মহানবীর ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়

উম্মেহানী বিনতে আব্দুর রহমান
প্রকাশ : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯: ১৪

হিজরির অষ্টম বছর, রমজান মাস। মক্কার চারপাশের পাহাড় আর উপত্যকা শুকনো কাষ্ঠের মতো, সময়টা বসন্তের শেষের আবহাওয়াময়। কিছু জায়গায় মাথা উঁচু করে আছে সবুজ ঘাসের প্রাণচাঞ্চল্য। মরুর আকাশ ভোরের আলোয় ঝলমল করছে; সেই সময়ে মরুর উপকণ্ঠে হাজার হাজার মুসলিম সৈন্যের পদচারণা। বৃহৎ সেনাসমাবেশ হলেও শৃঙ্খলা এত নিখুঁত যে, দূর থেকে মনে হচ্ছিল এক বিশাল সমুদ্র ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। বহু নির্যাতন, নির্বাসন আর সংগ্রামের পর নবীজি (সা.) ওই শহরের পথে, যেখান থেকে তাকে ও সাহাবিদের বের করে দেওয়া হয়েছিল। মুসলমানদের শক্তি তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে-প্রায় দশ হাজার সাহাবি নবীজির (সা.) নেতৃত্বে মক্কার উপকণ্ঠে।

ইতিহাসের নিয়ম অনুযায়ী তখন জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের ঢেউ ওঠার কথা ছিল কিন্তু ঘটল উল্টোটা। নবীজি (সা.) ঘোষণা করলেন, ‘আজ প্রতিশোধের দিন নয়, আজ দয়া ও ক্ষমার দিন।’ মুসলিম সেনারা চার দিক থেকে মক্কায় প্রবেশ করছিলেন। নবীজির চারপাশে ছিলেন ঘনিষ্ঠ সাহাবিরা। সেনারা গোত্র বা উপজাতি অনুযায়ী সারিবদ্ধ, হাতে পতাকা আর প্রহরীরা রাসুলের হাওদার দুই পাশে অবস্থান নিয়েছেন। সামনে অগ্রণী বাহিনী, পেছনে মূল বাহিনী, মাঝখানে নবীজি। আহ কি অভিনব এক যাত্রা, ভাবনায় আনে শকুনের ঢেউ।

বিজ্ঞাপন

রাসুল (সা.) মক্কায় প্রবেশকালে সুরা ফাতেহা পড়ছিলেন-আবদুল্লাহ ইবনু মুগাফফাল (রা.) সূত্রে ইমাম বোখারি উল্লেখ করেছেনÑমক্কা বিজয়ের দিন নবীজি (সা.) সুরা ফাতেহা তিলাওয়াতের সময়কার বর্ণনায়Ñতারজি শব্দের উল্লেখ রয়েছেÑরাব্বুল ইজ্জত নবীজিকে সার্বিক অহমিকা ও মহাসাফল্যে ডুবে থাকা দুনিয়াদারদের মতো আত্মহারা অবস্থা থেকে হেফাজত করেছেন। নবীজির চিন্তা-চেতনায় অহমিকার লেশমাত্র ছিল না। বরং নবীজি প্রতিপালকের দয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে ছিলেন নতশির ও বিনয়ী। যেমন আল্লাহ নবীজিকে বলেছেন, ‘যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে এবং আপনি দেখবেন মানুষ দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করছে, তখন আপনি আপনার প্রতিপালকের পবিত্রতা বর্ণনা করুন এবং তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয় তিনি মহাক্ষমাশীল।’ (সুরা নাসর : ১-৩)

কোরআনের ওই আয়াতই নবীজির মক্কা প্রবেশের প্রতিচ্ছবি। সুবহানাল্লাহÑকী চমৎকার ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আল্লাহর আদেশ মান্যতার চিত্র। ইবনু ইসহাকের বর্ণনায় পাওয়া যায়, নবীজি (সা.) জু-তুওয়ায় পৌঁছেই আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় অবলোকন করেন, যা দ্বারা রাব্বুল আরশিল আজিম তার মর্যাদা বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেন। তখন তিনি মাথা মোবারক বিনয় ও নম্রতায় এত ঝুঁকিয়ে দেন, দাড়ির অগ্রভাগ হাওদার কাঠের সঙ্গে লেগে যায়।

মক্কা বিজয়ের সে চিত্র আমাদের নৈতিকতার শিক্ষায় এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মরুর বাতাসে পতাকা দুলছে, সৈন্যদের পদচারণার ধূলির মধ্যেই এক বিনম্র নেতৃত্ব; তলোয়ার হাতে কিন্তু হৃদয় পূর্ণ ক্ষমায়। নবীজি (সা.) মক্কার বিভিন্ন পথ ধরে মুজাহিদদের প্রবেশের নির্দেশ দেন, যেন মক্কাবাসী চাইলেও লড়াই করতে না পারে। তারা যখন দেখবে মক্কার প্রতিটি প্রবেশপথ মুসলিমদের দখলে, তখন তারা না পারবে দ্রুত সংঘবদ্ধ হয়ে লড়াই করতে, না পারবে প্রতিরোধ করতে।

সাহাবিরা শহরে ঢুকে সাধারণ মানুষকে আশ্বস্ত করলেন নবীজি (সা.) ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। যারা ইসলামের শত্রু ছিলেন, তাদের অনেকেই নিরাপত্তা পেলেন। সেদিন মক্কা বিজয় হলো রক্তপাত ছাড়া; এরই সঙ্গে মুগ্ধতায় ছেয়ে গেল মক্কাবাসীর হৃদয়। তারা অবাক নেত্রে তাকিয়ে ছিলেন এ ক্ষমা ঘোষণার শব্দে।

আর রাহিকুল মাখতুমের বর্ণনায় আছেÑনবীজির কণ্ঠে ধ্বনিত হলোÑ‘আমি তোমাদের সে কথাই বলছি, যে কথা ইউসুফ (আ.) স্বীয় ভাইদের বলেছিলেনÑলা তাসরিবা আলাইকুমুল ইয়াওম, আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই, তোমরা সবাই মুক্ত।’

মুজাহিদ বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে নবী (সা.) বিনা বাধায় মক্কায় প্রবেশ করলেন। প্রথমে তিনি কাবাঘরের দিকে গেলেন। তার চারপাশে আনসার ও মুহাজিররা ঘিরে ছিলেন। কাবায় গিয়ে তিনি আল্লাহর ঘরের তাওয়াফ করলেন। রাসুলের হাতে একটি ধনুক ছিল। সে সময় কাবার অভ্যন্তরে ছিল ৩৬০টি মূর্তি। ধনুকের মাধ্যমে এক এক করে তিনি মূর্তিগুলোকে ভেঙে ফেললেন। এ সময় তিনি কোরআনের এই আয়াতটি পাঠ করছিলেন, ‘বলো সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয়ই মিথ্যা বিলুপ্ত হওয়ারই ছিল।’ (সুরা ইসরা : ৮১) এরপর নবীজি কাবার ভেতরে প্রবেশ করলেন এবং সালাত পড়লেন।

মক্কা বিজয় অনেক সুবাসিত অধ্যায়ের শিক্ষায় সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে আছে। যেমন-

১. ক্ষমা ও উদারতা : নবীজি মক্কা বিজয়ে শিক্ষার অনন্য অধ্যায় রেখেছেন পুরো মানবতার জন্য, যা ছিল এমন যে প্রকৃত সাফল্য ক্ষমার মধ্যে নিহিত।

২. শান্তিপূর্ণ পরিবর্তন : পুরো একটি বিশাল শহর বদলে গেল ক্ষমার শিক্ষার দরুন। সুতরাং সমাজ ও রাষ্ট্রের বড় পরিবর্তন বিনয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সম্ভব।

৩. বিনয়ী নেতৃত্ব : বিজয়ের মুহূর্তেও নবীজি (সা.) ছিলেন বিনয়ী; এটি নেতাদের জন্য অনন্য শিক্ষা।

৪. নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার : তিনি সবাইকে নিরাপত্তা দিলেন এবং মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করলেন।

৫. আদর্শে অটল থাকা : ত্যাগের দীর্ঘ সংগ্রাম সত্ত্বেও নবীজি (সা.) নীতি ও ন্যায়ের পথ ছাড়েননি।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত