বিএনপি কি জনমত বুঝতে সক্ষম?

মো. মোস্তাফিজার রহমান
প্রকাশ : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯: ১৭

গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দল বা রাজনীতিকদের জনগণের পালস বোঝার সক্ষমতা না থাকলে তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ইউরোপ, আমেরিকা, ভারতসহ পৃথিবীর বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সরকার জনমতের সরকার। সেসব রাষ্ট্র ও সরকারের যত ক্ষমতাই থাক জনমতই সেখানে মুখ্য। অর্থাৎ সেসব দেশ পরিচালনায় সরকারকে জনমতের গুরুত্ব দিতে হয়।

জনসমর্থন হারালে সরকারের বিদায়ঘণ্টা বেজে ওঠে। আগস্ট বিপ্লবের পর তেমন একটি গণতান্ত্রিক দেশের প্রত্যাশায় রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কারের অপেক্ষা করছে দেশবাসী। অন্তর্বর্তী সরকারকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না, একথা সবাই বলেছে; কিন্তু তারা নিজেরাই যদি নিজেদের ব্যর্থ করে, তা হলে তা হবে জাতির জন্য বড় দুর্ভাগ্যের বিষয়।

বিজ্ঞাপন

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গণতন্ত্র দিবসে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে তিনি বারবার জনমত ও জনগণের অংশগ্রহণের কথা বারবার বলেছেন। ‘জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো সংস্কার সুফল বয়ে আনবে না’, ‘সংস্কারের পথ ধরেই রোড ম্যাপে উঠবে দেশ’, ‘জনতার ক্ষমতায়ন ছাড়া সংস্কার টেকসই নয়’—এসব কথা বলেছেন তারেক রহমান, যা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি জনগণের অনুভূতি ধারণ করতে সক্ষম বলে আমরা মনে করি।

আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে দলকানা স্বভাব অতি প্রবল। অনেক সময়ই জনস্বার্থের পরিপন্থী দলীয় সিদ্ধান্তের বিপক্ষে কোনো মতামত তাদের মনঃপূত হয় না, বা সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষপাতদুষ্ট চিন্তায় সেটা তারা মানতে চান না। মতামত তাদের পক্ষে গেলে বেজায় খুশি, বিপক্ষে গেলে অখুশি। গঠনমূলক সমালোচনা যে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য এবং তা যে ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের পথ দেখাতে পারে, তা তারা বুঝতে চান না । বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে অনেকে তাদের নিয়ে লিখতেও অনাগ্রহী।

বিএনপির পক্ষ থেকে এর আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে যৌক্তিক সময় দেওয়ার অঙ্গীকার করা হলেও এখন তারা দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। বিএনপির বিভিন্ন নেতার এ দাবি সচেতন বিবেকবান মানুষের মনে সংশয় ও হতাশা তৈরি করছে। অনেকের মনে প্রশ্ন তৈরি হয়, দল হিসেবে অনাগত ভবিষ্যতে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা লাভের উজ্জ্বল সম্ভাবনার কারণেই কি নির্বাচন অনুষ্ঠানে দলটির এত তাড়াহুড়া? অনেকে ধারণা পোষণ করেন, দলটি কি সংস্কারের বিপক্ষে বা সরকারকে সংস্কার করতে সময় দিতে চায় না? আলাপচারিতায় মনে হয়, ওই দলটির সাধারণ সমর্থকদেরও অনেকেই তাড়াহুড়ার পক্ষে নয়।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে সুদীর্ঘকাল দমন-পীড়নের শিকার হওয়ার কারণে যখন দলটি জনগণের সহানুভূতি অর্জন করে জনপ্রিয়তা পেয়েছে বা পেতে শুরু করেছে, তখন রাষ্ট্রসংস্কারের লক্ষ্যে জনগণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে রাজি থাকলেও নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে দলটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সাম্প্রতিক বক্তব্য জনমনে দ্বিধা ও সংশয় সৃষ্টি করেছে। সাধারণ পর্যায়ে চলছে এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনা। কারণ বিএনপিপন্থিদের কেউ কেউ সংস্কারকে কাগুজে সংস্কার মনে করলেও সাধারণ জনগণ তাকে আমাদের জাতীয় জীবনের ম্যাগনাকার্টা হিসেবে বিবেচনা করতে চায়।

২০১৪ সালের নির্বাচনের পর টিভি টকশোসহ জনমনে দেশের দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল সম্পর্কে ‘যেই লাউ সেই কদু’ বা ‘ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে’ এমন ভাবের উদয় হয়েছিল। রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য যৌক্তিক সময় দেওয়ার কথা বলেও যখন বিএনপি দলের নেতাদের মুখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাড়াহুড়া লক্ষ করা গেল, তখন জনমনে ওই পুরোনো ভাবের নব আবিষ্কার হওয়ার আবার মনে হয় সুযোগ তৈরি হলো। সম্প্রতি দেশব্যাপী দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আসতে শুরু করেছে, তাতে এই জনমনে ওই ধারণা আরো প্রবল হয়ে উঠতে পারে ।

সেটা অনুভব করতে পেরেই হয়তো দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে নানা সাবধান বাণী উচ্চারিত হচ্ছে। অনেকের বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ব্যবস্থা গ্রহণ করাও হয়েছে। এবারের ভোট যেহেতু জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সুষ্ঠু করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে, তাই জনমতকে পক্ষে নিতে দলটির নেতাকর্মীদের সেভাবে তৈরি করা জরুরি। অন্যথায় আশানুরূপ ফল পাওয়া কষ্টকর হতে পারে। সে উদ্দেশ্যে উপজেলা, জেলা ও বিভাগ পর্যায়ে নেতাকর্মীদের নিয়ে সেমিনার ও কর্মশালা আয়োজন করার প্রয়োজন। দল পরিচালনায় জনমতের চাহিদার প্রতিফলন অপরিহার্য।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা থাকলেও জনগণ রাষ্ট্র ব্যবস্থা সংস্কারের প্রত্যাশায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ওই সময় দিতে চায়।

আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে যে ত্রুটি রয়েছে, তা সচেতন মানুষের আজ ভাবনার বিষয়। ছাত্রজনতার আন্দোলন ও আত্মাহুতি জনগণের সংস্কার ভাবনাকে শক্তিশালী করেছে। ১৯৪৭ ও ১৯৭১ সালে দুবার দেশ স্বাধীন হলেও আমাদের ব্যবস্থার মধ্যে যে বৈষম্য রয়েছে, যে বোঝা মাথায় নিয়ে আমরা চলেছি, তা দূরীকরণে অতীতে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। তাই নতুন করে রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ আর হাতছাড়া করতে চায় না মানুষ। সেজন্য তারা কষ্ট করতেও রাজি আছে। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো ব্যক্তিত্ব আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় বারবার আসবেন না।

দেশ ও মানুষের স্বার্থে আমাদের উচিত তাকে সর্বতোভাবে সহায়তা করা, তার পাশে দাঁড়ানো । বিএনপি নির্বাচন ও সংস্কার দুটোই চায়, এ ধরনের কথাও বলছেন অনেক নেতা। সাধারণ মানুষও নির্বাচন ও সংস্কার চায়। কিন্তু উপযুক্ত সংস্কার ছাড়া নির্বাচন চায় না সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষ নির্বাচনের পাশাপাশি সংস্কারের বিষয়টি এগিয়ে নেওয়ার জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে যথাযথ ও ইতিবাচক ভূমিকা প্রত্যাশা করে। এ ক্ষেত্রে দলের শীর্ষ নেতাদের সচেতন হওয়া জরুরি। কারণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যর্থ হলে তা হবে চরম আত্মঘাতী। দেশ নিমজ্জিত হবে অনিশ্চয়তার অন্ধকারে।

দেশের জনগণের এখন প্রধান চাওয়া হলো উপযুক্ত সংস্কার। এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক দলের দূরত্ব বা বিরোধ কাঙ্ক্ষিত নয় এবং জনহণ তা মানতে রাজি নয়। রাষ্ট্র সংস্কার ও সে উদ্দেশ্যে যৌক্তিক সময় দেওয়ার প্রশ্নে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে কোনো দল সংঘাতে গেলে সে দল জনগণের আস্থা হারাতে পারে। ‘পালস সার্ভে ২০২৪: জনগণের মতামত, অভিজ্ঞতা ও প্রত্যাশা’ এক জনমত জরিপে বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ওই জরিপে উঠে এসেছে ৮১ শতাংশ মানুষ চায় সংস্কার কার্যক্রম শেষ করতে এবং সেজন্য তারা সরকারকে সময় দিতে চায়।

দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশের কোনো জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব জনমতের পালস বা স্পিরিট বুঝতে পারবে না, তা কাম্য নয়। সেটা বুঝতে অক্ষম হলে জনবিচ্ছিন্নতা তার ললাট লিখন হতে পারে। তাই প্রয়োজন চিন্তার স্বচ্ছতা, একেক সময় একেক কথা নয়; চিন্তা ও কথায় একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাযুজ্য থাকা কাঙ্ক্ষিত মনে হয়। জনস্বার্থে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠবে, একটি জনপ্রিয় দল আরো জনপ্রিয় হয়ে জনমতকে সম্মান জানাবে, দেশ এগিয়ে যাবে—সে প্রত্যাশাই করি আমরা।

লেখক : অধ্যক্ষ (অব.) নওগাঁ সরকারি কলেজ

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত