ময়মনসিংহ শহরকে রণক্ষেত্রে পরিণত করেছিলেন শান্ত

আব্দুল কাইয়ুম, ময়মনসিংহ
প্রকাশ : ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১১: ৫০

নেত্রী পালিয়েছে। এ খবরে ময়মনসিংহ সদরের সাবেক এমপি মোহিত উর রহমান শান্তও বোরকা পরে দে চম্পট। এরা ছিলেন জনগণের সেবক। ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন এই শান্ত।

বিজ্ঞাপন

মোহিত উর রহমান শান্ত ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীর হাঁকডাক, চাঁদাবাজি এবং অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল ময়মনসিংহ সদরের ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগণ। যদিওবা হাসিনার আশীর্বাদে সংসদে বসার যোগ্যতা অর্জন করেছিল।

গত ৬ আগস্ট তারিখ রাত ৩টা ৩২ মিনিটে কলসিন্দুরের রানীপুর গ্রামে পৌঁছান তিনি। পরে সেখান থেকে ভোর ৫টা ৪৭ মিনিটে ঘোষগাঁও হয়ে শিববাড়ী সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যান। এর আগে ৪ আগস্ট বিকালেও নগরীর তাজমহল এলাকায় আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে আন্দোলনকারীদের দেখে নেওয়ার হুংকার দিয়েছিলেন এই শান্ত।

‘ফায়ারিং ক্যাডার ফোর্স’ গঠন

শিক্ষার্থীদের হত্যা করে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের ওপর দায় চাপানোর উদ্দেশ্যে জুলাইয়ে গঠন করেছিল ‘ফায়ারিং ক্যাডার ফোর্স’। ময়মনসিংহে এই সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন ও হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করার পেছনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সরাসরি নির্দেশ ছিল বলে জানা গেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে প্রতিহত করতে মোহিত উর রহমান শান্ত ১১ জুলাই দুপুরে ঢাকার গুলশান-১-এর ১৪ নম্বর রোডের একটি বাসায় ১০০ সদস্যের এই বাহিনী গঠন করে। ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক রেজাউল হাসান বাবুকে প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব দেন।

এই বাহিনীতে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ইকরামুল হক টিটু গ্রুপের ৩৫ জন দাগি ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীকেও যুক্ত করা হয়। ১২ জুলাই বিকাল থেকেই ময়মনসিংহ নগরীতে প্রকাশ্যে দেশি-বিদেশি অস্ত্র নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনেই মহড়া দেয় ‘ফায়ারিং ক্যাডার ফোর্স’-এর সদস্যরা।

সাগরকে যেভাবে হত্যা করে

১৮ জুলাই ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। এদিকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে দিশাহারা হয়ে মোহিত উর রহমান শান্ত ১৮ জুলাই রাতে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে ফিরেন।

১৯ জুলাই সন্ধ্যায় নগরীর মিন্টু কলেজ এলাকায় মোহিত উর রহমান শান্তর উপস্থিতিতে ‘ফায়ারিং ক্যাডার ফোর্স’-এর সন্ত্রাসী বাহিনী বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এতে ঘটনাস্থলেই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী রিদওয়ান হোসেন সাগর (২৩) এবং আহত হন অর্ধশতাধিক আন্দোলনকারী।

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, এই সংঘর্ষের সময় মোহিত উর রহমান শান্তর উপস্থিতিতে জঙ্গি স্টাইলে আন্দোলনকারীদের ওপর অতর্কিত গুলি চালানো হয়। সে সময় শান্তর হাতেও পিস্তল ছিল বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র।

ওই দিন সন্ধ্যা ৭টা ৪৭ মিনিটে শান্ত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে ফোন করেন এবং একজনকে গুলি করে হত্যা ও অর্ধশতাধিক আন্দোলনকারীকে আহত করার খবর নিশ্চিত করেন।

লাশ গুমের চেষ্টা

১৯ তারিখ রাত ১২টায় জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল সুমনকে ফোন করে সাগরের লাশ দ্রুত দাফনের ব্যবস্থা করতে বলেন শান্ত। শান্তর সিদ্ধান্ত মোতাবেক সুমন দ্রুত সাগরের জানাজার ব্যবস্থা করেন যা পরে এ প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেন সুমন। এদিকে আন্দোলনকারীদের ওপর সন্ত্রাসী কার্যক্রমের দায় চাপাতে সাগরের পাশের বাসার আলমগীর নামের এক ব্যক্তিকে ফোন করে শান্ত।

পরে শান্তর নির্দেশ মতো আলমগীর ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন কর্মী আলমগীরের বসতবাড়ি ভাঙচুর করে নাটকীয় ঘটনার সৃষ্টি করে ও ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপর সেই ঘটনার দায় চাপায়। এ ঘটনায় আলমগীর এ প্রতিবেদককে জানান, ওই দিন শান্ত ফোন করে তার বাসায় ভাঙচুরের খবর জানতে চেয়েছিল।

হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ ধ্বংসের চেষ্টা

রিদওয়ান হোসেন সাগরের বাবা আসাদুজ্জামান আসাদ জানান, গত ১৯ জুলাই সন্ধ্যায় অপরিচিত নাম্বার থেকে তার মোবাইলে কল আসে। একজন জানান গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সাগর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রয়েছে।

সাগরের বাবা ও চাচা আকরামুজ্জামান হাসপাতালে ছুটে যান। সাগরের বুকের বাঁ এবং ডান পাশে গুলির চিহ্ন দেখতে পান তারা। সাগরের বাবা বলেন, প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে জেনেছি হত্যাকাণ্ডের সময় সাবেক এমপি মোহিত উর রহমান শান্ত উপস্থিত ছিলেন এবং তার নির্দেশে তার চাচাতো ভাই ফয়জুর রাজ্জাক ওশান ও মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক রাসেল পাঠান গুলি করে সাগরকে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডকে ইতিহাস থেকে মুছে দিতে ঘটনাস্থলের আশপাশের সব সিসি ক্যামেরার ফুটেজ গায়েব করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সাগর হত্যাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য তৎকালীন কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি মাইন উদ্দিন প্রতি মুহূর্তে শান্তর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। তারই পরামর্শে ফয়জুর রাজ্জাক ওশান, মহানগর আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আসাদুজ্জামান রুমেল, রাসেল পাঠান ঘটনাস্থলের আশপাশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সিসি ক্যামেরার হার্ডডিস্ক খুলে নেয়।

আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার দাবি

র‌্যাবের একটি সূত্র জানিয়েছে, মোহিত উর রহমান শান্ত ভারতে অবস্থান করছে এমনটি নিশ্চিত হয়েছে র‌্যাব। ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি সফিকুল ইসলাম খান বলেন, বিভিন্ন মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

সম্পাদনা লাবিন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত