কলাম

নবোদ্যমে আজকের বিকেএসপি

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুনীরুল ইসলাম
প্রকাশ : ২১ মে ২০২৫, ১০: ০০

বিকেএসপি বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের স্বপ্নপুরী। সুন্দর-সবুজ ক্যাম্পাস, চিরসবুজ এখানকার ক্রীড়াবান্ধব পরিবেশ। ক্রীড়াজগতের এক অপূর্ব নয়নাভিরাম অভয়ারণ্য। এখান থেকেই ক্রীড়া প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সবুজের বুকে লাল সূর্য খচিত পতাকাকে বিশ্বদরবারে সগৌরবে তুলে ধরা হবে- এমনটাই আশা সবার। কিন্তু পেছনের ১৫ বছর দেশের ক্রীড়াঙ্গনের অগ্রযাত্রা হয়েছে বাধাগ্রস্ত। যার প্রভাব পড়েছিল খেলোয়াড় তৈরির আঁতুড়ঘর বিকেএসপিতেও। এর পেছনে অন্যতম কারণ ছিল খেলোয়াড় বাছাইয়ে অস্বচ্ছতা। গড়পড়তা মানের খেলোয়াড়দের নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে সাফল্য এলেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফল্য আনা ছিল খুবই দুষ্কর।

জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর বিকেএসপিতে ‘আমি জিতলে জিতবে দেশ’- এ প্রতিপাদ্যের ব্যানারে অনুপ্রেরণামূলক এক অনুষ্ঠানে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ আত্মদানকারী আহত সাত রিহ্যাবিলিটেশনপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বিকেএসপির প্রশিক্ষণার্থীরা গণঅভ্যুত্থানে আহত বীরদের আত্মত্যাগের কথা এবং তাদের জীবনযুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প শুনে অনুপ্রাণিত হন এবং নিজেদেরও খেলাধুলার মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনার বিষয়ে দৃঢ়প্রত্যয়ী হন। এ ছাড়াও কৃতী ব্যক্তিদের মাধ্যমে বিকেএসপির প্রশিক্ষণার্থীদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় অনুপ্রেরণামূলক অনুষ্ঠানের। ইতোমধ্যে লঙ্কা-বাংলা ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়রা আজমকে আমন্ত্রণ জানিয়ে অনুপ্রেরণামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আগামীতেও বিকেএসপি বা জাতীয় পর্যায়ে লিজেন্ড প্লেয়ার বা ব্যক্তিবগর্কে এ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হবে, যাতে করে বর্তমানে বিকেএসপিতে প্রশিক্ষণরত খেলোয়াড়রাও অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনতে পারেন।

বিজ্ঞাপন

বিকেএসপির দীর্ঘমেয়াদি ছাত্র ভর্তি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনয়নের লক্ষ্যে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের ক্রীড়া উপদেষ্টার দিকনির্দেশনা ও সংশ্লিষ্ট সবার আন্তরিক সহযোগিতায় এবার শতভাগ নিরপেক্ষ থেকে তদবির ও স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃত ক্রীড়ামেধাকে প্রাধান্য দিয়ে ভর্তি করা হয় এক ঝাঁক নবীন খেলোয়াড়কে। এদের তৈরিতে প্রস্তুত বিকেএসপির খেলোয়াড় তৈরির কারিগররা। আগামী ৩-৪ বছর পর এর গুণগত ফল পাওয়া যাবে বলে আশাবাদী আমরা সবাই।

জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নমূলক অনেক কাজ করে যাচ্ছে। দেশের ক্রীড়াঙ্গনেও এসেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সার্চ কমিটির মাধ্যমে ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোকে ঢেলে সাজানো এবং খেলাধুলার মাধ্যমে সুস্থ যুবসমাজ গড়ে তোলা। দেশের যুবসমাজকে সামাজিক অবক্ষয় থেকে ফিরিয়ে আনতে এবং খেলাধুলার প্রতি আকৃষ্ট করতে দেশব্যাপী আয়োজিত তারুণ্যের উৎসবে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে। সরকারের নির্দেশনার প্রতি লক্ষ রেখে বিকেএসপিতেও সৃষ্টি হয় প্রাণচাঞ্চল্য। আয়োজন করা হয় বিকেএসপি কাপ ফুটবল, অ্যাথলেটিক্স, টেনিস, কাবাডি, টেবিল টেনিস ও বক্সিং প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতাগুলোতে বিকেএসপির একক আধিপত্যই প্রমাণ করে বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতায় বিকেএসপিই সেরা।

সরকারের এই কার্যক্রমে বিকেএসপির কর্মপরিকল্পনায় আসে এক প্রাণের সঞ্চার। সবাই ব্যর্থতাকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে একে একে জয় করেছে অনেকগুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বিকেএসপির আর্চার সাগর ইসলামের সরাসরি অলিম্পিকে অংশগ্রহণ, জাতীয় যুব আর্চারিতে বিকেএসপি চ্যাম্পিয়ন, অ্যাথলেট তামিম হোসেনের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ট্রিপল জাম্পে ব্রোঞ্জ পদক, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় তায়কোয়ানডো দলের ৫টি স্বর্ণপদক, প্রথম সাউথ এশিয়ান কমবেট স্কুল তায়কোয়ানডোতে বিকেএসপি চ্যাম্পিয়ন, বিকেএসপি ক্রিকেট দলের প্রথম বিভাগে খেলার যোগ্যতা অর্জন, ডেভেলপমেন্ট হকিতে বিকেএসপির মেয়েদের একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রেখে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন, আর্চারি, কাবাডি ও শুটিং ফেডারেশন আয়োজিত তারুণ্যের উৎসব প্রতিযোগিতায় বিকেএসপি চ্যাম্পিয়ন, জাতীয় ও উন্মুক্ত টেনিস প্রতিযোগিতায় বিকেএসপির প্রাধান্য বিস্তার এবং চ্যালেঞ্জার্স ওপেন কারাতে প্রতিযোগিতায় বিকেএসপি চ্যাম্পিয়ন।

বিকেএসপি এখন আর শুধু খেলোয়াড় তৈরিই নয়, বাংলাদেশের খেলাধুলাকে আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে বিশ্বপরিমণ্ডলে পরিচিতি দেওয়ার প্রয়াস গ্রহণ করেছে। যেমন, বাংলাদেশ ও চীনের বন্ধুত্বের ৫০ বছর পূর্তিকে সামনে রেখে বিকেএসপি এবং ইউনান মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ের সমঝোতা চুক্তির আওতায় ক্রীড়া ও শিক্ষা বিনিময়ের ক্ষেত্রে ইউনান মিনজু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিকেএসপিতে ‘তাই চি সেন্টার’ খুলেছে। এছাড়া বিকেএসপিও ইউনান মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ‘বাংলাদেশ-চীন ক্রিকেট প্রশিক্ষণ সেন্টার’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সব ধরনের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, অবকাঠামোগত ও কারিগরি সহযোগিতা দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। উল্লেখ্য, বিকেএসপির গ্রাউন্ডসম্যান কর্তৃক ইউনান মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত হবে পিচ ও ক্রিকেট খেলার মাঠ। একইসঙ্গে বিকেএসপির ক্রিকেট কোচরা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করবেন। এর মাধ্যমে দুটি প্রতিষ্ঠান খেলাধুলায় পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে নিজ নিজ দেশের ক্রীড়ার মানোন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে সংশ্লিষ্ট সবাই আশাবাদ ব্যক্ত করেন। উল্লেখ্য, গত বছর ইউনান মিনজু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সমঝোতা চুক্তির শুভেচ্ছা স্মারক হিসেবে ইউনান মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ে বিকেএসপির ফুটবল ও বক্সিং বিভাগের দুই প্রশিক্ষণার্থীকে ৪ বছরমেয়াদি স্কলারশিপ প্রদান করে এবং এ বছর স্কলারশিপের সংখ্যা ২ থেকে ৪-এ উন্নীত করেছে। চীনের শেন ইয়াং স্পোর্টস ইউনিভার্সিটির সঙ্গে এক সমঝোতা চুক্তির আওতায় বিকেএসপির চিফ কোচ মন্টু দত্ত চায়নাতে চীনা সরকারের অর্থায়নে ক্রিকেটের ওপর এক মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে এসেছেন এবং এপ্রিল-মে ২০২৫-এ বিকেএসপিতে চীনের একটি ক্রিকেট দল বিকেএসপির কোচদের থেকে ক্রিকেটে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। চীনের প্রসিদ্ধ বেইজিং স্পোর্টস ইউনিভার্সিটি ও উহান স্পোর্টস ইউনিভার্সিটির সঙ্গেও বিকেএসপির দুটি সমঝোতা চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

বিকেএসপি কর্তৃপক্ষ তাদের প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সঙ্গে বিমা পলিসি খুলেছে। এর ফলে বিকেএসপির খেলোয়াড়রা প্রশিক্ষণকালে কোনো ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হলে চিকিৎসার ব্যয় বহন করবে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স । এ বিমা চুক্তির ফলে বিকেএসপির খেলোয়াড়রা একদিকে যেমন সুচিকিৎসা পাবেন, ঠিক তেমনি চিকিৎসার অভাবে অকালে ঝরেপড়া থেকে রক্ষা পাবেন এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা থেকেও মুক্তি পাবেন। গত বছর বিকেএসপির মোট ৩২ প্রশিক্ষণার্থী ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কাছ থেকে চিকিৎসা বিমার আওতায় চিকিৎসাসেবা পেয়েছেন।

বিশ্বক্রীড়াঙ্গনে বিকেএসপি একটি ব্র্যান্ড নাম। কারণ, কিছু কিছু ক্রীড়া বিভাগ, যেমন- আর্চারি, শুটিং, ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল ও হকিতে এ প্রতিষ্ঠানের খেলোয়াড়রা জাতীয় দলকে প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে দেশের জন্য অনেক সুনাম বয়ে এনেছেন। বিদেশিরা এর রহস্য খুঁজতে গিয়ে ‘বিকেএসপি’ নামের খেলোয়াড় তৈরির আঁতুড়ঘর সম্পর্কে জানতে পেরেছে; জানতে পেরেছে নেপথ্যের কারিগরদের মাধ্যমে সুশৃঙ্খল প্রশিক্ষণ পরিকল্পনার কথাও। ফলে বিদেশে এ প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি একদিকে যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, ঠিক তেমনি এ প্রতিষ্ঠানের কোচদের পাওয়ার বিষয়েও আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। আর এর মাধ্যমেই প্রমাণ হয় বিকেএসপি আজ শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও প্রশিক্ষণ প্রদানে সক্ষমতা রাখে।

উন্নত বিশ্বের দেশগুলো স্পোর্টস ও সায়েন্স- এ দুটি বিষয়ের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে উন্নয়ন ঘটিয়েছে। সেদিকে লক্ষ রেখেই বিকেএসপির প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকেও বিজ্ঞানভিত্তিক করার নিমিত্তে রয়েছে ক্রীড়াবিজ্ঞান বিভাগ। বিকেএসপি কর্তৃপক্ষ বিভাগটিকে যুগোপযোগী ও অধিকতর প্রয়োগিক করার লক্ষ্যে উন্নত এবং প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট সংযোজন ও বিভিন্ন দেশের সঙ্গে স্পোর্টস সায়েন্স-বিষয়ক মতবিনিময় সমঝোতার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর মাধ্যমে বিকেএসপির প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আরো বেশি ফলপ্রসূ হবে।

বিকেএসপি আজ দক্ষিণ এশিয়ার গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বে সুপ্রতিষ্ঠিত একটি নাম। প্রতিষ্ঠানটি জন্মলগ্ন থেকেই জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা, গর্ব ও অহংকারের প্রতীক হিসেবে সুধীমহলে প্রশংসিত একটি প্রতিষ্ঠান। তাই জাতীয় স্বার্থে দল-মত নির্বিশেষে এ প্রতিষ্ঠানটি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে খেলাধুলার একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক- এটাই সবার প্রত্যাশা।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুনীরুল ইসলাম

লেখক : মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত