বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থান শুরু হলে প্রথম থেকেই এর ব্যাপকতা বুঝতে পেরেছিল ভারতের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’। ফলে হাসিনাকে রক্ষা করতে শুরুতেই ওই আন্দোলন দমানোর পরিকল্পনা করেছিল তারা। ‘অপারেশন ডেল্টা সেভেন’ নাম দিয়ে তারা বাংলাদেশে গঠন করে গুপ্ত স্কোয়াড। আন্দোলন চলাকালে ঢাকা মহানগরজুড়ে স্নাইপার দিয়ে ব্যাপক গণহত্যাসহ বিভিন্ন নাশকতায় এ স্কোয়াডের জড়িত থাকার ভয়াবহ তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে।
আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে পাওয়া এমন বেশকিছু তথ্যপ্রমাণে দেখা যায়, এ স্কোয়াডের সদস্যরা ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করত এবং তার কাছে অগ্রগতি রিপোর্ট পাঠাত।
‘আপা আসসালামুআলাইকুম, ক্যাম্পাসে কোটা আন্দোলন আবার শুরু হয়েছে। আজ প্রাথমিক মিছিল করেছে। কাল থেকে ওরা বড় করে আন্দোলনে নামার চেষ্টা করবে। আমরা ওদের তথ্য সংগ্রহ করছি আর ওদের অবজারভেশনে রেখেছি। আমরাও যথেষ্ট প্রস্তুত আছি। আপনার নির্দেশনা প্রয়োজন।’ এভাবেই আন্দোলনের শুরুতেই র-এর ডেল্টা সেভেন গ্রুপের প্রভাবশালী এক সদস্য তার মোবাইল ফোন থেকে শেখ হাসিনাকে সরাসরি এ মেসেজ পাঠায়।
প্রাপ্ত নথিতে দেখা যায়, ডেল্টা সেভেন গ্রুপের সদস্যদের মোবাইলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরটি ‘আপা পিএম’ নামে সংরক্ষিত ছিল। যেকোনো প্রয়োজনে তারা সরাসরি শেখ হাসিনার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করত এবং আন্দোলনের বিভিন্ন তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীকে পাঠাত।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, কোটা আন্দোলনের শুরুতেই র-এর স্কোয়াডটি গঠন করা হয়। পরে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পয়েন্টের বিস্তারিত তথ্যউপাত্ত লেখা মেসেজ ও ছবি পরস্পরের মধ্যে আদান-প্রদান করত এবং র-এর দেওয়া দিকনির্দেশনা অনুযায়ী কার্যক্রম চালাত।
বিভিন্ন সময় গ্রুপের সদস্যদের বিভিন্ন আইডি থেকে ইন্টারনেট বন্ধ, শাটডাউন ও আন্দোলন-সম্পর্কিত মেসেজ পারস্পরের মধ্যে আদান-প্রদানের তথ্য পাওয়া যায়। গ্রুপের বিভিন্ন সদস্যের কাছে পাঠানো এমন অনেক মেসেজ উদ্ধার করেছে সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ১৪ আগস্ট রাতে রাজধানীতে ধরা পড়েন আওয়ামী লীগের সাবেক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এ দুজনের মোবাইল ফরেনসিক পরীক্ষা করে র-এর অপারেশন ডেল্টা সেভেনসম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ের সত্যতা নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা ও স্বনামধন্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা আমার দেশকে বলেন, বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। ইতঃপূর্বে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয়ে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততার কথা শোনা যেত কিন্তু এ ঘটনায় তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হলো, যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাব্যবস্থায় বিদেশি (ভারতীয়) গোয়েন্দা সংস্থা র-এর সরাসরি সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
তিনি জানান, তাদের তদন্তেও দেখা যায়-জুলাই আন্দোলনকে ঘিরে দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের যোগাযোগ তথ্য, কল লগ ও ডিজিটাল যোগাযোগের প্যাটার্নে বিদেশি সার্ভার ও র-এর এসব এজেন্টের কার্যক্রমের মিল পাওয়া গেছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এ বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা আরো জানান, এ অনুসন্ধান প্রযুক্তিগত দিক থেকে অত্যন্ত সংবেদনশীল। প্রতিটি ডেটা পয়েন্ট জুলাই আন্দোলনকেন্দ্রিক মামলাগুলোয় বিশেষ করে শেখ হাসিনাসহ প্রধান প্রধান কুশীলবের ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের উপাত্ত আদালতে যাচাইযোগ্য প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হবে।
তানভীর জোহা জানান, আমাদের সংশ্লিষ্ট টিমটি আন্তর্জাতিক সাইবার ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ও স্থানীয় সংস্থাগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে, যাতে প্রমাণগুলো আইনি ফ্রেমওয়ার্কে উপস্থাপন করা যায় । তদন্ত শুধু দায় নির্ধারণ নয়, এটি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা রক্ষার বিষয়। আমাদের লক্ষ্য প্রযুক্তিগত সত্য উদ্ঘাটন।
এ ব্যাপারে বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইরফান হায়দার আমার দেশকে বলেন, এটি একটি ভয়াবহ তথ্য। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা ঘটনাবলিতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এর সংশ্লিষ্টতার কথা বলা হলেও তা প্রমাণ করা মুশকিল ছিল। কিন্তু এ তদন্ত তার চাক্ষুষ প্রমাণ। বর্তমানে শেখ হাসিনাকে ভারতে নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে রাখাই প্রমাণ করে এত বছর ভারত তাকে বাংলাদেশের ক্ষমতায় তার নিজ স্বার্থে বসিয়ে রেখেছিল। তিনি এই গ্যাংয়ের আদ্যোপান্ত উদ্ধারের দাবি জানান।
এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক আরো বলেন, ভারতের সহযোগিতায়ই শেখ হাসিনা ফ্যাসিস্টের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। একদিনেই হাসিনা ফ্যাসিস্ট হয়নি, ভারতের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই হাসিনা এ রূপ ধারণ করেছিল। তিনি বলেন, গত বছরের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুপ্তহত্যা, স্পর্শকাতর স্থাপনাগুলোয় হামলা, জ্বালিয়ে দেওয়াসহ বিভিন্ন ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এর সহায়তা নেয় বলে এতদিন অনেকের কাছে সন্দেহ ছিল। এখন তা প্রমাণ হচ্ছে।

