আবুল কালাম আযাদের তিন সাক্ষীর স্বীকারোক্তি

যুদ্ধের সময় দেশেই ছিলাম না জোর করে সাক্ষ্য নেওয়া হয়

অলিউল্লাহ নোমান
প্রকাশ : ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩: ০৩

মাওলানা আবুল কালাম আযাদের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সব সাক্ষীই ছিল সাজানো। সাক্ষীদের সেফ হোমে রেখে ভয়ভীতি দেখিয়ে সাক্ষ্য দিতে সম্মতি নেওয়া হয়েছিল। প্রসিকিউশনের স্বপ্রণোদিত বক্তব্যেই এখন ঘটনাটি প্রকাশ পাচ্ছে। আবুল কালাম আযাদের মামলায় প্রসিকিউশনের তিনজন সাক্ষীর সঙ্গে কথা বলেছে আমার দেশ। এর মধ্যে দু’জন সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্য।

বিজ্ঞাপন

তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ১৯৭১ সালে যুদ্ধের শুরুতেই ভারতে চলে গিয়েছিলেন তারা। দেশে ফিরেছেন স্বাধীনতার অনেক পরে। তারপরও প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ) জোর করে ভয় দেখিয়ে তাদের ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী বানিয়েছিল মাওলানা আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে বলতে। ভয়ভীতির পর প্রসিকিউশনের শেখানো জবানবন্দি দিতে তারা বাধ্য হয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন আমার দেশকে।

উল্লেখ্য, সাক্ষীদের ঢাকায় এনে প্রশিক্ষণের জন্য গোলাপবাগে সেফ হোম নামে একটি ভবনে রাখা হতো। সেফ হোমে সাক্ষীদের এনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। এ নিয়ে ২০১১ সালের এপ্রিলেই আমার দেশ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। ওই প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল ‘ট্রাইব্যুনালকে প্রসিকিউশনের ধোঁকা’।

মূলত আল্লামা সাঈদীর মামলায় সাক্ষীদের পিরোজপুর থেকে এনে সেফ হোমে রেখে প্রশিক্ষণের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছিল। সেফ হোমের রেজিস্টার থেকে তখন দেখানো হয়েছিল কোন সাক্ষীকে এখানে কখন আনা হয়েছে। কতদিন ছিলেন এবং কতদিন পর তাদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করে সাক্ষ্য নেওয়ার পর রিলিজ হয়েছেন। এছাড়া অনেক সাক্ষী শেখানো জবানবন্দি দিতে অস্বীকার করায় ফেরত পাঠানোর তথ্য উঠে এসেছিল।

অনেক সাক্ষীকে সেফ হোমে রেখে প্রশিক্ষণের পর ট্রাইব্যুনাল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ তাদের ওপর পুরোপুরি ভরসা করতে না পারায় ট্রাইব্যুনাল পর্যন্ত নেওয়ার পর আর কোর্টে উঠানো হয়নি। সেফ হোমে রেখে প্রশিক্ষণের পরও যাদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়নি, তাদের বিষয়ে পুরোপুরি মিথ্যা তথ্য দেওয়া হয় প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে। প্রসিকিউশন থেকে লিখিত আবেদন ট্রাইব্যুনালকে জানানো হয়েছিল এই বলে যে, এসব সাক্ষী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

সেফ হোমে নিয়ে আমার দেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আল্লামা সাঈদীর পক্ষ থেকে তখন একটি আবেদন করা হয় ট্রাইব্যুনালে। এই আবেদনের শুনানি গ্রহণের পর বিচারক নিজামুল হক নাসিম ও এ টি এম ফজলে কবির খারিজ করে দেন। আদেশ দেওয়ার সময় অনুপস্থিত থাকেন বিচারক এ কে এম জহির। তিনি তাদের এই আদেশের সঙ্গে একমত হতে পারছিলেন না। তাই তাকে অনুপস্থিত রেখে আদেশটি দেওয়া হয় তখন। এতে সরকার তার ওপর আস্থা হারালে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমদ তাকে ডেকে নিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন। পদত্যাগের এ ঘটনা উঠে এসেছিল নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপ কথোপকথনে।

এ কে এম জহিরের অনুপস্থিতিতে নিজামুল হক নাসিম ও এ টি এম ফজলে কবিরের আদেশে বলা হয়েছিল, বিচারকে বাধাগ্রস্ত করতে আমার দেশ এ প্রতিবেদন করেছে। যদিও শুনানিতে আমার দেশকে ডাকা হয়নি। আমার দেশ-এর কাছে সেফ হোমের সব নথিপত্র তখন ছিল। আমরাও প্রস্তুত ছিলাম আদালতে ডাকা হলে নথিপত্র উপস্থাপন করা হবে প্রমাণের জন্য। আমাদের না ডেকেই নিজামুল হক নাসিম সেদিন একতরফা আদেশ দেন বিচার বাধাগ্রস্ত করার বায়বীয় কথা বলে।

তবে আমাদের অনুসন্ধান থেমে ছিল না। পরবর্তী অনুসন্ধানে উঠে এসেছিল স্কাইপ স্ক্যান্ডাল নিজামুল হক নাসিম ও তার বন্ধু ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রবাসী নেতা আহমদ জিয়াউদ্দিনের ১৭ ঘণ্টার কথোপকথন। এ কথোপকথনেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল বিচারটি কীভাবে সাজানো হয়েছে এবং পরিকল্পিতভাবে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে কীভাবে ফাঁসি দেওয়ার প্রস্তুতি চূড়ান্ত করা হচ্ছে।

এরই ধারাবাহিকতায় আমার দেশ সরকার বন্ধ করে দিলেও অনুসন্ধান থেমে নেই। ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর নতুন করে আমার দেশ প্রকাশের সুযোগ তৈরি হয়। এবারের অনুসন্ধানে আমরা দেখানোর চেষ্টা করব কীভাবে সাক্ষীদের সাজানো হয়েছিল। অনুসন্ধানের সূত্রেই আমরা ট্রাইব্যুনালে প্রথম ঘোষিত রায় অনুযায়ী মাওলানা আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের উপস্থিত করা সাক্ষীদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি। ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি আবুল কালাম আযাদকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করেছিল দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল। যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, রাষ্ট্রপক্ষের সেই সাক্ষীদের বক্তব্য আমলে নিয়েই ফাঁসির রায় দেওয়া হয়েছিল।

মাওলানা আবুল কালাম আযাদ দেশের একজন খ্যাতিমান আলেম। তাকে ‘বাচ্চু রাজাকার’ হিসেবে পরিচিতি দিয়ে প্রথমে আওয়ামী মিডিয়ায় মিডিয়া ট্রায়াল করা হয়। মিডিয়া ট্রায়ালের অপপ্রচারের মাধ্যমে শুরু হয় বিচারের নামে প্রহসনের প্রক্রিয়া। ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ওবায়দুল হাসান শাহিন ছিলেন তখন দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান। সাবেক ছাত্রলীগ নেতার নেতৃত্বে গঠিত ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়ে মাওলানা আবুল কালাম আযাদকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। যদিও মাওলানা আবুল কালাম আযাদ তখন অনুপস্থিত ছিলেন। তাকে পলাতক দেখিয়ে অনুপস্থিতিতেই একতরফা শুনানির মাধ্যমে রায় ঘোষণার পর উল্লাস করেছিল আওয়ামী ফ্যাসিবাদীরা। উল্লাস করেছিল আওয়ামী মিডিয়াও।

মাওলানা আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে রায় দিতে উপস্থিত করা তিন সাক্ষীর সঙ্গে কথা বলেছে আমার দেশ। রাষ্ট্রপক্ষের উপস্থিত করা তিন সাক্ষীই বলেছেন, তাদের জোর করে নেওয়া হয়েছিল ট্রাইব্যুনালে। কী বলতে হবে, সেটা শেখানো হয়েছিল গোলাপবাগের সেফ হোমে। একই সঙ্গে মাওলানা আবুল কালাম আযাদের সঙ্গেও কথা বলেছে আমার দেশ। এ অনুসন্ধানের সূত্র ধরেই আজকের প্রতিবেদন।

অসিত বরুণ সাহা

মাওলানা আবুল কালাম আযাদের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী ছিলেন অসিত বরুণ সাহা। তার বাড়ি আবুল কালাম আযাদের বাড়ি থেকে দেড় মাইল দূরে। অসিত বরুণ সাহার বর্ণনা অনুযায়ী, তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশেই ছিলেন না। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে চলে গিয়েছিলেন ভারতে। মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাসই ছিলেন সে দেশে। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে যা বলেছিলেন, সেটা কতটুকু সত্য। তখন তিনি বলেন, ঘটনার সময় আমি দেশেই ছিলাম না, ছিলাম ভারতে। এসব ঘটনা দেখিওনি; জানিও না।

দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, আপনি যদি ভারতে থাকেন, তাহলে সাক্ষী দিতে গেলেন কেন? উত্তরে বলেন, আমাকে পুলিশ এসে তুলে নিয়ে যায়। পুলিশ এসে বলে, আপনাকে সাক্ষী দিতে হবে। সাক্ষীর তালিকায় আপনার নাম লেখা আছে। তিনি আরও জানান, পুলিশকে তিনি প্রশ্ন করেছেনÑ‘আমার নাম কীভাবে লেখা হয়, আমি তো ছিলাম ভারতে’। পুলিশ তখন তাকে জানিয়েছে, কে লিখেছে, কারা লিখেছে জানি না। আপনাকে এখন যেতে হবে এবং সাক্ষী দিতেই হবে।

তার কাছে তখন আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়, তা-ই যদি হয়, স্বেচ্ছায় সাক্ষী দিতে গিয়েছিলেন কীভাবে? উত্তরে অসিত বরুণ বলেন, স্বেচ্ছায় সাক্ষী দিতে যাইনি। পুলিশ হ্যান্ডকাপ দেখিয়ে ভয় দেখায়। আরও বলে, সাক্ষী দিতে না গেলে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। তারপরই তিনি পুলিশের সঙ্গে গেছেন।

তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জানতে চাইলে বলেন, প্রথমে ফরিদপুর নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকায়।

তার কাছে তখন জানতে চাওয়া হয়, যাওয়ার পর সরাসরি কোর্টে উঠানো হয়েছিল, নাকি অন্য কোথাও? উত্তরে জানালেন, প্রথমে ধানমন্ডির ১৭ নম্বরে একটি বাড়িতে রাখা হয়। ওখানে তারা যা বলেছে, সেটা স্বীকার করেননি। কারা এসে শেখানোর চেষ্টা করত? জবাবে বলেন, এখানে ব্যারিস্টাররা এসে বিভিন্ন বিষয়ে তাকে শিখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন এবং আদালতে সাক্ষী দেওয়ার সময় এগুলো বলার জন্য চাপ দেন।

অসিত বরুণের বর্ণনা অনুযায়ী, প্রথমে তিনি এসব বলতে অস্বীকার করেন। এটাও জানান, তখন তিনি দেশে উপস্থিত ছিলেন না, এসব দেখেননি। তারপর তাকে ধানমন্ডি থেকে গোলাপবাগে পুলিশের নিয়ন্ত্রিত সেফ হোমে নিয়ে যায়। সেখানে আরও তিনদিন তাকে চাপে রাখা হয়। আইনজীবীরা সকাল-বিকাল দুই বেলা করে আসতেন সাক্ষী হিসেবে কি বলতে হবে শেখানোর জন্য। যারা আসতেন, তাদের নাম জানেন কি? জবাবে জানান, নাম জানতে চাওয়া হলে সেটা বলত না তারা। সেফ হোমে টানা তিনদিন চাপে রেখে চতুর্থ দিনে তাকে নেওয়া হয় কোর্টে। কোর্টে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, আবুল কালাম আযাদকে চেনেন কি না। তিনি জানিয়েছেন চেনেন। কিন্তু যখন আগুন লাগানো এবং মানুষ হত্যার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তখন তিনি কোর্টেও বলেছেন উপস্থিত ছিলেন না। তাই সঠিক বলতে পারবেন না।

দেব কুমার দাস

একই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আরেক সাক্ষী ছিলেন দেব কুমার দাস। তার কাছে আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কোথায় ছিলেন? উত্তরে সরাসরি জানালেন, ভারতে ছিলেন। তার ভাষ্যমতে, স্বেচ্ছায় নয় পুলিশ জোর করে সাক্ষী দিতে নিয়ে গিয়েছিলেন। পুলিশ প্রথম তাকে নিয়ে যায় ফরিদপুরের সালথা থানায়। সেখান থেকে ফরিদপুর সদরে এবং ফরিদপুর থেকে ঢাকায় নেওয়া হয়েছিল তাকে।

তার বর্ণনা অনুযায়ী, ঢাকার গোলাপবাগে পুলিশের নিয়ন্ত্রিত সেফ হোমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সরাসরি। তিনি জানান, কোর্টে যা বলেছিলেন, সবই ছিল তাদের শেখানো। তারা লিখে দিতেন শেখার জন্য। চারদিন সেফ হোমে রেখে শেখানো হয় কী বলতে হবে। তাদের লেখা মুখস্থ করে সেগুলো বলতে হয়েছে। তার বর্ণনা অনুযায়ী, পুলিশ কাগজে লিখে প্রমোট করত কী বলতে হবে এবং বলা হতো এই কথাগুলো কোর্টে বলতে হবে। যে ঘটনাগুলো লিখে দেওয়া হতো, সেগুলো জানতেন না বলেও আমার দেশ-এর কাছে স্বীকার করেন দেব কুমার দাস।

যদি না জানেন, তবে সাক্ষী দিতে গেলেন কেন? দেব কুমার দাস জবাবে বলেন, পুলিশ এসে তাকে বলেছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে সাক্ষী দিতে হবে। এর আগে তিনি জানতেনও না তাকে এরকম সাক্ষীর জন্য যেতে হবে। তখন পুলিশের কাছে তিনি বলেছেন, কিছুই জানেন না; কিন্তু সাক্ষী দেবেন কেমন করে! পুলিশ তখন জানিয়েছে, আপনাকে জানতে হবে না। সব শিখিয়ে দেওয়া হবে। টাকা-পয়সার লোভও দেখানো হয়েছিল বলে জানিয়েছেন দেব কুমার দাস।

রওশন শেখ

আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে রওশন শেখ নামে একজনকে হাজির করানো হয়েছিল। আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে তার সঙ্গেও কথা বলা হয়। তিনি জানান, আবুল কালাম আযাদকে চিনতেন অনেক বছর থেকে। তিনি জানালেন, একদিন বাজারে যাওয়ার পথে তাকে পাশের দেব কুমারের বাড়িতে ডেকে নিয়ে গেছে পুলিশ। তখন জানানো হয়েছে তাকে সাক্ষী দিতে হবে। তার ভাষ্যমতে, সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করেন তিনি। তখন বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় তো বয়স হয়েছিল। সাক্ষী দিতেই হবে। তার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, বয়স তখন তেমন হয়নি। তখন তাকে থানার দারোগা ও ডিবির সাদা পোশাকে পুলিশ সাক্ষী দিতে চাপ দেয়। এছাড়া এলাকার কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাও চাপ দেন তাকে সাক্ষী দেওয়ার জন্য। তার বর্ণনা অনুযায়ী, বাজারে যাচ্ছিলেন সদাই করতে। এ অবস্থায়ই রাস্তা থেকে তাকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হয় প্রথমে সালথা থানায়। সেখান থেকে ফরিদপুরে; অতঃপর ঢাকার গোলাপবাগে নিয়ে যাওয়া হয়।

গোলাপবাগে সেফ হোমে রেখে শেখানো হয় সাক্ষী হিসেবে আদালতে কী বলতে হবে। তার বর্ণনামতে, লেখাপড়া না জানার কারণে তারা পাঠ করে মুখস্থ করাত। তিনদিন সেফ হোমে রেখে তাকে শেখানোর পর চতুর্থ দিনে কোর্টে নেওয়া হয়। তার ভাষ্য অনুযায়ী, কোর্টে তারা বলতে ইতস্তত করলে বিচারক ও আইনজীবী মিলে এগুলো ঠিক করে নিতেন। সাক্ষ্য দেওয়ার পর আবার তাদের ফরিদপুরে নিজ বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হয়।

ন্যায়বিচার না পাওয়ার আশঙ্কায় দেশত্যাগ

এ বিষয়ে আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হয় আত্মগোপনে থাকা মাওলানা আবুল কালাম আযাদের সঙ্গে কথা বলতে। মোবাইলে যোগাযোগের পর মাওলানা আবুল কালাম আযাদ বলেন, ন্যায়বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা থেকেই তিনি দেশত্যাগ করেছিলেন। দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে প্রথমে তিনি ভারতে যান। সেখান থেকে নেপাল হয়ে শ্রীলঙ্কায় এক শুভাকাঙ্ক্ষীর তত্ত্বাবধানে ছিলেন। শ্রীলঙ্কা থেকে মালয়েশিয়ায় যান বড় ছেলের কাছে। এরপর তিনি মালয়েশিয়ায়ও নিরাপদ মনে না করায় অন্য এক দেশে যান। যদিও ওই দেশটির নাম বলতে তিনি রাজি হননি।

মাওলানা আবুল কালাম আযাদ জানান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় কলেজের ছাত্র ছিলেন। ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়তেন তখন। এর আগে মাদরাসায় পড়েছেন। ইসলামী ছাত্রসংঘের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এজন্য মুক্তিযুদ্ধের পরও একবার তাকে টার্গেট করা হয়েছিল। আটক করে জেলেও নেওয়া হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বিচারে নির্দোষ হয়ে বেকসুর খালাস পেয়েছিলেন শেখ মুজিব আমলেই। তিনি বলেন, কোনো দোষ করে থাকলে তো তখনই প্রমাণ হতো। শেখ মুজিব আমলেই আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ তারা বিচারে প্রমাণ করতে পারেনি।

তিনি বলেন, ষড়যন্ত্রমূলকভাবেই জাতির সামনে তার চরিত্র হননের জন্য প্রথমে মিডিয়া ট্রায়াল করা হয় অসত্য প্রচারণার মাধ্যমে। তিনি আরও জানান, মামলা শুরুর দিকে আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেছেন। আইনজীবীরাই তাকে নিশ্চিত করেছেন ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে না। আইনজীবীর পরামর্শ মোতাবেক আত্মগোপনে চলে যান তিনি।

ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা পেলে দেশে ফিরে আদালতে আইনি লড়াইয়ের ইচ্ছা রয়েছে বলেও নিশ্চিত করেন এই বয়োজ্যেষ্ঠ আলেম।

উল্লেখ্য, ভারত ও তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মঈন উদ্দিনের সঙ্গে সমঝোতায় একটি সাজানো নির্বাচনে ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। নির্বাচনে তার একটি ওয়াদা ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করবেন। ক্ষমতা গ্রহণের এক বছর পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়।

প্রথমে নিজামুল হক নাসিমকে চেয়ারম্যান, এ টি এম ফজলে কবির ও এ কে এম জহিরকে সদস্য করে গঠিত ট্রাইব্যুনালে শুরু হয়েছিল বিচারিক কার্যক্রম। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর নিজামুল হক নাসিমকে প্রথমে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ টি এম ফজলে কবীর চারদলীয় জোট সরকারের সময় হাইকোর্ট বিভাগে নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন। এ কে এম জহির ছিলেন জেলা জজ। এর পরই শুরু হয় মামলার আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতি।

সম্পাদনা : আহমদ মতিউর রহমান

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত