রাজকীয় বার্নাব্যুতে মদ্রিচের শেষ পদচিহ্ন

আরিফুল হক বিজয়
প্রকাশ : ২৬ মে ২০২৫, ১০: ০০
বিদায়বেলায় ভক্তদের অভিবাদনের জবাব দিচ্ছেন মদ্রিচ। ছবি: সংগৃহীত

রিয়াল মাদ্রিদ-রিয়াল সোসিয়েদাদ ম্যাচের ৮৭তম মিনিট। ডাগআউট থেকে কার্লো আনচেলত্তির ইঙ্গিত। বোর্ড তুললেন লাইন্সম্যান। ইলেকট্রনিক বোর্ডে পাশাপাশি দুটো নম্বর। যার মধ্যে একটি সংখ্যা '১০', লাল রংয়ের আলোয় সংখ্যাটা ভেসে ওঠতেই থমকে গেল মাঠের পরিবেশ। সতীর্থরা দুই সারিতে দাঁড়িয়ে গেছেন। ক্যামেরার লেন্স ঘুরে গেল একদিকে। সবুজ গালিচা ছেড়ে উঠে আসছেন লুকা মদ্রিচ, সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর ‘ক্রোয়েশিয়ান মৌমাছি’। এই উঠে আসা বিদায়ের, বার্নাব্যুর ঘাসে পদচিহ্ন থেমে যাওয়ার।

বিজ্ঞাপন

মদ্রিচ যখন রিয়ালে আসেন, বয়স সবে ২৬। উড়ন্ত দুরন্ত টগবগে যুবক। বল পায়ে গেলেই ঝাড়া দিয়ে ওঠেন। মৌমাছির মতোন উড়ে-উড়ে ঘুরে-ঘুরে প্রতিপক্ষকে হুল ফোটান। তার ক্ষিপ্রগতির দৌঁড়ে জেগে ওঠে বার্নাব্যু। ১৩ বছর পর ৩৯-এ এসে আরেকবার বার্নাব্যুকে জাগিয়ে তুললেন মদ্রিচ। শেষবার রাজকীয় মাদ্রিদের সবুজ গালিচায় এঁকে দিলেন পদচিহ্ন। বার্নাব্যুও তাকে অভিবাদন জানালো সমস্বরে, ‘গ্রাসিয়াস লুকা’ কৃতজ্ঞতার ধ্বনিতে।

মাদ্রিদের সমর্থকরা মদ্রিচকে কৃতজ্ঞতার সাগরে ভাসাতেই পারেন। এক যুগের বেশি সময় ধরে স্পেনের সেরা ক্লাবের মাঝমাঠের ভার বয়ে চলা চাট্টিখানি কথা নয়। ২০১২ সালে ইংলিশ ক্লাব টটেনহ্যাম হটস্পার থেকে রিয়ালে আসা। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন দলের প্রাণভোমরা। তার দূরদর্শী পাস, ঠাণ্ডা মাথার নিয়ন্ত্রণ আর অসামান্য ফুটবল মেধা রিয়ালকে উপহার দিয়েছে অসংখ্য সাফল্য। যে সাফল্যের ঝর্ণাধারায় মদ্রিচ নিজেও ভিজেছেন। মেসি-রোনালদোর রাজত্বে প্রবেশ করে ছিনিয়ে এনেছেন সেরার মুকুট। ২০১৮ সালে উয়েফা এবং ফিফার বর্ষসেরা ফুটবলার হিসেবে ‘দ্য বেস্ট’ এবং ব্যালন ডি’অর জিতেছিলেন ৩৯ বছর বয়সী এই মিডফিল্ডার।

মাদ্রিদের রাজাদের হয়ে এখন পর্যন্ত ৫৯১ ম্যাচ খেলেছেন মদ্রিচ। তাতে ৪৩ গোলের পাশাপাশি করেছেন ৯৫ অ্যাসিস্ট। রিয়ালের ২৮টি ট্রফি পেয়েছে তার ছোঁয়া। ছয়টি চ্যাম্পিয়নস লিগ, পাঁচটি করে ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ, উয়েফা সুপার কাপ, স্প্যানিশ সুপার কাপ, চারটি লা লিগা, দুটি স্প্যানিশ কাপ এবং একটি ফিফা ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ জিতেছেন ক্রোয়েশিয়ান তারকা। রিয়ালের ১২৩ বছরের ইতিহাসে ট্রফি জয়ের ক্ষেত্রে তার ওপরে কেউ নেই। বিদেশি ফুটলারদের মধ্যে রিয়ালের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলার রেকর্ড মদ্রিচের। শীর্ষে রয়েছেন করিম বেঞ্জেমা। ফ্রান্সের সাবেক ফুটবলার রিয়ালের হয়ে ৬৪৮টি ম্যাচ খেলেছিলেন।

ক্লাবের হয়ে ফুটবলাররা শুধু ফুটবলটাই খেলেন না, কারো কারো জীবনের একটা অংশ হয়ে যায় নির্দিষ্ট একটি ক্লাব। সান্তোস-পেলে, নাপোলি-ম্যারাডোনা, রিয়াল-রাউল, মেসি-বার্সেলোনার মতো মদ্রিচের জীবনেও রিয়াল মাদ্রিদ অক্ষয়। বিদায় বেলায় এই চিরন্তন সত্য অকপটে স্বীকার করলেন মদ্রিচও, ‘রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে খেলা আমার জীবন বদলে দিয়েছে। আমি গর্বিত ইতিহাসের অংশ হতে পেরে। ক্লাব বিশ্বকাপের পর আমি আর রিয়ালের জার্সি না পরলেও আমি সব সময় একজন মাদ্রিদিস্তাই (রিয়াল মাদ্রিদের ভক্ত) থাকব। রিয়াল মাদ্রিদই আমার ঘর।’ সেই ঘর থেকে একই সঙ্গে বিদায় নিচ্ছেন রিয়ালের কোচ কার্লো আনচেলত্তিও।

প্রতিটি গল্পের শুরু থেকে শেষ আছে। একযুগের বেশি সময় পেরিয়ে সূর্যাস্তের এক বিকেলে মাদ্রিদের ঘরের মাঠের গল্পের উপসংহার টানলেন মদ্রিচ। প্রত্যেকটি বিদায় বেদনার। তবে মদ্রিচ মাদ্রিদ ভক্তদের শুনিয়ে গেলেন নিজের দর্শন, সবচেয়ে প্রিয় বাক্য, ‘শেষ হওয়ায় কেঁদো না, বরং আনন্দচিত্তে বিদায় দাও।’ পুরো বার্নাব্যু লুফে নিল তার আহবান। মদ্রিচের করতালি আর অভিবাদনের জবাবে বার্নাব্যুর বিশাল জমিনে ভেসে উঠল চিরচেনা শেষ বাক্যটি, ‘হালা মদ্রিচ…’।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত