‘স্বাধীন আরাকান’ ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ

ড. এহতেশামুল হক
প্রকাশ : ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১০: ৫৫
আপডেট : ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১১: ১৮

রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটের অগ্রভাগে রয়েছে বাংলাদেশ, যেখানে বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী বসতিগুলোর মধ্যে একটি কক্সবাজারের জনাকীর্ণ শিবিরে এক মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বসবাস করছে। চলমান শরণার্থী প্রবাহ বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামাজিক কাঠামোর ওপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছে।

তাছাড়া এটি ঢাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক নীতিগত চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, বিশেষ করে প্রতিবেশী মিয়ানমার ও ভারত, উদীয়মান পরাশক্তি চীন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে তার নীতির ক্ষেত্রে।

বিজ্ঞাপন

এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হলো মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক, যা রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে উত্তেজনা ও অবিশ্বাসের মধ্য দিয়ে চলমান। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের আহ্বান এবং আন্তর্জাতিক নিন্দা সত্ত্বেও মিয়ানমারের সামরিক নেতৃত্বাধীন সরকার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার দায়িত্ব নিতে বা তাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন সহজতর করতে খুব কমই আগ্রহী। সিরিজ দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হলেও মিয়ানমার প্রত্যাবর্তনকারীদের নিরাপত্তা ও অধিকারের জন্য পর্যাপ্ত গ্যারান্টি দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

এছাড়া বাংলাদেশ জাতিসংঘ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সংগঠনের (আসিয়ান) মতো আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমেও মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করেছে, কিন্তু তা কোনো অর্থপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণে অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে, কারণ আসিয়ান ও মিয়ানমারের কৌশলগত জোটের মধ্যে ঐকমত্যের অভাব রয়েছে।

চীন মিয়ানমারে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করে, বিশেষ করে কিয়াকফিউ গভীর সমুদ্রবন্দর ও চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোরের মতো বড় অবকাঠামোগত প্রকল্প নির্মাণের মাধ্যমে। এই কৌশলগত বিনিয়োগগুলো মিয়ানমারকে চীনের ওপর ক্রমবর্ধমানভাবে নির্ভরশীল করে তুলেছে, যা প্রায়ই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে চীনা ভেটোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক তদন্ত থেকে মিয়ানমারকে রক্ষা করেছে।

বেইজিং ঐতিহাসিকভাবে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের পদক্ষেপের সমালোচনা করতে অনিচ্ছুক, যার একটা কারণ হতে পারে নিজ দেশেই সংখ্যালঘু উইঘুরদের ওপর চীনা রাষ্ট্রীয় আচরণ। মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের শক্ত সামরিক সম্পর্ক মানবিক সংকট মোকাবিলার সময় বেইজিংয়ের সঙ্গে নিজস্ব কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে একটি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করে।

অন্যদিকে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্র ভারত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিয়ে এ অঞ্চলে ইসলামি চরমপন্থার সম্ভাব্য উত্থানের কথা মাথায় রেখে শরণার্থী সংকটের বিষয়ে বরাবর কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করে। এভাবে চীন ও ভারত উভয়ই রোহিঙ্গা ইস্যুকে তাদের নিজ দেশে মুসলিম সংখ্যালঘুদের প্রেক্ষাপট থেকে দেখে। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়।

২০২১ সালে মিয়ানমারে জান্তা সরকার আবার সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার পর আরাকান আর্মিসহ সেদেশের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীভিত্তিক সশস্ত্র গ্রুপগুলো একত্রিত হয়ে ‘ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ গঠন করে। তাদের সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয় এবং সামরিক জান্তাকে হটিয়ে তারা বিভিন্ন অঞ্চল দখলে নেয়।

এভাবে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশে ২০০৯ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু করা আরাকান আর্মি সক্রিয় হয়ে ওঠে। আরাকান আর্মি দাবি করেছে, তারা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর মংডুতে শেষ জান্তা ফাঁড়িটিও দখলে নিয়েছে, যার ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে ২৭১ কিলোমিটার (১৬৮ মাইল) দীর্ঘ সীমান্তের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছে। তাদের সশস্ত্র সংগ্রামের ধরন বলে দেয় আরাকানকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

এ ঘটনা এমন একসময় ঘটছে যখন বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অনেকটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বাংলাদেশের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। কারণ আরাকান আর্মির স্বার্থের সঙ্গে জড়িয়ে যাবে ইস্যুটি। সেইসঙ্গে রয়েছে আরাকান আর্মির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের প্রতিযোগিতায় নামা আঞ্চলিক শক্তিগুলোর স্বার্থ।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এরই মধ্যে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের জন্য আরাকান আর্মির সঙ্গে আলোচনা সম্ভব নয়, কারণ এটি একটি অ-রাষ্ট্রীয় পক্ষ। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সহজাত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বিবেচনা করলে বাংলাদেশের এ অবস্থান যথেষ্ট যৌক্তিক। আরাকান আর্মি সত্যিকার অর্থে কী চায় তা এখনও স্পষ্ট নয়। আবার যুক্তরাষ্ট্র ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো আরাকান আর্মিকে কীভাবে দেখছে, তা বুঝতে আরও কিছুটা সময় প্রয়োজন।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বিদ্যমান শীতল সম্পর্ক বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আরাকান অঞ্চলে বিদ্যমান ভারতের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ভারতকে বাধ্য করবে আরাকান আর্মির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে। আগে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, দেশটিতে চীনেরও রয়েছে অনেক উন্নয়ন প্রকল্প। ফলে দেশটি সর্বোচ্চভাবে চেষ্টা করবে আরাকানে ইন্ডিয়ার প্রভাব কমিয়ে চীনের স্বার্থ ধরে রাখতে। এ প্রতিযোগিতা শুধু অর্থনৈতিক পর্যায়ে সীমিত থাকবে, নাকি সামরিক রূপ নেবে তার ওপর নির্ভর করছে বাংলাদেশের ওপর স্বাধীন আরাকান রাষ্ট্রের প্রভাব কতটা পড়বে।

তবে বার্মাকেন্দ্রিক বহিঃশক্তির সম্পৃক্ততা অতীতের সবকিছু ছাপিয়ে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘বার্মা অ্যাক্ট-২০১৮ ও ২০২২’-এর মাধ্যমে, যা স্পষ্টভাবে রোহিঙ্গা মানবাধিকার সংরক্ষণের এবং বাংলাদেশ, বার্মা, থাইল্যান্ড ও তার আশেপাশের অঞ্চলে গণতন্ত্রকর্মী, সুশীল সমাজের নেতা, স্বাধীন গণমাধ্যম ও বিরোধী মতের নিরাপত্তা বিধানের অঙ্গীকার করে। এছাড়া ২০২২ সালে ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট কর্তৃক রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চালানো আগ্রাসনকে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের সরাসরি সম্পৃক্ততার অবস্থান জানান দেয়।

ফলে আরাকান যদি গণতন্ত্রভিত্তিক স্বাধীন রাষ্ট্র হয়, তা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতির কারণ হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপ্রাপ্ত জান্তাবিরোধী মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি) এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের একটি জাতিগত গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। স্বাধীন আরাকান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে তাই রোহিঙ্গাদের আরাকানে পুনর্বাসনের পথ আরও পরিষ্কার হবে বলে ধরে নেওয়া যায়।

এখন আরাকান আর্মির ব্যাপারে প্রতিবেশী ভারত ও চীনের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। বার্মায় মার্কিন প্রভাবের কারণে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে এখন চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশের সঙ্গেই সতর্ক কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে তাদের সহযোগিতামূলক মনোভাব দেখিয়েছে।

তবে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের মানবিক নীতির পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থও জড়িত। যুক্তরাষ্ট্রের মদতপুষ্ট স্বাধীন গণতান্ত্রিক আরাকান রাষ্ট্রের অর্থ হচ্ছে, এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের চীনবিরোধী আরও শক্ত অবস্থান, যার বিপরীতে চীন সরাসরি বাংলাদেশকে পাশে চাইতে পারে। আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশের খারাপ সম্পর্ক থাকলে তা সরাসরি বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের নিরাপত্তায় প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে বহিঃশক্তিগুলো বাংলাদেশকে চাপে রাখার জন্য তাদের মতো করে আরাকান আর্মিকে ব্যবহার করতে চাইবে।

বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভালো সম্পর্কের ইঙ্গিত বাংলাদেশের জন্য আশার সঞ্চার করলেও বাংলাদেশের উচিত হবে বহুমাত্রিক সম্পর্কের মাধ্যমে তার সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি অব্যাহত রাখা, সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপসহীন থেকে আরাকানকেন্দ্রিক আঞ্চলিক শক্তি ভারত ও চীন এবং পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ ও ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা।

লেখক: সিনিয়র লেকচারার, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

এমবি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত