আমাদের সমাজে বেশ পরিচিত দুটি শব্দ হলো অলি-আওলিয়া। বাঙালি মুসলমান সমাজে সাধারণত মুসলমানদের একটি বিশেষ শ্রেণিকে অলি-আওলিয়া মনে করা হয়। অলি-আওলিয়াদের বিশেষ মর্যাদা ও ক্ষমতা আছে এমন বিশ্বাসও সাধারণ মুসলমানদের রয়েছে। আবার জীবিত অলি-আওলিয়াদের চেয়ে মৃত অলি-আওলিয়াদের ক্ষমতা বহুগুণে বেশি-এ ধরনের বিশ্বাসও মানুষ লালন করে থাকেন। বলা হয়, বাংলাদেশ হাজার হাজার অলি-আওলিয়ার দেশ। অলি-আওলিয়াদের চারণভূমি সুজলা-সুফলা, সাগর-নদীবেষ্টিত, সবুজে ঘেরা, সমতল ধানক্ষেতের দেশ বাংলাদেশ। প্রশ্ন হলো এই অলি-আওলিয়া কারা? তাদের কী পরিচয়? কীভাবে অলি-আওলিয়া চেনা যায়? অলি-আওলিয়া বলতে আসলে কী বোঝানো হয়? আসলেই কি অলি-আওলিয়া বলতে মুসলমানদের বিশেষ কোনো শ্রেণিকে বোঝানো হয়? অলি-আওলিয়াদের বিশেষ অলৌকিক ক্ষমতা আছে? এ লেখায় বিষয়টি আমরা পরিষ্কার করতে চাই।
অলি-আওলিয়া বাংলা ভাষায় বহুল ও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হলেও শব্দযুগল মূলত বাংলা নয়, তবে এখন এটি বাংলা ভাষায় মিশে গিয়ে বাংলা হয়ে গেছে। আসলে অলি-আওলিয়া শব্দ দুটি আরবি ভাষার এবং কোরআন ও সুন্নাহতে ব্যবহৃত শব্দ-পরিভাষা। অলি অর্থ বন্ধু আর আওলিয়া হলো অলি শব্দের বহুবচন অর্থ বন্ধুরা। কোরআনে আওলিয়া শব্দটি যেমন আল্লাহর বন্ধু অর্থে এসেছে, আবার শব্দটি শয়তানের বন্ধু অর্থেও এসেছে। সুরা বাকারাহর ২৫৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আর যারা কুফুরি করে তাদের বন্ধু হলো তাগুত অর্থাৎ শয়তান।’ এই লেখায় আওলিয়া দ্বারা আল্লাহর বন্ধু উদ্দেশ্য। এখন জানার বিষয় হলো, আল্লাহর বন্ধু অর্থাৎ কারা অলি-আওলিয়া? এর উত্তর আমরা দেখতে পাই আল্লাহর কালাম মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে। কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘জেনে রেখো! আল্লাহর আওলিয়া তথা বন্ধুদের কোনো ভয় নেই আর তারা দুঃখিতও হবে না। যারা ঈমান আনে আর তাকওয়া অবলম্বন করে।’ (সুরা ইউনুস : ৬২-৬৩)
এই আয়াত দুটি থেকে জানা গেল, অলি-আওলিয়া হলো তারা-ই, যারা ঈমান আনে ও তাকওয়া অবলম্বন করে অর্থাৎ দুটি বৈশিষ্ট্য থাকলে একজন মানুষ আল্লাহর অলি তথা বন্ধু হতে পারে। এক হলো ঈমান আর দ্বিতীয় হলো তাকওয়া এবং এর ফল হলো আখিরাতে তাদের কোনো ভয়ও থাকবে না এবং তারা দুঃখিতও হবে না। সুবাহানাল্লাহ! কী চমৎকার অলি-আওলিয়াদের সংজ্ঞা ও পরিচয় স্বয়ং আল্লাহতায়ালা কোরআনে তুলে ধরেছেন। সেই মানুষই আল্লাহর অলি, যার মধ্যে ঈমান ও তাকওয়া থাকবে। বোঝা গেল ঈমান ও তাকওয়া হলো অলি হওয়ার মৌলিক মানদণ্ড। আল্লাহতায়ালা কোরআনে সুরা হুজরাতের ১৩ নম্বর আয়াতে বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়াবান। নিশ্চয় আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত।’
তাহলে আমরা বুঝলাম ঈমানের অধিকারী মুমিন আর তাকওয়ার অধিকারী মুত্তাকি ব্যক্তি হলো অলি তথা আল্লাহর বন্ধু। যার ঈমান ও তাকওয়া যত বেশি, তিনি তত বড় আল্লাহর অলি হবেন। সুতরাং প্রত্যেক ঈমানদার-মুসলমানই আল্লাহর অলি। হানাফি মাজহাবের অন্যতম যুগশ্রেষ্ঠ ফকিহ ইমাম আবু জাফর তাহাবি (রহ.) ইমাম আবু হানিফা (রহ.), ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.), ইমাম মুহাম্মাদ (রহ.) এবং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আকিদা ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘সব মুমিন করুণাময় আল্লাহর অলি। তাদের মধ্য থেকে যে যত বেশি আল্লাহর অনুগত ও কোরআনের অনুসরণকারী, তিনি তত বেশি আল্লাহর কাছে সম্মানিত-মর্যাদার অধিকারী।’ (ইমাম তাহাবি, শরাহ আল আকিদাহ, পৃষ্ঠা ৩৫৭-৩৬২)
প্রকৃতপক্ষে অলি-আওলিয়া বলতে মুসলমানদের আলাদা কোনো শ্রেণি বা গোষ্ঠী নেই। এমনকি অদৃশ্য বা গায়েব থেকে জীবিত কিংবা মৃত কোনো অলি-আওলিয়ার পক্ষে মানুষের জন্য ভালো-মন্দ, ক্ষতি বা উপকার করার কোনো ধরনের কোনো অলৌকিক ক্ষমতা নেই। প্রত্যেক সৎ, ইলম ও আমলের অধিকারী ঈমানদার-মুত্তাকিই ব্যক্তিই হলেন আল্লাহর অলি-বন্ধু। আর এমন অলি-আওলিয়ার দ্বারা যদি কোনো ধরনের অলৌকিক কিছু প্রকাশ পায়, যাকে আমরা কারামাত বলি, তা সত্য এবং তা আল্লাহর ইচ্ছায় ঘটে, তাদের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, এতে তাদের নিজস্ব কোনো কৃতিত্ব নেই, তাদের ইচ্ছায়ও ঘটে না, ঘটাতে পারেও না। যখন ইচ্ছা তখন অলৌকিক কিছু ঘটাবেন বা দেখাবেন এমন ক্ষমতা তাদের নেই। যদি কেউ নিজের ইচ্ছায় অলৌকিক কিছু দেখাতে বা ঘটাতে পারেন বলে জানায়, ধরে নিতে হবে সেটি ইসতিদরাজ তথা শয়তানি কাজ আর সে হলো শয়তান।

