ব্রিটেনের ১৯৪১ সালের ভিসা লিস্টে ফিলিস্তিনের নাগরিক হিসেবে নাম পাওয়া যায় ডেভিড বেন গুরিয়নের। আর এই নামটির সাথেই জড়িয়ে রয়েছে ফিলিস্তিনির কান্নার ইতিহাস।
বেন গুরিয়নের জন্ম ১৮৮৬ সালে, পোল্যান্ডে। ছোটকাল থেকেই তিনি বাবার জায়নবাদী (ইহুদিবাদ) আদর্শে বড় হয়েছিলেন গুরিয়ন। ১৯০৬ সালে তিনি ফিলিস্তিনে আসেন এবং জাফ্ফাতে বসতি স্থাপন করেন। অধিকাংশ অভিবাসী ইহুদিদের মতো তিনিও ছিলেন একজন শ্রমিক, যিনি ক্ষেত থেকে কমলা তোলার কাজ করতেন। ১৯০৯ সালে হাশোমার গঠিত হয়। হাশেমার ছিল একটি ইহুদি প্রতিরক্ষা সংস্থা। গুরিয়ন হাশেমার একজন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগ দেন। খুব অল্পদিনের মধ্যেই তিনি নিজের দূরদর্শিতা দিয়ে হাশেমার অন্যতম প্রধান নেতা হন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বেন গুরিয়ন রাশিয়ার বিরুদ্ধে গিয়ে অটোমান সাম্রাজ্যের পক্ষে কাজ করেন। এমনকি অটোমানদের পক্ষ হয়ে লড়াই করার জন্য ১০ হাজার ইহুদি সদস্যের একটি বাহিনী গঠনের জন্যও কাজ করেছিলেন গুরিয়েন।
অন্যদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ সরকার প্রথমবারের মতো ইহুদি জনগণের জন্য ফিলিস্তিনে একটি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার প্রতি তাদের সমর্থন জানায়। ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার বেলফোর ইহুদিবাদী নেতা ব্যারন রথচাইল্ডকে লেখা এক ৬৭ শব্দের চিঠিতে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জাতীয় আবাসভূমি গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেন, যা ‘বেলফোর ঘোষণা’ হিসেবে পরিচিত।
আর বেলফোর ঘোষণার পর গুরিয়নের অবস্থান পুরোপুরি পাল্টে যায়। বেন গুরিয়ন এবং তার সমমনা অন্যান্য ইহুদিরা পক্ষ পরিবর্তন করে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অধীনস্থ ‘জিউইশ লেজিয়ন’ ব্রিগেড গঠন করেন এবং ব্রিটিশদের হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এ পদক্ষেপকে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের অন্যতম বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়। এরপর ১৯১৭ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনের ভূমি ছিল ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে।
এদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে বেন গুরিয়ন ইসরাইল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। তিনি মনে করেন, জায়নবাদী আন্দোলনের জন্য ব্রিটিশদের সমর্থন আদায় করতে হলে তাদেরকে কিছুটা হলেও সহিংসতা পরিহার করে নিজেদেরকে মধ্যপন্থী এবং নমনীয় বাহিনী হিসেবে পরিচিত করতে হবে। তাই তিনি সন্ত্রাসী সংগঠন ‘হাগানা’কে এমনভাবে পরিচালিত করতে চান। তাই হাগনা প্রথমদিকে ছিল রাজনৈতিকভাবে জায়নবাদী প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহী একটি সংস্থা। সেই হাগানাকেই পরবর্তীকালে বেন গুরিয়ন পরিণত করেন পুরোদস্তুর সন্ত্রাসী সংগঠনে।
অন্যদিকে ১৯৩০-এর দশকের শেষের দিকে ব্রিটেন চেয়েছিল হিটলারের নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের অবস্থান জোরালো করতে। সেজন্য আরব এবং ইহুদি—দুপক্ষকেই হাতে রাখতে চেয়েছে ব্রিটেন। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যেসব ইহুদি বেঁচে ছিল, তাদের জন্য কী করা যায় সেটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে দুটি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকে দ্বিখণ্ডিতকরণ সংক্রান্ত ১৮১ নম্বর প্রস্তাব গৃহীত হয়। জাতিসংঘ ফিলিস্তিনের ৪৫ শতাংশ ভূমি ফিলিস্তিনিদের এবং বাকি ৫৫ শতাংশ ভূমি ইহুদিদের দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ইহুদিরা মোট ভূখণ্ডের ১০ শতাংশের মালিক হলেও তাদের দেওয়া হয় মোট জমির অর্ধেকেরও বেশি। স্বভাবতই আরবরা এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। তারা জাতিসংঘের এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে দেয়।
ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ডে তখন ইহুদিরা বিজয় উল্লাস শুরু করে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যায় ব্রিটেন। একইদিন তৎকালীন ইহুদি নেতারা ঘোষণা করেন যে, সেদিন রাতেই ইহুদি রাষ্ট্রের জন্ম হবে। এভাবেই আরবদের হটিয়ে সেসময় রাতারাতি প্রতিষ্ঠা করা হয় ইসরাইল নামে একটি রাষ্ট্র। আর বেন গুরিয়েন পরিচিতি লাভ করেন ইসরাইলের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর এই হাগানাই রূপান্তরিত হয় তাদের প্রধান প্রতিরক্ষা বাহিনী অর্থাৎ ইসরাইলি ডিফেন্স ফোর্স তথা আইডিএফ-এ। আর ডেভিড বেন গুরিয়ন হন ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী।
আর এভাবেই ব্রিটেনের যে ভিসা নিয়ে একদিন ফিলিস্তিনের নাগরিক হয়ে আরব ভূমিতে প্রবেশ করেছিল, সেই ধার করা ভিসার নাগরিকরা আজ ফিলিস্তিনের জমিদার হয়ে উঠেছে। আর তাদের জবর দখল করা সেই জমিদারীকে বৃদ্ধি করতে গুরিয়েনের উত্তরসূরীরা টনকে টন বোমা ফেলছে ফিলিস্তিনি ভূ-খন্ডে। শুধু কি তাই, গ্রেটার ইসরাইল প্রতিষ্ঠার নামে পার্শ্ববর্তী লেবানন ও সিরিয়ায় নিয়মিত ভিত্তিতে হামলা চালাচ্ছে ইসরাইলের দখলদার বাহিনী।
চলতি বছরের গত ১০ অক্টোবর থেকে কার্যকর হওয়া গাজা যুদ্ধবিরতির মধ্যেও ইসরাইল ৪৪ দিনে ৪৯৭ বার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে। অথচ আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় হওয়া এই যুদ্ধবিরতির উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তিনে বিমান হামলা ও দুর্ভিক্ষের অবসান ঘটানোর পাশাপাশি গাজায় মানবিক সাহায্য প্রবেশের সুযোগ তৈরি করা। সেই সঙ্গে ধ্বংসস্তূপে থাকা ডুবে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের নতুন জীবন দেয়া। কিন্তু কূটনৈতিক বক্তব্যের সেই যুদ্ধবিরতি বাস্তবে নেই বললেই চলে; বরং ইসরাইল ধীর গতিতে হলেও তার গণহত্যা চালিয়েই যাচ্ছে। ব্রিটেনের সেই ভিসাই আজও ফিলিস্তিনিদের কাঁদাচ্ছে।

