
সুশান্ত সিং

গত মাসে সৌদি আরব আর পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে। জটিল আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামোর মধ্যে এটিকে আর দশটি গতানুগতিক দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হিসেবে দেখলে ভুল হবে। গভীর তাৎপর্য বহন করছে এই চুক্তি।
উপসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা সংকট ক্রমেই জটিল হচ্ছে। এই বাস্তবতায় চুক্তিটিকে ইসরাইলের লাগামহীন সামরিক কর্মকাণ্ডের জবাব হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব অনেক গভীর। এই চুক্তি একদিকে পাকিস্তানের কৌশলগত অবস্থান বদলে দিয়েছে, অন্যদিকে, রিয়াদের সঙ্গে ইসলামাবাদের প্রতিরক্ষা সম্পর্কও আরো গভীর হয়েছে। এই চুক্তি ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। প্রতিবেশীদের ব্যাপারে নীতিনির্ধারণে তাদের জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।
প্রায় এক দশক ধরে পাকিস্তানকে কূটনৈতিকভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে একঘরে করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু নতুন এই পরিবর্তন তাকে কঠিন বাস্তবতার মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। শুধু পশ্চিম এশিয়াতেই নয়, বরং বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক বলয়েও ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের অবস্থান সংহত করেছে এই চুক্তি। সৌদি আরবের সঙ্গে এই চুক্তি পাকিস্তানকে নতুন বৈধতা দিয়েছে। উপমহাদেশের সামরিক ভারসাম্য থেকে শুরু করে ইসলামিক বিশ্বে ইতিবাচক বয়ান নির্মাণেও এই চুক্তি ভূমিকা রাখবে।
এই নতুন চুক্তিটি শুধু তাৎক্ষণিক নিরাপত্তাব্যবস্থা নয়। বরং তার চেয়েও বেশি কিছু। এই অংশীদারত্বের বড় সুবিধাভোগী হলো পাকিস্তান। ভারতের জন্য এই চুক্তি তাৎক্ষণিক সামরিক ঝুঁকি তৈরি করেছে। একই সঙ্গে তৈরি করেছে দীর্ঘস্থায়ী কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ। শুধু কৌশলগত সমন্বয়, নাকি মৌলিক নীতি পরিবর্তনÑকীভাবে ভারত এর জবাব দেয়, তার ওপরই নির্ভর করবে এর প্রভাব কতটা ব্যাপক হবে। এটা কি শুধু সাময়িক ধাক্কা হবে, নাকি কৌশলগত ভূগোলে স্থায়ী পরিবর্তন নিয়ে আসবে।
নতুন চুক্তি পাকিস্তানকে তাৎক্ষণিক এবং গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা দিয়েছে। সামরিক আধুনিকায়নের জন্য সৌদি অর্থায়নের সুস্পষ্ট আর্থিক সুবিধা তো আছেই। সেই সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধের পর থেকে পাকিস্তান যে কূটনৈতিক সুরক্ষার অভাব বোধ করছিল, এই চুক্তি তা পূরণ করেছে। ইসলামাবাদ এখন আরব বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী শক্তির সমর্থন পাচ্ছে। সৌদি আবর এমন একটি রাষ্ট্র, যার অর্থনৈতিক প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যের বাইরেও বিস্তৃত।
এই চুক্তি পাকিস্তানকে শুধু সাহসীই করে তুলবে না, বরং ভবিষ্যতে সামরিক সংকটের সময় আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার মধ্যেও এটি একটি বাধা তৈরি করবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মে মাসে ভারতের সঙ্গে যে সামরিক সংঘাতে জড়িয়েছিল পাকিস্তান, এ ধরনের পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে নয়াদিল্লির পক্ষে বিশ্বব্যাপী সমর্থন জোগাড় করা কঠিন হয়ে যাবে।
আরো তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, এই চুক্তির ফলে পাকিস্তান পরোক্ষভাবে উন্নত পশ্চিমা সামরিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ পাবে, যা আসবে সৌদি চ্যানেলের মাধ্যমে। রিয়াদ মার্কিন ও ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা শিল্পের অন্যতম ক্রেতা। এর মধ্যে এমন সব সামরিক সরঞ্জামও থাকতে পারে, যেগুলো কিছু কিছু ভারতের কাছে রয়েছে। সেটি ঘটলে দুই দেশের সামরিক সক্ষমতার ব্যবধান কমে আসবে। পরিহাসের বিষয় হলো, ভারতীয় সামরিক পরিকল্পনাবিদরা বছরের পর বছর ধরে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্য হিসাব কষেছেন। কিন্তু এখন থেকে তাদের সৌদি-অর্থায়নে অর্জিত পাকিস্তানের সক্ষমতার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।
প্রতিরক্ষা চুক্তিটি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর পেশাদারিত্ব, সক্ষমতা ও কৌশলগত দক্ষতার প্রতি আস্থার প্রতীক হিসেবে কাজ করছে। মে মাসের ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের পর সৌদি আরব পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্বের পক্ষে বৈধতা উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ফলে ভারত তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীকে সামরিকভাবে কোণঠাসা করার যে দাবি তুলেছিল, তা আসলে অর্থহীন হয়ে পড়ে।
এই চুক্তির একটি পারমাণবিক দিকও রয়েছে। সৌদি আরবকে নিজেদের পারমাণবিক প্রতিরক্ষার আওতায় নিয়ে এসেছে পাকিস্তান। এর মাধ্যমে আঞ্চলিক শক্তি থেকে বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের জায়গায় চলে গেছে তারা। পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা জোরালো করার পাশাপাশি নিষ্ক্রিয় বিনিয়োগকারী থেকে সক্রিয় অংশীদার হয়ে উঠেছে সৌদি আরব। এই চুক্তির কারণে ইসলামাবাদের পারমাণবিক আধুনিকায়নে সমর্থন জোগাতে রিয়াদ আরো উৎসাহিত হবে। এই সমর্থন এমন সব উন্নয়নের গতি বাড়াবে, যেটি উপমহাদেশের কৌশলগত ভারসাম্য বদলে দিতে পারে।
এই চুক্তি ইসলামাবাদের কৌশলগত স্থিতিশীলতার হিসাবও বদলে দিয়েছে। কারণ তাদের পারমাণবিক অস্ত্র এখন শুধু ভারতকে উদ্দেশ্য করে নয়, বরং ইসলামিক বিশ্বে বৃহত্তর প্রতিরোধ সমীকরণের অংশ হয়ে গেছে। পাকিস্তানের পারমাণবিক কৌশল এখন অন্যান্য মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের জন্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা হিসেবে কাজ করতে পারে। তাদের পারমাণবিক বিষয়টি এখন ভারতের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সীমা পেরিয়ে গেছে। এটি এখন বাইরে বৃহত্তর ভূকৌশলগত হিসাবনিকাশ দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক সমীকরণ এমনিতেই উত্তেজনাপূর্ণ। নতুন এই পরিস্থিতি নয়াদিল্লির জন্য সেটাকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলেছে।
সামরিক বিবেচনা তো থাকছেই। এর বাইরে, সৌদি আরবের সঙ্গে এই চুক্তি পাকিস্তানের জন্য কূটনৈতিক বিপ্লব হয়ে এসেছে। বছরের পর বছর ধরে আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতার পর, ইসলামাবাদ হঠাৎ করেই ইসলামের পবিত্র দুটি স্থান, মক্কা ও মদিনার প্রকাশ্য রক্ষকের মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে। এই প্রতীকী বাস্তবতার দুটো ভিন্ন দিক রয়েছে। একদিকে, এটা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর মূল অভ্যন্তরীণ বয়ানকে শক্তিশালী করে। বিশেষ করে গভীর রাজনৈতিক বিভেদ ও অর্থনৈতিক সংগ্রামের সময় তারা উপলব্ধি করবে যে, তারা জাতি এবং ইসলামের রক্ষক। অন্যদিকে, ইসলামিক বিশ্বের অপরিহার্য শক্তি হয়ে ওঠায় পাকিস্তানের দাবি বাইরের বিশ্বে বাড়তি গুরুত্ব পাবে।
ভারতের জন্য এই বাস্তবতা ক্ষতিকর। বহু বছর ধরে ইসলামিক বিশ্বে পাকিস্তানের অবস্থান দুর্বল ছিল। তুরস্ক তাদের কর্তৃত্বপূর্ণ ভূমিকাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চেয়েছিল। ইরান ও কাতারের মতো দেশগুলো ইসলামিক নেতৃত্ব এবং পরিচয়ের ভিন্ন ধারণা নিয়ে হাজির হয়েছিল। আর সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলো ভারতের সঙ্গে গভীর বাণিজ্যিক ও নিরাপত্তা সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। নয়াদিল্লিও চেয়েছিল এই বিভাজনকে কাজে লাগাতে।
অর্থনৈতিক প্রভাব, নিরাপত্তা অংশীদারত্ব এবং বয়ান নির্মাণের মাধ্যমে ভারত দীর্ঘকাল ধরে পাকিস্তানকে একটি অস্থির, সন্ত্রাস-সমর্থক রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরেছিল। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সৌদি আরবের সঙ্গে অংশীদারত্ব চুক্তি বহু যত্নে গড়ে তোলা মোদির এই বয়ান চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছে। পাকিস্তান এখন আবার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে আলোচনার টেবিলে জায়গা করে নিয়েছে।
তবে সৌদি আরব এবং পাকিস্তানের এই কৌশলগত চুক্তিকে ত্রুটিহীন মনে করা ভুল হবে। উভয় দেশেরই কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, যা এই অংশীদারত্বের ব্যাপ্তি এবং কার্যকারিতাকে কমিয়ে দিতে পারে।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এখন অনেক বেশি জায়গায় সক্রিয়। তারা একদিকে বালুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের উপজাতি অঞ্চলে বিভিন্ন বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করছে। অন্যদিকে ভারত ও আফগানিস্তান সীমান্তেও তাদের প্রস্তুতি ধরে রাখতে হচ্ছে। ফলে উপসাগরীয় অঞ্চলে জরুরি পরিস্থিতিতে সামরিক প্রস্তুতির জন্য তাদের রিজার্ভ খুব একটা থাকবে না। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুর্বলতাও তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার লাগাম টেনে ধরছে। সৌদি সমর্থন থাকলেও টেকসই আধুনিকায়নের জন্য নিজস্ব প্রযুক্তির শক্ত ভিত্তি প্রয়োজন। সেই জায়গায় পাকিস্তান এখনো চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে আছে।
যদিও পাকিস্তানের পারমাণবিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন নেই। তবে প্রতিষ্ঠিত পারমাণবিক শক্তিগুলোর তুলনায় তাদের ব্যাপ্তি এবং প্রস্তুতির ঘাটতি আছে। বাইরের কাউকে এই সুবিধা দিতে গেলে দেশের নিরাপত্তা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। এটা করলে পাকিস্তানের কমান্ড কাঠামোর ওপর চাপ পড়বে। তাদের যোগাযোগব্যবস্থা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রোটোকল এবং বহুস্তরের অনুমোদন প্রক্রিয়ার দুর্বলতাগুলো প্রকাশ হয়ে পড়বে। এছাড়া স্পর্শকাতর উপাদানের স্থানান্তর এবং নাড়াচাড়াও তখন বেড়ে যাবে। উপরন্তু, ইসলামাবাদে এখনো রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে, যা দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত সমন্বয় নিয়ে প্রশ্ন তুলবে।
সৌদি আরবেরও নিজস্ব সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ভারত তাদের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও জ্বালানি অংশীদার। উপসাগরীয় অঞ্চলে লাখ লাখ ভারতীয় শ্রমিক সৌদি অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। নয়াদিল্লির সঙ্গে রিয়াদের গভীর অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্পর্ক রক্ষার জন্য এমন কোনো পদক্ষেপ তাদের নেওয়া উচিত নয়, যেটা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষতি করতে পারে। এর মানে হলো, সৌদি আরব খুব সাবধানে পাকিস্তানের সঙ্গে অংশীদারত্ব বজায় রাখবে। ভারতের বিরুদ্ধে সরাসরি সংঘাত এড়িয়ে চলবে। যেকোনো পরিস্থিতিতে সৌদি আরব ইরান এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে বেশি গুরুত্ব দেবে। দক্ষিণ এশিয়ার সংঘাতকে ততটা গুরুত্ব দেবে না।
সৌদি আরব চীনের মধ্যস্থতায় ইরানের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে। এটি তাদের অভ্যন্তরীণ বৈপরীত্য সামনে এনেছে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে সুরক্ষা, ইরানের সঙ্গে সেতুবন্ধ এবং পাকিস্তানকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে লাভজনক সম্পর্ক ধরে রাখাÑএগুলো সৌদি আরবের জন্য পরস্পরবিরোধী স্বার্থের জটিল জাল তৈরি করেছে। এসব দ্বন্দ্ব নিঃসন্দেহে রিয়াদ আর ইসলামাবাদের মধ্যে কার্যকর সহযোগিতার ওপর প্রভাব ফেলবে।
সৌদি আরব-পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা চুক্তির কার্যকর প্রভাব তাই শেষ পর্যন্ত ধারণার চেয়ে কম হতে পারে। নিজেদের শক্তিশালী মুহূর্তগুলো অতিরিক্ত ব্যবহারের অতীত ইতিহাস রয়েছে পাকিস্তানের। আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক থেকে শুরু করে চীনের সঙ্গে তাদের প্রাথমিক অংশীদারত্বÑসবখানেই সেটা দেখা গেছে। পাকিস্তানি নীতিনির্ধারকরা যদি ট্যাকটিক্যাল লাভকে মৌলিক কৌশলগত অর্জন ভেবে ভুল করেন, তাহলে সৌদির সঙ্গে তাদের সম্পর্কটাও সেদিকে যেতে পারে।
ভারত প্রতিপক্ষের নির্বুদ্ধিতাকে কাজে লাগিয়ে কৌশলগত চিন্তাভাবনা সাজাতে পারে না। সৌদি আরব-পাকিস্তান নিরাপত্তা চুক্তি দিল্লির জন্য নতুন সমীকরণ তৈরি করেছে। ফলে সৌদি আরবের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কটা এখন আরো জটিল হলো। অথচ গত এক দশকে জ্বালানি, বিনিয়োগ ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সম্পর্কটা অনেক গভীর হয়েছিল। এখন রিয়াদকে একই সঙ্গে দুটো পারমাণবিক-অস্ত্রধারী প্রতিদ্বন্দ্বী দেশকে সামলাতে হচ্ছে।
এই পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক মহলে ভারত ও পাকিস্তানকে আবার একই সমীকরণে নিয়ে আসার ঝুঁকি তৈরি করছে। অর্থাৎ, তৃতীয় পক্ষগুলো তাদের দুটি আলাদা কৌশলগত শক্তি হিসেবে না দেখে একই দৃষ্টিতে দেখতে পারে। ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের জন্য এটি একটি বড় ধাক্কা। তারা ভারতকে প্রতিবেশী প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো থেকে আলাদা উদীয়মান শক্তি হিসেবে দেখানোর প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শেষ তিনটি সংঘাত (২০১৬, ২০১৯ এবং এই বছরের) কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল। সৌদি আরব এই সংকটগুলোয় মধ্যস্থতা করেছে। তবে পাকিস্তানের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তায় প্রকাশ্য অংশগ্রহণের পর কাশ্মীর সমস্যার সমাধানে জড়িত হওয়ার জন্য সৌদি আরবের উৎসাহ এবং প্রভাব দুটোই বাড়তে পারে। দীর্ঘদিন ধরে কাশ্মীর ইস্যুতে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপকে ভারত ‘রেড লাইন’ বিবেচনা করে এসেছে। কিন্তু এখন ইসলামাবাদের নতুন কৌশলগত মিত্রের যদি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় জোরালো স্বার্থ থাকে, তবে তা দিল্লির জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হবে।
ভারত এখন আরো বিপজ্জনক প্রতিপক্ষের মুখোমুখি। আর্থিক সহায়তা, পরোক্ষভাবে পশ্চিমা অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ এবং সৌদি আরবের কূটনৈতিক সমর্থনের কারণে ভারতের প্রতি পাকিস্তানের সামরিক অবস্থান কঠোর হবে। এমনকি সৌদি আরবের সঙ্গে এই অংশীদারত্ব সম্পূর্ণরূপে কার্যকর না হলেও, এর প্রতীকী প্রভাব প্রতিরোধের চেহারা পাল্টে দেবে। এখন ভারতকে এমন এক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হচ্ছে, যাদের প্রতি চীনের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে, সৌদি আরব যাদের কৌশলগত পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে আর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছ থেকে যারা নতুন করে মার্কিন আনুকূল্য পাচ্ছে।
এই বাস্তবতা দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত পরিবেশকে এমনভাবে বদলে দিচ্ছে, যা দিল্লি আগে ভাবেনি। নির্মম সত্যি হলো, ভারত নিজেই এই পরিস্থিতির দিকে অসাবধানে এগিয়ে গেছে। ট্রাম্প, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বা সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের মতো নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে পররাষ্ট্রনীতিতে প্রাধান্য দিয়েছিলেন মোদি। বর্তমান ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেটা আর উপযুক্ত নাও হতে পারে।
ব্যক্তিত্ব এবং নেতা পর্যায়ে যোগাযোগের ওপর অতিরিক্ত জোর দেওয়ায় মোদি কিছু স্বল্পমেয়াদি সুবিধা পেয়েছেন ঠিক, কিন্তু এতে ভারতের কূটনৈতিক দুর্বলতাও তৈরি করেছে। ভারতের এখন নতুন কৌশলগত বিচক্ষণতা দরকার। তাদের বুঝতে হবে, আঞ্চলিক জোটের নতুন রূপরেখা দিল্লিতে নয়, বরং রিয়াদ, ইসলামাবাদ এবং বেইজিংয়ে তৈরি হচ্ছে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার দিকে জোর দেওয়া অর্থহীন। ভারতকে অবশ্যই এমন কৌশল নিতে হবে এবং এমন নেতা তৈরি করতে হবে, যারা গত এক দশকের ভুল এড়িয়ে চলতে পারবে। এই ভুলগুলোর মধ্যে রয়েছেÑপশ্চিমা আনুকূল্যের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা, পাকিস্তানের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে তুচ্ছ করা এবং শুধু মোদির ব্যক্তিত্বের জোরে ভারতের বৈশ্বিক উত্থানের বিষয়ে অতিরিক্ত অহংকার।
ভারতের এগিয়ে যাওয়ার উপায় হলো, মোদির আমলের সহজপ্রাপ্য অর্জনগুলো ত্যাগ করা এবং এই তিক্ত বাস্তবতা মেনে নেওয়া যে, আঞ্চলিক ক্ষমতা আর দিল্লির আকাঙ্ক্ষা দিয়ে নির্ধারিত হচ্ছে না। সেটি নির্ধারিত হচ্ছে তাদের প্রতিপক্ষের কৌশলগত পছন্দ দ্বারা।
লেখক : ফরেন পলিসি অবলম্বনে সংক্ষেপিত ভাষান্তর জুলফিকার হায়দার

গত মাসে সৌদি আরব আর পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে। জটিল আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামোর মধ্যে এটিকে আর দশটি গতানুগতিক দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হিসেবে দেখলে ভুল হবে। গভীর তাৎপর্য বহন করছে এই চুক্তি।
উপসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা সংকট ক্রমেই জটিল হচ্ছে। এই বাস্তবতায় চুক্তিটিকে ইসরাইলের লাগামহীন সামরিক কর্মকাণ্ডের জবাব হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব অনেক গভীর। এই চুক্তি একদিকে পাকিস্তানের কৌশলগত অবস্থান বদলে দিয়েছে, অন্যদিকে, রিয়াদের সঙ্গে ইসলামাবাদের প্রতিরক্ষা সম্পর্কও আরো গভীর হয়েছে। এই চুক্তি ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। প্রতিবেশীদের ব্যাপারে নীতিনির্ধারণে তাদের জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।
প্রায় এক দশক ধরে পাকিস্তানকে কূটনৈতিকভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে একঘরে করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু নতুন এই পরিবর্তন তাকে কঠিন বাস্তবতার মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। শুধু পশ্চিম এশিয়াতেই নয়, বরং বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক বলয়েও ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের অবস্থান সংহত করেছে এই চুক্তি। সৌদি আরবের সঙ্গে এই চুক্তি পাকিস্তানকে নতুন বৈধতা দিয়েছে। উপমহাদেশের সামরিক ভারসাম্য থেকে শুরু করে ইসলামিক বিশ্বে ইতিবাচক বয়ান নির্মাণেও এই চুক্তি ভূমিকা রাখবে।
এই নতুন চুক্তিটি শুধু তাৎক্ষণিক নিরাপত্তাব্যবস্থা নয়। বরং তার চেয়েও বেশি কিছু। এই অংশীদারত্বের বড় সুবিধাভোগী হলো পাকিস্তান। ভারতের জন্য এই চুক্তি তাৎক্ষণিক সামরিক ঝুঁকি তৈরি করেছে। একই সঙ্গে তৈরি করেছে দীর্ঘস্থায়ী কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ। শুধু কৌশলগত সমন্বয়, নাকি মৌলিক নীতি পরিবর্তনÑকীভাবে ভারত এর জবাব দেয়, তার ওপরই নির্ভর করবে এর প্রভাব কতটা ব্যাপক হবে। এটা কি শুধু সাময়িক ধাক্কা হবে, নাকি কৌশলগত ভূগোলে স্থায়ী পরিবর্তন নিয়ে আসবে।
নতুন চুক্তি পাকিস্তানকে তাৎক্ষণিক এবং গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা দিয়েছে। সামরিক আধুনিকায়নের জন্য সৌদি অর্থায়নের সুস্পষ্ট আর্থিক সুবিধা তো আছেই। সেই সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধের পর থেকে পাকিস্তান যে কূটনৈতিক সুরক্ষার অভাব বোধ করছিল, এই চুক্তি তা পূরণ করেছে। ইসলামাবাদ এখন আরব বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী শক্তির সমর্থন পাচ্ছে। সৌদি আবর এমন একটি রাষ্ট্র, যার অর্থনৈতিক প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যের বাইরেও বিস্তৃত।
এই চুক্তি পাকিস্তানকে শুধু সাহসীই করে তুলবে না, বরং ভবিষ্যতে সামরিক সংকটের সময় আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার মধ্যেও এটি একটি বাধা তৈরি করবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মে মাসে ভারতের সঙ্গে যে সামরিক সংঘাতে জড়িয়েছিল পাকিস্তান, এ ধরনের পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে নয়াদিল্লির পক্ষে বিশ্বব্যাপী সমর্থন জোগাড় করা কঠিন হয়ে যাবে।
আরো তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, এই চুক্তির ফলে পাকিস্তান পরোক্ষভাবে উন্নত পশ্চিমা সামরিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ পাবে, যা আসবে সৌদি চ্যানেলের মাধ্যমে। রিয়াদ মার্কিন ও ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা শিল্পের অন্যতম ক্রেতা। এর মধ্যে এমন সব সামরিক সরঞ্জামও থাকতে পারে, যেগুলো কিছু কিছু ভারতের কাছে রয়েছে। সেটি ঘটলে দুই দেশের সামরিক সক্ষমতার ব্যবধান কমে আসবে। পরিহাসের বিষয় হলো, ভারতীয় সামরিক পরিকল্পনাবিদরা বছরের পর বছর ধরে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্য হিসাব কষেছেন। কিন্তু এখন থেকে তাদের সৌদি-অর্থায়নে অর্জিত পাকিস্তানের সক্ষমতার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।
প্রতিরক্ষা চুক্তিটি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর পেশাদারিত্ব, সক্ষমতা ও কৌশলগত দক্ষতার প্রতি আস্থার প্রতীক হিসেবে কাজ করছে। মে মাসের ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের পর সৌদি আরব পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্বের পক্ষে বৈধতা উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ফলে ভারত তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীকে সামরিকভাবে কোণঠাসা করার যে দাবি তুলেছিল, তা আসলে অর্থহীন হয়ে পড়ে।
এই চুক্তির একটি পারমাণবিক দিকও রয়েছে। সৌদি আরবকে নিজেদের পারমাণবিক প্রতিরক্ষার আওতায় নিয়ে এসেছে পাকিস্তান। এর মাধ্যমে আঞ্চলিক শক্তি থেকে বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের জায়গায় চলে গেছে তারা। পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা জোরালো করার পাশাপাশি নিষ্ক্রিয় বিনিয়োগকারী থেকে সক্রিয় অংশীদার হয়ে উঠেছে সৌদি আরব। এই চুক্তির কারণে ইসলামাবাদের পারমাণবিক আধুনিকায়নে সমর্থন জোগাতে রিয়াদ আরো উৎসাহিত হবে। এই সমর্থন এমন সব উন্নয়নের গতি বাড়াবে, যেটি উপমহাদেশের কৌশলগত ভারসাম্য বদলে দিতে পারে।
এই চুক্তি ইসলামাবাদের কৌশলগত স্থিতিশীলতার হিসাবও বদলে দিয়েছে। কারণ তাদের পারমাণবিক অস্ত্র এখন শুধু ভারতকে উদ্দেশ্য করে নয়, বরং ইসলামিক বিশ্বে বৃহত্তর প্রতিরোধ সমীকরণের অংশ হয়ে গেছে। পাকিস্তানের পারমাণবিক কৌশল এখন অন্যান্য মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের জন্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা হিসেবে কাজ করতে পারে। তাদের পারমাণবিক বিষয়টি এখন ভারতের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সীমা পেরিয়ে গেছে। এটি এখন বাইরে বৃহত্তর ভূকৌশলগত হিসাবনিকাশ দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক সমীকরণ এমনিতেই উত্তেজনাপূর্ণ। নতুন এই পরিস্থিতি নয়াদিল্লির জন্য সেটাকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলেছে।
সামরিক বিবেচনা তো থাকছেই। এর বাইরে, সৌদি আরবের সঙ্গে এই চুক্তি পাকিস্তানের জন্য কূটনৈতিক বিপ্লব হয়ে এসেছে। বছরের পর বছর ধরে আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতার পর, ইসলামাবাদ হঠাৎ করেই ইসলামের পবিত্র দুটি স্থান, মক্কা ও মদিনার প্রকাশ্য রক্ষকের মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে। এই প্রতীকী বাস্তবতার দুটো ভিন্ন দিক রয়েছে। একদিকে, এটা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর মূল অভ্যন্তরীণ বয়ানকে শক্তিশালী করে। বিশেষ করে গভীর রাজনৈতিক বিভেদ ও অর্থনৈতিক সংগ্রামের সময় তারা উপলব্ধি করবে যে, তারা জাতি এবং ইসলামের রক্ষক। অন্যদিকে, ইসলামিক বিশ্বের অপরিহার্য শক্তি হয়ে ওঠায় পাকিস্তানের দাবি বাইরের বিশ্বে বাড়তি গুরুত্ব পাবে।
ভারতের জন্য এই বাস্তবতা ক্ষতিকর। বহু বছর ধরে ইসলামিক বিশ্বে পাকিস্তানের অবস্থান দুর্বল ছিল। তুরস্ক তাদের কর্তৃত্বপূর্ণ ভূমিকাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চেয়েছিল। ইরান ও কাতারের মতো দেশগুলো ইসলামিক নেতৃত্ব এবং পরিচয়ের ভিন্ন ধারণা নিয়ে হাজির হয়েছিল। আর সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলো ভারতের সঙ্গে গভীর বাণিজ্যিক ও নিরাপত্তা সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। নয়াদিল্লিও চেয়েছিল এই বিভাজনকে কাজে লাগাতে।
অর্থনৈতিক প্রভাব, নিরাপত্তা অংশীদারত্ব এবং বয়ান নির্মাণের মাধ্যমে ভারত দীর্ঘকাল ধরে পাকিস্তানকে একটি অস্থির, সন্ত্রাস-সমর্থক রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরেছিল। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সৌদি আরবের সঙ্গে অংশীদারত্ব চুক্তি বহু যত্নে গড়ে তোলা মোদির এই বয়ান চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছে। পাকিস্তান এখন আবার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে আলোচনার টেবিলে জায়গা করে নিয়েছে।
তবে সৌদি আরব এবং পাকিস্তানের এই কৌশলগত চুক্তিকে ত্রুটিহীন মনে করা ভুল হবে। উভয় দেশেরই কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, যা এই অংশীদারত্বের ব্যাপ্তি এবং কার্যকারিতাকে কমিয়ে দিতে পারে।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এখন অনেক বেশি জায়গায় সক্রিয়। তারা একদিকে বালুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের উপজাতি অঞ্চলে বিভিন্ন বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করছে। অন্যদিকে ভারত ও আফগানিস্তান সীমান্তেও তাদের প্রস্তুতি ধরে রাখতে হচ্ছে। ফলে উপসাগরীয় অঞ্চলে জরুরি পরিস্থিতিতে সামরিক প্রস্তুতির জন্য তাদের রিজার্ভ খুব একটা থাকবে না। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুর্বলতাও তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার লাগাম টেনে ধরছে। সৌদি সমর্থন থাকলেও টেকসই আধুনিকায়নের জন্য নিজস্ব প্রযুক্তির শক্ত ভিত্তি প্রয়োজন। সেই জায়গায় পাকিস্তান এখনো চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে আছে।
যদিও পাকিস্তানের পারমাণবিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন নেই। তবে প্রতিষ্ঠিত পারমাণবিক শক্তিগুলোর তুলনায় তাদের ব্যাপ্তি এবং প্রস্তুতির ঘাটতি আছে। বাইরের কাউকে এই সুবিধা দিতে গেলে দেশের নিরাপত্তা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। এটা করলে পাকিস্তানের কমান্ড কাঠামোর ওপর চাপ পড়বে। তাদের যোগাযোগব্যবস্থা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রোটোকল এবং বহুস্তরের অনুমোদন প্রক্রিয়ার দুর্বলতাগুলো প্রকাশ হয়ে পড়বে। এছাড়া স্পর্শকাতর উপাদানের স্থানান্তর এবং নাড়াচাড়াও তখন বেড়ে যাবে। উপরন্তু, ইসলামাবাদে এখনো রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে, যা দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত সমন্বয় নিয়ে প্রশ্ন তুলবে।
সৌদি আরবেরও নিজস্ব সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ভারত তাদের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও জ্বালানি অংশীদার। উপসাগরীয় অঞ্চলে লাখ লাখ ভারতীয় শ্রমিক সৌদি অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। নয়াদিল্লির সঙ্গে রিয়াদের গভীর অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্পর্ক রক্ষার জন্য এমন কোনো পদক্ষেপ তাদের নেওয়া উচিত নয়, যেটা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষতি করতে পারে। এর মানে হলো, সৌদি আরব খুব সাবধানে পাকিস্তানের সঙ্গে অংশীদারত্ব বজায় রাখবে। ভারতের বিরুদ্ধে সরাসরি সংঘাত এড়িয়ে চলবে। যেকোনো পরিস্থিতিতে সৌদি আরব ইরান এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে বেশি গুরুত্ব দেবে। দক্ষিণ এশিয়ার সংঘাতকে ততটা গুরুত্ব দেবে না।
সৌদি আরব চীনের মধ্যস্থতায় ইরানের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে। এটি তাদের অভ্যন্তরীণ বৈপরীত্য সামনে এনেছে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে সুরক্ষা, ইরানের সঙ্গে সেতুবন্ধ এবং পাকিস্তানকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে লাভজনক সম্পর্ক ধরে রাখাÑএগুলো সৌদি আরবের জন্য পরস্পরবিরোধী স্বার্থের জটিল জাল তৈরি করেছে। এসব দ্বন্দ্ব নিঃসন্দেহে রিয়াদ আর ইসলামাবাদের মধ্যে কার্যকর সহযোগিতার ওপর প্রভাব ফেলবে।
সৌদি আরব-পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা চুক্তির কার্যকর প্রভাব তাই শেষ পর্যন্ত ধারণার চেয়ে কম হতে পারে। নিজেদের শক্তিশালী মুহূর্তগুলো অতিরিক্ত ব্যবহারের অতীত ইতিহাস রয়েছে পাকিস্তানের। আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক থেকে শুরু করে চীনের সঙ্গে তাদের প্রাথমিক অংশীদারত্বÑসবখানেই সেটা দেখা গেছে। পাকিস্তানি নীতিনির্ধারকরা যদি ট্যাকটিক্যাল লাভকে মৌলিক কৌশলগত অর্জন ভেবে ভুল করেন, তাহলে সৌদির সঙ্গে তাদের সম্পর্কটাও সেদিকে যেতে পারে।
ভারত প্রতিপক্ষের নির্বুদ্ধিতাকে কাজে লাগিয়ে কৌশলগত চিন্তাভাবনা সাজাতে পারে না। সৌদি আরব-পাকিস্তান নিরাপত্তা চুক্তি দিল্লির জন্য নতুন সমীকরণ তৈরি করেছে। ফলে সৌদি আরবের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কটা এখন আরো জটিল হলো। অথচ গত এক দশকে জ্বালানি, বিনিয়োগ ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সম্পর্কটা অনেক গভীর হয়েছিল। এখন রিয়াদকে একই সঙ্গে দুটো পারমাণবিক-অস্ত্রধারী প্রতিদ্বন্দ্বী দেশকে সামলাতে হচ্ছে।
এই পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক মহলে ভারত ও পাকিস্তানকে আবার একই সমীকরণে নিয়ে আসার ঝুঁকি তৈরি করছে। অর্থাৎ, তৃতীয় পক্ষগুলো তাদের দুটি আলাদা কৌশলগত শক্তি হিসেবে না দেখে একই দৃষ্টিতে দেখতে পারে। ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের জন্য এটি একটি বড় ধাক্কা। তারা ভারতকে প্রতিবেশী প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো থেকে আলাদা উদীয়মান শক্তি হিসেবে দেখানোর প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শেষ তিনটি সংঘাত (২০১৬, ২০১৯ এবং এই বছরের) কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল। সৌদি আরব এই সংকটগুলোয় মধ্যস্থতা করেছে। তবে পাকিস্তানের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তায় প্রকাশ্য অংশগ্রহণের পর কাশ্মীর সমস্যার সমাধানে জড়িত হওয়ার জন্য সৌদি আরবের উৎসাহ এবং প্রভাব দুটোই বাড়তে পারে। দীর্ঘদিন ধরে কাশ্মীর ইস্যুতে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপকে ভারত ‘রেড লাইন’ বিবেচনা করে এসেছে। কিন্তু এখন ইসলামাবাদের নতুন কৌশলগত মিত্রের যদি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় জোরালো স্বার্থ থাকে, তবে তা দিল্লির জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হবে।
ভারত এখন আরো বিপজ্জনক প্রতিপক্ষের মুখোমুখি। আর্থিক সহায়তা, পরোক্ষভাবে পশ্চিমা অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ এবং সৌদি আরবের কূটনৈতিক সমর্থনের কারণে ভারতের প্রতি পাকিস্তানের সামরিক অবস্থান কঠোর হবে। এমনকি সৌদি আরবের সঙ্গে এই অংশীদারত্ব সম্পূর্ণরূপে কার্যকর না হলেও, এর প্রতীকী প্রভাব প্রতিরোধের চেহারা পাল্টে দেবে। এখন ভারতকে এমন এক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হচ্ছে, যাদের প্রতি চীনের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে, সৌদি আরব যাদের কৌশলগত পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে আর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছ থেকে যারা নতুন করে মার্কিন আনুকূল্য পাচ্ছে।
এই বাস্তবতা দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত পরিবেশকে এমনভাবে বদলে দিচ্ছে, যা দিল্লি আগে ভাবেনি। নির্মম সত্যি হলো, ভারত নিজেই এই পরিস্থিতির দিকে অসাবধানে এগিয়ে গেছে। ট্রাম্প, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বা সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের মতো নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে পররাষ্ট্রনীতিতে প্রাধান্য দিয়েছিলেন মোদি। বর্তমান ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেটা আর উপযুক্ত নাও হতে পারে।
ব্যক্তিত্ব এবং নেতা পর্যায়ে যোগাযোগের ওপর অতিরিক্ত জোর দেওয়ায় মোদি কিছু স্বল্পমেয়াদি সুবিধা পেয়েছেন ঠিক, কিন্তু এতে ভারতের কূটনৈতিক দুর্বলতাও তৈরি করেছে। ভারতের এখন নতুন কৌশলগত বিচক্ষণতা দরকার। তাদের বুঝতে হবে, আঞ্চলিক জোটের নতুন রূপরেখা দিল্লিতে নয়, বরং রিয়াদ, ইসলামাবাদ এবং বেইজিংয়ে তৈরি হচ্ছে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার দিকে জোর দেওয়া অর্থহীন। ভারতকে অবশ্যই এমন কৌশল নিতে হবে এবং এমন নেতা তৈরি করতে হবে, যারা গত এক দশকের ভুল এড়িয়ে চলতে পারবে। এই ভুলগুলোর মধ্যে রয়েছেÑপশ্চিমা আনুকূল্যের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা, পাকিস্তানের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে তুচ্ছ করা এবং শুধু মোদির ব্যক্তিত্বের জোরে ভারতের বৈশ্বিক উত্থানের বিষয়ে অতিরিক্ত অহংকার।
ভারতের এগিয়ে যাওয়ার উপায় হলো, মোদির আমলের সহজপ্রাপ্য অর্জনগুলো ত্যাগ করা এবং এই তিক্ত বাস্তবতা মেনে নেওয়া যে, আঞ্চলিক ক্ষমতা আর দিল্লির আকাঙ্ক্ষা দিয়ে নির্ধারিত হচ্ছে না। সেটি নির্ধারিত হচ্ছে তাদের প্রতিপক্ষের কৌশলগত পছন্দ দ্বারা।
লেখক : ফরেন পলিসি অবলম্বনে সংক্ষেপিত ভাষান্তর জুলফিকার হায়দার

আজকের বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা মূলত শিক্ষা ও গবেষণার উৎকর্ষ ঘিরে। যে বিশ্ববিদ্যালয় যত মানসম্মত শিক্ষা দিতে পারে, যত বেশি প্রভাবশালী গবেষণা প্রকাশ করতে পারে, সে-ই বিশ্ব র্যাংকিংয়ে এগিয়ে থাকে।
১ দিন আগে
আমি বলছি না যে, ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণির কোনো বিরূপ প্রভাব পরিবেশের ওপর নেই; কিন্তু তাদের চাষাবাদ বন্ধ না করে ব্যবহারে একটা সীমারেখা টানা যেতে পারে। যেমন : প্রাকৃতিক বনাঞ্চল, একক বাগান এবং ফসলি জমির পরিবর্তে উপকূলীয় অঞ্চল
১ দিন আগে
বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার সমীকরণ, আঞ্চলিক ভূরাজনীতি এবং জনগণের প্রত্যাশাÑএই তিনটি উপাদান যূথবদ্ধ হয়ে নতুন বাস্তবতা তৈরি করছে।
১ দিন আগে
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান দেশের তরুণদের রাজনৈতিক ভাবনায় বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। এর প্রতিচ্ছবি আমরা দেখতে পারছি দেশের চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের ভোটের ফল থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিজয় দেশের রাজনীতির ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে।
১ দিন আগে