এক পরিবর্তিত বাংলাদেশের বিজয় দিবস
প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর, বাংলাদেশ তার মহান মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়কে স্মরণ করে—এক যুদ্ধ, যা অবিশ্বাস্য সাহস, অপরিমেয় ত্যাগ এবং স্বাধীনতার প্রতি অটল অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছিল। বিজয় দিবস বরাবরই শুধু সামরিক জয়ের প্রতীক নয়; এটি এমন এক জাতির নৈতিক পুনর্জন্মকে নির্দেশ করে, যারা মর্যাদা, ন্যায়বিচার, সাম্য ও গণতান্ত্রিক আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী। কিন্তু ২০২৪ সালে, এই দিনটি আরো গভীর ও বহুমাত্রিক অর্থ বহন করে। জুলাই বিপ্লবের পর দ্বিতীয় বিজয় দিবস হিসেবে—এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহি এবং ২০২৬ সালের নির্বাচনের আগে গণতন্ত্র রক্ষার ব্যাপক সংস্কারের প্রেক্ষাপটে—বাংলাদেশ আজ শুধু অতীতের মুক্তিকে নয়, নতুন এক মুক্তিকেও স্মরণ করছে। এটি জনসচেতনতার দ্বিতীয় জাগরণের উদযাপন, যা ছাত্রনেতৃত্বাধীন বিপ্লবের মাধ্যমে স্বৈরাচারী শাসন পতনের ফলে জাতিকে নতুন গণতান্ত্রিক চেতনা উপহার দিয়েছে।
জুলাই-২০২৪-এর ঘটনাপ্রবাহ ছিল শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়, একটি নৈতিক জাগরণ
২০২৪ সালের জুলাইয়ে যা ঘটেছিল, তা শুধু সরকারের পরিবর্তন ছিল না; এটি জাতির জন্য এক গভীর নৈতিক জাগরণ ছিল। এটি জনগণের সার্বভৌমত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিল, নাগরিক মর্যাদার পুনরুত্থান ঘটিয়েছিল এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মকে অনুপ্রাণিত করা মূল মূল্যবোধগুলোর শক্তিশালী পুনর্জাগরণ এনেছিল। এই অভ্যুত্থান দেশকে এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায় : স্বাধীনতা অর্জনের পাঁচ দশকেরও বেশি সময় পরও এর চেতনা স্বৈরশাসন, এলিট দখল, দুর্নীতির শিকড়, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন এবং প্রতিবেশী এক দেশের আধিপত্যবাদী চাপের প্রতিক্রিয়ায় গঠিত বৈদেশিক নীতির মাধ্যমে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছিল। জুলাই বিপ্লব সেই আত্মসমর্পণের চক্র ভেঙে দেয়। ২০২৪ সালের সেই গ্রীষ্মে যুবরাই, যারা প্রকৃত অর্থেই ১৯৭১-এর আকাঙ্ক্ষার উত্তরাধিকারী, জাতিকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে স্বাধীনতা কখনো এককালীন অর্জন নয়—এটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম রক্ষা করতে হয়।
দুটি মুক্তির মধ্যে বিজয় দিবস-২০২৪ এক সেতুবন্ধ
বিজয় দিবস ২০২৪ তাই দুই ধরনের মুক্তির মধ্যে অবস্থিত এক ঐতিহাসিক সেতুবন্ধ হয়ে দাঁড়ায়— ১৯৭১ সালের ভৌগোলিক মুক্তি এবং ২০২৪ সালের জনসচেতনতার মুক্তি। দুটি মিলিয়ে আমরা সংগ্রামের এক ধারাবাহিকতা দেখতে পাই। জাতির জন্মকে যে শক্তি নির্মাণ করেছিল—অর্থাৎ জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছাশক্তি—সেই শক্তিই আবার উঠে দাঁড়িয়েছিল তাদের মোকাবিলা করতে, যারা জাতীয় সম্পদ অপব্যবহার করেছিল, মতপ্রকাশ দমন করেছিল এবং সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিয়েছিল। জুলাই বিপ্লব-১৯৭১-এর অপূর্ণ মিশনেরই আত্মিক ধারাবাহিকতা—এক সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক ও মর্যাদাপূর্ণ প্রজাতন্ত্র নির্মাণের সংগ্রাম।
এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য
এই প্রবন্ধ ১৯৭১-এর অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষাকে জুলাই বিপ্লবের রূপান্তরমূলক চেতনার সঙ্গে যুক্ত করে ব্যাখ্যা করে কীভাবে ছাত্রনেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থান জনগণের নৈতিক কর্তৃত্ব পুনরুজ্জীবিত করেছে এবং পূর্ববর্তী ফ্যাসিবাদী শাসনামলে সার্বভৌমত্ব কীভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে, তা উন্মোচিত করেছে। সার্বভৌমত্বের এই ক্ষয়ের সবচেয়ে গুরুতর উদাহরণ ছিল আদানি গ্রুপের জন্য মিরসরাইয়ের ৯০০ একর ভূমি হস্তান্তর—একটি সিদ্ধান্ত, যা কার্যত কৌশলগত ভূখণ্ডকে বিদেশি প্রভাববলয়ে ঠেলে দেয়। এটি ছিল বৃহত্তর বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার অংশ—বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ত্রিপুরা ও ভারতের সেভেন সিস্টার্সে একতরফা ট্রানজিট সুবিধা, অসম বাণিজ্য ও জ্বালানি চুক্তি, পানিবণ্টনের ভারসাম্যহীনতা এবং জাতীয় স্বার্থের বদলে প্রাধান্যশীল শক্তির সুবিধা নিশ্চিত করা এক বৈদেশিক নীতি।
এই প্রেক্ষাপটে জুলাই বিপ্লব ছিল এক ঐতিহাসিক সংশোধনী। এটি ভেঙে পড়া প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন, পূর্ণ সার্বভৌমত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং ১৯৭১-এর অপূর্ণ প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করার জন্য একটি নবায়িত জাতীয় ম্যান্ডেট তৈরি করেছে। এর মাধ্যমে এটি মুধু একটি রাজনৈতিক রূপান্তর নয়; এটি বাংলাদেশের দীর্ঘ বিলম্বিত মুক্তিযাত্রার দ্বিতীয় অধ্যায়, যা এক নতুন প্রজন্ম তাদের নিজস্ব ভবিষ্যৎ পুনরুদ্ধারের দৃঢ় প্রত্যয়ে লিখছে।
১৯৭১-এর চেতনা : এক জাতি যারা মাথা নত করেনি
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ মূলত মর্যাদা ও মানবিকতার সংগ্রাম ছিল। এটি ছিল রাজনৈতিক দমন, অর্থনৈতিক শোষণ, সাংস্কৃতিক মুছে ফেলা এবং গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পূর্ণ অস্বীকারের বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক বিদ্রোহ। বিজয় দুটি চিরন্তন নীতিকে জাতীয় চেতনায় স্থাপন করে— প্রথমত, বাংলাদেশের ভাগ্য কোনো বহিঃশক্তি নির্ধারণ করতে পারে না; দ্বিতীয়ত, সার্বভৌমত্ব জনগণের, শাসকের নয়।
ধীরে ধীরে এই মূল্যবোধগুলো ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে। প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়, বংশানুক্রমিক শাসন গণতান্ত্রিক ঐকমত্যের জায়গা দখল করে এবং ভূরাজনৈতিক নির্ভরতা সার্বভৌম সিদ্ধান্তকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিজয় দিবস আনুষ্ঠানিক উৎসবে পরিণত হয়—অর্থশূন্য ও স্মৃতিহীন। মুক্তির আদর্শ ও মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যে ব্যবধান বিস্তৃত হতে থাকে।
জুলাই ২০২৪ : যখন জাতি নিজেকে ফের চিনল
২০২৪-এর প্রজন্ম হলো নতুন মুক্তিযোদ্ধা
২০২৪ সালের জুলাইয়ে শিক্ষার্থীরা যখন রাজপথে নামে, তারা কোনো দলের স্বার্থে নয়; বরং নিজেদের মর্যাদা ও ভবিষ্যৎ পুনরুদ্ধারের জন্য নামে। তারা enforced disappearance, বিচারবহির্ভূত হত্যা, ডিজিটাল নজরদারি, অর্থনৈতিক লুণ্ঠন এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয়। রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন ছিল নির্মম-১৪০০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়, হাজারে হাজারে আহত হয়—তবু জাতি পিছিয়ে যায়নি।
অসহিংস গণআন্দোলনেই পতন ঘটে স্বৈরশাসনের
৫ আগস্ট ২০২৪-এ সরকার পতন ঘটে—সেনা হস্তক্ষেপ বা বিদেশি মধ্যস্থতায় নয়, জনগণের নৈতিক শক্তির জোরে। কয়েক দিনের মধ্যে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান, যা এক মাস আগেও অকল্পনীয় ছিল। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস জনগণই।
১৯৭১-এর বিশ্বাসঘাতকতা : সার্বভৌমত্ব কীভাবে ক্ষুণ্ণ হলো
জুলাই বিপ্লবের পর প্রকাশ পেতে থাকে একের পর এক বিপজ্জনক সত্য—দেশের সার্বভৌমত্ব কীভাবে বারবার বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল। সবচেয়ে উদ্বেগজনক ছিল মিরসরাইয়ের ৯০০ একর কৌশলগত উপকূলীয় ভূমি ভারতের আদানি গ্রুপকে হস্তান্তরের কেলেঙ্কারি, যা ছিল জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি সরাসরি হুমকি।
স্থানীয় প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে, ভারতীয় শ্রম ও উপকরণ বাধ্যতামূলক করে, সঠিক মূল্যায়ন ছাড়া এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক অবস্থান উপেক্ষা করে এই জমি হস্তান্তর করা হয়েছিল। এ ঘটনাকে বহু বিশেষজ্ঞ ‘বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ক্ষুদ্র উপনিবেশ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
নতুন মুক্তি : জনসচেতনতার জাগরণ
১. নৈতিক চেতনার পুনরুত্থান
দীর্ঘদিন ভয়ের শাসন জনজীবনকে অচল করে রেখেছিল। কিন্তু শিক্ষার্থীদের মুক্তির স্লোগানে জাতি তার নৈতিক কেন্দ্র পুনরুদ্ধার করে।
২. বিদেশি আধিপত্যের বিরুদ্ধে স্পষ্ট প্রত্যাখ্যান
একতরফা পানি চুক্তি, ট্রানজিট, বাণিজ্য, সংস্কৃতি ও ভূমি হস্তান্তর নিয়ে নতুন প্রশ্ন তৈরি হয়। মানুষ প্রথমবার উপলব্ধি করে—কূটনীতি কখনোই আত্মসমর্পণের নাম হতে পারে না।
৩. জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার নতুন দাবি
জনগণ এখন গোপন চুক্তি, বংশানুক্রমিক ক্ষমতা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের অপব্যবহার মেনে নিতে নারাজ।
কেন জুলাই বিপ্লব ১৯৭১-এর প্রতিচ্ছবি
১৯৭১ এবং ২০২৪—উভয় আন্দোলনই বৈধতার সংকট থেকে জন্ম নিয়েছিল। উভয় ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব দিয়েছিল। উভয় আন্দোলনই দমন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাতীয় আত্মমর্যাদার সংগ্রাম ছিল এবং উভয়ই শুধু সরকার পরিবর্তনের জন্য নয়—বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ আবার কল্পনা করার জন্য ছিল।
অন্তর্বর্তী সরকার : ১৯৭১-এর স্বপ্নপূরণের দ্বিতীয় সুযোগ
ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার এখন অর্থনীতি স্থিতিশীল করা, প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন, দুর্নীতিপ্রতিরোধ, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের মতো গুরুদায়িত্ব পালন করছে। এর চেয়েও বড় দায়িত্ব হলো ১৯৭১-এর মূল মূল্যবোধকে পুনরুজ্জীবিত করা।
বিজয় দিবস ২০২৪ : উদযাপন ও সতর্কতা
যদিও বাংলাদেশ আজ উদযাপন করছে, তবু বিপ্লব রক্ষার জন্য সতর্ক থাকা জরুরি। কারণ পরাজিত স্বৈরশক্তি এখনো পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে। আত্মতুষ্টি বিপ্লবের সবচেয়ে বড় শত্রু।
অগ্রযাত্রা : অপূর্ণ মুক্তিযুদ্ধ সম্পন্ন করার আহ্বান
১৯৭১-এর প্রজন্ম আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছে; ২০২৪-এর প্রজন্ম জাতির আত্মাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। এখন রাষ্ট্রকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে কোনো ক্ষমতাকেন্দ্র আর কখনো জনগণের সার্বভৌমত্ব ছিনিয়ে নিতে না পারে।
নতুন বাংলাদেশের ভোর
বিজয় দিবস-২০২৪ পূর্ববর্তী সব বিজয় দিবসের চেয়ে আলাদা। এটি শুধু অতীতের ত্যাগের স্মরণ নয়; বরং নতুন মুক্তির উদযাপন—জনসচেতনতার জাগরণ, নৈতিক সাহসের উত্থান এবং সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারের ঘোষণা। জুলাই বিপ্লব ১৯৭১-এর আলোকে পুনর্জন্ম দিয়েছে, বহু বছরের স্বৈরতন্ত্র, নির্ভরতা ও আধিপত্যের চাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করেছে।
২০২৪-এর যুবসমাজ প্রমাণ করেছে যে ১৯৭১-এর আদর্শ আজও জীবন্ত। ১৯৭১ আমাদের জাতি দিয়েছিল; ২০২৪ আমাদের জাতির আত্মা ফিরিয়ে দিয়েছে।
যদি বাংলাদেশ এই গতি ধরে রাখতে পারে এবং বিপ্লবের অর্জনগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সুরক্ষিত করতে পারে, তবে অবশেষে মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত লক্ষ্য—গণতান্ত্রিক শাসন, সামাজিক ন্যায্যতা, অর্থনৈতিক সাম্য ও জাতীয় মর্যাদা—পূর্ণতা লাভ করবে। এটাই বিজয় দিবস-২০২৪-এর প্রকৃত অর্থ। এটাই জনসচেতনতার নতুন মুক্তি।
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র যেমন বলেছিলেন, ‘নৈতিক মহাবিশ্বের বাঁক দীর্ঘ, কিন্তু তা ন্যায়ের দিকেই ঝোঁকে।’ আজ বাংলাদেশ সেই বাঁকের মোড়ে দাঁড়িয়ে নিজের ভবিষ্যৎ নিজেই পুনরুদ্ধার করে এগিয়ে যাচ্ছে।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের সাভান্না স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিষয়ে অধ্যাপক
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন


বছরে বিলীন হবে চার হাজার হিমবাহ
সিরিয়াসহ আরো যে ৭ দেশের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ট্রাম্পের