ভুল চিকিৎসা নাকি ভুল বোঝাবুঝি?

ডা. ঋষা নিয়োগী বৃষ্টি
প্রকাশ : ১১ জুন ২০২৫, ১৩: ৫০

নিউজ মিডিয়ায় একটি খবর প্রায়ই চোখে পড়ে—“ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু”। সাধারণ পাঠকের মনে সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয় নেতিবাচক একটি ধারণা, যেখানে চিকিৎসকের অদক্ষতা বা গাফিলতিকে দায়ী করা হয়। একজন চিকিৎসক হিসেবে এই শিরোনামগুলো যখন দেখি, তখন কেবল দুঃখই নয়, এক ধরনের অসহায়ত্বও অনুভব করি। কারণ আমরা জানি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমস্যাটা চিকিৎসা ব্যবস্থার ভেতরে নয়, বরং চিকিৎসক ও রোগীর পরিবারের মধ্যে যোগাযোগের অভাবে তৈরি হওয়া একটি বিভ্রান্তি। আমরা চিকিৎসকেরা রোগীকে সেবা দিতে নিরলস চেষ্টা করি। প্রতিটি সিদ্ধান্ত গাইডলাইন, অভিজ্ঞতা ও সর্বোচ্চ সতর্কতার ভিত্তিতে নেওয়া হয়। কিন্তু চিকিৎসা কখনোই নির্ভুল ফলাফল দেওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারে না। জটিল অনেক রোগে সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেওয়ার পরেও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি আসতেই পারে। তবে যখন রোগীর পরিবার এসব সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানেন না বা তাদের সঙ্গে ঠিকভাবে আলোচনা করা হয়নি, তখন একটি প্রাকৃতিক মৃত্যুও ‘ভুল চিকিৎসা’ হিসেবে ব্যাখ্যা পায়।

বিজ্ঞাপন

চিকিৎসার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে রোগী ও তার পরিবারের সঙ্গে স্পষ্ট ও সংবেদনশীল যোগাযোগ। একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি জানি, অনেক সময় রোগীর স্বজনদের সঙ্গে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ হয় না। কারণ একদিকে রোগীর জরুরি অবস্থা, অন্যদিকে হাসপাতালের চাপ, সীমিত সময় ও জনবল। অথচ এই ‘কমিউনিকেশন গ্যাপ’ থেকেই সবচেয়ে বেশি ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। একজন ডাক্তার কখনোই রোগীর জরুরি অবস্থার ক্ষেত্রে চিকিৎসার কোন ঘাটতি রাখার চেষ্টা করে না। হয়তো বা রোগীর স্বজনদের সাথে বিভিন্ন বাস্তবতার কারণে সবসময় নিজ থেকে যোগাযোগ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। কখনো একজন ডাক্তার একজন রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থায় কোনো কমতি রাখতে চান না। যতটা সম্ভব গ্যাপ না রেখে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী যতটুকু আমাদের সাধ্য আছে সে সব ধরনের চিকিৎসা করার চেষ্টা একজন ডাক্তার করে থাকে। রোগীর অবস্থা, ঝুঁকি, সম্ভাব্য পরিণতি—এসব স্পষ্ট না হলে চিকিৎসার ব্যর্থতাকে মানুষ সহজেই চিকিৎসকের ব্যর্থতা হিসেবে দেখে।

রোগীর স্বজনদেরও ডাক্তারদের বা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বা বাস্তবতা বোঝার সক্ষমতা থাকা উচিত। চিকিৎসা একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া। চিকিৎসকের যেমন দায়িত্ব রয়েছে চিকিৎসার বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা দেওয়ার, তেমনি রোগীর পরিবারকেও খোলামেলা আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে হবে। আমাদের সমাজে এখনও চিকিৎসকের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন করাকে অনেকেই অশোভন মনে করেন। অথচ চিকিৎসকের সঙ্গে স্পষ্ট আলোচনা, সংশয় প্রকাশ, ও চিকিৎসার বিকল্প জানার চেষ্টাই প্রকৃত সহযোগিতামূলক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারে। এই সংকটের সমাধান এককভাবে কারও পক্ষে সম্ভব নয়। প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ। চিকিৎসকের দিক থেকে রোগীর স্বজনদের সঙ্গে যতটা সম্ভব খোলামেলা আলোচনা করা, ঝুঁকি ও সীমাবদ্ধতা বুঝিয়ে বলা এবং প্রয়োজনে ডকুমেন্টেড ইনফর্মড কনসেন্ট নেওয়া।

হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় পৃথক কাউন্সেলিং ডেস্ক থাকতে পারে, যারা রোগী ও পরিবারের সঙ্গে চিকিৎসা পরিকল্পনা ও সম্ভাব্য জটিলতা নিয়ে আলোচনা করবে। রোগীর পরিবার ও সমাজ চিকিৎসকের প্রতি অন্ধ প্রত্যাশার পরিবর্তে বাস্তবতা জানা, প্রশ্ন করার সাহস রাখা এবং চিকিৎসা পদ্ধতি বোঝার চেষ্টা করা। গণমাধ্যমের ভূমিকা সংবেদনশীলতা বজায় রেখে খবর পরিবেশন করা উচিত, যাতে অপূর্ণ তথ্য বা একতরফা মন্তব্য থেকে চিকিৎসক-পেশার মর্যাদা ক্ষুন্ন না হয়। চিকিৎসক হিসেবে আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের জীবন রক্ষা করা, তার কষ্ট লাঘব করা। প্রতিটি ভুল আমাদেরও কষ্ট দেয়। কিন্তু প্রতিটি ব্যর্থতা যে চিকিৎসকের দোষ, তা বলা যেমন অন্যায়, তেমনি বিভ্রান্তিকরও। চিকিৎসা একটি সম্মিলিত প্রক্রিয়া—এখানে রোগী, তার পরিবার, চিকিৎসক ও সমাজ সকলেরই দায়িত্ব রয়েছে। আমরা যদি একে অপরকে দোষারোপ না করে বোঝার চেষ্টা করি, তাহলে চিকিৎসা হবে আরও মানবিক, আরও সহানুভূতিশীল। এবং সবচেয়ে বড় কথা—ভুল চিকিৎসা নয়, ভুল বোঝাবুঝিই যে অনেক ক্ষেত্রে আমাদের ক্ষতির কারণ, তা আমরা তখনই বুঝতে পারব।

লেখক : শিক্ষানবিশ, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল

শুক্র-শনিবারও চলবে বিমানবন্দরের শুল্কায়ন কার্যক্রম

প্রধান উপদেষ্টার আদেশে জুলাই সনদের আইনি রূপ দিতে হবে

নভেম্বরের মধ্যে তিস্তা মহাপরিকল্পনা শুরুর দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি

আইআরআই’র সঙ্গে নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও ইসির নিরপেক্ষতা নিয়ে আলোচনা এনসিপির

দেশে মুক্তি পাচ্ছে জাপানি অ্যানিমে সিরিজ, শিশুদের দেখা নিষেধ

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত