বাংলাদেশের বহু মসজিদে দেখা যায়, অভিভাবকরা ছোট শিশুদের সঙ্গে নিয়ে নামাজে আসেন। কিন্তু এ সময় অনেক শিশু দৌড়ঝাঁপ ও চিৎকার করে কিংবা নামাজের পরিবেশে বিঘ্ন ঘটায়। ফলে মুসল্লিদের মধ্যে বিরক্তি সৃষ্টি হয়, কেউ কেউ শিশুদের প্রতিই উঁচু আওয়াজ করে ফেলেন। অথচ ইসলাম শিশুদের মসজিদে আনার ব্যাপারে ভিন্ন শিক্ষা দিয়েছে। কোরআন ও হাদিসে শিশুদের মসজিদের সঙ্গে পরিচিত করানো এবং তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শনের একাধিক উদাহরণ রয়েছে।
নিজেকে ও পরিবারকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানো
ভয়াবহ জাহান্নাম থেকে নিজেকে ও পবিরাবরকে বাঁচানোর জন্য পবিত্র কোরআনে নির্দেশনা এসেছে। পরিবারকে বাঁচাতে হলে অবশ্যই ছোট থেকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা বাবা-মায়ের দায়িত্ব। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই অগ্নি থেকে রক্ষা করো, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর।’ (সুরা আত-তাহরিম : ০৬)
পরিবারকে নামাজে অভ্যস্ত করার নির্দেশ
আল্লাহ পরিবার-সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই নামাজে অভ্যস্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। ‘তুমি তোমার পরিবারকে নামাজের নির্দেশ দাও এবং নিজেও এতে অবিচল থাকো।’ (সুরা ত্ব-হা : ১৩২) এ আয়াত প্রমাণ করে যে সন্তানদের মসজিদের সঙ্গে পরিচিত করা তাদের ইসলামি শিক্ষা ও চরিত্র গঠনের অংশ।

সন্তানদের দ্বীনের উত্তরাধিকারী বানানো
মুমিনের দোয়া হলো, পরিবার-সন্তানদের দ্বীনের পথে বড় করা। আল্লাহর শেখানো দোয়া : ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের চোখের শীতলতা দাও এবং আমাদের মুত্তাকিদের জন্য আদর্শ বানাও।’ (সুরা আল-ফুরকান : ৭৪) সন্তানরা যেন মুত্তাকিদের অনুসারী হয়, এ জন্য তাদের মসজিদের পরিবেশে আনা জরুরি।
নবী (সা.) শিশুদের নিয়ে নামাজ পড়েছেন
রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো শিশুদের মসজিদে আসতে নিষেধ করেননি, বরং তাদের কোলে বা কাঁধে নিয়ে নামাজ পড়েছেন। আবু কাতাদা (রা.) বলেন, আমি নবী (সা.)-কে নামাজ পড়তে দেখেছি, তিনি নাতনি উমামাহকে কাঁধে বহন করতেন। রুকুতে গেলে নামিয়ে দিতেন, দাঁড়ালে আবার কাঁধে নিতেন। (আবু দাউদ : ১৮২) শিশুর উপস্থিতি নামাজের জন্য বাধা নয়, বরং ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী এটি স্বাভাবিক।
শিশুর কান্নায় নামাজ সংক্ষিপ্ত করা
নবী (সা.) শিশুদের কান্নার প্রতি মমতা দেখিয়ে নামাজ সংক্ষিপ্ত করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি অনেক সময় দীর্ঘ করে সালাত আদায়ের ইচ্ছা নিয়ে দাঁড়াই। পরে শিশুর কান্নাকাটি শুনে সালাত সংক্ষিপ্ত করি। কারণ, শিশুর মাকে কষ্টে ফেলা আমি পছন্দ করি না।’ (বুখারি : ৬৭৫) এ হাদিস থেকে বোঝা যায় শিশুদের উপস্থিতি মসজিদে বৈধ এবং তাদের জন্য ইমাম ও মুসল্লিদের সহনশীল হওয়া উচিত।

খুতবা থামিয়ে শিশুদের কোলে নেওয়া
নবী (সা.)-এর কাছে শিশুর উপস্থিতি কখনো ঝামেলা ছিল না, বরং স্নেহের কারণ। একবার রাসুল (সা.) খুতবা দিচ্ছিলেন, এ সময় হাসান ও হুসাইন হোঁচট খেতে খেতে এলেন। নবী (সা.) মিম্বর থেকে নেমে তাদের কোলে নিলেন এবং বললেন, “আল্লাহ সত্য বলেছেন ‘নিশ্চয়ই তোমাদের সন্তানরা পরীক্ষা’। আমি এ দুজনকে দেখে আর ধৈর্য ধরতে পারলাম না।” (বায়হাকি : ৫৮১৯) শিশুদের মসজিদে আসা নবী (সা.)-এর কাছে প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক ছিল।
ছোটদের প্রতি দয়া প্রদর্শন
মুসল্লিদের জন্য শিশুদের প্রতি বিরক্ত না হয়ে বরং দয়ার্দ্র ও সহনশীল হওয়া জরুরি। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে আমাদের ছোটদের প্রতি দয়া করে না এবং বড়দের মর্যাদা দেয় না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (তিরমিজি : ১৯২১) সুতরাং শিশুদের প্রতি বিরক্ত না হয়ে তাদের প্রতি মমতা প্রদর্শন আবশ্যক।
কোরআন ও হাদিসের আলোকে স্পষ্ট যে, শিশুদের মসজিদে আনা ইসলাম অনুমোদিত করেছে। কাজেই শিশুদের উপস্থিতিকে বিরক্তিকর না ভেবে বরং তাদের আল্লাহর ঘরের মেহমান হিসেবে দেখা উচিত। অভিভাবকের দায়িত্ব হলো শিশুদের ধীরে ধীরে শৃঙ্খলিত করা আর মুসল্লিদের কর্তব্য হলো সহনশীলতা ও দয়া প্রদর্শন। কেননা, শিশুদের আজকের উপস্থিতিই আগামী দিনের মসজিদভরা ভবিষ্যৎ।
লেখক : শিক্ষক, প্যারামাউন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রাজশাহী

