পেহেলগাম হামলা

সহানুভূতি দেখিয়ে ঢাকা পেল পুশ ইন

বশীর আহমেদ
প্রকাশ : ১৫ মে ২০২৫, ০৮: ৩৪
আপডেট : ১৫ মে ২০২৫, ১১: ৪৪
ছবি: সংগৃহীত

কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলার নিন্দা জানিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ভারত বাংলাদেশের এই সহানুভূতিকে গুরুত্ব দেয়নি। উল্টো বাংলাদেশ ভারত থেকে পেল পুশ ইন। গত ৭-৮ মে যখন ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ চলছে, ঠিক সেই মুহূর্তে ভারত উত্তেজনা তৈরি করে বাংলাদেশ সীমান্তে।

৭-৮ মে বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ২০২ জনকে বাংলাদেশে পুশ ইন করে ভারত। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গাও রয়েছে। খাগড়াছড়ি সীমান্তে আরো ২০০ থেকে ৩০০ জনকে জড়ো করা হয় পুশ ইনের জন্য।

বিজ্ঞাপন

৯ মে সেখান থেকে ৭৮ জনকে একটি জাহাজে করে বাংলাদেশের সুন্দরবন সীমান্তের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে ফেলে যায়। ৯ মে ভারতের এই পদক্ষেপের প্রতিবাদ জানিয়ে ঢাকার পক্ষ থেকে দিল্লিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দিল্লিকে চিঠি দেওয়ার পরও বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পুশ ইন অব্যাহত রেখেছে ভারত। গতকাল বুধবারও সিলেট সীমান্তে ৪৪ জনকে পুশইন করেছে ভারত।

হাসিনা জামানায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ছিল সম্পূর্ণভাবে দিল্লিকেন্দ্রিক। জুলাই বিপ্লবে হাসিনা সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দিল্লিকেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতির বদলে বাংলাদেশের জন্য একটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি দাঁড় করানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকরা অনেক ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত শক্ত অবস্থান নিতে পারেননি।

বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক এম শহীদুজ্জামান এ ব্যাপারে আমার দেশকে বলেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর যেভাবে বাংলাদেশ নিয়ে বিভিন্ন ইস্যুতে অযাচিতভাবে আগ্রাসী মনোভাব দেখিয়েছেন, তার প্রতি-উত্তরে আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সেভাবে জোরালো অবস্থান নিতে পারেননি। তিনি আসলে দিল্লির সঙ্গে কিছুটা ব্যালান্স করে চলতে চেয়েছেন।

বিশিষ্ট নিরাপত্তাবিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) এম মুনিরুজ্জামান মনে করছেন, এই জটিল সময়ে ভারতের সঙ্গে ডিল করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হতে হবে। তিনি বলেন, ভারত-পাকিস্তানের এই সংঘাতময় পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বক্তব্য-বিবৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

এদিকে পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন আমার দেশকে বলেন, বিগত ১৫ বছর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কীভাবে পরিচালিত হয়েছে, তা সবারই জানা। আমরা সে পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে এসেছি। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন যাত্রা শুরু করেছি। তিনি বলেন, আমাদের জাতীয় স্বার্থে যা যা করা দরকার, আমরা তা করার চেষ্টা করছি। পাকিস্তানে ভারতের হামলার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমরা আমাদের গভীর উদ্বেগের কথা জানিয়েছি।

শেখ হাসিনার পতনের পর গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশকে চাপে রাখতে ঢাকার সঙ্গে দিল্লি রীতিমতো বৈরী আচরণ শুরু করে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করসহ ভারতের অন্য রাজনীতিবিদরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

শেখ হাসিনার মাধ্যমে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছে। মিডিয়াকে লেলিয়ে দেওয়া হয় বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচারে। উত্তেজনা বাড়িয়েছে সীমান্তে। তথাকথিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের মিথ্যা অভিযোগ এনে চাপে ফেলতে চেয়েছে বাংলাদেশকে। সর্বশেষ পুশইনের মাধ্যমে চরম বৈরী মনোভাব দেখাচ্ছে ভারত। পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে একই পাল্লায় মাপছে দিল্লি।

ভারতের এসব আগ্রাসী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে প্রতিবাদের ধরন এবং ভাষা আরো শক্ত ও জোরালো হতে পারত বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক। এ ব্যাপারে প্রফেসর এম শহীদুজ্জামান বলেন, ‘ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম জয়শঙ্কর একজন পেশাদার কূটনীতিক ছিলেন। কিন্তু তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন ইস্যুতে যেভাবে কথা বলেছেন, তা কূটনৈতিক রীতিনীতির মধ্যে পড়ে না।

তিনি হিন্দুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তা করেছেন। এর জবাবে আমাদের তৌহিদ সাহেব কূটনীতির মধ্য থেকেই ভারতকে ডিল করতে চেয়েছেন। ঢাকা দিল্লির বিরুদ্ধে আরো কঠোর অবস্থান নিতে পারত। এ ক্ষেত্রে মালদ্বীপ আমাদের সামনে বড় উদাহরণ।

মইজু সরকার তো দেখিয়ে দিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হচ্ছে চীন এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা। বিশেষ করে সামরিক খাতে সহযোগিতা বাড়ানো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক ও কৌশলগত অংশীদারত্ব গড়তে পারলে ভারতের আগ্রাসী নীতি মোকাবিলা সহজ হবে।’

ভারত-পাকিস্তান সংঘাতময় পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে প্রফেসর শহীদুজ্জামান বলেন, ‘এই মুহূর্তে ভারত অত্যন্ত চাপের মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশের এমন কিছু বলা বা করা ঠিক হবে না, যার ফলে ভারত কোনো অজুহাত খুঁজে পায়। পাকিস্তানে ভারতের হামলার ঘটনায় বাংলাদেশ উদ্বেগ জানিয়ে শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে। এই মুহূর্তে এটি সঠিক সিদ্ধান্ত।’

তিনি আরো বলেন, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেটা আবার আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমকে জানিয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের প্রতি এক ধরনের সংহতি জানানো হয়েছে।

বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী এ প্রসঙ্গে আমার দেশকে বলেন, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কারণে ভারত এখন দক্ষিণ এশিয়ায় একপ্রকার একা। বলা যায় বন্ধুহীন। এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে আরো বিপাকে পড়েছে। কোনো দেশই ভারতের পাশে সেভাবে নেই। বাংলাদেশ এখানে যে ধরনের বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছে, তা রুটিনওয়ার্ক। এই মুহূর্তে প্রকাশ্যে কোনো পক্ষ নেওয়াটা ঠিক হবে না। তবে বাংলাদেশকে অবশ্যই যেকোনো ধরনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকতে হবে।

ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে লিপ্ত হওয়ায় গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতা এক ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে মন্তব্য করে নিরাপত্তা বিশ্লেষক জেনারেল মুনিরুজ্জামান বলেন, ‘এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পা ফেলতে হবে। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্কের সূচনা হয়েছে। ফলে আমরা একটি ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে আছি।’ তিনি বলেন, ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের ফলে যদি দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়, বাংলাদেশে তার প্রভাব পড়বে সুদূরপ্রসারী।

এমনকি আমাদের জন্য নিরাপত্তাঝুঁকিও তৈরি হতে পারে। এমনিতেই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব ব্যাপক। তাই সবকিছু বিবেচনা করে ঢাকাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাংলাদেশ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে দুই পক্ষকে শান্তি বজায় রাখার যে আহ্বান জানিয়েছে, তা এক ধরনের সতর্ক পদক্ষেপ বলেই মনে করেন জেনারেল মুনিরুজ্জামান।

ভারতের আগ্রাসী নীতি ও পদক্ষেপের জবাবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাঙ্ক্ষিত জোরালো অবস্থান নিতে পারেনি- এই অভিযোগ মানতে রাজি নন পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন। এ ব্যাপারে আমার দেশ-এর প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কীভাবে পরিচালিত হয়েছে, তা আপনারা সবাই জানেন। আমরা সেই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে এসেছি।

আমরা একটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে অনেকদূর এগিয়েছি। জাতীয় স্বার্থের কথা বিবেচনায় নিয়ে প্রতিটি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা কারো পক্ষে বা বিপক্ষে যাচ্ছি না। আমরা এমন কিছু করব না, যাতে মনে হতে পারে কেউ আমাদের ব্যবহার করছে।’

একটি অপ্রমাণিত অভিযোগের ভিত্তিতে ভারত পাকিস্তানে হামলা চালিয়েছে। একই ঘটনা তো বাংলাদেশেও ঘটতে পারে। বাংলাদেশ কেন এ ঘটনার নিন্দা জানাতে পারলে না- এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘এ ঘটনায় আমরা তো আমাদের গভীর উদ্বেগের কথা জানিয়েছি। বাংলাদেশ কোনো ধরনের সংঘাত দেখতে চায় না। দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়ে এমন যেকোনো পদক্ষেপের বিপক্ষে আমরা আমাদের অবস্থানের কথা জানিয়েছি।’

এমবি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত