রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাতের ভয়াবহ পরিণতি

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১: ১২

সম্প্রতি দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনেক সুবিধাবাদী মানুষ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও আত্মসাৎ করছে। অথচ রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষা করা প্রতিটি নাগরিকের ইমানি দায়িত্ব। রাষ্ট্র যেমন নাগরিক হিসেবে আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়, তেমনি নাগরিক হিসেবে আমাদেরও রাষ্ট্রের সম্পদ সুরক্ষা করা কর্তব্য। দেশের প্রচলিত আইন রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্টকারীদের অপরাধী হিসেবে গণ্য করে। ইসলামেও দেশের সম্পদ আত্মসাৎ করা জঘন্য পাপ।

বিজ্ঞাপন

কেননা, দেশের সম্পদে দেশের সব মানুষের হক রয়েছে। তাই রাষ্ট্রীয় সম্পদ গ্রাস করা দেশের সব মানুষের হক মেরে দেওয়ার মতো। পরকালে এমন আত্মসাৎকারীর পরিণতি খুবই ভয়াবহ হবে। যে যা আত্মসাৎ করবে, তা নিয়েই কেয়ামতের দিন উপস্থিত হতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কোনো নবীর জন্য শোভনীয় নয়, তিনি খেয়ানত করবেন। আর যে ব্যক্তি খেয়ানত করবে, সে কেয়ামতের দিন সেই খেয়ানত করা বস্তু নিয়ে উপস্থিত হবে। এরপর প্রত্যেকেই পরিপূর্ণভাবে পাবে, যা সে অর্জন করেছে। তাদের প্রতি কোনো অন্যায় করা হবে না।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৬১)।

রাষ্ট্রীয় সম্পদের অসদ্ব্যবহার বৈধ নয়

রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যয় ও অসদ্ব্যবহার ইসলামে নিষিদ্ধ। কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থে ব্যবহার করতে পারবে না। পরকালে এমন ব্যক্তি জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কিছু মানুষ আল্লাহর দেওয়া সম্পদ অন্যায়ভাবে ব্যয় করে, কেয়ামতের দিন তাদের জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত।’ (বোখারি : ৩১১৮)। ওমর (রা.) কসম করে বলেন, ‘নিশ্চয় এ (রাষ্ট্রীয়) সম্পদে কেউ কারো চেয়ে বেশি হকদার নয়। আমিও কারো চেয়ে বেশি হকদার নই। এ সম্পদে সব মুসলমানের অধিকার রয়েছে; তবে মালিকানাধীন দাস ছাড়া।’ (আল-ফাতহুর রব্বানি : ৮৭)। রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যয়ে দক্ষ ও সৎ প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ওমর (রা.) বলেন, ‘আমি কি তোমাকে আমার ও এদের দৃষ্টান্ত সম্পর্কে বলব? আমার দৃষ্টান্ত হলো এমন যাত্রীদলের মতো, যারা তাদের সম্পদ একত্র করে এবং তাদের একজনের হাতে অর্পণ করে, যে প্রয়োজন অনুযায়ী খরচ করবে। এখন সেই ব্যক্তির জন্য কি বৈধ হবেÑ কাউকে অগ্রাধিকার দেওয়া?’ (মানাকিবু আমিরিল মুমিনিনা ওমর ইবনুল খাত্তাব : ১০২)।

প্রভাব খাটিয়ে সুবিধা গ্রহণ করা নিষেধ

কোনো ব্যক্তি তার সামাজিক বা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কোনো সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করলে তা ইসলামি আইনে অপরাধ। কেননা, এর ফলে রাষ্ট্র যেমন যোগ্য কর্মী ও প্রাপ্য রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে, তেমনি একজন যোগ্য ব্যক্তি তার প্রাপ্য সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। আবু হুমাইদ সাঈদ (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আজদ গোত্রের ইবনে উতবিয়া নামের এক ব্যক্তিকে সদকা সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি ফিরে এসে বললেন, ‘এগুলো আপনাদের, আর এগুলো আমাকে হাদিয়া দেওয়া হয়েছে।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘সে তার বাবা-মায়ের ঘরে কেন বসে থাকল না! সে দেখত, তাকে কেউ হাদিয়া দেয় কিনা। যাঁর অধীনে আমার প্রাণ, সেই সত্তার কসম! সদকার মাল থেকে স্বল্প পরিমাণও যে আত্মসাৎ করবে, সে তা কাঁধে করে কেয়ামতের দিন উঠবে। সেটা উট হলে তার আওয়াজ করবে, গাভি হলে হাম্বা হাম্বা করবে, আর বকরি হলে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করতে থাকবে।’ (বোখারি : ২৫৯৭)।

আত্মসাৎকারীর জন্য জান্নাত হারাম

দেশের সম্পদ আত্মসাৎ ও খেয়ানত ভয়ংকর অপরাধ। যারা দুনিয়ায় এগুলোর সঙ্গে জড়িত হবে, হাশরের ময়দানে সবার সামনে তাদের পরিচয় করানোর ব্যবস্থা করা হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন প্রত্যেক বিশ্বাসঘাতকের জন্য একেকটি পতাকা উত্তোলন করা হবে। বলা হবে, এটা অমুকের পুত্র অমুকের বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক।’ (বোখারি : ৬১৭৮)। রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎকারীর জন্য জান্নাত হারাম করা হয়েছে। এমন ব্যক্তি অপরাধের শাস্তি না পেয়ে জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ পাবে না। মাকিল ইবনে ইয়াসার (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘কোনো ব্যক্তি মুসলমানের দায়িত্ব গ্রহণের পর খেয়ানত অবস্থায় মারা গেলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন।’ (বোখারি : ৭১৫১)। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘যার প্রতি আল্লাহ কোনো দায়িত্ব অর্পণ করেন, এরপর যদি সে তা সুষ্ঠুভাবে পালন না করে, তাহলে সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না।’ (বোখারি : ৭১৫০)। পরকালে এ সম্পদের ‘পাই টু পাই’ হিসেব দিতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সম্ভ্রমহানি বা অন্য কোনো বিষয়ে জুলুমের জন্য দায়ী থাকে, সে যেন আজই তার কাছ থেকে মাফ করিয়ে নেয়, সেদিন আসার আগে, যেদিন তার কোনো দিনার বা দিরহাম থাকবে না। সেদিন তার কোনো সৎকর্ম না থাকলে তার জুলুমের পরিমাণ তার কাছ থেকে নেওয়া হবে। আর তার কোনো সৎকর্ম না থাকলে তার প্রতিপক্ষের পাপ থেকে নিয়ে তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে।’ (বোখারি : ২৪৪৯)।

রাষ্ট্রীয় সম্পদ চুরি ক্ষমাযোগ্য নয়

রাষ্ট্রীয় সম্পদ মূলত জনগণের সম্পদ। তাই কোনো রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি মানে দেশেরই ক্ষতি। বর্তমানে দেশে যেভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ চুরি হচ্ছে, এ অপরাধের সঙ্গে শুধু শাসকরাই জড়িত নন; জনগণও যে যখন সুযোগ পাচ্ছে, জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠন করছে। জাতীয় সম্পদের এ চুরি সাধারণ চুরি অপেক্ষা মারাত্মক। কারণ, একজন মানুষ যদি কারও ঘরে চুরি করে, তাহলে তা প্রতিকারের সুযোগ থাকে। যদি কখনও তার মনে অনুতাপ জাগে, ইচ্ছে করলে সহজে মাফ করিয়ে নেওয়া সম্ভব। রাষ্ট্রীয় সম্পদ আপামর জনগণের হক। এ সম্পদ দেশের মানুষের কাছে আমানত। কোনোভাবেই তা নষ্ট ও অপচয় করার সুযোগ নেই। যে বা যারা এটা নষ্ট ও অপচয় করবে, এর সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত থাকবে, তাদের প্রত্যেকেই পাপের ভাগীদার হবে। আমানত রক্ষার গুরুত্ব প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। মানুষের ধন-সম্পদের কিছু অংশ জেনেশুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশে তা বিচারকের কাছে পেশ করো না।’ (সুরা বাকারা : ১৮৮)।

আত্মসাৎকারীর বাসস্থান জাহান্নাম

আত্মসাৎকারীর জান্নাতে ঠাঁই হবে না। তাদের বাসস্থান হবে জাহান্নাম। আত্মসাতের সম্পদ দিয়ে দুনিয়ায় কিছুটা সুখ ভোগ করবে হয়তো; কিন্তু পরকালে তাকে এ সুখের মাসুল পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বুঝিয়ে দিতে হবে। উবাদা ইবনে সামেত (রা.) বলেন, হুনাইনের যুদ্ধের দিন রাসুলুল্লাহ (সা.) গনিমতের এক ক্ষুদ্র কণা পরিমাণ জিনিস হাতে নিয়ে বললেন, ‘হে উপস্থিত জনগণ! আমার হাতের এ ক্ষুদ্র অংশ তোমাদের গনিমতের মাল। সূঁচ পরিমাণ বা তার চেয়ে কমবেশি সম্পদ কারো কাছে থাকলে তা পেশ কর। নিশ্চয় খেয়ানত (আত্মসাৎ) কেয়ামাতের দিন খেয়ানতকারীর জন্য অপমান-অপদস্থ ও জাহান্নামের কারণ হবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৮৫০)। রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষা করা প্রত্যেক মোমিনের ইমানি দায়িত্ব। কেননা, এটি পবিত্র আমানত। প্রতিটি নাগরিকের এ আমানত রক্ষা করা উচিত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা তোমাদের নির্দেশ দিয়ে বলেন, তোমাদের আমানতগুলো প্রাপকের কাছে পৌঁছে দাও।’ (সুরা নিসা : ৫৮)।

প্রকৃত মোমিনের পরিচয়

প্রকৃত মোমিন হওয়ার অন্যতম আলামত হলো আমানত রক্ষা করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(তারাই প্রকৃত মোমিন), যারা আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে।’ (সুরা মোমিনুন : ৮)। তাই রাষ্ট্রের কোনো সম্পদ নষ্ট করলে পুরো দেশের মানুষের কাছ থেকে ক্ষমা চাইতে হবে। তারা ক্ষমা না করলে কেয়ামতের যে মুহূর্তে সবাই একটা নেকির জন্য হাঁসফাঁস করবে, তখন নেকির বিনিময়ে এ ঋণ শোধ করতে হবে। রাষ্ট্রের উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্রীয় সম্পদের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব। রাষ্ট্রীয় গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, পাহাড়, মাটি, বন, বালি ও ঘরবাড়িসহ যে কোনো সম্পদ যথাযথ ব্যবহার না করলে রাষ্ট্রীয় সম্পদ অপচয় হবে। আর অপচয়কারী শয়তানের ভাই। তাদের আল্লাহতায়ালা পছন্দ করেন না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ খেয়ানতকারীদের ভালোবাসেন না।’ (সুরা আনফাল : ৫৮)। যাকে যে কাজের দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়েছে, সে সম্পর্কে তাকে বিচারের মাঠে জবাবদিহিতা করতে হবে। যেখানে কোনো রকম ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। তাই স্ব-স্ব দায়িত্ব আমনতদারিতার সঙ্গে সঠিকভাবে পালন করা উচিত। যেন পরকালে জবাব দেওয়া সহজ হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল। প্রত্যেকে নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (বোখারি : ৭১৩৮)।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত