ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদীর সম্পর্কের বরফ কি গলছে?

আমার দেশ অনলাইন
প্রকাশ : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২০: ০৮

টানাপোড়েনের পর, 'ভাল বন্ধু' যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সম্পর্কে কি চেনা ছন্দ ফিরছে? দুই দেশের মধ্যে বরফ কি শেষপর্যন্ত গলতে শুরু করেছে?

ভারতে এখন আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে এই দু'টো প্রশ্ন।

বিজ্ঞাপন

আর এর পেছনে রয়েছে সামাজিক মাধ্যমে ডােনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিকতম পোস্ট এবং তারপর মি. মোদীর জবাব।

ঘটনার শুরু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যাল প্লাটফর্মে তার সাম্প্রতিক পোস্টে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে 'খুব ভাল' বন্ধু বলে সম্বোধন করে জানিয়েছেন, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য শুল্ক নিয়ে আলোচনা চলছে এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা নিয়ে অত্যন্ত আশাবাদী তিনি।

জবাব দিতে দেরি করেননি নরেন্দ্র মোদীও। এক্স হ্যান্ডেলে তিনি লিখেছেন, "ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং অংশীদার।"

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে তিনিও আশাবাদী।

প্রসঙ্গত, ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে যেন কিছুটা ছন্দপতন ঘটে।

আর তার ধারাবাহিকতা চলতে থাকে একের পর এক ঘটনার মধ্য দিয়ে।

তবে, সবশেষ ৫০ শতাংশ শুল্ক বসিয়ে ভারতকে প্রায় কােণঠাসা করে ফেলার পর ভারত চীন এবং রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে মন দেয়।

সেই প্রেক্ষােপটেই ট্রাম্পের এই উদ্যােগ কী না - সে প্রশ্নও তুলছেন বিশ্লেষকেরা।

সেই সাথে, ট্রাম্প এবং মােদী দুই শীর্ষ নেতার বক্তব্যে বন্ধুত্বের কথা বলা হলেও তা কতটা বাস্তবে রূপ নেবে তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে বলে তারা মনে করেন।

প্রসঙ্গতঃ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শুল্ক নীতির বিরুদ্ধে মার্কিন আদালতে মামলা দায়ের হয়েছিল। বিভিন্ন দেশের উপরে যে শুল্ক আরোপ তিনি করেছেন, তার অধিকাংশই বেআইনি বলে জানিয়েছিল নিউ ইয়র্কের আদালত।

সে রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। শীঘ্রই তার রায় আসার কথা, তার আগেই ভারতের প্রতি সুর নরম করেছেন মি. ট্রাম্প।

'কূটনীতিতে কিছু স্থায়ী হয় না'

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ উপমন্যু বসু মনে করেন, কূটনীতিতে কিছুই স্থায়ী নয়- না বন্ধুত্ব না শত্রুতা।

তিনি বলছেন, "এর বড় উদাহরণ হলো গালওয়ানের ঘটনার পরেও ভারত ও চীনের মধ্যে সাম্প্রতিক সমীকরণ।"

"কূটনীতি কিন্তু মেসার্ড আর্ট (মাপা পদক্ষেপ অর্থে)। কিন্তু ট্রাম্প অন্য পথে হাঁটেন। সেই কারণেই সমস্যা। শুধুমাত্র ট্রাম্প প্রশাসনই ভারতের তরফ থেকে মার্কিন পণ্যে চড়া শুল্ক নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে, তা তো নয়। ওবামার সময়েও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য শুল্ক নিয়ে ইস্যু ছিল।"

কিন্তু তার মতে, ওই সময়ের সাথে তফাত হলো "ডিপ্লোম্যাটিক অ্যাপ্রোচ"এ।

মি. বসুর কথায়, "ট্রাম্পের কূটনীতি অনেকটা ইনআর্টিকুলেট ডিপ্লোম্যাসি- যেখানে বিভিন্ন বিষয়ে অস্পষ্টতা রাখা হয়, পেনালাইজ করার প্রবণতা থাকে। অনেকটা কোল্ড ওয়ারের মতো মনোভাব।"

"তিনিই আবার হঠাৎ ট্রুথ সোশ্যাল প্লাটফর্মে তিনি লিখেছেন, মোদী তার ভাল বন্ধু এবং ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব রাখেন ইত্যাদি।"

ভারতের বিদেশনীতি বিশেষজ্ঞ গীতাঞ্জলি সিন্হা রায় মনে করেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ভিন্ন ধরনের রাষ্ট্রনেতা, তাকে কিছুটা মুডভিত্তিক সিদ্ধান্তও নিতে দেখা গিয়েছে এর আগে।

"তবে তিনি ভারত-বিরোধী নন। তাহলে ভারতের সঙ্গে সমস্ত ধরনের সম্পর্ক ছেদ করত যুক্তরাষ্ট্র। তা কিন্তু হয়নি। বরং, মহাকাশ গবেষণা এবং প্রযুক্তিগত আদান-প্রদানের বিষয়ে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করছে।"

বরফ কি আসলে গলছে?

বিশেষজ্ঞদের মতে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে রাতারাতি বদলাবে না।

মি. বসু বলেছেন, "একটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু তার মানে এই নয় যে বরফ গলছে এবং দুই দেশ আবার ভাল বন্ধু হয়ে গেছে। আমার মনে হয় দিল্লির কিছুটা সতর্ক থাকাটা ভাল।"

"সতর্ক থাকার কারণ ট্রাম্প ২.০ তে দুই দেশের মধ্যে শত্রুতা দেখা গিয়েছে তা নয়। ট্রাম্পের পরেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক থাকবে, যেমনটা তিনি ক্ষমতায় আসার আগে ছিল। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের মনোভাবের কারণে দুই দেশের মধ্যে স্থিতিশীলতায় যে প্রভাব পড়েছিল, সেটা মানতে হবে।"

তিনি মনে করেন, প্রভাব কিছুটা হলেও থাকার আশঙ্কা আছে।

এই বিশেষজ্ঞের কথায়, "একটা সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টের কারণে সব কিছু ভুলে গিয়ে আগের সম্পর্ক হয়ে যাবে, এটা ভাবার কারণ নেই। একটা মিক্সড ব্যাগেজ (সম্পর্কে মিশ্র প্রভাব বোঝাতে) থাকবে।"

"উদাহরস্বরূপ - ভারত বিকল্প হিসাবে অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের কথা ভাববে। যেভাবে কোণঠাসা করা হয়েছিল, তাতে ভারত অন্যান্য বিকল্প যে খুঁজবে সেটাই স্বাভাবিক।"

কেন এই পরিবর্তন?

গীতাঞ্জলি সিন্হা রায় বলেন, "আমার মনে হয়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এ পরিবর্তনের একটা বড় কারণ সাংহাই কো–অপারেশন অর্গানাইজেশন এসসিও সামিট। সেখানে ভারত নিজের অবস্থান তুলে ধরেছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক নিয়ে টানাপোড়েনের মাঝে রাশিয়া এবং চীনের সঙ্গে ভারত নিজেদের সম্পর্ককে বজায় রেখেছে।"

তার মতে, "পাশাপাশি এসসিও কিন্তু পহেলগাম হামলার তীব্র নিন্দা করেছে এবং সেটাও পাকিস্তানের উপস্থিতিতেই। এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা আন্তর্জাতিকস্তরে একটা বার্তা দেয়।"

"কারণ পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ভাল সম্পর্ক। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্ততা করেছেন, সে বিষয়ে সম্মতিও জানিয়েছিল পাকিস্তান।"

তৃতীয় কারণ হিসাবে জাপানের কথা বলেছেন তিনি।

গীতাঞ্জলি সিন্হা রায়ের কথায়, "ভারতের প্রধানমন্ত্রী কিন্তু চীনে যাওয়ার আগে জাপান সফরে গিয়েছেন। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং অংশীদ্বারিত্ব বেড়েছে। আবার জাপানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক জোট রয়েছে।"

"এদিকে, ভারত-জাপানের অংশীদারিত্ব বাড়লে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সাপ্লাই চেনের উপর প্রভাব পড়বে। আগে 'জেএআই' মানে জাপান-আমেরিকা-ইন্ডিইয়া বলা হতো এখন 'জে- আই' হবে। এই বিষয়গুলো কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনও বোঝে।"

পাশাপাশি চীনও একটা কারণ বলে মনে করেন তিনি।

এই বিশেষজ্ঞের কথায়, "ভারত-চীনের নৈকট্য যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ভাল নয়, এটা মার্কিন কর্মকর্তাদের বলতে শোনা গিয়েছে।"

এদিকে, উপমন্যু বসু বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের মনোভাবের কারণে চীনের লাভ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র তা বুঝতে পেরেছে।

তিনি বলেন, "বহুপাক্ষিক বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। আমরা যে বহুপাক্ষিক বিশ্বে বাস করি সেটা ওয়াশিংটনকে বুঝতে হবে। হয় আমরা বা ওরা -এমন শর্ত দিলে হবে না।"

দুই দেশেরই একে অপরকে প্রয়োজন

যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের একে অপরকে প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

মি. বসু বলেন, "দুই দেশই নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ভাববে সেটাই স্বাভাবিক। ভারতের নিজস্ব দেশজ বাজার রয়েছে যার বিশাল আয়তন। তাকে বাঁচানোর জন্য ভারত মার্কিন পণ্যের উপর বেশি শুল্ক আরোপ করেছে।"

"আবার ট্রাম্পও নিজের দেশের স্বার্থে এমন পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু তার পদ্ধতি প্রথাগত কূটনৈতিকে দর্শায় না। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের একে অপরকে প্রয়োজন। দুই দেশের কৌশলগত চাহিদাকে ভুলে গেলে হবে না।"

তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, "ভারত যে গুরুত্বপূর্ণ ইন্দো-প্যাসিফিক পার্টনার সেটা যুক্তরাষ্ট্রকে মানতে হবে। তাছাড়া কোয়াডের কথাও ভুলে গেলে হবে না। ভারত, জাপানের মতো সদস্য দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব নিয়ে সন্তুষ্ট নয়।"

মি. বসু বলেছেন, আবার যুক্তরাষ্ট্রকেও ভারতের দরকার। বাণিজ্যের দিক থেকে তাদের উপর আমরা নির্ভরশীল। ভারত বিকল্প হিসাবে অন্যান্য দেশের কথা ভাবছে, কিন্তু সেটা রাতারাতি হবে না।"

তবে, চীন যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প হয়ে উঠতে পারবে না বলে মনে করেন মি. বসু।

তার কথায়, "চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ততদিন ভাল হবে না, যতদিন না সীমান্ত বিরোধের স্থায়ী সমাধান হচ্ছে।" সূত্র: বিবিসি বাংলা

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত