‘আগেও গাজার পুনর্গঠন দেখেছি, এবার কোনো ভবিষ্যৎ নেই’

আমার দেশ অনলাইন
প্রকাশ : ২০ অক্টোবর ২০২৫, ১৪: ৩২
ছবি: আল জাজিরা

১৯৪৮ সাল, ফিলিস্তিন তখনো ব্রিটেনের উপনিবেশ। ওই বছরই বাধে প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধ। তখন আয়িশ ইউনুসের বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। আঙ্গুর, গম, ভুট্টার জন্য বিখ্যাত নিজের গ্রাম বারবারা ছেড়ে পরিবারের সঙ্গে পালিয়ে যান তিনি। সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করে ৮৯ বছর বয়সী আয়িশ বলেন, আমরা প্রাণ হারানোর ভয়ে ছিলাম। ইহুদিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সক্ষমতা ছিল না আমাদের। তাই আমরা পালাতে শুরু করি।

তিনি বলেন, “বালুময় পথে দাদির সঙ্গে উটে চড়ার সময় আমি কেঁদে দিই।” উটটি আয়িশ ও তার দাদিকে নিয়ে বারবারা থেকে সাত মাইল দক্ষিণে মিসরের অধীনস্থ একটি অঞ্চলে পাড়ি জমায়। এলাকাটি এখন গাজা উপত্যকা নামে পরিচিত। মাত্র ২৫ মাইল দীর্ঘ ও কয়েক মাইল প্রশস্ত গাজা মাত্রই দখলে নিয়েছিল মিসর।

বিজ্ঞাপন

১৯৪৮-৪৯ সালের যুদ্ধে আনুমানিক ৭ লাখ ফিলিস্তিনি তাদের ঘরবাড়ি হারিয়ে শরণার্থী হয়ে পড়ে। ধারণা করা হয় প্রায় ২ লাখ ফিলিস্তিনি গাজায় ভিড় করে।

আয়িশ বলেন, “আমাদের কাছে কিছু কাঠের টুকরো ছিল, যা দিয়ে আমরা অস্থায়ী আশ্রয়স্থল বানাই।” পরে জাতিসংঘের একটি শিবিরে চলে যায় আইশের পরিবার।

৮৯ বছরের আয়িশের জীবনে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। গাজার খান ইউনিস শহরের কাছে আল-মাওয়াসিতে একটি তাঁবুতে বাস করছেন তিনি।

ইসরাইলি বাহিনীর উচ্ছেদ আদেশের পর দক্ষিণ গাজার রাফা শহরের নিজ বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন আয়িশ। চারতলা বাড়িটি ইসরাইলি কামানের গোলার আঘাতে ধ্বংস হয়েছে বলে ধারণা তার। সেখান থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরে তাঁবু গেড়ে থাকছেন তিনি। বাড়ির অন্য সদস্যরা পাশের তাঁবুতেই থাকেন। খোলা আকাশের নিচে রান্না করতে হয়। তবে পানির সংকট আছে সেখানে।

আয়িশ বলেন, “আমরা যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, আবার সেখানেই ফিরে এসেছি। বারবারা ছেড়ে তাঁবুতে থাকার এক পর্যায়ে আমরা একটি বাড়ি নির্মাণে সফল হয়েছিলাম। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বিপর্যয়কর। আমি জানি না ভবিষ্যতে কী হবে এবং আমরা আবার কখনো বাড়ি বানাতে পারব কি না। সবশেষে আমি বারবারায় ফিরে যেতে চাই।”

গত ৯ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তির চুক্তির বিষয়ে একমত হয় ইসরাইল ও হামাস। যুদ্ধবিরতি নিয়ে গাজায় আনন্দের বাতাস বয়ে গেলেও আয়িশ গাজার দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদী নন। তার ভাষ্য, আমি মনে করি শান্তি আসবে। তবে আমার বিশ্বাস, ইসরাইলিরা যা খুশি, তা-ই করবে।

Gaza 2

১৮ সন্তান ও ৭৯ নাতি-নাতনি :

১৯৪৮ সালে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর বারবারা থেকে মিসরে পালিয়ে যান আয়িশ। ১৯ বছর বয়সে শিক্ষক হন এবং বৃত্তি কর্মসূচির আওতায় কায়রোতে সাহিত্যে ডিগ্রি অর্জন করেন।

খাদিজাকে বিয়ে করাকে নিজের জীবনের সেরা মুহূর্ত আখ্যা দেন আয়িশ। তাদের ১৮টি সন্তান ছিল। আজ তার ৭৯ জন নাতি-নাতনি রয়েছে, যাদের মধ্যে দুজন গত কয়েক মাসে জন্ম নিয়েছে।

পরিবারটি শিগগিরই তাঁবু থেকে শরণার্থী শিবিরের তিন কক্ষের বাড়িতে চলে যাবে।

আয়িশের সন্তানদের মধ্যে একজন ছাড়া বাকি সবাই বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তারা প্রকৌশলী, নার্স, শিক্ষকতার মতো পেশায় নিযুক্ত। অনেকেই বিদেশে চলে গেছেন। পাঁচজন উপসাগরীয় দেশে থাকেন এবং এক চিকিৎসক ছেলে এখন লন্ডনে থাকেন। গাজার আরো অনেক পরিবার একইভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

গাজার অনেকের মতো আয়িসের পরিবারেরও রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা নেই। আয়িশ রাফাহ মসজিদের ইমাম হন এবং বিরোধ নিষ্পত্তির দায়িত্ব পান। সরকার তাকে নিযুক্ত না করলেও হামাস ও ফাতাহ উভয়ই তাকে সম্মান করত।

তবে ২০০৭ সালে ফাতাহ ও হামাসের লড়াইয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারায় তার মেয়ে ফাদওয়া।

গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান :

গাজার পুনর্গঠন নিইয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। কিন্তু আয়িশ বিশ্বাস করেন, অবকাঠামো, স্কুল ও স্বাস্থ্যসেবার ধ্বংসের পরিমাণ এতটাই বেশি যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্য নিয়েও এটি সম্পূর্ণরূপে পুনর্গঠন সম্ভব নয়। তার ভাষ্য, গাজার কোনো ভবিষ্যৎ আছে, তা বিশ্বাস করি না।

আয়িশের বিশ্বাস, যুদ্ধবিরতি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হলে তার নাতি-নাতনিরা গাজার পুনর্গঠনে ভূমিকা রাখতে পারবেন। তবে বিদেশে যেমন চাকরি মিলবে, তা এই অঞ্চলে পাওয়ার সুযোগ নেই।

সূত্র : বিবিসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত