রমজানেই বন্ধ হোক ফিলিস্তিনের কান্না

আলী হাসান তৈয়ব
প্রকাশ : ২০ মার্চ ২০২৫, ১০: ০৪
ছবি: সংগৃহীত

পবিত্র রমজান মাসে সাহরির সময় ঘুমন্ত নারী-শিশুদের ওপর বর্বর ইসরাইলি বোমা হামলায় স্তম্ভিত বিশ্ববিবেক। প্রায় পাঁচশ ফিলিস্তিনি এ হামলায় শহীদ হয়েছেন। যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে এ হামলার প্রতিবাদে পুরো বিশ্বের দেশে দেশে যখন বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে, তখন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু মিডিয়ায় বলেন, ‘এটা নাকি কেবল হামলার সূচনা।’ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যক্ষ সমর্থন ও আস্কারাতেই কসাই নেতার এমন দম্ভোক্তি তা বলাই বাহুল্য। এসব আর সহ্য করা যায় না। এবার এর বিহিত অবশ্যই করতে হবে।

ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম সেরা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মেরাজ হয়েছিল এই ফিলিস্তিনের পবিত্র আকসা থেকে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি নিজের বান্দাকে রাত্রিবেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত- যার চার দিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দিই। নিশ্চয়ই তিনি (আল্লাহ) পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ১)।

বিজ্ঞাপন

মসজিদে আকসা ও জেরুজালেমের মর্যাদা এবং ফজিলত সম্পর্কে কোরআন-হাদিসে অজস্র বক্তব্য এসেছে। আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর সব মানুষের মধ্য থেকে নবীদের বাছাই করেছেন। তেমনি পৃথিবীর সব ভূখণ্ডের মধ্যে কিছু ভূমিকেও বানিয়েছেন পবিত্র, সম্মানিত ও বরকতময়। জেরুজালেমের প্রাণ বায়তুল মুকাদ্দাস ইসলামের তিন সম্মানিত মসজিদের মধ্যে তৃতীয়। এখানে একেকটি নামাজের সওয়াব পাঁচশ গুণ বেশি। এটি মুসলমানদের প্রথম কেবলা। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর বিন খাত্তাব (রা.) ১৫ হিজরির ১৩ রমজান বায়তুল মুকাদ্দাস জয় করেন।

এই পবিত্র ভূমির মতো পৃথিবীর আর কোনো জনপদে এত নবী-রাসুলের কদম পড়েনি। ফিলিস্তিনের প্রতিটি ধূলিকণার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নবীদের স্মৃতি। সেদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে উদ্ধৃত আয়াতে। ফিলিস্তিনের প্রতিটি মুসলিমের দেহে বইছে নবী-রাসুলদের রক্ত। জেরুজালেম কেবল একটি জাতি বা দেশের ইস্যু নয়, এটি পুরো ‍মুসলিম উম্মাহর ইস্যু। কুদস, আকসা আমাদের কাছে আমানত। এর সঙ্গে পুরো উম্মাহর ভাগ্য জড়িত। এই পবিত্র ভূমি রক্ষায় এখন পৃথিবীর সব মুসলমানের একতা প্রয়োজন। এই ইস্যুতে সবার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস দরকার।

পবিত্র কাবার পর এটি পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রাচীনতম মসজিদ। বনি ইসরাইলদের আগে ও পরে সব সময়ই এটি ছিল এক আল্লাহর ইবাদতের স্থান। এই মসজিদে প্রধান চার আসমানি ধর্মের গ্রন্থই পঠিত হয়েছে। এখানে আমাদের শেষ নবী (সা.)-এর পেছনে ঐতিহাসিক ও মহাঅলৌকিক মিরাজের রাতে সব নবী-রাসুল নামাজ পড়েছেন। এতে করে পরিষ্কার বার্তা দেওয়া হয়েছে, শেষ নবী আসার পর এই মসজিদটি কেবল এক আল্লাহর ইবাদতকারী মুসলিমদেরই। আগের সব বাতিল। তাই কুদসের প্রকৃত হকদার মুসলমানরাই। এ নিয়ে কোনো টালবাহানা সহ্য করা যায় না। ফিলিস্তিনের পাশে মুসলিম উম্মাহ ছিল ও থাকবে। আকসা মুসলমানদের ছিল ও থাকবে ইনশাল্লাহ।

ফিলিস্তিন সংকট শুধু রাজনৈতিক বা ভৌগোলিক ব্যাপার নয়, এটি নিরেট ধর্মীয় একটি ইস্যু। এ সংকট সমাধানের দায় কোনো মুসলিমই এড়াতে পারে না। আমাদের সবার নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করতে হবে, সব সমস্যা নিরসনে আগে দরকার খাঁটি ঈমান ও তাওহিদের অবিনাশী চেতনা। প্রকৃত ঈমান ও নেক আমলের মাধ্যমেই সব সংকটের উত্তরণ ঘটবে। মুসলিম নেতাদের এখন বুদ্ধিদীপ্ত ও ঐক্যবদ্ধ কৌশল গ্রহণ করতে হবে। প্রজ্ঞা ও ঈমানদীপ্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।

আদ ও সামুদ জাতির করুণ পরিণতির কথা কোরআনে এসেছে। এখানকার জালিমদের পরিণতিও একই রকম হবে। আল্লাহ তায়ালার ওয়াদা চূড়ান্ত সত্য। পবিত্র কোরআন বলছে, ‘দেশে যাদের দুর্বল করা হয়েছিল, আমার ইচ্ছা হলো তাদের প্রতি অনুগ্রহ করার, তাদেরকে নেতা করার এবং তাদের দেশের উত্তরাধিকারী করার।’ (সূরা কাসাস: ৫)

গতবার ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হয়ে আল-কুদসকে গায়ের জোরে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণার পর সারা বিশ্ব এর নিন্দা জানায়। এবার তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে নির্বাচনের কিছুদিন পর ঘোষণা করেন, গাজা উপত্যকাকে ফিলিস্তিনিমুক্ত করে তিনি পুনর্নির্মাণ করবেন। ফিলিস্তিন ইস্যু বারবার প্রমাণ করেছে, পশ্চিমাদের কাছে মানবিক মূল্যবোধ মুসলিমদের জন্য আলাদা। সবার মানবাধিকার থাকলেও মুসলিমদের মানবাধিকার নেই। মুসলিমদের বেলায় ‘অধিকার, স্বাধীনতা, মানবিকতা ও শিশু-নারীর’ সস্তা আবেগ একদমই প্রযোজ্য নয়।

বরং আমরা দূর ও নিকট অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে খোলাখুলি বলতে পারি, প্রায় শত বছর ধরে দগ্ধ করা এই ইস্যুর সমাধান আলোচনার টেবিলে কোনোদিন হবে না। এর জন্য প্রয়োজন এক্ষুনি মুসলিম বিশ্বের নেতাদের সম্মিলিত কঠোর সিদ্ধান্ত। বদর-মক্কা ও আকসা বিজয়ের ঐতিহাসিক এই রমজানে যদি এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, তাহলেই কেবল উম্মাহর চোখের পানি মোছা সম্ভব। নয়তো ইতিহাস এই নেতাদের ক্ষমা করবে না।

কয়েক বছর আগে আল-আকসার খতিব কান্নাজড়িত কণ্ঠে জুমার খুতবায় বলেছিলেন, ‘জেরুজালেমের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব সব মুসলমানের। বিশেষ করে, মুসলিম বিশ্বের নেতাদের। হে দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দ, আপনারা এ পবিত্র ভূমির মর্যাদা রক্ষার ক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করুন। পবিত্র এ ভূখণ্ড আমাদের মানসম্মান ও গৌরবের কেন্দ্র। সবাই মিলে একটিবারের জন্য হলেও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। আপনারা এর বিনিময় অবশ্যই আল্লাহর কাছে পাবেন। বিবৃতি প্রদান, স্লোগান আর নিন্দা জ্ঞাপনে কাজের কাজ কিছুই হবে না। আপনারা এগুলো করে মুসলিম উম্মাহর সঙ্গে যথেষ্ট উপহাস করেছেন। এবার কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করুন।’

লেখক : খতিব, আন-নূর জামে মসজিদ, টঙ্গী

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত