বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসে, রাজনৈতিক মাঠ যেমন উত্তপ্ত হয়, তেমনি উত্তেজনার ছোঁয়া লাগে শিল্পাঞ্চলেও। বিশেষ করে আশুলিয়া, সাভার, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জের মতো শিল্প-বহুল এলাকায় নির্বাচনের আগে-পরে একটি চাপা অস্থিরতা তৈরি হয়, যা শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া, ব্যবস্থাপনার সিদ্ধান্ত, ইউনিয়নের তৎপরতা এবং সামগ্রিক উৎপাদন পরিবেশের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
একদিকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অন্যদিকে শ্রমিকদের আর্থিক ও সামাজিক চাপ—এই দুই প্রেক্ষাপট মিলেই নির্বাচন ঘিরে শ্রমিক অসন্তোষ বাড়ার ঝুঁকি সর্বদা থেকেই যায়। নির্বাচনের বছর এলে বেতন-বোনাস নিয়ে সমস্যা, নানা ধরনের উসকানি, গুজব ছড়ানো আর বাইরের প্রভাব—এসব কারণে শ্রমিক আর ব্যবস্থাপনার সম্পর্ক খুব দ্রুত খারাপ হয়ে যেতে পারে। এর প্রভাব পড়ে আমাদের রপ্তানি-বাণিজ্য, শিল্পোন্নয়ন এবং বিদেশি বিনিয়োগের ওপর।
বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এবং পরবর্তী সংশোধনীগুলো—বিশেষত ২০২৫ সালের সংস্কারে যুক্ত অল্টারনেটিভ ডিসপিউট রেজল্যুশন বা এডিআর-সংক্রান্ত ধারা—এই পদ্ধতির ব্যবহারকে আরো স্পষ্ট, কাঠামোবদ্ধ ও কার্যকর করেছে। আলোচনা, মধ্যস্থতা এবং সমঝোতার ভিত্তিতে আদালতে না গিয়েই বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ দিয়ে এডিআর ইতোমধ্যেই দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে তার দক্ষতা প্রমাণ করেছে।
বিশেষ করে নির্বাচনি সময়ে, যখন সামান্য ভুল বোঝাবুঝিও বড় অস্থিরতায় রূপ নিতে পারে, তখন এডিআরের প্রয়োজনীয়তা আরো বাড়ে। বিরোধের প্রাথমিক পর্যায়েই সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে সমাধান হলে শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ন্ত্রণে থাকে, উৎপাদন ব্যাহত হয় না এবং সামগ্রিক শিল্প-শান্তি বজায় রাখা সহজ হয়। তাই নির্বাচনকেন্দ্রিক উত্তেজনার সময় শিল্প-পরিবেশ স্থিতিশীল রাখতে এডিআরই সবচেয়ে নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য উপায় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
বাংলাদেশের শ্রমবাজার শুধু অর্থনীতি দিয়ে চলে না—রাজনৈতিক পরিস্থিতিও শ্রমিকদের আচরণ, প্রত্যাশা ও আন্দোলনের ওপর বড় প্রভাব ফেলে। নির্বাচন সামনে এলে অবরোধ, পরিবহন সংকট, নিরাপত্তাহীনতা—এসব কারণে শ্রমিকদের কর্মস্থলে যাওয়া-আসা কঠিন হয়ে পড়ে, ব্যয় বাড়ে, অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। একই সময়ে শ্রমিক সংগঠনগুলোও বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে; নতুন দাবি তোলে, আন্দোলনের প্রস্তুতি নেয় এবং অনেক ক্ষেত্রে বাইরের রাজনৈতিক প্রভাবও শ্রমিকদের উত্তেজিত করার চেষ্টা করে। শ্রমিকদের বিশ্বাস থাকে—নির্বাচনের বছরে সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলো শ্রমিকবান্ধব সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য, ফলে তাদের প্রত্যাশাও বেড়ে যায়। কিন্তু সেই প্রত্যাশা পূরণ না হলে খুব দ্রুত অসন্তোষ জন্ম নেয়, যা ছোট সমস্যাকেও বড় সংকটে পরিণত করতে পারে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো গুজব ও ভুল তথ্য শিল্পাঞ্চলে পরিস্থিতিকে দ্রুত জটিল করে তোলে। শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং সামান্য উসকানিতেই উত্তেজনা তৈরি হয়, যা নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রশাসনের সময় লাগে—বিশেষ করে নির্বাচন-পূর্ব সময়ে। তাই এ ধরনের সংকটময় সময়ে দ্রুত, মানবিক ও আস্থাভিত্তিক সমাধান প্রয়োজন, যেখানে মামলা বা শাস্তির পরিবর্তে আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান হয়। এই জায়গায় এডিআর কার্যকর ভূমিকা রাখে। এডিআর সরাসরি শ্রমিক ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে সংলাপ তৈরি করে, ভুল বোঝাবুঝি দূর করে এবং অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ার আগেই স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
এডিআর বা বিকল্পবিরোধ নিষ্পত্তি হলো একটি মানবিক প্রক্রিয়া, যেখানে আদালতের বাইরে সংলাপ, আলোচনা ও বোঝাপড়ার মাধ্যমে বিরোধ সমাধান করা হয়। এটি জয়ের বা পরাজয়ের প্রতিযোগিতা নয়; বরং উভয় পক্ষের সন্তুষ্টি ও সম্মতি মূল লক্ষ্য। আদালতের আনুষ্ঠানিকতা ও দীর্ঘসূত্রতা ছাড়াই এডিআর বন্ধুত্বপূর্ণ সমাধানের পথ তৈরি করে এবং ভবিষ্যতের জন্য বিশ্বাসভিত্তিক সম্পর্ক গড়ে তোলে।
বাংলাদেশের শ্রমক্ষেত্রে এডিআর শ্রমিক ও নিয়োগকর্তাকে একটি আস্থাভিত্তিক সংলাপের প্ল্যাটফর্ম দেয়। এতে সময় ও ব্যয় কমে, উৎপাদন ব্যাহত হয় না এবং দুই পক্ষের মধ্যে অবিচ্ছিন্ন বিশ্বাস তৈরি হয়। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে-পরে উত্তেজনা বেশি থাকায়, এডিআর স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সবচেয়ে কার্যকর ও নিরাপদ পদ্ধতি। তবে বাস্তব প্রয়োগে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। মধ্যস্থতাকারীর অভাব, এইচআর ও ওয়েলফেয়ার কর্মকর্তাদের অদক্ষতা, শ্রমিকদের আইনি জ্ঞানের ঘাটতি এবং আস্থা সংকট এখনো চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে এই সীমাবদ্ধতাগুলো আরো স্পষ্ট হয়।
নির্বাচনকালীন সময় এডিআর কার্যকর করতে প্রতিটি কারখানায় কোম্পানির অভ্যন্তরীণ এডিআর কমিটি গঠন অত্যন্ত প্রয়োজন, যেখানে ব্যবস্থাপনা ও শ্রমিক প্রতিনিধির পাশাপাশি দক্ষ এডিআর বিশেষজ্ঞরা যৌথভাবে কাজ করবে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের এইচআর ও ওয়েলফেয়ার কর্মকর্তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে তারা সমস্যার সূচনাতেই তা শনাক্ত করে দ্রুত সমাধান দিতে পারে। পাশাপাশি বেতন-বোনাসসংক্রান্ত বিরোধ আগেভাগে নিষ্পত্তি, ইউনিয়নের সঙ্গে নিয়মিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠক, সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং সেল এবং শিল্পপুলিশ–প্রশাসন-ব্যবস্থাপনার সমন্বিত টিম দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও শিল্পাঞ্চলের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এছাড়া শ্রম আইন সংশোধনীতে সংযোজিত ৩৪৮(গ) ধারার আওতায় প্রস্তাবিত বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি কর্তৃপক্ষকে দ্রুত গঠন ও বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত জরুরি, কারণ এটি নীতিমালা নির্ধারণ, প্রশিক্ষণ এবং মান নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখবে। শ্রম আদালতের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য এডিআর এডিআর বাধ্যতামূলক করা হলে আদালতের চাপ কমবে এবং সমাধান আরো দ্রুত হবে।
লেখক : শ্রম সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন


ভারতে ভোটার তালিকা সংশোধনে হুমকিতে গণতন্ত্র ও মুসলিমরা
র্যাব যথাযথ ব্যবস্থা নিলে বদলে যেতে পারত চিত্র