অবহেলিত বখতিয়ার খিলজির কবর

ওয়ালিউল্লাহ সিরাজ
প্রকাশ : ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩: ১১

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বাংলা ও বিহার অঞ্চলে প্রথম মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনিই বাংলার লক্ষণ সেনকে পরাস্ত করে প্রথম বাংলা দখল করেন। জিয়াউদ্দিন বারানির ইতিহাস গ্রন্থ তারিখ-ই ফিরোজ শাহি, আলবরুনির তহকিকাত ও ইবনে বাতুতার ভ্রমণকাহিনিতে বখতিয়ার খিলজির কথা গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। এসব গ্রন্থে বলা হয়েছে, এই তুর্কি সেনাপতি ও বীর যোদ্ধাই প্রথম বাংলা ও বিহার অঞ্চলে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।

বিজ্ঞাপন

বখতিয়ার খিলজির রণকৌশল ছিল খুবই চমৎকার ও অতুলনীয়। তার রণকৌশলের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল দ্রুতগতি। তিনি খুব অল্পসংখ্যক সেনা নিয়ে শত্রুকে আক্রমণ করতেন, যা শত্রুপক্ষকে অবাক করে দিত। বখতিয়ার খিলজি এমন সময় এবং এমন স্থানে আক্রমণ করতেন, যা শত্রুর কল্পনার বাইরে ছিল। ১২০৪ সালে মাত্র ১৭ জন ঘোড়সওয়ার সেনা নিয়ে তিনি নদিয়া আক্রমণ করেন এবং লক্ষণ সেনকে পরাজিত করেন। তিনি সব সময় শত্রুর দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো কাজে লাগাতেন। তার রণপরিকল্পনায় শক্তির তুলনায় কৌশলকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো।

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার ছিলেন তুর্কি জাতিভুক্ত খিলজি বংশের সন্তান। তার পূর্বপুরুষ আফগানিস্তানের গরমশির অঞ্চলে বাস করতেন। অল্প বয়সে তিনি ভাগ্যান্বেষণে বের হন এবং বহু দরবার ঘুরে অযোধ্যার শাসক হুসামুদ্দিনের সেনাবাহিনীতে থিতু হন। হুসামুদ্দিন তাকে ‘ভগবত’ ও ‘ভিউলা’ নামক দুটি পরগনার জায়গির দান করেন। এরপরই তার জীবনধারা বদলে যায় এবং নিজেকে একজন শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠার সুযোগ পান।

একজন যোগ্য শাসক ও সেনাপতি হিসেবে বখতিয়ার খিলজির সুনাম ছড়িয়ে পড়লে দিল্লির শাসক কুতুবুদ্দিন আইবেকের সুদৃষ্টি লাভ করেন এবং তার আনুগত্য স্বীকারের বিনিময়ে বিহার অভিযানের অনুমতি পান। বিহার বিজয়ের পর বখতিয়ার খিলজির ক্ষমতা ও সামর্থ্য আরো সংহত হয়।

এই উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের সূচনা হয় তার মধ্যমেই। তিনিই বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা করেন। আর এই শাসনই পরবর্তী ৫০০ বছরের ইতিহাস গড়ে তোলে। বখতিয়ার খিলজির শাসনামলেই এ অঞ্চলে ইসলামি শিক্ষার প্রচলন বাড়ে। এ ছাড়া মসজিদ, মাদরাসা ও খানকাহ নির্মাণে তার অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য।

তিব্বত বিপর্যয়ের পর ব্যর্থতার গ্লানি ও শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েন বখতিয়ার। তিনি ফিরে আসেন দেবকোটে (বর্তমান দিনাজপুর)। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। ইসলামি ইতিহাসের উজ্জ্বল সিপাহসালার বখতিয়ারের সমাধিস্থল আজও অবহেলিত ও অনেকটাই অজ্ঞাত। বখতিয়ার খিলজির কবর যে এখনো চিহ্নিত আছে তা-ও জানেন না অনেকে। বাংলায় মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠাতা বখতিয়ার খিলজি বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় ঘুমিয়ে আছেন। জেলার বালুরঘাট মহকুমার গঙ্গারামপুর থানায় পীরপালে এখনো টিকে আছে তার সমাধিসৌধ।

মুসলিম শাসনামলের বহু স্থাপনার মতোই অযত্নে-অবহেলায় ধ্বংসের মুখে বখতিয়ার খিলজির সমাধিসৌধও। সমাধিস্থলে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে বারো দুয়ারি ও দীঘির ঘাট এরই মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। ধসে গেছে সমাধিসৌধের দেয়ালের একাংশ। ধারণা করা হয়, বারো দুয়ারি নামে চিহ্নিত স্থাপনাটি মূলত একটি মসজিদ ছিল। মসজিদের মুসল্লি ও কবর জিয়ারতকারীদের অজুর জন্য পাথর বাঁধানো ঘাট তৈরি করা হয়েছিল। সমাধি ও বারো দুয়ারি পাথরের দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল। তবে ব্রিটিশ সার্ভেয়ার স্যার ফ্রান্সিস বুকানন হামিল্টন, যিনি ১৮০৭ খ্রিষ্টাব্দে উত্তরবঙ্গ ও বিহারের জরিপকাজে নিযুক্ত হন। তিনি বখতিয়ার খিলজির সমাধির বিবরণ দেওয়ার সময় বারো দুয়ারির ভেতরে একটি কবর আছে বলে উল্লেখ করেছেন।

স্যার হামিল্টনের ধারণা বারো দুয়ারির কবরটিই বখতিয়ার খিলজির এবং এখনো টিকে থাকা কবরটি বখতিয়ারের সহচর পীর বাহাউদ্দিনের। অবশ্য সমাধিসৌধের সামনে টাঙানো বর্তমান নামফলকে স্যার হামিল্টনের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে এবং টিকে থাকা সৌধটিকেই বখতিয়ারের বলে দাবি করা হয়েছে। তার কবর অবহেলিত থাকলেও তিনি আছেন বাংলার প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে। মানুষ আজও স্মরণ করে তাকে। গবেষণা করে তার রণকৌশল নিয়ে। কেননা এ অঞ্চলে মুসলিম আধিপত্য ও ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদেরও তাদের পদাঙ্গ অনুসরণ করেই চলতে হবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত