রাজনীতিতে উত্তাপ ও সংস্কার-প্রত্যাশা

এম আবদুল্লাহ
প্রকাশ : ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯: ০৯

মাঘ মাসের এক-তৃতীয়াংশ অতিক্রান্ত হয়েছে। ‘মাঘের শীতে বাঘ কাঁপা’র কথা। এখনো তেমন কাঁপুনি দেওয়া শীত অনুভূত হচ্ছে কমই। কোনো কোনো অঞ্চলে তাপমাত্রার পারদ অবশ্য বেশ নিচে। তাপের পারদের ওঠানামা যাই হোক না কেন, দেশে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতির পারদ মাঝেমধ্যেই বেশ ঊর্ধ্বমুখী হতে দেখা যাচ্ছে। তাপ-উত্তাপের আঁচ লাগছে রাজনীতি ও ক্ষমতার সদরে-অন্দরে।

ফ্যাসিবাদী ও লুটেরা শাসক শেখ হাসিনাকে গত বছর ৫ আগস্টে ক্ষমতা ও দেশ দুটোই ছাড়তে বাধ্য করেছে এ দেশের বীর ছাত্র-জনতা। হাজারো জীবন, অপরিমেয় রক্তের বিনিময়ে প্রায় দেড় যুগ পর নিষ্ঠুর কর্তৃত্ববাদী শাসনমুক্ত হয়েছে দেশ। কিন্তু এখনো ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকাঠামো থেকে জাতির মুক্তি মিলছে না। এ মুক্তি অত সহজও নয়। ফ্যাসিবাদের দোসররা কিছুদিন ঘাপটি মেরে থেকে এখন মাথা তুলতে শুরু করেছে। নতুন বাংলাদেশে ভিন্নরূপে ফ্যাসিবাদের উত্থানের শঙ্কাও ব্যক্ত করছেন অনেকে।

বিজ্ঞাপন

‘ফ্যাসিবাদ ফ্যাসিবাদ বলতে বলতে নিজেরাই যাতে ফ্যাসিস্ট না হয়ে যাই, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে’Ñ এমন একটি দামি কথা শোনা গেল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক স্নিগ্ধা রিজওয়ানার মুখে। তিনি বলেন, নিজেরা ফ্যাসিস্ট হলে এটা হবে বড় পরাজয়। ‘ইউনিটি ফর বাংলাদেশ’ নামক একটি সংগঠনের ব্যানারে বুধবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক আলোচনায় এ মন্তব্য করেন তিনি।

‘ফ্যাসিজম’ হচ্ছে একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ, যেটি ১৯১৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সদর্প উপস্থিতি ছিল। ‘ফ্যাসিজম’ বা ‘ফ্যাসিবাদ’-এর আবির্ভাব ঘটে ইউরোপে। তাতে বিরোধীদের কোনো জায়গা ছিল না। কর্তৃত্বময় শাসন ক্ষমতাই ছিল ‘ফ্যাসিবাদ’-এর মূলমন্ত্র। ‘ফ্যাসিবাদ’ সব সময় মনে করত যে রাষ্ট্রই সব, এখানে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের কোনো স্থান নেই। এর মাধ্যমে তারা ব্যক্তি স্বাধীনতাকে হরণ করত, ক্ষমতাকে একটি কেন্দ্রে আবদ্ধ রাখত।

কেন যেন মনে হয়, আমরা প্রত্যেকেই কমবেশি ফ্যাসিবাদী মানসিকতা ধারণ করি, লালন করি। নিজের মতের সঙ্গে অন্যের অমত কতটা সহ্য করি আমরা? বুকে হাত দিয়ে নিজের জীবনাচারকে নির্মোহ বিশ্লেষণ করলে দেখব; পরিবারে, সমাজে, দলে, সংগঠনে, সরকারে, রাষ্ট্রে আমরা যে যতটুকু ক্ষমতা ভোগ করি, সেখানে ভিন্নমতকে আমরা খুব একটা সহ্য করি না। শুধু তাই নয়, ভিন্নমত পোষণকারীকে নানাভাবে হেনস্তা করি, নির্মূলের চেষ্টা করি, নিদেনপক্ষে এড়িয়ে চলি।

নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন এখন সরগরম। জাতীয় নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই উত্তাপ বাড়ছে। নতুন নতুন বলয় সৃষ্টির চেষ্টা চোখে পড়ছে। ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজনৈতিক দলগুলো দল-জোট ভারী করার নানা কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে। গেল সপ্তাহে রাজনৈতিক মেরূকরণে নতুন মাত্রা দেখা গেছে। জামায়াতে আমির ডা. শফিকুর রহমান চরমোনাই পীরের দরবারে হাজির হয়ে দুই দলের সমর্থকদের চির-বৈরিতার তাপে পানি ঢেলেছেন। তার এক দিন পরই বিএনপি ইসলামপন্থি দলগুলোকে নতুন করে কাছে টানার উদ্যোগ নিয়ে ধারাবাহিক বৈঠকের সূত্রপাত করেছে।

এদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবিসি বাংলার সঙ্গে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যদি অন্তর্বর্তী সরকার পূর্ণ নিরপেক্ষতা পালন করে, তাহলেই তারা নির্বাচন কন্ডাক্ট (পরিচালনা) করা পর্যন্ত থাকবে। তা না হলে তো নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হবে।’ বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যের কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। মির্জা ফখরুলের বক্তব্যকে মূলত আরেকটা ১/১১ সরকার গঠনের ইঙ্গিত বহন করে বলে মন্তব্য করেছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেছেন, এমন কোনো পরিকল্পনা গণতন্ত্র ও জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে এবং ছাত্র-জনতা কোনোভাবেই মেনে নেবে না। এমন কিছুর চিন্তা হলে সেটা বিএনপির বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্র মনে করেন সরকারের এই উপদেষ্টা।

অন্তর্বর্তী সরকারে ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিত্বকারী উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম ভেরিফায়েড ফেসবুকে দেওয়া এই কড়া প্রতিক্রিয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গনে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। সরকারের আরেক ছাত্র উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া প্রায় একই সময়ে পৃথক এক ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছেন, কোনো উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলে যুক্ত হলে সরকার থেকে পদত্যাগ করেই যুক্ত হবেন। এর আগে সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসসের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকার দিয়ে তথ্য উপদেষ্টা বলেছেন, জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের ফলে দুই দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজে তরুণদের প্রভাব অব্যাহত থাকবে।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠন প্রসঙ্গে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘সরকার গঠনের আগেই ৬ আগস্ট অ্যাটর্নি জেনারেল এবং পুলিশের আগের আইজির নিয়োগ হয়েছিল যারা মূলত বিএনপির লোক। এ রকমভাবে সরকারের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত নানা স্তরে বিএনপিপন্থি লোকজন রয়েছেন। নির্বাচনের নিরপেক্ষতার কথা বললে এই বাস্তবতায়ও মাথায় রাখতে হবে। রাষ্ট্রপতির পরিবর্তন, সংস্কার, নতুন সংবিধান, জুলাই ঘোষণা সব ইস্যুতেই বিএনপি বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অথচ এগুলো কোনোটাই ছাত্রদের দলীয় কোনো দাবি ছিল না। কিন্তু দেশের স্থিতিশীলতা, বৃহত্তর স্বার্থ এবং জাতীয় ঐক্য ধরে রাখার জন্য ছাত্ররা বারবার তাদের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। কিন্তু এর মানে এই না যে, গণতন্ত্রবিরোধী ও অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাবিরোধী কোনো পরিকল্পনা হলে, সেখানে আমরা বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেব।’

নাহিদ ইসলাম আক্ষেপের সুরে লেখেন, আওয়ামী লীগ বিষয়ে ভারতে প্রধান দলগুলোর মধ্যে ঐক্য সম্ভব হয়েছে অথচ বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ বিষয়ে আমরা ঐক্য করতে পারিনি এত হত্যা ও অপরাধের পরও। হায় এই ‘জাতীয় ঐক্য লইয়া আমরা কি রাষ্ট্র বানাবো!’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশকে দুর্বল করা সহজ। কারণ বাংলাদেশকে সহজেই বিভাজিত করা যায়। এ দেশের বড় বড় লোক অল্পমূল্যে বিক্রি হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে। আমি মনে করি না, সমগ্র বিএনপি এই অবস্থান গ্রহণ করে। বরং বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের বড় অংশই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন চায়।

বিএনপির দেশপ্রেমিক ও ত্যাগী নেতৃত্বকে আহ্বান করব, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে না গিয়ে ছাত্র-জনতার সঙ্গে বৃহত্তর ঐক্য ও সংহতির পথ বেছে নিন।

মির্জা ফখরুল ও নাহিদ ইসলামের পাল্টাপাল্টি এই বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বিশ্লেষণ এবং আলোচনা হচ্ছে। ক্ষমতার ছায়ায় রাজনৈতিক দল গঠন নিয়ে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আগে থেকেই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া রয়েছে। আগামী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রত্যাশী প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি বারবার বলছে, ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতায় যাতে কোনো রাজনৈতিক দল গড়ে না ওঠে। তাতে বর্তমান ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে বলেও সতর্কবাণী উচ্চরণ করা হচ্ছে বিএনপি নেতৃত্ব থেকে। নির্বাচন ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক এসব বাহাসে কার্যত সংস্কারের আলোচনা চাপা পড়ে যাচ্ছে, যা এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি। বস্তুত চলতি বছরের শেষে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক হিসাবনিকাশে যে যার মতো করে মেলাতে শুরু করেছেন। ভোটের বাজারে প্রভাববলয় প্রসারিত করতে উঠেপড়ে লেগেছেন।

অভাবনীয় এক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র, সরকার, নির্বাচন, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার আমূল সংস্কারের যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, তা থেকে আমরা দিনে দিনে দূরে সরে যাচ্ছি কি না, সে প্রশ্ন উঠেছে। অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে যে ১১টি কমিশন গঠন করেছিল, এর মধ্যে চারটি কমিশনের সুপারিশ গত ১৬ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কমিশনের প্রধানরা। এগুলো হলো সংবিধান সংস্কার, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার ও পুলিশ সংস্কার কমিশন।

দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী, কর্তৃত্ববাদী ও একনায়কত্ববাদী শাসনের কারণে দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো খাদের কিনারে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি স্তরকে দুর্নীতি গ্রাস করেছে। এ অবস্থায় রাষ্ট্রকে ফ্যাসিবাদী ধারা থেকে জনকল্যাণমুখী গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে নিতে আমূল সংস্কারের বিকল্প নেই।

সংবিধান সংস্কার কমিশন রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে যেসব প্রস্তাব করেছে, তার মধ্যে আছে এক ব্যক্তির দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত না হওয়া, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রতিষ্ঠা, জাতীয় সংসদের মেয়াদ কমিয়ে চার বছর করা, প্রার্থিতার বয়স ২৫ থেকে ২১-এ নামিয়ে আনা, সংসদের নিম্নকক্ষে ১০ শতাংশ তরুণকে প্রার্থী করা, সংরক্ষিত নারী আসন ১০০ করে সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা করা এবং অর্থবিল ছাড়া কোনো ক্ষেত্রে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ ব্যবহার না করা।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে পলাতক আসামি, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিত ব্যক্তিদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বিরত রাখা, ৪০ শতাংশের কম ভোট পেলে পুনরায় ভোটের ব্যবস্থা করা, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। দুদক সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে কালোটাকা সাদা করার রাষ্ট্রীয় চর্চা বন্ধ ও নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে পুলিশ সংস্কার কমিশন ফৌজদারি অপরাধ তদন্তে বিশেষায়িত তদন্ত দল, থানায় কাচের ঘরে জিজ্ঞাসাবাদ ও যথেচ্ছ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার না করার কথা বলা হয়েছে।

এসব কমিশন সুপারিশ জমা দেওয়ার আগে বিশেষজ্ঞসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে আলোচনা করেছে। কোনো কোনো কমিশন জনমত জরিপের মাধ্যমেও মতামত নিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরাসরি আলোচনা না করলেও দলগুলোর কাছে লিখিত প্রস্তাব চাওয়া হয়েছিল এবং অনেক দল তা দিয়েছে।

বিতর্ক দেখা দিয়েছে সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে। কীভাবে বাস্তবায়িত হবে এসব সংস্কার প্রস্তাব? এ জন্য যেসব রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রয়োজন রয়েছে। ঐকমত্য মানে সব বিষয়ে সব দল একমত হবে, তা নয়। সেটা বাস্তবসম্মতও নয়। তবে নির্বাচন, সংবিধান ইত্যাদি বিষয়ে মোটাদাগে ঐকমত্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকার জাতীয় ঐকমত্যের বিষয়টি অনুধাবন করে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে ঐকমত্য কমিশনও গঠন করেছে।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে যানা যাচ্ছেÑ চারটি বিভাগকে চারটি প্রদেশ করার ভাবনা এবং অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের অনেক প্রস্তাবনাকে ‘অপ্রয়োজনীয়’ বলে মনে করছে বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, এ ধরনের সংস্কার প্রস্তাব জটিলতা বাড়াবে। এ ছাড়া এত দিন পর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ‘ঘোষণাপত্র’ তৈরির উদ্যোগকেও ‘অপ্রাসঙ্গিক’ মনে করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারণী নেতারা। তারা মনে করেন, এই মুহূর্তে এর কোনো প্রয়োজন নেই। দেশকে চার প্রদেশে ভাগ করার প্রস্তাবে জামায়াতে ইসলামীও একমত নয়।

বিএনপি বলছে, সময়ের চাহিদা ও বাস্তবতা বিবেচনায় বিএনপি রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারে অঙ্গীকারবদ্ধ। এ লক্ষ্যে তারা ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে। এটিই সংস্কারের বড় দলিল। এর বাইরে বিএনপি সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনকে সহযোগিতা করতে নিজেরাও দলীয়ভাবে ছয়টি সংস্কার কমিটি গঠন করেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কী ধরনের সংস্কার আনা যেতে পারে, সে ব্যাপারে তারা ইতোমধ্যে কমিশনের কাছে প্রস্তাবগুলো জমাও দিয়েছে। বিএনপি আশা করছে, বিভিন্ন কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে সরকার শিগগিরই একটি রাজনৈতিক সংলাপ আহ্বান করবে। এ বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পর রাজনৈতিক মতৈক্যের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাবগুলো গৃহীত হবে।

এই যে সংস্কার কতটুকু হবে, নির্বাচনের আগে না পরে হবে, ভোটটা জুলাই-আগস্টে হবে না ডিসেম্বরের মধ্যে হবে, গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, তা কতদূর গড়াবে, তা নিয়ে সাধারণের মধ্যে একধরনের অস্বস্তি ও শঙ্কার জায়গা আছে। মতভিন্নতার প্রকাশটা কখনো কখনো এতটাই আক্রমণাত্মক হয়ে যাচ্ছে যে, জুলাই আন্দোলনের শক্তিগুলোর মধ্যে ঐক্যপ্রত্যাশী মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। ভোটের রাজনীতিতে মেরূকরণ হোক, মাঝেমধ্যে উত্তাপ ছড়াক, তাতে সমস্যা নেই।

কিন্তু সাধারণ মানুষ চায় এ দেশে ফ্যাসিবাদী সরকার ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থায়ী বিলোপ হোক। গেল জুলাই-আগস্টের রক্তই যেন সুশাসন ও গণতন্ত্রের জন্য শেষ রক্ত হয়। গণহত্যা এবং পনেরো বছরের দানবীয় শাসনে খুন, গুম, নিপীড়ন, নির্যাতনের বিচারটা দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক চায় মানুষ। আর কোনো শক্তি গদিতে বসে যেন দেশের মালিক বনে না যায়, সে নিশ্চয়তা চায়। ভোটাধিকার হরণের সব পথ যেন এবারেই পাকাপোক্তভাবে বন্ধ হয়। গদির লড়াইয়ে যাতে জন-আকাঙ্ক্ষাগুলো উপেক্ষিত না হয়। পরমত-ভিন্নমতকে যেন ফ্যাসিবাদের নিষ্ঠুরতার কবলে পড়তে না হয়।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সাবেক সভাপতি, বিএফইউজে

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত