ভূগর্ভস্থ পানি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান প্রাকৃতিক সম্পদ। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট হাওর অঞ্চল জলসম্পদের দিক থেকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। বর্ষা মৌসুমে এই অঞ্চলের নদী-নালা ও বিল-হাওর প্লাবিত থাকে এবং বিশাল জলাভূমি গড়ে ওঠে। এ কারণে সাধারণ মানুষের কাছে এ অঞ্চলকে পানিতে ভরপুর বলেই মনে হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা প্রমাণ করেছে, ভূগর্ভস্থ পানির দিক থেকে হাওরাঞ্চল মোটেও নিরাপদ নয়; বরং এখানে ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে। সিলেট জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে পরিচালিত গবেষণায় যার প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে কিছু তথ্য ও বিবরণী নিচে প্রদান করা হলো।
শুকিয়ে আসছে কূপের পানি
গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সিলেটের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গড় পানির স্তর ৮ দশমিক ০২ মিটার থেকে নেমে ৭ দশমিক ০৮ মিটারে পৌঁছেছে। অর্থাৎ, গড়ে এক মিটারের বেশি পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। বিশেষ করে ফেঞ্চুগঞ্জের (SY ৩০) এবং দক্ষিণ সুরমার (SY ৮৫) পর্যবেক্ষণ কূপে পানির স্তর ২ থেকে ৪ দশমিক ৫ মিটারের মধ্যে ওঠানামা করছে, যা পানি সংকটেরই ইঙ্গিত দেয়।
বৃষ্টিপাত বাড়লেও পানির স্তর কমেছে
মজার বিষয় হলো, এ সময়ে সিলেটে বৃষ্টিপাত বেড়েছে। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ৪ হাজার ২০০ মিলিমিটার থেকে বেড়ে ৫ হাজার মিলিমিটারে পৌঁছলেও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বাড়েনি। গবেষণায় পানির স্তর ও বৃষ্টিপাতের মধ্যে সম্পর্ক খুবই দুর্বল (মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ) পাওয়া গেছে। এর প্রধান কারণ, সিলেট অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক গঠন বা লিথোলজি ভূগর্ভস্থ পানির পুনর্ভরণে (Recharge) বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে। পুরু কাদার স্তর (কনফাইনিং লেয়ার) পানিকে নিচে প্রবেশে বাধা দেয়, ফলে বৃষ্টির পানি সহজে ভূগর্ভস্থ স্তরে পৌঁছাতে পারে না। এর ফলে ভূগর্ভস্থ পানির সংকট দীর্ঘস্থায়ী হয়ে উঠছে। এ অবস্থার ফলে স্থানীয় কৃষকরা শুষ্ক মৌসুমে সেচ ব্যবস্থাপনায় মারাত্মক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন।
২০৫০ সালের ভয়াবহ পূর্বাভাস
ভবিষ্যৎ পূর্বাভাস আরো ভয়াবহ। গবেষণায় ব্যবহৃত MAKESENS মডেল অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ দক্ষিণ সুরমার (SY৫৫) নম্বর কূপের পানির স্তর ৩ দশমিক ২১ মিটার নিচে নেমে যেতে পারে। একই উপজেলার (SY১১১) কূপের ন্যূনতম স্তর ২ দশমিক ৫১ মিটারে পৌঁছাতে পারে, যা সাকশন পাম্পের সক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। এর ফলে এসব এলাকায় সাধারণ পাম্প দিয়ে পানি তোলা অসম্ভব হবে।
আশাব্যঞ্জক হাইড্রোজিওলজিক্যাল চিত্র
সিলেট জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেশিরভাগ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর উদ্বেগজনক হারে হ্রাস পেলেও গোলাপগঞ্জ উপজেলা এবং দক্ষিণ সুরমা উপজেলার কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় আকুইফারের (Aquifer) অবস্থান তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল। গোলাপগঞ্জ (SY৫৩) ও দক্ষিণ সুরমা (SY৫৭) পর্যবেক্ষণ কূপের উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৯০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এখানে পানির স্তরের গড় গভীরতা যথাক্রমে ১৭ দশমিক ৬৯ মিটার ও ১১ দশমিক ৭০ মিটার থেকে সামান্য পরিবর্তিত হয়ে ১৮ দশমিক ২২ মিটার ও ১১ দশমিক ৭৯ মিটারে পৌঁছেছে। এই স্থিতিশীলতা ইঙ্গিত দেয়, স্থানীয় ভূতাত্ত্বিক গঠন (Dupi Tila Formation-এর প্রভাব) এবং আকুইফারের সুনির্দিষ্ট হাইড্রোজিওলজিক্যাল বৈশিষ্ট্যের কারণে এসব এলাকায় প্রাকৃতিক রিচার্জ ও নিষ্কাশনের মধ্যে একটি ভারসাম্য বজায় রয়েছে।
দুর্বল পানি নীতি ও আইনগত কাঠামো
বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনার জন্য প্রণীত নীতি ও আইনগত কাঠামো বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও এর বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের মুখে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৮৫ সালের Ground Water Management Ordinance, ১৯৯৯ সালের National Water Policy, ২০১৩ সালের Bangladesh Water Act এবং ২০১৮ সালের Bangladesh Water Rules ভূগর্ভস্থ পানির টেকসই ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু দুর্বল প্রয়োগ, প্রতিষ্ঠানগত সমন্বয়ের অভাব, পর্যাপ্ত মনিটরিং ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা এবং স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সচেতনতার ঘাটতি কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনে বাধা সৃষ্টি করছে।
সমাধানের পথ
১. বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ : রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং (Rainwater Harvesting) বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা। বাড়িঘর ও প্রতিষ্ঠানের ছাদে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে বিশেষ ফিল্টার মাধ্যমে পরিশোধন করা। এছাড়া রিচার্জ শ্যাফ্ট নির্মাণ করলে এর মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ কঠিন শিলাস্তর ভেদ করে বৃষ্টির পানি সরাসরি ভূগর্ভস্থ আকুইফারে পৌঁছে যাবে। চেক ড্যাম ও কনট্যুর ট্রেঞ্চের মাধ্যমে পাহাড়ি অঞ্চলে ছোট ছোট বাঁধ ও খাল তৈরি করে বৃষ্টির পানি ধারণ করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এছাড়া শহরাঞ্চলে খোলা জায়গায় বিশেষভাবে ডিজাইনকৃত রিচার্জ পিট তৈরি করা যেতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, সঠিকভাবে রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং বাস্তবায়ন করলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বছরে শূন্য দশমিক ৫ থেকে ১ দশমিক ৫ মিটার পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব।
২. আধুনিক সেচ পদ্ধতি : AWD (বিপরীত ভিজানো ও শুকানো) ও ড্রিপ ইরিগেশন চালু করে পানি সাশ্রয় করা। মাঠপর্যায়ে সেচ প্রযুক্তির দক্ষতা বৃদ্ধি করা। মাটির আর্দ্রতা রক্ষার উপযুক্ত কৃষিকৌশল প্রয়োগ করা।
৩. ফসল বৈচিত্র্যকরণ : কৃষিতে বিকল্প স্বল্পমেয়াদি ফসলের চাষ বৃদ্ধি করা, যাতে পানির ওপর চাপ কমে। বোরো ধানের পরিবর্তে কম পানি প্রয়োজনীয় হয় এ ধরনের ফসল, যেমন ডাল ও তেলবীজ চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করা।
৪. নীতিগত হস্তক্ষেপ : গ্রাউন্ডওয়াটার ম্যানেজমেন্ট অধ্যাদেশের প্রয়োগ জোরদার করে অতিরিক্ত নলকূপ স্থাপন নিয়ন্ত্রণ করা। নতুন টিউবওয়েল বসানোর আগে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা ও অনুমোদন বাধ্যতামূলক করা। উপজেলা ও জেলা সেচ কমিটির মাধ্যমে নিয়মিত মনিটরিংয়ের ব্যাপারে জোরদার পদক্ষেপ গ্রহণ নিশ্চিত করা।
৫. সামাজিক সচেতনতা : কৃষকদের মধ্যে পানির সঠিক ব্যবহার ও সংরক্ষণ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
উপসংহার
ভূগর্ভস্থ পানি একটি ‘অদৃশ্য সম্পদ’, যা সহজে দৃশ্যমান নয়, কিন্তু আমাদের জীবনজীবিকার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। সিলেটের হাওরাঞ্চল প্রাকৃতিক জলাভূমিতে সমৃদ্ধ হলেও ভূগর্ভস্থ পানির সংকট এখানে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক দশকে এই অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে। যেসব এলাকায় আকুইফারের গভীরতা আট মিটারের (সাকশন লিমিট) বেশি, সেখানে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ তুলনামূলকভাবে কম। ফলে এসব জোনে টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা কৌশল (যেমন : কৃত্রিম রিচার্জ, সেচের জন্য পানির দক্ষ ব্যবহার এবং নিবিড় মনিটরিং বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির সংরক্ষণ ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব। এই গবেষণার ফলাফল regional-scale ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবস্থাপনায় ‘হটস্পট’-ভিত্তিক কৌশল প্রণয়নের গুরুত্ব তুলে ধরে, যেখানে তুলনামূলকভাবে সুস্থিত আকুইফার এলাকাগুলোকে মডেল হিসেবে ব্যবহার করে আশপাশের সংকটাপন্ন এলাকার জন্য ব্যবস্থাপনা কাঠামো develop করা যেতে পারে। তাই এখনই সমন্বিত নীতি গ্রহণ, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও বিকল্প কৃষিকৌশল প্রয়োগ করা জরুরি। অন্যথায় হাওরের কৃষি, পরিবেশ ও মানুষের জীবনযাত্রা মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। তাই সরকার, নীতি-নির্ধারক, গবেষক, কৃষক ও সাধারণ জনগণ—সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা সম্ভব নয়।
লেখক : ড. মুক্তারুন ইসলাম, প্রফেসর, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগ
এবং ডিন, কৃষি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
তথ্যসূত্র : ‘Environment, Development and Sustainability’ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্র, ২০২৫

