এলাহী নেওয়াজ খান
মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি নিয়ে আমাদের রাজনীতির ইতিহাস বেশ দীর্ঘ ও বেদনাদায়ক। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এদেশের মানুষ এসব দেখে আসছে। বারবার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত হয়েছে। কতবার কতভাবে যে তাদের জীবনের স্বপ্নগুলো ভেঙে খান খান হয়ে গেছে তার কোনো হিসাব নেই। কেবলই ভাগ্যকে দোষ দিয়ে বেঁচে থাকার এই চেষ্টা। কিন্তু এ কথা তারা জানে না যে, মানবসৃষ্ট বিপর্যয়েও এই বাংলায় লাখ লাখ মানুষ অকালে এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছে।
অর্থাৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগে সৃষ্ট সংকট ছাড়াও শাসকদের বেপরোয়া লুণ্ঠনের ফলেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে বারবার। হয়তো বর্তমান যুগে বিশ্বব্যাপী সহজলভ্য সাপ্লাই লাইনের কারণে দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা খুব কম। কিন্তু সীমাহীন লুটপাট ও শাসকদের সহযোগিতায় গঠিত ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে পরিস্থিতি নাজুক করে দিতে পারে। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে এটা আমরা বারবার দেখেছি। এ ধরনের পরিস্থিতিতে শাসকেরা শুধু রাষ্ট্রীয় কোষাগার নয়, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে একজন ভিক্ষুকের পকেট থেকেও টাকা খসিয়ে নেয়।
আমাদের জানা ইতিহাস অনুযায়ী, এ অঞ্চলের মানুষ তিন-তিনটা ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ প্রত্যক্ষ করেছে। মানবসৃষ্ট এসব দুর্ভিক্ষ যে বেদনাদায়ক ইতিহাস রেখে গেছে, তা কখনো ভুলে যাওয়ার নয়। এসব দুর্ভিক্ষের মূল কারণ ছিল বেপরোয়া লুণ্ঠন।
ছোটবেলায় আমরা মুরব্বিদের কাছে শুনেছি ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কথা। শুনেছি ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কাহিনি। সবশেষে আমরা নিজেরা দেখেছি ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সেই নিদারুণ দৃশ্য। বাংলায় মোগল সুবেদার শায়েস্তা খাঁর আমলে টাকায় আট মণ ধান পাওয়ার মতো সমৃদ্ধ অর্থনীতির কথা শুনে আমরা যখন চমকিত হই, তখন ব্রিটিশ শাসনের শুরু ও শেষের দিকের দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুবরণের ইতিহাস আমাদের মনোজগতে সৃষ্টি করে নিদারুণ কষ্ট ও বেদনা। আর ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে দুঃশাসন ও লুণ্ঠনের রাজনীতি মানবজাতিকে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে।
ব্রিটিশদের আগমনে বাংলার হিন্দু বণিকেরা সামজিক পরিচয়ে ‘বাবু শ্রেণি’তে পরিণত হলেও মাত্র ১২ বছরের মাথায় ব্রিটিশ কোম্পানি শাসন যে দুর্ভিক্ষ উপহার দেয়, তাতে মারা গিয়েছিল এক কোটি মানুষ। এই দুর্ভিক্ষের সময়কাল ছিল ১৭৬৯-৭০ সাল, বাংলা ১১৭৬ সাল। তাই এই বাংলা বছর অনুযায়ী এ সময়কে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বলা হয়।
ব্রিটিশ শাসনের শেষ অধ্যায়ে ১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষের কথা তো আমাদের বাবা-চাচাদের মুখে বহুবার শুনছি। এই দুর্ভিক্ষে ৩০ লাখ আদমসন্তান প্রাণ হারিয়েছিল। এর ৩০ বছর পর ১৯৭৪ সালে সদ্য স্বাধীন দেশে যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল, তাতে ১৫ লাখ কিংবা তার চেয়েও বেশি মানুষ না খেয়ে মারা যায়। যদিও সরকারি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছিল, মাত্র ২৭ হাজার মৃত্যুর খবর। এখানে উল্লেখ করতে হয়, ’৬৫ সালের ১৭ দিনের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় এমনকি ’৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ৯ মাসেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়নি। অথচ স্বাধীনতার পর এক বছরের মধ্যে দ্রব্যমূল্য আকাশছোঁয়া হয়ে যায়, সেইসঙ্গে কমে যায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা।
চুয়াত্তরের ওই দুর্ভিক্ষের মূল কারণ ছিল পৃথিবীর নানা দেশ থেকে আসা শত শত কোটি টাকার ত্রাণসামগ্রী লুটপাট ও ভারতে পাচারের ফলাফল। ঠিক ব্রিটিশ সহযোগিতায় ফুলেফেঁপে ওঠা বাবু শ্রেণির মতোই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা রাতারাতি ফুলেফেঁপে উঠেছিল সেই লণ্ঠনের মাধ্যমে। ধারণা করা হয়, বিদেশ থেকে যে পরিমাণ ত্রাণ-সাহায্য এসেছিল, তা যদি ভারতে পাচার না হতো, তাহলে এদেশের মানুষ ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ আওয়ামী লীগের সেই পোস্টারের বাস্তবতা দেখত পেত। ’৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ওই পোস্টার সারাদেশের দেয়ালে দেয়ালে সাঁটিয়ে দিয়েছিল। এটা ছিল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকার। ওই পোস্টারে উল্লেখ করা হয়েছিল, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে ২৫ টাকা মণ চাল, ১৫ টাকা মণ আটা ও ২ টাকা ৫০ পয়সা সের দরে সরিষার তেল খাওয়াবে। স্বর্ণের ভরি নির্ধারণ করবে ১৩৫ টাকায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বেপরোয়া লুটপাতের কারণে সে স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়।
এখান উল্লেখ করা যায়, ’৭২ সালের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্ত ঢাকা শহরের গড়পড়তা মধ্যবিত্তের দৈনিক বাজারে বাজেট ছিল এক থেকে দেড় টাকা। ধনীদের কথা আলাদা। দুর্ভিক্ষও তাদের স্পর্শ করে না। যাহোক এখনকার মতো তখন ঘরে ঘরে ফ্রিজ ছিল না। তাই প্রতিদিন সকালে প্রথম কাজ ছিল বাজার করা। বলা যায়, ’৭২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ঢাকার বাজারমূল্য খুবই কম ছিল। শীতের মৌসুমে শিম, বেগুন ইত্যাদি তরিতরকারির মূল্য দুই পয়সা হয়ে যেত। অনেক সময় দরদাম করে সোয়া সেরও দু’পয়সায় কেনা যেত। গরুর মাংস পাঁচ সিকে অর্থাৎ এক টাকা পঁচিশ পয়সা ও খাসীর মাংস দু’টাকায় বিক্রি হতো। একজন রিকশাওয়ালা চার আনা থেকে আট আনা করে ভাড়া নিয়েও রাতে একটা বড় ইলিশ মাছ কিনে হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে বাসায় ফিরত। তখন মালিবাগ মোড় থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত ভাড়া ছিল আট আনা, সদরঘাট পর্যন্ত ছিল এক টাকা। সবাই শেয়ারে যাতায়াত করত। প্রসঙ্গক্রমে ’৭২ সালের বাজারমূল্যের দু-একটি দৃষ্টান্ত দেয়া হলো মাত্র। পরবর্তী সময়ে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে। আমাদের মূল বিষয় হচ্ছে, শাসকদের বেপরোয়া লুণ্ঠন কীভাবে একটি জাতির ভাগ্য বিপর্যয় ঘটায়।
আবার ফিরে আসা যাক ব্রিটিশ শোষণের চিত্রের দিকে। ভারত থেকে ব্রিটিশরা যে অর্থ পাচার করেছিল, তার পরিমাণ শুনলে চোখ কপালে উঠবে। এ সম্পর্কে অক্সফাম ইন্টারন্যাশনালের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘ব্রিটিশরা ভারত থেকে যে পরিমাণ অর্থ লুট করেছে, তার পরিমাণ এতটাই বেশি যে, গোটা লন্ডন শহর ৫০ পাউন্ডের নোট দিয়ে চারবার বিছানো সম্ভব। সেটার পরিমাণ ছিল ৬৪ দশমিক ৮২ ট্রিলিয়ন ডলার। কিন্তু তারা তো ছিল ঔপনিবেশিক শাসক। তারা ভারতে এসেছিল লুট করতে। আর আওয়ামী লীগ নেতারা নিজ দেশেই লুট করে বিদেশে পাচার করেছে। অথচ এই আওয়ামী লীগ নেতারা একসময় পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীকে সোনার বাংলা শ্মশান বানানোর জন্য অভিযুক্ত করছিল। সেই নেতারা নিজেরাই মাত্র দুই বছরের মাথায় সদ্য স্বাধীন দেশকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করে। আগেই উল্লেখ করেছি বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ত্রাণসামগ্রী ভারতে পাচার এবং খাদ্যদ্রব্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অধিক মুনাফা লাভের লক্ষ্যে আওয়ামী নেতাদের তৎপরতাই পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ করে তুলেছিল। আর সেটা যে কোন মাত্রায় ছিল তা বোঝা যায় একটি ঘটনা থেকে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের এক জনসভায় বলেছিলেন, সাড়ে সাত কোটি বাঙালি—আট কোটি কম্বল এসেছে, আমারটা কই? অর্থাৎ আওয়ামী লীগ নেতারা সব পাচার করে দিয়েছিল। কোনো কোনো নেতা লবণ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে ইতিহাস হয়ে যান। কেউ কেউ সুতা কেলেঙ্কারিতে জড়িত ছিলেন। ভারতে বেপরোয়া পাচারের জন্য তখন একজন নেতা সীমান্ত গান্ধী হিসেবে ভূষিত হয়েছিলেন। আর ওই সবেরই অবধারিত পরিণতি ছিল ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষ।
এখনো চোখের সামনে ভাসে সেইসব করুণ দৃশ্য। সে কী হাহাকার! কী হৃদয়বিদারক সব ঘটনা! আমি একদিন মিটফোর্ড হাসপাতালে রোগী দেখতে যাওয়ার পথে দেখলাম এক বৃদ্ধ ড্রেন থেকে কুড়িয়ে খাচ্ছেন। সংবাদপত্রে এমন সব ছবি প্রকাশিত হতো, যা এখন ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। রাস্তায় পড়ে থাকত পরিচয়হীন অসংখ্য লাশ। আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম এসব কুড়িয়ে নিয়ে দাফন করত বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে। এই সংস্থাটি তখন অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিল, আবার যেমনটা করছিল করোনা মহামারির সময়।
সেই পুরোনো ইতিহাসের পথ ধরে আওয়ামী লীগ নেতারা আবারো লুণ্ঠনের নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। গত ১৫ বছরে তারা শুধু ২৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদেরও লজ্জায় ফেলে দিয়েছেন। এই টাকা তারা অর্জন করেছেন উন্নয়নের নামে, উৎকোচ ও সিন্ডিকেটেড ব্যবসার মাধ্যমে। আওয়ামী লীগ আমলে ফ্যাসিবাদী শাসন ও সিন্ডিকেটেড ব্যবসা পরিপূরক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কঠিন শাসনের কারণে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করতে পারেনি। জুলাই বিপ্লবের পর এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার এবার রমজানের আগে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ দ্বিগুণ করে দিয়ে সিন্ডিকেট ভেঙে তছনছ করে দেওয়ায় অনেক বছর পর মানুষ স্বস্তিতে রোজা পালন করছে।
এ থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে, সরকার নিজে সিন্ডিকেটে জড়িত থাকলে সিন্ডিকেট ভাঙা যায় না, যেটা আমরা ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে দেখেছি। এবার আরেকটি বিষয় হচ্ছে, জনগণের উপলব্ধি। তারা বুঝতে পারছে যে, শুধু আইন করে সিন্ডিকেটের কার্যক্রম বন্ধ করা যাবে না। এবার তাই সাধারণ মানুষ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট তৈরির চেষ্টা করেছে। যেমন এবার রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কম থাকলেও লেবুর হালি ১০০ টাকার ওপরে ছিল। হঠাৎ লক্ষ করলাম, বেশ কিছু জায়গায় সাধারণ মানুষ ‘লেবু কিনব না’ বলে সিন্ডিকেট করে ফেলেছে। এতে কাজও হলো। বিক্রেতারা লেবুর দাম কমাতে বাধ্য হলো। ঠিক এভাবে জনগণকেই পাল্টা সিন্ডিকেট তৈরি করতে হবে। তাহলেই সরকার ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট উভয়ই সজাক থাকবে।
মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি নিয়ে আমাদের রাজনীতির ইতিহাস বেশ দীর্ঘ ও বেদনাদায়ক। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এদেশের মানুষ এসব দেখে আসছে। বারবার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত হয়েছে। কতবার কতভাবে যে তাদের জীবনের স্বপ্নগুলো ভেঙে খান খান হয়ে গেছে তার কোনো হিসাব নেই। কেবলই ভাগ্যকে দোষ দিয়ে বেঁচে থাকার এই চেষ্টা। কিন্তু এ কথা তারা জানে না যে, মানবসৃষ্ট বিপর্যয়েও এই বাংলায় লাখ লাখ মানুষ অকালে এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছে।
অর্থাৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগে সৃষ্ট সংকট ছাড়াও শাসকদের বেপরোয়া লুণ্ঠনের ফলেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে বারবার। হয়তো বর্তমান যুগে বিশ্বব্যাপী সহজলভ্য সাপ্লাই লাইনের কারণে দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা খুব কম। কিন্তু সীমাহীন লুটপাট ও শাসকদের সহযোগিতায় গঠিত ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে পরিস্থিতি নাজুক করে দিতে পারে। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে এটা আমরা বারবার দেখেছি। এ ধরনের পরিস্থিতিতে শাসকেরা শুধু রাষ্ট্রীয় কোষাগার নয়, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে একজন ভিক্ষুকের পকেট থেকেও টাকা খসিয়ে নেয়।
আমাদের জানা ইতিহাস অনুযায়ী, এ অঞ্চলের মানুষ তিন-তিনটা ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ প্রত্যক্ষ করেছে। মানবসৃষ্ট এসব দুর্ভিক্ষ যে বেদনাদায়ক ইতিহাস রেখে গেছে, তা কখনো ভুলে যাওয়ার নয়। এসব দুর্ভিক্ষের মূল কারণ ছিল বেপরোয়া লুণ্ঠন।
ছোটবেলায় আমরা মুরব্বিদের কাছে শুনেছি ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কথা। শুনেছি ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কাহিনি। সবশেষে আমরা নিজেরা দেখেছি ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সেই নিদারুণ দৃশ্য। বাংলায় মোগল সুবেদার শায়েস্তা খাঁর আমলে টাকায় আট মণ ধান পাওয়ার মতো সমৃদ্ধ অর্থনীতির কথা শুনে আমরা যখন চমকিত হই, তখন ব্রিটিশ শাসনের শুরু ও শেষের দিকের দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুবরণের ইতিহাস আমাদের মনোজগতে সৃষ্টি করে নিদারুণ কষ্ট ও বেদনা। আর ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে দুঃশাসন ও লুণ্ঠনের রাজনীতি মানবজাতিকে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে।
ব্রিটিশদের আগমনে বাংলার হিন্দু বণিকেরা সামজিক পরিচয়ে ‘বাবু শ্রেণি’তে পরিণত হলেও মাত্র ১২ বছরের মাথায় ব্রিটিশ কোম্পানি শাসন যে দুর্ভিক্ষ উপহার দেয়, তাতে মারা গিয়েছিল এক কোটি মানুষ। এই দুর্ভিক্ষের সময়কাল ছিল ১৭৬৯-৭০ সাল, বাংলা ১১৭৬ সাল। তাই এই বাংলা বছর অনুযায়ী এ সময়কে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বলা হয়।
ব্রিটিশ শাসনের শেষ অধ্যায়ে ১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষের কথা তো আমাদের বাবা-চাচাদের মুখে বহুবার শুনছি। এই দুর্ভিক্ষে ৩০ লাখ আদমসন্তান প্রাণ হারিয়েছিল। এর ৩০ বছর পর ১৯৭৪ সালে সদ্য স্বাধীন দেশে যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল, তাতে ১৫ লাখ কিংবা তার চেয়েও বেশি মানুষ না খেয়ে মারা যায়। যদিও সরকারি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছিল, মাত্র ২৭ হাজার মৃত্যুর খবর। এখানে উল্লেখ করতে হয়, ’৬৫ সালের ১৭ দিনের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় এমনকি ’৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ৯ মাসেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়নি। অথচ স্বাধীনতার পর এক বছরের মধ্যে দ্রব্যমূল্য আকাশছোঁয়া হয়ে যায়, সেইসঙ্গে কমে যায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা।
চুয়াত্তরের ওই দুর্ভিক্ষের মূল কারণ ছিল পৃথিবীর নানা দেশ থেকে আসা শত শত কোটি টাকার ত্রাণসামগ্রী লুটপাট ও ভারতে পাচারের ফলাফল। ঠিক ব্রিটিশ সহযোগিতায় ফুলেফেঁপে ওঠা বাবু শ্রেণির মতোই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা রাতারাতি ফুলেফেঁপে উঠেছিল সেই লণ্ঠনের মাধ্যমে। ধারণা করা হয়, বিদেশ থেকে যে পরিমাণ ত্রাণ-সাহায্য এসেছিল, তা যদি ভারতে পাচার না হতো, তাহলে এদেশের মানুষ ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ আওয়ামী লীগের সেই পোস্টারের বাস্তবতা দেখত পেত। ’৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ওই পোস্টার সারাদেশের দেয়ালে দেয়ালে সাঁটিয়ে দিয়েছিল। এটা ছিল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকার। ওই পোস্টারে উল্লেখ করা হয়েছিল, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে ২৫ টাকা মণ চাল, ১৫ টাকা মণ আটা ও ২ টাকা ৫০ পয়সা সের দরে সরিষার তেল খাওয়াবে। স্বর্ণের ভরি নির্ধারণ করবে ১৩৫ টাকায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বেপরোয়া লুটপাতের কারণে সে স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়।
এখান উল্লেখ করা যায়, ’৭২ সালের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্ত ঢাকা শহরের গড়পড়তা মধ্যবিত্তের দৈনিক বাজারে বাজেট ছিল এক থেকে দেড় টাকা। ধনীদের কথা আলাদা। দুর্ভিক্ষও তাদের স্পর্শ করে না। যাহোক এখনকার মতো তখন ঘরে ঘরে ফ্রিজ ছিল না। তাই প্রতিদিন সকালে প্রথম কাজ ছিল বাজার করা। বলা যায়, ’৭২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ঢাকার বাজারমূল্য খুবই কম ছিল। শীতের মৌসুমে শিম, বেগুন ইত্যাদি তরিতরকারির মূল্য দুই পয়সা হয়ে যেত। অনেক সময় দরদাম করে সোয়া সেরও দু’পয়সায় কেনা যেত। গরুর মাংস পাঁচ সিকে অর্থাৎ এক টাকা পঁচিশ পয়সা ও খাসীর মাংস দু’টাকায় বিক্রি হতো। একজন রিকশাওয়ালা চার আনা থেকে আট আনা করে ভাড়া নিয়েও রাতে একটা বড় ইলিশ মাছ কিনে হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে বাসায় ফিরত। তখন মালিবাগ মোড় থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত ভাড়া ছিল আট আনা, সদরঘাট পর্যন্ত ছিল এক টাকা। সবাই শেয়ারে যাতায়াত করত। প্রসঙ্গক্রমে ’৭২ সালের বাজারমূল্যের দু-একটি দৃষ্টান্ত দেয়া হলো মাত্র। পরবর্তী সময়ে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে। আমাদের মূল বিষয় হচ্ছে, শাসকদের বেপরোয়া লুণ্ঠন কীভাবে একটি জাতির ভাগ্য বিপর্যয় ঘটায়।
আবার ফিরে আসা যাক ব্রিটিশ শোষণের চিত্রের দিকে। ভারত থেকে ব্রিটিশরা যে অর্থ পাচার করেছিল, তার পরিমাণ শুনলে চোখ কপালে উঠবে। এ সম্পর্কে অক্সফাম ইন্টারন্যাশনালের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘ব্রিটিশরা ভারত থেকে যে পরিমাণ অর্থ লুট করেছে, তার পরিমাণ এতটাই বেশি যে, গোটা লন্ডন শহর ৫০ পাউন্ডের নোট দিয়ে চারবার বিছানো সম্ভব। সেটার পরিমাণ ছিল ৬৪ দশমিক ৮২ ট্রিলিয়ন ডলার। কিন্তু তারা তো ছিল ঔপনিবেশিক শাসক। তারা ভারতে এসেছিল লুট করতে। আর আওয়ামী লীগ নেতারা নিজ দেশেই লুট করে বিদেশে পাচার করেছে। অথচ এই আওয়ামী লীগ নেতারা একসময় পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীকে সোনার বাংলা শ্মশান বানানোর জন্য অভিযুক্ত করছিল। সেই নেতারা নিজেরাই মাত্র দুই বছরের মাথায় সদ্য স্বাধীন দেশকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করে। আগেই উল্লেখ করেছি বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ত্রাণসামগ্রী ভারতে পাচার এবং খাদ্যদ্রব্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অধিক মুনাফা লাভের লক্ষ্যে আওয়ামী নেতাদের তৎপরতাই পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ করে তুলেছিল। আর সেটা যে কোন মাত্রায় ছিল তা বোঝা যায় একটি ঘটনা থেকে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের এক জনসভায় বলেছিলেন, সাড়ে সাত কোটি বাঙালি—আট কোটি কম্বল এসেছে, আমারটা কই? অর্থাৎ আওয়ামী লীগ নেতারা সব পাচার করে দিয়েছিল। কোনো কোনো নেতা লবণ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে ইতিহাস হয়ে যান। কেউ কেউ সুতা কেলেঙ্কারিতে জড়িত ছিলেন। ভারতে বেপরোয়া পাচারের জন্য তখন একজন নেতা সীমান্ত গান্ধী হিসেবে ভূষিত হয়েছিলেন। আর ওই সবেরই অবধারিত পরিণতি ছিল ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষ।
এখনো চোখের সামনে ভাসে সেইসব করুণ দৃশ্য। সে কী হাহাকার! কী হৃদয়বিদারক সব ঘটনা! আমি একদিন মিটফোর্ড হাসপাতালে রোগী দেখতে যাওয়ার পথে দেখলাম এক বৃদ্ধ ড্রেন থেকে কুড়িয়ে খাচ্ছেন। সংবাদপত্রে এমন সব ছবি প্রকাশিত হতো, যা এখন ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। রাস্তায় পড়ে থাকত পরিচয়হীন অসংখ্য লাশ। আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম এসব কুড়িয়ে নিয়ে দাফন করত বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে। এই সংস্থাটি তখন অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিল, আবার যেমনটা করছিল করোনা মহামারির সময়।
সেই পুরোনো ইতিহাসের পথ ধরে আওয়ামী লীগ নেতারা আবারো লুণ্ঠনের নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। গত ১৫ বছরে তারা শুধু ২৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদেরও লজ্জায় ফেলে দিয়েছেন। এই টাকা তারা অর্জন করেছেন উন্নয়নের নামে, উৎকোচ ও সিন্ডিকেটেড ব্যবসার মাধ্যমে। আওয়ামী লীগ আমলে ফ্যাসিবাদী শাসন ও সিন্ডিকেটেড ব্যবসা পরিপূরক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কঠিন শাসনের কারণে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করতে পারেনি। জুলাই বিপ্লবের পর এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার এবার রমজানের আগে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ দ্বিগুণ করে দিয়ে সিন্ডিকেট ভেঙে তছনছ করে দেওয়ায় অনেক বছর পর মানুষ স্বস্তিতে রোজা পালন করছে।
এ থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে, সরকার নিজে সিন্ডিকেটে জড়িত থাকলে সিন্ডিকেট ভাঙা যায় না, যেটা আমরা ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে দেখেছি। এবার আরেকটি বিষয় হচ্ছে, জনগণের উপলব্ধি। তারা বুঝতে পারছে যে, শুধু আইন করে সিন্ডিকেটের কার্যক্রম বন্ধ করা যাবে না। এবার তাই সাধারণ মানুষ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট তৈরির চেষ্টা করেছে। যেমন এবার রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কম থাকলেও লেবুর হালি ১০০ টাকার ওপরে ছিল। হঠাৎ লক্ষ করলাম, বেশ কিছু জায়গায় সাধারণ মানুষ ‘লেবু কিনব না’ বলে সিন্ডিকেট করে ফেলেছে। এতে কাজও হলো। বিক্রেতারা লেবুর দাম কমাতে বাধ্য হলো। ঠিক এভাবে জনগণকেই পাল্টা সিন্ডিকেট তৈরি করতে হবে। তাহলেই সরকার ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট উভয়ই সজাক থাকবে।
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
৪ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
৪ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
৫ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
১ দিন আগে