তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায়ে শঠতা

ব্যারিস্টার নাজির আহমদ
প্রকাশ : ১১ আগস্ট ২০২৫, ০৯: ৩৮
ব্যারিস্টার নাজির আহমদ

গত দেড় দশকে দেশ গভীর রাজনৈতিক সংকটে পড়েছিল, যা থেকে পরিত্রাণ পেয়েছে ছাত্র-জনতার সফল গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। আর এ সংকটের গোড়ায় ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায়। শঠতা ও গোঁজামিলে ভরপুর এই রায়ের প্রধান কারিগর হলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। দেশকে গভীর রাজনৈতিক সংকটে ফেলা সেই রায়ের আইনি, নৈতিক, সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি কতটুকু, তা নিয়েই আজকের এই লেখা।

২০১১ সালের ১০ মে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এই রায় সর্বসম্মত ছিল না, বরং বিভক্ত ছিল। রায় দেওয়ার সময় প্রধান বিচারপতি ছিলেন বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। ছয়জন বিচারপতির মধ্যে তিনজন (বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এস কে সিনহা ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন) তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে রায় দেন। তিনজন (বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি মো. ইমান আলী) তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে রায় দেন। বিচারপতি মো. ইমান আলীর রায়টি একটু ভিন্ন ধাঁচের হলেও তার রায় স্পষ্টত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার পক্ষে ছিল। এ পরিস্থিতিতে বিচারপতি খায়রুল হক রায় বাতিলের পক্ষে মত দিলে চার-তিনে মেজরিটি হয়ে এই রায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিদের রায়ে পরিণত হয়।

বিজ্ঞাপন

তবে এ রায়ে পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে মত দেওয়া হয়। ওই সময় সংক্ষিপ্ত রায়ে আপিল বিভাগ বলে, বিদায়ি প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের বিচারপতিদের বাদ দিয়ে সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংস্কার করতে পারে। ওই সংক্ষিপ্ত রায়ের ওপর ভিত্তি করে পূর্ণাঙ্গ রায় বের হওয়ার আগেই তড়িঘড়ি করে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে তৎকালীন মহাজোট সরকার। কিন্তু কেন এত তাড়াহুড়োর দরকার পড়েছিল?

পূর্ণাঙ্গ রায় বের হলে পুরো রায়ের ব্যাখ্যা ও চুলচেরা বিশ্লেষণ করার সুযোগ থাকত, থাকত সর্বোচ্চ আদালতে পুনর্বিবেচনা করার আবেদনের অধিকার। যেহেতু ৩:৩-এ সমানভাবে বিভক্ত রায় বিচারপতি খায়রুল হকের কাস্টিং ভোটে মেজরিটি হয়েছিল এবং বিচারপতি খায়রুল হক যেহেতু সংক্ষিপ্ত আদেশের পরপরই অবসরে যান, সেহেতু সমূহ সম্ভাবনা ছিল পুনর্বিবেচনায় রায় পাল্টে যাওয়ার! এ কারণেই সংক্ষিপ্ত রায়ের ওপর ভিত্তি করে দ্রুত সংবিধান সংশোধন করে পুনর্বিবেচনার আবেদনের সুযোগ ও অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়।

এ রায় ঘিরে পর্দার আড়ালে যা হয়েছে, তার কিছুটা আন্দাজ করা যায় কয়েকটি তথ্য-প্রমাণ থেকে। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ওপেন কোর্টে তার সংক্ষিপ্ত আদেশে পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে মত দেন। কিন্তু সরকার সংক্ষিপ্ত আদেশের ওপর ভর করে সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার পর যখন বিচারপতি খায়রুল হক পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন, তখন পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে যে মত দিয়েছিলেন, তা আর রাখেননি!

কোনো অধিকতর বা পরবর্তী শুনানি ছাড়া এভাবে রায় পরিবর্তন করা যায় না। সংগত কারণে প্রশ্ন ওঠে—কেউ কি তাকে চাপ দিয়েছিল বা কারো সঙ্গে কোনো যোগসাজশে তেমনটি করা হয়েছিল? শোনা যায়, বিচারপতি খায়রুল হক অবসরের পর রায় লিখে জমা দেওয়ার পর আবার সেটি নিয়ে সংশোধন করে লিখে জমা দেন। এমনটি কি তিনি করতে পারেন? উন্নত বিশ্বে এভাবে রায় পরিবর্তন করাকে সিরিয়াস জুডিশিয়াল মিসকন্ডাক্ট বা বিচার-সম্পর্কিত গুরুতর অসদাচরণ হিসেবে দেখা হয়।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, বিচারপতি খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসর গ্রহণের অব্যবহিত আগে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী-সংক্রান্ত মামলার আপিল শুনানি করেন এবং একটি সংক্ষিপ্ত বিভক্ত আদেশ দেন। এর পরপরই তিনি অবসরে যান। অবসরে যাওয়ার প্রায় ১৬ মাস পর তিনি ৭৪৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় লিখে স্বাক্ষর করে জমা দেন! প্রশ্ন হচ্ছে—তিনি জানেন, অবসরে যাওয়ার আগে পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা সম্ভব নয়, তাহলে কেন তিনি এই আপিল মামলায় নিজেকে জড়ালেন? তিনি নিজেকে সরিয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি এই মামলার আপিল শুনানিতে অতি উৎসাহী ছিলেন কেন?

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা-সংবলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে জনৈক আইনজীবী ১৯৯৮ সালে হাইকোর্টে রিট করেন। কিন্তু এতে গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ব্যাখ্যা ও সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচারের প্রশ্ন জড়িত থাকায় তৎকালীন প্রধান বিচারপতি হাইকোর্টের তিনজন সিনিয়র বিচারপতির সমন্বয়ে একটি বিশেষ ও বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করেন। এই বেঞ্চ পূর্ণাঙ্গ ও চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বৈধ ও সংবিধানসম্মত বলে ঘোষণা করে। (৫৭ ডিএলআর, ২০০৫)

ত্রয়োদশ সংশোধনীকে হাইকোর্টের তিনজন সিনিয়র বিচারপতি সর্বসম্মতভাব বৈধ ঘোষণার পর এর বিরুদ্ধে করা আপিল পাঁচ বছরের বেশি সময় পড়েছিল। বিচারপতি খায়রুল হক অবসরে যাওয়ার ঠিক আগে হঠাৎ করে এর শুনানি করার উদ্যোগ নেন কেন? তাও ক্ষমতাসীন দল সংসদীয় বিশেষ কমিটি গঠন করে সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ার পর? বিষয়গুলো মোটেই কাকতালীয় নয়।

অবসরে যাওয়ার পর একজন বিচারপতি শপথের আওতায় থাকেন না এবং এক বছরের মধ্যে তাকে রাষ্ট্রের দেওয়া বাড়ি, গাড়ি ও স্টাফ ছাড়তে হয়। তখন তিনি হয়ে পড়েন একজন সাধারণ নাগরিক। এ অবস্থায় কীভাবে বিচারপতি খায়রুল হক অবসরে যাওয়ার প্রায় ১৬ মাস পর স্পর্শকাতর একটি সাংবিধানিক মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় দেন এবং তাতে স্বাক্ষর করেন? এটি দুনিয়ার সভ্য দেশের ইতিহাসে বিরল।

বিচারপতি খায়রুল হকের উত্তরসূরি সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা (যিনি বিচারপতি খায়রুল হকের সঙ্গে একমত হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার রায় দিয়েছিলেন) অবসর গ্রহণের পর রায় লেখা আইন ও সংবিধান পরিপন্থী বলে ২০১৬ সালের ১৯ জানুয়ারি স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দেন। এর আলোকে বিচারপতি খায়রুল হকের অবসরের প্রায় ১৬ মাস পর লেখা ও স্বাক্ষর করা ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় কি সংবিধান পরিপন্থী হয় না?

অনেকে বলে থাকেন, বিচারপতি খায়রুল হক পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হওয়ার চিন্তায় সম্ভবত এই অতি উৎসাহ দেখিয়েছেন। তাদের এই সন্দেহ বা অভিযোগ কি অমূলক? আরেকবার অতি উৎসাহ দেখিয়েছিলেন তিনি হাইকোর্টের বিচারপতি থাকতে। মুন সিনেমা হলের এক মামলায় অপ্রাসঙ্গিকভাবে (ওই মামলায় বাদীর আবেদনে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল চাওয়ায়ই হয়নি!) পুরো পঞ্চম সংশোধনীকে টেনে এনে তা বাতিল করেন। অথচ পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের বাড়ানো বয়স বহাল রাখেন!

শুধু তাই নয়, হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে শপথ নিয়েই তিনি মুজিব হত্যা মামলার শুনানিতে বসেন এবং রায়ে সিনিয়র বিচারপতির সঙ্গে দ্বিমত করে সবাইকে দেওয়া ফাঁসির দণ্ড বহাল রাখেন। বোঝাই যায়, তাকে কেন বিচারপতি বানানো হয়েছিল। একটি রাজনৈতিক বিষয় খামোখা আদালতে এনে তিনি বিতর্কের সৃষ্টি করেন এবং রায়ের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানকে আন্ডারমাইন করে শেখ মুজিবকে স্বাধীনতার ঘোষক বানান। এটা কি আদালতের রায়ের বিষয়?

একজন বিচারপতির পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থাকা ও নেওয়ার পরও তিনি প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণের ফান্ড থেকে ১০ লাখ টাকা নেন। সরকারের পারপাস সার্ভ করায় অন্য বিচারপতিদের ডিঙিয়ে বিচারপতি খায়রুল হককে ত্বরিত গতিতে আপিল বিভাগে নেওয়া হয় এবং পরে দুজন সিনিয়র ও দক্ষ বিচারপতিকে ডিঙিয়ে তাকে প্রধান বিচারপতি করা হয়।

আপিল বিভাগেও ন্যক্বারজনক কাণ্ড ঘটিয়েছেন তিনি। আদালত অবমাননা মামলায় আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে আপিল বিভাগে তিনি অপমান ও নাজেহাল করেন এবং ‘চান্স এডিটর’ বলে কটাক্ষ করেন। বিচারপতি খায়রুল হকের আগের প্রধান বিচারপতি হাইকোর্টের দুজন অতিরিক্ত বিচারপতির শপথ দেননি, কেননা তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা ও আদালত প্রাঙ্গণে ভাঙচুরের মতো গুরুতর অভিযোগ ছিল। খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি হয়েই তাদের শপথ দেন।

আপিল বিভাগে মামলা পেনডিং থাকা অবস্থায় বেগম খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়। শুনানি ছাড়াই লিভ পিটিশন ডিসমিস করেন বিচারপতি খায়রুল হক। তিনি অনাস্থা পিটিশন তুলতেই দেননি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে, বরং বাড়ি ভাঙতে সায় দিয়েছেন। অবসরে যাওয়ার কিছুদিন পর প্রধান বিচারপতির মর্যাদায় তিনি বাংলাদেশ আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হন এবং থাকেন বহুদিন। ৫ আগস্ট না ঘটলে এ পদেই থাকতেন হয়তো আমৃত্যু!

যে তিনজন বিচারপতি আপিল বিভাগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন, তাদের পর্যায়ক্রমে প্রধান বিচারপতি বানিয়েছিল আওয়ামী লীগ। শুধু তা-ই নয়, এ মামলা শুরুর কিছুদিন আগে বিচারপতি খায়রুল হককে দুজন সিনিয়র ও দক্ষ বিচারপতিকে ডিঙিয়ে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যে তিনজন বিচারপতি আপিল বিভাগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন, সব দিক দিয়ে যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও সিনিয়রিটি থাকার পরও তাদের প্রধান বিচারপতি করা হয়নি।

এই মামলার শুনানিতে সুপ্রিম কোর্টের আটজন সিনিয়র আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু তথা আইনি সহায়তাকারী) নিযুক্ত করা হয়। তারা হলেনÑসাবেক বিচারপতি টি এইচ খান, সংবিধানপ্রণেতা ড. কামাল হোসেন, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. এম জহির, অন্যতম সংবিধানপ্রণেতা ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ এবং ব্যারিস্টার আজমালুল হক কিউসি।

একমাত্র ব্যারিস্টার আজমালুল হক কিউসি ছাড়া অন্য সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে আইনি ও সাংবিধানিক ব্যাখ্যা আদালতে উপস্থাপন করেন। কিন্তু তাদের মতামতের কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এমনকি শুনানিকালে তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে বক্তব্য দেন। তার বক্তব্যও গ্রহণ করা হয়নি।

ত্রয়োদশ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্ট বিভাগে এই মামলা ছাড়াও অতীতে আরো একটি মামলা হয়েছিল। সাঈদ মশিউর রহমান বনাম বাংলাদেশ মামলার রায়ে বিচারপতি মোজাম্মেল হক ও বিচারপতি এম এ মতিনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বৈধ বলে ঘোষণা করেন [১৭ বিএলডি (এইচসিডি) (১৯৯৭)]।

সুতরাং এ দুজন বিচারপতির সংখ্যা বিবেচনায় নিলে বলা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা-সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগ অর্থাৎ হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের ১২ জন বিচারপতি রায় দিয়েছেন। এর মধ্যে আটজন (দুই-তৃতীয়াংশ) বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে (হাইকোর্টের পাঁচজন ও আপিল বিভাগের তিনজন) এবং বিপক্ষে ছিলেন চারজন বিচারপতি (খায়রুল হকসহ আপিল বিভাগের চারজন বিচারপতি)।

ওপরের আইনি দিকগুলো ছাড়াও রাজনৈতিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের নৈতিক ভিত্তি খুবই দুর্বল। আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হলেও তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের কোনো প্রস্তাব ছিল না। ফলে তা ছিল জনগণের ম্যান্ডেটের বাইরে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত রায়ের ওপর ভিত্তি করে সম্পাদিত কাজ। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১০ সালের জুলাই মাসে তৎকালীন সংসদ উপনেতা বেগম সাজেদা চৌধুরী ও সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের যৌথ নেতৃত্বে সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে ১৫ সদস্যের একটি সংসদীয় বিশেষ কমিটি গঠন করা হয় যাতে বিএনপি অংশ নেয়নি।

এই কমিটি তিনজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, ১১ জন শীর্ষ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ, ১৮ জন বুদ্ধিজীবী, ১৮টি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক বা জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের নেতাদের মতামত নেয়। বিশেষজ্ঞ এবং বিশিষ্ট নাগরিকদের পায় সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন। এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও দল হিসেবে কমিটির কাছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের সুপারিশ করেনি।

এমনকি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সংশোধিত আকারে এর পক্ষে বক্তব্য দেন। কিন্তু ২০১১ সালের ৩০ মে কমিটি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলে সবকিছু উল্টে যায়, সবকিছু বদলে যায়। ২০ জুন কমিটি অন্য সবার মতামত উপেক্ষা করে একেবারে ৩৬০ ডিগ্রি ইউটার্ন দিয়ে নতুন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের সুপারিশ করে। দেশকে এক গভীর সংকটে ফেলার পথ উন্মুক্ত করা হয়, যা বিচারপতি খায়রুল হকের মাধ্যমে পূর্ণতা পায়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের জন্য যে রায়ের দোহাই দেওয়া হয়েছিল, তার প্রেক্ষাপট ও ধরন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই রায়ের আইনি, নৈতিক ও সাংবিধানিক ভিত্তি খুবই দুর্বল ও গলদপূর্ণ ছিল। নৈতিকভাবে সেই রায় ও তার ওপর ভিত্তি করে সংবিধান সংশোধন করা ছিল শঠতা, ধূর্ততা, অতি উৎসাহ এবং গোঁজামিলে ভরপুর।

এই শঠতাপূর্ণ রায়ই পলাতক ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দানবে পরিণত করতে সহায়তা করেছে। শুধু দেশ নয়, শেখ হাসিনা ও তার দলের বর্তমান অবস্থার জন্যও বিচারপতি খায়রুল হক সরাসরি দায়ী। তাই দেশ ও জাতির স্বার্থে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার, যাতে এই দেশের উচ্চ আদালতে আর কোনো খায়রুল হক সৃষ্টি না হয়।

সম্প্রতি বিচারপতি খায়রুল হক গ্রেপ্তার হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে আরো সুনির্দিষ্ট মামলা করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করলে তা ভবিষ্যতে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি করা ব্যক্তিদের জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করবে। বর্তমান আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলকে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বহুবার বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ের তীব্র সমালোচনা করতে দেখেছি। তার বিচারও দাবি করছেন তিনি অনেকবার। সেই দাবি বাস্তবায়নের সুযোগ এখন তারই হাতের মুঠোয়।

লেখক : আইনজীবী, রাষ্ট্রচিন্তক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ

বর্তমানে ইংল্যান্ডে আইন পেশায় নিয়োজিত

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত