পারিবারিক রাজনীতির উত্তরাধিকারে উত্থান হয় শেখ হাসিনার। অপরিপক্ব হলেও শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে হিসেবে ১৯৮১ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি হন। টানা ৪৪ বছর ধরে পালন করছেন এ দায়িত্ব। এর মধ্যে ‘পাঁচ’ বার প্রধানমন্ত্রী ও দু’বার বিরোধী দলীয় নেতা ছিলেন। তবে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর পালিয়ে ভারতে যান হাসিনা। এর আগেই তার নির্দেশে দেশে চলে গণহত্যা। সেই অপরাধের দায়ে গতকাল সোমবার তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনাল।
শেখ হাসিনার রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে তাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। জাতীয় রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য কোনো অবস্থান না থাকলেও বাবা শেখ মুজিবের পরিচয়ে দলটির সভাপতি হন। তখনও তিনি ভারতে নির্বাসনে ছিলেন। তাকে শীর্ষ পদে আসীন করার ক্ষেত্রে দলের একটি অংশের তীব্র বিরোধিতাও ছিল।
সভাপতি হওয়ার তিন মাসের মাথায় ওই বছরের ১৭ মে দেশে এসে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নেন ৩৩ বছর বয়সি হাসিনা। অভিযোগ আছে, দলের দায়িত্ব নিয়ে তিনি একটি নিজস্ব বলায় তৈরি করেন। একে একে আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদের কোণঠাসা করেন। ক্রান্তিকালে দলের হাল ধরে রাখা সৈয়দা জোহরা তাজ উদ্দিনও তার বলয়ের কারণে সাইডলাইনে চলে যান। শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচনের বিপক্ষে ছিলেন এমন ডাকসাইটে নেতারা অবমূল্যায়নের শিকার হন। এমনকি ১৯৯১ সালের নির্বাচনকে সুষ্ঠু বলায় দলীয় খড়্গ নেমে আসে ড. কামাল হোসেনের ওপর। হাসিনা বলয়ের লোকজন প্রখ্যাত এই আইনজীবীকে নানাভাবে অপদস্তও করেন। পরে বাধ্য হয়ে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে নতুন দল গঠন করেন।
দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শেখ হাসিনার রানিংমেট ছিলেন আবদুর রাজ্জাক। জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এ সংগঠককেও ঠিকমত কাজ করতে দেওয়া হয়নি। পরে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি দল থেকে বেরিয়ে বাকশালে যোগ দেন। তিনি আবার দলে ফিরলেও মূল্যায়িত হননি। ওয়ান ইলেভেনের সময় দলের সংস্কার প্রস্তাব দেওয়ার কারণেও আবদুর রাজ্জাকের ওপর ক্রুদ্ধ হন হাসিনা।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলেও তাকে মূল্যায়ন করা হয় না। দলের সভাপতিমণ্ডলীর পদ থেকে সরিয়ে গুরুত্বহীন উপদেষ্টা পরিষদে যুক্ত করা হয় তাকে। বর্ষীয়ান নেতা আবদুর রাজ্জাক মারা যাওয়ার পরও হাসিনা তাকে সম্মানিত করতে চাননি বলেও জানা যায়। শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তার লাশ তিনি শহীদ মিনারে নেওয়ার বিপক্ষে ছিলেন। তবে আবদুল জলিলসহ কয়েকজন নেতার হস্তক্ষেপে সেদিন শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের অনুষ্ঠানটি সম্ভব হয়েছিল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্রজীবন থেকেই আবদুর রাজ্জাকের প্রতি ক্ষোভ ছিল হাসিনার। ১৯৬৬ সালে ইডেন কলেজ ছাত্রসংগঠন নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকায় হাসিনাকে ভিপি পদে মনোনয়ন দেওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন ছাত্রলীগের (বর্তমানে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ) তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক। পরে শেখ মুজিবের প্রভাব খাটিয়ে মনোনয়ন দিতে বাধ্য করা হয়। হাসিনা এই ক্ষোভ পুষে রাখেন বলে দলের মধ্যে আলোচনা আছে।
আবদুর রাজ্জাকের মতো আবদুল জলিলকেও শেষ জীবনে অসম্মান হয়ে চলে যেতে হয়েছে। আবদুল জলিল ওয়ান ইলেভেনের সময়ে গ্রেপ্তার হয়ে যৌথবাহিনীর কাছে হাসিনার চাঁদাবাজি ও নানা অনিয়ম-দুর্নীতিসহ অপশাসনের স্বীকারোক্তি দেওয়ার কারণে ক্ষুব্ধ হন আওয়ামী লীগ প্রধান। যার কারণে পরে দল বা সরকারে আবদুল জলিলকে মূল্যায়ন করা হয়নি। অবশ্য যৌথ বাহিনীর কাছে একই ধরনের স্বীকারোক্তি দিলেও হাসিনার ফুফাত ভাই শেখ ফজলুল করিম সেলিম দলে বহাল আছেন।
জানা গেছে, ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নেওয়ার পর হাসিনা দল গোছানোর পাশাপাশি আন্দোলনের কর্মসূচি পালন শুরু করেন। তিনি বিএনপিসহ অন্যান্য দলের সঙ্গে যুগপৎভাবে স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হন। তবে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও আন্দোলনরত বামপন্থি দলগুলোর সঙ্গে বিঈমানি করে হাসিনা ১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকারের সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেন হাসিনা। পরে অবশ্য পরাজিত হওয়ায় এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে তিনি আবার বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সম্মিলিত আন্দোলেনে যোগ দেন।
এরশাদের পতনের পর অনুষ্ঠিত ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালান হাসিনা। সংশ্লিষ্টরা জানান, ওই সময় তার অবস্থান এমন ছিল যে, তিনি নিশ্চিত প্রধানমন্ত্রী। তবে নির্বাচনে তার দলের ভরাডুবি হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মাত্র ৮৮ আসনে জয়লাভ করে। হতবাক হাসিনা নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলেন। কিন্তু দেশের ইতিহাসে যত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে তার মধ্যে সেটি একটি। এমনটি তার দলের প্রভাবশালী নেতা ড. কামাল হোসেন বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও বলেছিলেন। যদিও এ কারণে তিনি দলের রোষানলে পড়েন।
নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ আনলেও হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের এমপিরা শপথ নেন। দলটির সভাপতি বিরোধী দলীয় নেতার দায়িত্বও পালন করেন। তবে একের পর এক সংসদ বর্জন করে বিএনপি সরকারকে দেশ পরিচালনায় নানাভাবে অসহযোগিতা করেন তিনি। ১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরে। প্রধানমন্ত্রী হন হাসিনা। তবে দুর্নীতি, অপশাসন ও ভারতপন্থি মনোভাবের কারণে সমালোচনার মুখে পড়ে তার নেতৃত্বাধীন সরকার। এ সময়ে ১ টাকা টোকেন মূল্যে গণভবন বরাদ্দ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন এবং তিনি নির্বাচনের আগে ওই বাড়ি ত্যাগ করতে বাধ্য হন। ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত পরবর্তী নির্বাচনে বিএনপির কাছে লজ্জাজনক পরাজয় হয় হাসিনার নেতৃত্বাধীন দলের। আওয়ামী লীগ মাত্র ৬২টি আসন পায়।
নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে ব্যাপক জালিয়াতির অভিযোগ করেন এবং প্রাথমিকভাবে শপথ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান হাসিনা। এমনকি তারই নিযুক্ত রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে অত্যন্ত বাজেভাবে অপমান করতে থাকেন। হাসিনা ও তার আইনপ্রণেতারা সংসদে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান। তবে সংবিধান অনুযায়ী, ৯০টি বৈঠকে টানা অনুপস্থিতি থাকলে সংসদীয় সদস্যপদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাওয়ার বিধান থাকায় হাসিনা সংসদে ফেরেন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকারের মেয়াদ শেষের দিন ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে লগি-বৈঠা আন্দোলনের নামে ব্যাপক সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায় আওয়ামী লীগ। পরেও এই আন্দোলন অব্যাহত রাখে। তাদের আন্দোলনে ভীত হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন বিচারপতি কে এম হাসান। তাদের আন্দোলন এতটাই সহিংস রূপ ধারণ করে যে, ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয় এবং সেনাবাহিনী-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়।
হাসিনাকে লন্ডনে চলে যেতে বাধ্য করা হয়। তবে খালেদা জিয়া দেশ ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে হাসিনা মনে করেন যে, রাজনৈতিকভাবে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে তিনি পিছিয়ে পড়ছিলেন। এ কারণে তিনি বাড়ি ফিরে আসতে চান। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রাথমিকভাবে তার দেশে ফেরার প্রচেষ্টা প্রতিরোধ করলেও পরে তাকে আসার অনুমতি দেয়। তবে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। খালেদা জিয়াকেও কারাগারে পাঠানো হয়। এ সময় ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ নামে তাদের রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার একটি প্রচেষ্টা নিয়ে বেশ আলোচনা হয়, কিন্তু তা সফল হয়নি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য হাসিনা ও খালেদা জিয়া মুক্তি পান। ওই বছরের ডিসেম্বরের নির্বাচনে হাসিনা ব্যাপক ভোটে জয়লাভ করেন। যদিও ওয়ান ইলেভেন সরকারকে ‘আইনি বৈধতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি’ দেওয়ায় হাসিনাকে মসনদে বসানো হয় বলে অভিযোগ আছে।
ক্ষমতায় এসেই স্বৈরশাসনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রতিহিংসার রাজনীতি প্রকাশ করতে শুরু করেন হাসিনা। তিনি বিরোধী মতামতের প্রতি ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করতে শুরু করেন, সংবাদমাধ্যম তার কঠোর আক্রমণের শিকার হয় এবং তিনি বিএনপিকে ধ্বংস করার অঙ্গীকার করেন। সেনানিবাসের বাড়ি থেকে বেগম খালেদা জিয়াকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করেন। তিনি ওয়ান ইলেভেন সরকারের নিজের নামে করা সব মামলা উঠিয়ে নেন এবং কথিত দুর্নীির মামলায় অভিযুক্ত করে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে কারাদণ্ড দেন।
হাসিনার দুঃশাসনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অধ্যায় ছিল বিচারিক হত্যাকাণ্ড। ২০১৪ সালের বিনাভোটের নির্বাচনে ক্ষমতা ধরে রেখে একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে নাটক মঞ্চস্থ করেন হাসিনা। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ দলটির শীর্ষ ছয় নেতাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। এমনকি দলটির নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসেইন সাঈদিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার প্রতিবাদ করায় শতাধিক নিরস্ত্র ভক্তকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এছাড়া বিএনপির বর্ষীয়ান নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকেও ক্যাঙ্গারু কোর্টের মাধ্যমে প্রহসনের বিচারের নামে হত্যা করা হয়।
গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রতিষ্ঠানটি থেকে সরিয়ে দেন হাসিনা। তাকে নানাভাবে হয়রানিও করা হয়। হাসিনা সবচেয়ে বিধ্বংসী কাজটি করেন সংবিধানে সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে বিলুপ্ত করে। এর মাধ্যমে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সুযোগ শেষ করে দেন। এর জের ধরে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। এই তিনটি নির্বাচন দেশের জনগণের কাছে যথাক্রমে বিনাভোট, রাতের ভোট ও ডামি ভোটের পরিচিতি পায়। টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে হাসিনা ক্রমান্বয়ে বিধ্বংসী হয়ে উঠলেন। তিনি বিরোধী কণ্ঠরোধের জন্য ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট এবং সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো কালো আইন তৈরি করেন। সংবাদমাধ্যম আইন ও তার গোয়েন্দা বাহিনী এসব ব্যবহার করে সবকিছু স্তব্ধ এবং ভয়ভীতির মধ্যে রেখেছিল। একটি ভয়ের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, সমস্ত সমালোচনা দমন করা হয়। এতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ধ্বংস হয়ে যায়।
বিচারবিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকসহ সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে ধ্বংস হয়ে যায়। মানবাধিকার কমিশন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ব্যাপকভাবে ঘটতে থাকে। তার সরকার স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বার বার আহ্বান উপেক্ষা করে কয়েকটি পদক্ষেপ নেয়। সংসদ তার প্রতি এতটাই অনুগত হয়ে ওঠে যে, এটি কখনো তার মন্ত্রিসভার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করেনি। ওই সভার একমাত্র কাজ ছিল হাসিনার প্রশংসা করা। এ সময় তিনি ‘ব্যক্তি পূজার’ রাজনীতি শুরু করেন। মৃত বাবা শেখ মুজিবের স্মৃতিকে ধরে রাখতে অফিস এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’ স্থাপনের নিয়ম করেন। সব মুদ্রায় শেখ মুজিবের ছবি যুক্ত করেন। ২০২০ সালকে ‘মুজিব বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করে তা দুই বছরেরও বেশি সময় টেনে নেন। এজন্য রাষ্ট্রীয় শত শত কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। মা ফজিলাতুন নেছা ও ভাইয়ের নামে রাষ্ট্রীয় দিবস চালু করেন।
সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিজমের সময় হাসিনা সম্পূর্ণভাবে চাটুকার এবং দুর্নীতিগ্রস্তদের মাধ্যমে ঘেরাও হয়ে যান। তারা কেবল তার প্রশংসা ও দেশের অসত্য চিত্র উপস্থাপন করতেন। তিনি উন্নয়নের মিথকে নিজের গর্ব হিসেবে তুলে ধরতে শুরু করেন। অবকাঠামো নির্মাণের প্রাকৃতিক প্রবাহকে তার একক কৃতিত্ব হিসেবে দেখাতে শুরু করেন। আর দুর্নীতির কারণে প্রকল্পগুলোর খরচ অত্যন্ত বেড়ে যায়।
হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলজুড়ে বিডিআর বিদ্রোহের নামে পিলখানায় ৫৭ জন দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তাকে নৃশংসভাবে হত্যা, শাপলা চত্বরে শত শত আলেম হত্যাসহ ভোটাধিকার ও বাকস্বাধীনতা হরণ, বিরোধী দল ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও পুলিশি নিপীড়ন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ঋণের নামে ব্যাংক লুণ্ঠন, সরকার ঘনিষ্ঠদের ব্যাপক দুর্নীতি ও অর্থপাচার, সচিবালয় থেকে বিচার বিভাগ পর্যন্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক দলীয়করণ, দ্রব্যমূল্যের ব্যাপক ঊর্ধ্বগতি, ভারতের সঙ্গে নতজানু পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি কারণে ছিল তীব্র গণঅসন্তোষ।
গণমাধ্যমের ওপর একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বানোয়াট পরিসংখ্যান আর বিভিন্ন দৃশ্যমান অবকাঠামো উন্নয়নকেন্দ্রিক প্রচারণার মাধ্যমে দুঃশাসনকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে। আর্থিক খাত ব্যাপক দুর্নীতিতে আক্রান্ত হয়ে যায়। লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়।
হাসিনার শাসনামলে রীতিমতো আইন করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হয়। এসব কারণে তার সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ বারুদের বিশাল স্তূপের মতো জমা হচ্ছিল। আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী দলের আন্দোলন ও ভিন্নমত দমনের জন্য গুমের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত ছিল। গত দেড় দশকে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে বাসা, অফিস কিংবা রাস্তা থেকে মানুষকে তুলে নিয়ে পরবর্তী সময়ে অস্বীকার করা হয়। তাদের অনেকে ফিরে আসেন, কারো লাশ পাওয়া যায়, আবার অনেকে এখনো নিখোঁজ আছেন।
চতুর্থ দফায় ২০২৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর তার অপশাসন অব্যাহত থাকে। তবে ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পথ ধরে পতনের মুখে পড়ে হাসিনার ফ্যাসিজম। গত বছর জুলাইয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের দমনপীড়নের সামনে রাজপথে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়ুয়া শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। স্বৈরাচারের রাহুমুক্ত হতে ছাত্র-জনতা একজোট হয়েছিলেন রাজপথে। দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে উঠে আসে হাসিনা সরকারের পদত্যাগের এক দফা। এ গণদাবি সরকারের ভিত নাড়িয়ে দেয়। সরকারের পুলিশ ও দলীয় সন্ত্রাসীদের গুলি, হত্যার বীভৎসতায় ছাত্র-জনতার আন্দোলন রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। শিক্ষার্থীসহ প্রাণ দেন ১৪০০ মানুষ।
প্রবল জনরোষের মুখে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পদত্যাগ করেন হাসিনা। ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে তিনি ওই দিন দুপুরে সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে দেশ ছেড়ে ভারতের নয়াদিল্লিতে গিয়ে আশ্রয় নেন। এরপর ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন সরকার হাসিনার গণহত্যার বিচারের কাজ এগিয়ে নেওয়াসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে সংস্কারের উদ্যোগসহ বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।
হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরপরই তার দলের নেতারাও যে যার মতো পালিয়ে যান। কেউ কেউ গ্রেপ্তার হন। অনেকে জনরোষের শিকার হন। বিক্ষুব্ধ জনতা তাদের বাড়িঘর ভাংচুরসহ আগুন ধরিয়ে দেয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা শেখ মুজিবের মূর্তি ও ম্যুরাল ভেঙে ফেলা হয়। শেখ মুজিবের ৩২ নম্বরের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে জনতা। শেখ মুজিব ও তার পরিবারের নামে থাকা সরকারি স্থাপনাগুলোর নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে তাদের নামে পালিত দিবসগুলোও।
বর্তমান সরকার তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জুলাই গণহত্যার বিচার শুরু করেছে। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার ১৫ মাসের মাথায় তার গঠন করা ট্রাইব্যুনালেই প্রথম মামলার রায়ও ঘোষণা করা হয়েছে। এতে গণহত্যার দায়ে হাসিনার ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে। তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

