জিএসএ শর্ত শিথিলে শতকোটি টাকা রাজস্ব হারানোর শঙ্কা

কবিতা
প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৬: ০২

যৌক্তিক মূল্যে টিকিট যাত্রীদের কাছ পৌঁছে দেওয়া বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকার। আমাদের শ্রমিক শ্রেণি বিদেশযাত্রার ক্ষেত্রে যাতে প্রতারিত না হয় সে জন্য এই উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এ জন্য সরকার কঠোর আইনের ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে বিদেশি এয়ারলাইনসের জন্য স্থানীয় জেনারেল সেলস এজেন্ট (জিএসএ) নিয়োগ বাধ্যতামূলক করার বিধান নিয়েও নতুন করে চিন্তাভাবনা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে অংশীজনের সঙ্গে মতামতের ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাবে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে এয়ার টিকিটের অস্বাভাবিক মূল্য বাড়ানো ও সিন্ডিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে ১৩টি ট্রাভেল এজেন্সির নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর জন্য স্থানীয় জেনারেল সেলস এজেন্ট (জিএসএ) নিয়োগ বাধ্যতামূলক করার বিধান বাতিল করা হলে সরকার বছরে সরাসরি ১০০ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারাতে পারে। অতিরিক্ত ৫০০ কোটিরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা বহিঃপ্রবাহ ঘটতে পারে বলে মনে করছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা। এ কারণে অংশীজনরা জিএসএ বাধ্যতামূলক করার বিধান বাতিলের বিরোধিতা করেছেন। এরই অংশ হিসেবে গত ১ জুন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব)। তাদের মতে, এমন সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রক সংস্থার তত্ত্বাবধান দুর্বল করবে, স্বচ্ছতা হ্রাস করবে এবং কর্মসংস্থান ও রাজস্ব উভয় ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

বিজ্ঞাপন

সূত্র জানায়, গত ৪ আগস্ট তারিখে আটাবের কমিটি ভেঙে দিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে। এরপর উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন বিদেশি অপারেটর কর্তৃক বাণিজ্যিক বিমান পরিবহন সেবার জন্য একক বিক্রয় প্রতিনিধি নিয়োগের বিষয়ে আইনগত বিষয় পর্যালোচনার জন্য গত ১২ আগস্ট মন্ত্রণালয়ে এক বিশেষ সভার আয়োজন করে। এরপর গত ২০ আগস্ট উপদেষ্টা বশির উদ্দীন দ্বিতীয় দফায় বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের জিএসএদের সঙ্গে জরুরি বেঠকে বসেন এবং জিএসএদের মতামতও নেন।

জানা গেছে, ২০১৭ সালের আগে বাংলাদেশে অধিকাংশ বিদেশি এয়ারলাইন্স সরাসরি টিকিট বিক্রি এবং বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করত। তখন থেকেই অভিযোগ ছিল, অসৎ এজেন্সিগুলো টিকিট বিক্রিতে অস্বচ্ছ এবং নানা রকমের জালিয়াতি করছিল। ফলে টিকিটপ্রতি বাড়তি ভাড়া নেওয়া, ভুক্তভোগীর টাকা ফেরাতে দীর্ঘসূত্রতা, ফ্লাইট বাতিল হলে ক্ষতিপূরণে জটিলতা, বিদেশ থেকে টিকিট বিক্রির মাধ্যমে ট্যাক্স থেকে বঞ্চিত হতো দেশ। সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল বিপুল পরিমাণ অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার হতো। এ অবস্থায় বিমান পরিষেবা খাতের অব্যবস্থাপনা ঠেকাতে সরকার ২০১৭ সালে প্রতিটি বিদেশি বিমান কোম্পানির জন্য বাংলাদেশে ব্যবসা শুরুর আগে একক বিক্রয় প্রতিনিধি বা জিএসএ নিয়োগ করতে বাধ্য হয়। ওই আইনের বলে জিএসএরা বাংলাদেশের আইন, বিধি-বিধান মেনে কোটি গ্রাহককে সেবা দিয়ে আসছে। সর্বোপরি টিকিট বিক্রি ও অন্যান্য বাণিজ্যিক কার্যক্রমে সরকারের নজরদারি সহজ হয়েছে।

গ্যালাক্সি বাংলাদেশ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী আহমেদ ইউসুফ ওয়ালিদ আমার দেশকে বলেন, ২০১৭ সালে যেখানে বিদেশি এয়ারলাইন্সের বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনার জন্য জিএসএ নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল যৌক্তিক কারণেই। সেটি হঠাৎ করে কেন পরিবর্তন করার কথা বলা হচ্ছে- তা এই ব্যবসার মূল অংশীজন জিএসএদের কাছে ব্যাখ্যা করা হয়নি। এই আইন পরিবর্তন করে সরকার বা জনগণ কার লাভ হচ্ছে তা আমাদের বোধগম্য নয়। এই আইন সংশোধন একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বাবধান প্রক্রিয়া ধ্বংস করবে এবং বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোকে স্থানীয় জবাবদিহি ছাড়াই পরিচালনার সুযোগ করে দেবে।

বিমান ভাড়া নির্ধারণ ও বৃদ্ধিতে জিএসএদের ভূমিকা আছে- এমন ধারণা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে ওয়ালিদ বলেন, এটি টেকনিক্যালি অসম্ভব। বিমান ভাড়া নির্ধারণ, পরিবর্তন, পরিমার্জন, বাড়ানো এবং টিকিট বিক্রয়ের কৌশল ও পলিসি নির্ধারণ সম্পূর্ণভাবে এয়ারলাইন্সের সদর দপ্তরের হাতে।

জিএসএ রাখার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থা এমিরেটস এয়ারলাইন্সের জিএসএ খালেদ ফারাজি বলেন, জিএসএ কিংবা ট্রাভেল এজেন্ট কী হারে কমিশন পাচ্ছে তা-ও নথিভুক্ত হয়। ফলে ট্যাক্স ও ফি আদায়ে স্বচ্ছতা বেড়েছে। জিএসএরা এয়ারলাইন্স থেকে কমিশন পেয়ে থাকে, যার ওপর অগ্রিম উৎসে কর (এআইটি) কেটে নেয় সরকার। এ ছাড়া প্রত্যেকটি জিএসএ মুনাফার ওপর করপোরেট ট্যাক্স দেয়। আগে এই অর্থের পুরোটা এয়ারলাইন্সগুলো তাদের উদ্বৃত্ত আয়ের অংশ হিসেবে নিজ দেশে নিয়ে যেত। কিন্তু জিএসএ নিযুক্ত হওয়ার ফলে তা দেশের ভেতরেই কর ও রাজস্ব আকারে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হচ্ছে।

অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ওয়াহিদুল আলম বলেন, বিদেশি কোম্পানির স্থানীয় এজেন্ট থাকায় যাত্রীরা সহজে টিকিট-সংক্রান্ত সব সেবা পাচ্ছেন। ফ্লাইট বাতিল হলে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার মতো বিষয়ে দ্রুত সমাধান পেয়ে যাচ্ছেন। জিএসএ থাকলে সরকার কূটনৈতিক ও প্রশাসনিক সুবিধাও পায়।

ওয়াহিদুল আলম বলেন, বাংলাদেশে থাকা শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্স কোম্পানি, এমিরেটস, কাতার এয়ারওয়েজ, সৌদিয়া, টার্কিশ এয়ারলাইন্স, গালফ এয়ার, কুয়েত এয়ার ও মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের টিকিট সেবা যদি অল্পসংখ্যক বিদেশি করপোরেট এজেন্টের হাতে চলে যায় তাহলে বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। ফলে বাজারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হবে। একই সঙ্গে, বিদেশ থেকে গ্রুপ টিকিট বিক্রির মাধ্যমে দেশীয় বাজারে টিকিট সংকট তৈরি হবে এবং বিপরীতে বিদেশ থেকে আসা টিকিট দেশের বাজারে সয়লাব হয়ে পড়বে। এর ফলে ওইসব টিকিটের অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। এছাড়া স্থানীয় যেসব এজেন্ট নিয়ম মেনে ব্যবসা করবে তাদের ব্যবসায় ঝুঁকি বাড়বে।

জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন আমার দেশকে বলেন, ‘টিকিট দুর্বৃত্তায়ন এমনভাবে হচ্ছে যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আমরা শিকড় থেকে সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করছি। আমাদের শতকরা ৮০ ভাগ বিদেশগামী যাত্রী শ্রমিক। টিকিটের অফিশিয়াল ভেল্যু ও আনঅফিশিয়াল ভেল্যুর মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য করার চেষ্টা করছি। টিকিটের ব্যয় আমরা কীভাবে কমাতে পারি এবং কীভাবে সংকটকালীন অবস্থা চিহ্নিত করে মোকাবিলা করতে পারি- সেটি আমাদের অন্যতম কাজ।’

উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন বলেন, ‘আমি সমস্ত নেটওয়ার্ককে আইনের আওতায় আনতে চাই। সবার সঙ্গে বসে আমরা কথা বলেছি, প্রয়োজনে আবারও বসব। সংশোধনের প্রয়োজন আছে কি না, সুপারভাইজিং নিশ্চিত করা হয়েছে কি না- এগুলো আমরা খতিয়ে দেখছি।’

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত