছে গেছেন। আমি তার দলকে পার্শ্ববর্তী দুটি টিলায় মোতায়েন করে সার্বিকভাবে ভারতীয়দের ওপর নজরদারি করার দায়িত্ব দিই।

এদিকে মেজর কামরুল ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী বায়েজীদূল ইসলামকে ঘটনার বিবরণ জানালে তিনি তা তাৎক্ষণিকভাবে ব্রিগেড কমান্ডার মহোদয়কে অবহিত করেন এবং পরবর্তী করণীয় সম্বন্ধে দিকনির্দেশনা চান। আমার জন্য আদেশ এলো আমার অবস্থান সুদৃঢ় করতে, ভারতীয় দলটিকে আটকে রাখতে এবং পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে।

সময় তখন সকাল ৬টা ১৫ মিনিট। আমি মেজর ভাণ্ডারীকে নিয়ে তাদের তৈরি একটি খালি ছাউনির ভেতরে বসলাম। উল্লেখ্য, তল্লাশি করে ভারতীয়দের একত্র করার সময় এলাকাটিতে বিভিন্ন আকারের মোট সাতটি অস্থায়ী ছাউনি বা শেল্টার পাওয়া যায়। তার মোট সৈন্যসংখ্যা কত জিজ্ঞেস করলে, মেজর ভাণ্ডারী প্রথমে ৪৫ বললেও পরে সরেজমিনে মাথা গণনায় মোট ৬২ জন পাওয়া যায়, যার মধ্যে দুই অফিসার, দুই জেসিও এবং অন্যান্য পদবির ৬২ সৈনিক ছিলেন। অন্য অফিসার ছিলেন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট।

চূড়ান্ত নির্দেশের অপেক্ষায়

ঘটনা সংঘটিত হওয়ার তিন ঘণ্টার মধ্যেও ঊর্ধ্বতন সদর দপ্তর থেকে ভারতীয়দের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো আদেশ বা নির্দেশ পাওয়া যায়নি! এদিকে প্রাথমিক শক্ কেটে যাওয়ার পর ভারতীয়রা ক্রমেই অস্থির ও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিল। আহত সৈনিকদের আহাজারি সবাইকে বেশ উদ্বিগ্ন ও হতাশ করছিল। বোঝা যাচ্ছিল তারা উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে দ্রুত নিষ্কৃতি চাচ্ছে। মেজর ভাণ্ডারী বারংবার আমাকে অনুরোধ করছিলেন, আমি যেন হতাহতদের তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিই। তাকে জানাই, বিষয়টি এখন আর আমার এখতিয়ারে নেই। আমি উদ্ভূত সব পরিস্থিতি সম্বন্ধে সর্বদা মেজর কামরুলকে অবহিত করে রাখছিলাম।

ব্যাটালিয়ন সদরের ভাষ্য মোতাবেক আমি ভারতীয়দের আশ্বাস দিচ্ছিলাম, শিগগিরই আহতদের হেলিকপ্টারযোগে আমাদের নিকটস্থ সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। যাই হোক, ব্যস্ত থাকলে তাদের অস্থিরতা কিছুটা প্রশমিত হবে ভেবে আমি তাদের হতাহতদের বহনের জন্য বাঁশ-বেত ও গ্রাউন্ডশিট দিয়ে কিছু make-shift stretcher বানাতে বললাম। দেখলাম, এ কাজে তারা উৎসাহ-সহ লেগে গেল। এদিকে ঘটনার বাহুল্যে এ পর্যন্ত সবাই অভুক্ত ছিল। আরেকটি দলকে লাগিয়ে দিলাম প্রাপ্ত সব রসদ দিয়ে সবার জন্য ‘খিচুড়ি’ রান্না করতে। খালের নিকটবর্তী একটি ছাউনিতে ভারতীয়দের ‘কুকহাউস’ ছিল, যেখানে চাল, ডাল, আটা ও বিভিন্ন রকমের canned food-সহ প্রায় তিন-চার দিনের খাদ্যদ্রব্য মজুত ছিল।

সকাল পৌনে ১০টায় মেজর কামরুল আমাকে জানান, ব্রিগেড কমান্ডার ও ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক একত্রে হেলিকপ্টারযোগে ঘটনাস্থলে আসছেন। তিনি আরো জানান, ঘটনাটির বিষয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুদেশের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। কমান্ডার মহোদয় এ ব্যাপারে মেজর ভাণ্ডারীর জন্য বিশেষ বার্তা নিয়ে আসছেন। মেজরকে ব্যস্ত রাখতে আমি তার ব্যক্তিগত ও চাকরিজীবনের প্রসঙ্গ টেনে আলাপচারিতা শুরু করি।

তিনি জানান, তার ১৩ বছর চাকরি হয়েছে এবং এরই মধ্যে স্টাফ কোর্স সম্পন্ন করেছেন। তিনি বিবাহিত ও এক ছেলের জনক। তার পরিবার তখন দিল্লিতে বসবাস করছিল। মাত্র তিন মাস আগে তিনি মিজোরামে এই ব্যাটালিয়নে পোস্টিংয়ে এসেছেন। এর আগে তিনি দিল্লিস্থ ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে স্টাফ অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি জানান, জেনারেল এরশাদ দিল্লিতে ‘NDC’ কোর্স করার সময় ভাণ্ডারী তাকে অনেক সহায়তা করেছিলেন। খোশ গল্পের এই ফাঁকে আমি সুবেদার নাজিমকে আমাদের ক্যামেরা দিয়ে সংগোপনে মেজরসহ অন্যান্য ভারতীয়দের কিছু ছবি তুলতে বলি। তিনি যথাযথভাবে তা করেন।

প্ল্যান পরিবর্তন

বেলা সোয়া ১০টায় খবর এলো, আগের পরিকল্পনায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। দুদেশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে আমরা আটককৃত ভারতীয়দের একটি অংশকে তাদের হতাহতদের নিয়ে তাদের নিজস্ব ক্যাম্পে যেতে অনুমতি দেব। মেজর ভাণ্ডারীসহ অন্যদের যথারীতি আমাদের হেফাজতেই রাখতে হবে। এ খবরে ভারতীয়রা বেশ কিছুটা স্বস্তি পেল বলে মনে হলো। আধা ঘণ্টার মধ্যেই কনিষ্ঠ অফিসারটির নেতৃত্বে দুই ধাপে এক মৃত ও চার আহত সৈনিকসহ মোট ৩২ জনের একটি দল আন্তর্জাতিক সীমানার দিকে রওনা হয়ে গেল। যাওয়ার আগে তাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ ফেরত দেওয়া হয়েছিল।

মেজর ভাণ্ডারী ও আমি ওই ছাউনির নিচে বসে আমাদের আলাপচারিতা চালিয়ে যেতে লাগলাম। মিজোরামে তাদের ব্যস্ততা কেমন জিজ্ঞেস করলে তিনি সতর্কতার সঙ্গে উত্তর দেন, মিজো বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযান বেশ জোরেশোরে চলছে। তবে শান্তিবাহিনী সন্ত্রাসীদের আশ্রয় ও সাহায্য করার ব্যাপারে আমার অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন। সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত তাদের ক্যাম্পগুলোর কার্যকলাপ সম্বন্ধে আলাপে অনীহা দেখালেও আমাদের অবস্থান ও কার্যকলাপ সম্বন্ধে তিনি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল বলে মনে হলো।

এর প্রমাণ পেলাম তার মুখে আমাদের বেশ কটি ক্যাম্প, তথায় মোতায়েনরত ইউনিট ও কমান্ডারদের নাম শুনে। প্রশ্নোত্তরে তিনি জানান, তাদের ঊর্ধ্বতন সদর দপ্তর ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোই তাদের এসব তথ্য সরবরাহ করে থাকে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ভারতীয় দলটি যে বেতারযন্ত্র ব্যবহার করত তা ছিল আমাদেরটারই অনুরূপ। আমি ওই সেটের ফ্রিকোয়েন্সিগুলো এরই মধ্যে ব্যাটালিয়ন সদরে জানিয়েছিলাম, যা রনিপারাস্থ আমাদের ক্যাম্প কমান্ডার (আমারই কোর্সমেট) তদানীন্তন ক্যাপ্টেন জহুরুল ইসলাম ব্যবহার করে ঘটনা-সম্পর্কিত ভারতীয় নেটের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন।

হেলিকপ্টারের আগমন

বেলা আনুমানিক সাড়ে ১১টার পর পশ্চিমাকাশে হেলিকপ্টারের শব্দ শুনতে পেলাম। পরপর দুবার চেষ্টার পরও বিরাটকায় MI-8 হেলিকপ্টারটি বেইজ-ক্যাম্পটি চিনতে না পারায় তা রুমাতে ফেরত চলে যায়।

চূড়ান্ত নির্দেশ

বেলা ১টায় খবর এলো, হেলিকপ্টার আর আসবে না। কূটনৈতিক পর্যায়ে ঘটনাটির বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, অবশিষ্ট ভারতীয়দের তাদের অস্ত্রসহ ছেড়ে দিতে হবে। তার আগে মেজর ভাণ্ডারীর কাছ থেকে একটি লিখিত বিবৃতি রাখতে হবে। সিদ্ধান্তটিতে আমি শুধু অবাকই হইনি, রীতিমতো হতাশও হয়েছি! আন্তর্জাতিক সীমানা লঙ্ঘন করে দেশের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশকারী (প্রায় আট কিমি) ভারতীয় সেনাদলের এমন গর্হিত কাজকে আমরা বিনা অনুশোচনা ও কোনো ধরনের প্রচারণা ছাড়াই যেতে দেব, এ যেন কেমন নতজানুতার পরিচয় বলে আমার মনে হলো। যাই হোক, নির্দেশ মোতাবেক মেজর ভাণ্ডারীকে একটি লিখিত স্টেটমেন্ট দিতে বললে তিনি প্রথমে অপারগতা প্রকাশ করেন। স্টেটমেন্ট ছাড়া আমরা তাকে যেতে দেব না বলা হলে তিনি এক টুকরো কাগজে নিজ হাতে সংক্ষিপ্ত একটি বিবৃতি লেখেন, যাতে আমরা দুজনেই সই করি (চিত্র-৮ ও ৯)। অতঃপর তাদের অস্ত্র-সরঞ্জাম ফেরত দিলে তারা যাত্রার প্রস্তুতি নেয়। যাওয়ার সময় করমর্দনকালে মেজর ভাণ্ডারী মন্তব্য করেন, ‘Hope we meet again, but not in a battlefield like this!’ ঘড়িতে সময় তখন বেলা দেড়টা।

রুমাতে প্রত্যাবর্তন

ভারতীয় দলটি খাল পার হয়ে থেগা রেঞ্জে আরোহণ শুরু না করা পর্যন্ত আমরা আমাদের অবস্থানে চতুর্মুখী প্রতিরক্ষায় ছিলাম। উদ্ভূত ঘটনাটির কারণে আমাদের মূল লক্ষ্যবস্তু ‘শান্তিবাহিনী সিম্পেথাইজার’ গ্রুপটি এরই মধ্যে পলায়ন করেছিল বলে আমরা আর ওই স্থানে যাইনি। অবশ্য পরে ওই স্থান থেকে সাতটি পরিবারের ২৬ সদস্যকে রুমার নিকটবর্তী স্থানে পুনর্বাসন করা হয়েছিল। বিকাল ৪টায় আমরা সবাই বেইজ-ক্যাম্পটি পরিত্যাগ করি।

পরবর্তী দুদিনে বড়থলিপাড়া ও র‌্যাংখিয়াং পুকুর হয়ে ভিন্ন এক পথে ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহে ১৯৮২ সালের ২০ মার্চ সকালে আমরা ব্যাটালিয়ন সদর রুমা গ্যারিসনে পৌঁছাই। সেখানে ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক গ্যারিসনে প্রাপ্ত সব অফিসার, জেসিও ও সৈনিকসহ আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানান। পৌঁছানোর ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই জিওসি মেজর জেনারেল আব্দুল মান্নাফ ব্রিগেড কমান্ডারসহ হেলিকপ্টারযোগে সেখানে পৌঁছান এবং সরাসরি আমার কাছ থেকে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ শোনেন।

শেষ কথা

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর মধ্যে এ ধরনের ঘটনা ছিল এটিই প্রথম। তবে তথাকথিত নিরাপত্তাজনিত কারণে এর বিচার-বিশ্লেষণ বা প্রচার তেমন হয়নি। এ সংঘর্ষে সন্দেহাতীতভাবে আমাদের বিজয় হয়েছিল। মাত্র সাড়ে তিন বছরের চাকরিসম্পন্ন এক ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বাধীন মাত্র ২৫ জনের একটি ছোট দলের কাছে ১৩ বছরের যোগ্যতাসম্পন্ন এক মেজরের নেতৃত্বাধীন প্রায় তিনগুণ বৃহৎ ভারতীয় টহলের পর্যুদস্ত হওয়া কোনো ছোট ঘটনা নয়।

ঘটনাটির কৌশলগত গুরুত্ব অনেক। বাংলাদেশ আকারে ও শক্তি-সামর্থ্যে একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র হলেও ভারতের মতো বিশালকায় দেশের আধিপত্যবিস্তারকারী মনোভাবকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি বিশ্বাস করি অস্ত্র ও ভূমির সঠিক ব্যবহার, উচ্চতর রণকৌশল, কঠিন প্রশিক্ষণ প্রভৃতি স্পর্শনীয় (tangible) দক্ষতার সঙ্গে অদম্য সাহস, দৃঢ় আত্মবিশ্বাস, প্রখর বুদ্ধিমত্তা, ঈর্ষণীয় উদ্ভাবনী দক্ষতা, উদ্যোগী মনোভাব প্রভৃতি অস্পর্শনীয় (Intangible) গুণাবলির নিবিড় সমন্বয়ের মাধ্যমে আমাদের কার্যক্ষম শক্তি বহুগুণ বৃদ্ধি ও বিজয় অর্জন করা সম্ভব। ওপরে বর্ণিত ঘটনাটি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ!

২৬ মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতাকামী জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের হাতে তুলে দিয়ে গেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা। আর এর স্বাতন্ত্র্য ও মর্যাদা সমুন্নত রাখার পবিত্র দায়িত্ব আমাদের সবার। ২০২৪ সালের ‘জুলাই আন্দোলন’-এর ফলে এখন উন্মুক্ত হয়েছে বিশাল সম্ভাবনার দ্বার। আবির্ভাব ঘটেছে তারুণ্যনির্ভর শান্তি ও সমৃদ্ধিশালী এক নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের লগ্ন। একে আমাদের কাজে লাগাতেই হবে।

লেখক : নিরাপত্তা, সমর ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত