ত্রুটি জেনেও অনুমোদন দেন শেখ হাসিনা
সোহাগ কুমার বিশ্বাস, চট্টগ্রাম
জলাবদ্ধতাকে বলা হয় চট্টগ্রামের অভিশাপ। আর এই অভিশাপকে পুঁজি করে একটি প্রকল্পেই সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা লুটপাটের আয়োজন করে আওয়ামী লীগ সরকার। চট্টগ্রাম ওয়াসার ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানকে কাটছাঁট করে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প নামের একটি থামরুল বা অনুমানভিত্তিক ডিপিপি একনেকে উপস্থাপন করেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সিডিএর সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুচ ছালাম।
একনেকের সভায় বড় এই প্রকল্পের ত্রুটি থাকার কথা জানানো হলেও তা ফেরত না পাঠিয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়ে নজিরবিহীনভাবে নিজস্ব ক্ষমতাবলে ত্রুটিগুলো সংশোধনে কয়েকটি অনুশাসন দিয়েই প্রকল্পের অনুমোদন দেন শেখ হাসিনা। শুরুতে তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পের ব্যয় ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা ধরা হয়। তবে দফায় দফায় সময় ও ব্যয় বাড়িয়ে সাত বছর পর করা হয়েছে ৮ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা। শতভাগ কাজ শেষ হওয়ার পর প্রকল্প ব্যয় ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান সিডিএ বলছে, সাত বছরে খাতা-কলমে ৭৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে কিন্তু ১ শতাংশও সুফল পায়নি সাধারণ মানুষ। এখনও প্রতি বছর আকাশে মেঘ দেখলেই আতঙ্কে থাকেন নগরবাসী। সামান্য বৃষ্টি ছাড়াও বর্ষা মৌসুমে অমাবস্যা, পূর্ণিমার ভরা জোয়ারে নিয়ম করে পানিতে তলিয়ে যায় বন্দর নগরী। নির্ধারিত মেয়াদের তিনগুণ সময় ও প্রথম পর্যায়ের বরাদ্দের চেয়ে বেশি টাকা খরচ করেও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান সিডিএ বলছে, সাধারণ মানুষ খালে ময়লা ফেলা বন্ধ না করলে প্রকল্পের সুফল পাওয়া সম্ভব নয়।
২০২০ সালের জুনে শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (একনেক) অনুমোদন করে ২০১৭ সালের আগস্টে। আদর করে যার নাম দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রাপ্ত চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প। প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ৩৬টি খাল সংস্কার, ড্রেনেজ লাইন নির্মাণ, গার্ডার ব্রিজ, কালভার্ট, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য জলাধার ও জোয়ারের পানি নগরে প্রবেশ ঠেকাতে স্লুইসগেট নির্মাণ।
দফায় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি
২০২০ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ে ৩০ শতাংশও শেষ করতে পারেনি সিডিএ। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকল্প ব্যয় এক লাফে দ্বিগুণ বাড়িয়ে ১০ হাজার ৪২০ কোটি টাকা ধরে সংশোধিত প্রস্তাবিত ডিপিপি উপস্থাপন করে প্রতিষ্ঠানটি। এক লাফে দ্বিগুণ ব্যয় বাড়ানোর যৌক্তিকতা নির্ণয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একটি তথাকথিত কমিটি তা কমিয়ে ৮ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা নির্ধারণ করে। পূর্ত মন্ত্রণালয়ের এই বরাদ্দ কমানোর প্রক্রিয়াকে আইওয়াশ বলে অভিহিত করেন সংশ্লিষ্টরা। সবশেষ তিন দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৬ সালের জুনে শেষ করার গল্প শোনাচ্ছে সিডিএ।
সিডিএর প্রকল্প ছিনতাই
বহুকাল ধরে জলাবদ্ধতা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। কিন্তু যে কোনো প্রকল্প করতে গেলে মোট টাকার ২৫ শতাংশ ‘ম্যাচিং ফান্ড’ হিসেবে করপোরেশনকে জোগান দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। আর এ কারণেই এতবড় প্রকল্প নিতে ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করে প্রতিষ্ঠানটি। এদিকে ২০১৪ সালের সাজানো নির্বাচনের পর থেকেই বড় এই প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহী হয়ে ওঠেন শেখ হাসিনা। তার আগ্রহের কথা জানতে পেরে আলাদা আলাদা প্রজেক্ট প্রোফাইল রেডি করে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও চট্টগ্রাম ওয়াসা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাস্টারপ্ল্যানে একদিকে কর্ণফুলী নদী অন্যদিকে বঙ্গোপসাগর আর শেষে হালদা নদীকে বেজ ধরে পরিকল্পনা সাজায় তারা। আর নগরীর ৫৭টি খাল ধরে ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান নামের আলাদা প্রকল্প তৈরি করে চট্টগ্রাম ওয়াসা। এর মধ্যে ওয়াসার প্রকল্পটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ে কিছুটা ছোট আর সহজ হওয়ায় ওই প্রকল্পটিই গুরুত্ব পায়।
ওয়াসা তাদের প্রকল্পে প্রস্তাবনা যুক্ত করতে প্ল্যানের কপি সিডিএ, সিটি করপোরেশন, বুয়েট, চুয়েট, চট্টগ্রাম বন্দর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে কপিও পাঠায়। এরই মাঝে মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে নিজেরা প্রকল্প বাস্তবায়ন করার প্রক্রিয়া থেকে সরে এসে মাস্টারপ্ল্যানটি সিটি করপোরেশনকে হস্তান্তর করে ওয়াসা। সে অনুযায়ী ম্যাচিং ফান্ড মওকুফ করাসহ অন্যান্য শর্ত শিথিল করতে মন্ত্রণালয়ে তদবিরও শুরু করে সিটি করপোরেশন। কিন্তু সবার অগোচরে ওয়াসার ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানকে কাটছাঁট করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোকে বাদ রেখে ঢাকার ডিপিএম নামের একটি কনসালটেন্ট প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প নামের একটি থামরুল ডিপিপি বানিয়ে জমা দেন সিডিএর তৎকালীন চেয়ারম্যান ও নগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আব্দুচ ছালাম। ২০১৭ সালের আগস্টে একনেকের সভায় হঠাৎ করেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রকল্পটি পাস হয়। সভা থেকেই বড় এই প্রকল্পে ত্রুটি আছে জানানো হলেও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ও তার আত্মীয় খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে প্রধান করে ত্রুটি সংশোধনের জন্য কয়েকটি অনুশাসন দিয়ে প্রকল্পটি পাস করে দেন। কিন্তু নিয়মানুযায়ী একনেকের সভায় প্রকল্পের ত্রুটি ধরা পড়লে তা সংশোধনের জন্য ফেরত পাঠানো হয়।
চট্টগ্রাম ওয়াসার সাবেক এমডি ইঞ্জিনিয়ার ফজলুল্লাহ জানান, চট্টগ্রামবাসীর দুরবস্থা ও সিটি করপোরেশনের আর্থিক সংগতি না থাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা নামে একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজ শুরু করে ওয়াসা। অন্যদিকে সিটি করপোরেশনও প্রকল্পটি পাস করানোর জন্য তোড়জোড় চালাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই ওয়াসার করা খসড়া ড্রেনেজ প্ল্যানকে ভিত্তি ধরে ডিপিপি প্রণয়ন করে অত্যন্ত গোপনে একনেকে সাবমিট করে সিডিএ। হঠাৎ করেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব ক্ষমতায় প্রকল্পটি সিডিএকে বাস্তবায়ন করার অনুমতিও দেয়। কোনো ধরনের অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও সিডিএকে কীভাবে এত বড় ও জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সেই রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি বলে জানান ফজলুল্লাহ।
সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প
মূলত চট্টগ্রাম ওয়াসার খসরা ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানকে ভিত ধরে প্রকল্পটি পাস করিয়ে নেয় সিডিএ। পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রকল্প পাসের আট মাস পরও কাজ শুরু করতে পারেনি সিডিএ। বাধ্য হয়ে ২০১৮ সালের ৯ এপ্রিল প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। একই বছর ২৮ এপ্রিল নালা-নর্দমা পরিষ্কারের মাধ্যমে প্রকল্পের কাজ শুরু করে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেড।
১৯৯৫ সালের মাস্টারপ্ল্যানকে উপেক্ষা করে নেওয়া প্রকল্পে যথাযথ পরিকল্পনাও ছিল না। আর এই কারণেই খাতা কলমে ৭৬ শতাংশ কাজ শেষ হলেও সুফল পাচ্ছে না নগরবাসী। সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের চট্টগ্রাম জেলা সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী জানান, বড় এই প্রকল্পটি বাগিয়ে নিতে সিডিএ, সিটি করপোরেশন ও ওয়াসা তিনটি প্রতিষ্ঠানই ছিল আগ্রহী। এর মধ্যে আন্ডার টেবিল ডিলিংসে এগিয়ে যায় সিডিএ। তিনটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা ওই সময়ের সরকারের আস্থাভাজন থাকায় কাজ বাগিয়ে নিতে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো। অনেকটা চুপিসারে তড়িঘড়ি করে নেওয়া প্রকল্পটিতে বিশেষজ্ঞের মতামত ছিল না। সম্ভাব্যতা যাচাই না করায় প্রকল্পের কাজ শুরুর পর একাধিকবার ঘষামাজা করতে হয়েছে নকশায়। ফলে প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে কমপক্ষে ৫৪ শতাংশ। সক্ষমতা ও অভিজ্ঞতা না থাকার পরও সিডিএকে দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করানোর ফলে পদে পদে জটিলতা দেখা দিয়েছে।
নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার জানান, ১৯৯৫ সালের মাস্টারপ্ল্যানে চট্টগ্রামে শতাধিক খালের অস্তিত্ব ছিল। এর বাইরে বাকুলিয়া, অনন্যা, হালিশহরসহ বেশ কিছু এলাকায় মোট ২২টি রিটেনশন পন্ড বা বড় আকারের জলাধার তৈরি করার কথা ছিল। সবচেয়ে ছোট জলাধারের আয়তন প্রস্তাব করা হয়েছিল দুই হেক্টর আর বড় আকারের জলাধার ১০ হেক্টরজুড়ে করার কথা ছিল। বৃষ্টির পানি এসব জলাধারে ধারণ করার পরিকল্পনা ছিল। তবে ওয়াসার কথিত মাস্টারপ্ল্যানে ছোট আকারের কয়েকটি নামকাওয়াস্তে জলাধার থাকলেও শুরুতেই অর্ধেক খাল বাদ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি হাতিয়ে নেওয়ার পর সিডিএ তার থেকে আরও ২১টি খালকে বাদ দিয়ে মাত্র ৩৬টি খালের ওপর প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে। শতভাগ এলাকা টার্গেট করে কাজ করলেও ফলাফল ৮০ শতাংশের ওপরে পাওয়া যায় না। সেখানে মাত্র ৩০ শতাংশের কিছু বেশি টার্গেট করে কাজ করা হচ্ছে তাই সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ।
খাল বাছাই প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রণয়ন করা ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানে ৫৭টি খাল সংস্কারের কথা স্বীকার করেছে। কিন্তু সিডিএর ডিপিপিতে ৩৬টি খাল বাছাই করা হয়েছে। এসব খালগুলো হলো চাক্তাই খাল, মহেশ খাল, হিজড়া খাল, নোয়া খাল, রামপুর খাল, ডোমখালী খাল, মির্জা খাল, নাসির খাল, রাজাখালী খাল-১, রাজাখালী খাল-২, রাজাখালী খাল-৩, চাক্তাই ডাইভারশন খাল, মহেশখালী খাল, বির্জা খাল, বাকলিয়া খাল, মরিয়ম বিবি খাল, জামালখান খাল, ফিরিঙ্গিবাজার খাল, কলাবাগিচা খাল, সদরঘাট খাল-১, সদরঘাট খাল-২, বামন শাহী খাল, বদরখালী খাল, শীতল ঝর্ণা খাল, ত্রিপুরা খাল, নয়ারহাট খাল, মোঘলটুলি খাল, গুপ্তা খাল, রুবী সিমেন্ট ফ্যাক্টরি খাল, উত্তরা খাল, খন্দকিয়া খাল, টেকপাড়া খাল, আজব বাহার খাল, গয়না ছড়া খাল, চশমা খাল ও ১৫ নং ঘাট বিমানবন্দর খাল। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান সিডিএর তখনকার চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম দাবি করেছিলেন জলাবদ্ধতা প্রবণ এলাকাগুলোকে টার্গেট করে ওইসব এলাকার খালগুলোকেই প্রকল্পে বাছাই করা হয়েছে। কিন্তু সিডিএর প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে জানান, সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুচ ছালাম আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকলেও আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র আ জ ম নাছিরসহ প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে দূরত্ব ছিল। তাই ওইসব নেতার আধিপত্যসম্পন্ন এলাকাগুলোকে বাদ রাখা হয়েছে। এ ছাড়া বড় কোনো প্রতিষ্ঠান যেমন চট্টগ্রাম বন্দর সংলগ্ন বিশাল এলাকার মধ্যে শুধু মহেশখাল ছাড়া অন্য কোনো বড় বা সেকেন্ডারি খালগুলোকেও প্রকল্পের আওতায় রাখা হয়নি। কারণ, জমি অধিগ্রহণসহ নানা কারণে বন্দরের সঙ্গে বিরোধে জড়ানোর আশঙ্কাকে মাথায় রেখেছিলেন সিডিএর চেয়ারম্যান। অর্থাৎ জলাবদ্ধতা নিরসনের চেয়ে যেনতেনভাবে প্রকল্প সম্পন্ন করার টার্গেট নিয়েই প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
বৃষ্টি ছাড়াও জোয়ারের পানি নগরে প্রবেশ করা স্বাভাবিক ঘটনা। তাই শুধু বৃষ্টির পানিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতাই নয় জোয়ারের পানি আটকাতে প্রকল্পটির আওতায় সব খালের মুখে টাইডাল রেগুলেটার স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
প্রকল্প এখন মৃত্যুফাঁদ
২০২১ সাল থেকে গত চার বছরে কোনো ধরনের নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়া চলমান জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কারণে অন্তত ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর ওপর নতুন ঝুঁকি হিসেবে যুক্ত হয়েছে সিল ট্র্যাপ নামের নতুন ফাঁদ। বৃষ্টির পানির সঙ্গে নেমে আসা পাহাড়ি বালি ও পলি ঠেকাতে ২৭টি বড় খালের নির্দিষ্ট পয়েন্টে ২১ থেকে ২৪ ফুট গভীরতার ২০ থেকে ২৫ ফুট করে লম্বা ও চওড়া গর্ত করে রাখা হয়েছে। নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় বর্ষা মৌসুমে এসব সিল ট্রাপ আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, নালাগুলো অরক্ষিত থাকায় বৃষ্টি হলে কিংবা জোয়ারের পানি ঢুকে রাস্তাগুলো পানিতে তলিয়ে নালা-নর্দমার সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। এ সময় চলাচল করতে গিয়ে সেগুলো চোখে না পড়ায় সেখানে পড়ে মৃত্যু হচ্ছে নগরবাসীর। বৃষ্টির সময় নগরীর অন্তত ৭০ শতাংশ এলাকা পানিতে ডুবে থাকায় সময়মতো উদ্ধারকারী দলও পৌঁছতে পারে না ঘটনাস্থলে।
সামাজিক বিপর্যয়
খালের গভীরতা না বাড়িয়ে দিয়ে ক্রমাগতভাবে স্থানভেদে সড়ক ও কালভার্টের উচ্চতা বাড়ানো হয়েছে ৫-৮ ফুট পর্যন্ত। এতে করে চট্টগ্রামের বেশির ভাগ আবাসিক এলাকার ঘরবাড়ির নিচতলা রাস্তার নিচে চলে গেছে। তাই বর্ষার পানি ঘরে ঢুকে পড়ছে হরহামেশা। রাস্তা ও নালার উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে এলাকাগুলো জলমগ্ন হয়ে থাকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত। তাই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সম্পদ বণ্টন নিয়ে সারা বছর চলে পারিবারিক দ্বন্দ্ব।
বিশেষজ্ঞ মত
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সভাপতি ইস্ট ডেলটা ইউনিভার্সিটির সাবেক উপাচার্য মুহম্মদ সিকান্দার খান জানান, সেনাবাহিনীকে ডেকে কাজের ড্রয়িং ডিজাইন ধরিয়ে দিয়েছে তারা সে কাজটুকু করেছে। অনেক খালের দুই পাশের অবৈধ স্থাপনা ভাঙা হয়েছে দুপারে রিটেইনিং ওয়াল করে পানি চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও বিভিন্ন পয়েন্টে জলাবদ্ধতা হচ্ছে। কারণ, খালে পানি নামার ব্যবস্থাটা নিশ্চিত করা যায়নি। আর এটি করতে হলে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি টিম করে গবেষণা করে ভুক্তভোগীদের মতামতের ভিত্তিতে নতুন পরিকল্পনা নিতে হবে।
সিটি মেয়রের বক্তব্য
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নতুন মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন জানান, আগের সরকার শুধু ব্যবসাকে মাথায় রেখে লুটপাট করতেই এই প্রকল্পটি নিয়েছিল। ওয়াসার মাস্টারপ্ল্যান থেকে যে ২১টি খাল বাদ দেওয়া হয়েছে সেগুলো অন্তর্ভুক্ত না হলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। এই বিষয়টিতে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে বার্তা পাঠানো হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে সমাধানের পথ খুঁজতে সরকারের চারজন উপদেষ্টা শিগগিরি চট্টগ্রামে আসবেন। বাদ পড়া খালগুলো অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি সবপক্ষের সঙ্গে সমন্বয়ের উদ্যোগ নেবেন তারা। এটা কার্যকর করা গেলে সুফল পাওয়া যাবে বলেও জানান তিনি।
প্রকল্প ছেড়ে দিতে চান সিডিএর বর্তমান চেয়ারম্যান
সিডিএর চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল করিম জানান, জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব সিডিএর নয়। বিগত সরকার কোন কারণে এই প্রকল্পের কাজ সিডিএকে দিয়েছে, সিডিএ এই কাজ নিয়েছে কেন- সে বিষয়টিই একটি বড় রহস্য। অন্তর্বর্তী সরকার চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে আগ্রহী। তাই বাদ পড়া ২১টি খাল নিয়ে নতুন প্রকল্প তৈরি করার আগ্রহ আছে সরকারের কিন্তু সিডিএ আর এমন প্রকল্প নিতে আগ্রহী নয় বলে জানান তিনি। তবে যতটুকু কাজ হয়েছে তার সবটুকু কাজে লাগানো গেলে প্রকল্পের সুফল আসবে।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান প্রকৌশলী হাসান বিন শামস জানান, প্রতিদিন ৩২ লাখ টন ময়লা উৎপাদন হয় নগরীতে। এর মধ্যে ১০ লাখ টন সিটি করপোরেশন সংগ্রহ করে। বাকি প্রায় ২২ লাখ টন ময়লা নালা-নর্দমা হয়ে খালে পড়ে। ময়লা ফেলা বন্ধ না করতে পারলে লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেও কোনো লাভ হবে না।
সম্পাদনা: ইলিয়াস
জলাবদ্ধতাকে বলা হয় চট্টগ্রামের অভিশাপ। আর এই অভিশাপকে পুঁজি করে একটি প্রকল্পেই সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা লুটপাটের আয়োজন করে আওয়ামী লীগ সরকার। চট্টগ্রাম ওয়াসার ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানকে কাটছাঁট করে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প নামের একটি থামরুল বা অনুমানভিত্তিক ডিপিপি একনেকে উপস্থাপন করেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সিডিএর সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুচ ছালাম।
একনেকের সভায় বড় এই প্রকল্পের ত্রুটি থাকার কথা জানানো হলেও তা ফেরত না পাঠিয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়ে নজিরবিহীনভাবে নিজস্ব ক্ষমতাবলে ত্রুটিগুলো সংশোধনে কয়েকটি অনুশাসন দিয়েই প্রকল্পের অনুমোদন দেন শেখ হাসিনা। শুরুতে তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পের ব্যয় ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা ধরা হয়। তবে দফায় দফায় সময় ও ব্যয় বাড়িয়ে সাত বছর পর করা হয়েছে ৮ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা। শতভাগ কাজ শেষ হওয়ার পর প্রকল্প ব্যয় ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান সিডিএ বলছে, সাত বছরে খাতা-কলমে ৭৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে কিন্তু ১ শতাংশও সুফল পায়নি সাধারণ মানুষ। এখনও প্রতি বছর আকাশে মেঘ দেখলেই আতঙ্কে থাকেন নগরবাসী। সামান্য বৃষ্টি ছাড়াও বর্ষা মৌসুমে অমাবস্যা, পূর্ণিমার ভরা জোয়ারে নিয়ম করে পানিতে তলিয়ে যায় বন্দর নগরী। নির্ধারিত মেয়াদের তিনগুণ সময় ও প্রথম পর্যায়ের বরাদ্দের চেয়ে বেশি টাকা খরচ করেও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান সিডিএ বলছে, সাধারণ মানুষ খালে ময়লা ফেলা বন্ধ না করলে প্রকল্পের সুফল পাওয়া সম্ভব নয়।
২০২০ সালের জুনে শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (একনেক) অনুমোদন করে ২০১৭ সালের আগস্টে। আদর করে যার নাম দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রাপ্ত চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প। প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ৩৬টি খাল সংস্কার, ড্রেনেজ লাইন নির্মাণ, গার্ডার ব্রিজ, কালভার্ট, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য জলাধার ও জোয়ারের পানি নগরে প্রবেশ ঠেকাতে স্লুইসগেট নির্মাণ।
দফায় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি
২০২০ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ে ৩০ শতাংশও শেষ করতে পারেনি সিডিএ। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকল্প ব্যয় এক লাফে দ্বিগুণ বাড়িয়ে ১০ হাজার ৪২০ কোটি টাকা ধরে সংশোধিত প্রস্তাবিত ডিপিপি উপস্থাপন করে প্রতিষ্ঠানটি। এক লাফে দ্বিগুণ ব্যয় বাড়ানোর যৌক্তিকতা নির্ণয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একটি তথাকথিত কমিটি তা কমিয়ে ৮ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা নির্ধারণ করে। পূর্ত মন্ত্রণালয়ের এই বরাদ্দ কমানোর প্রক্রিয়াকে আইওয়াশ বলে অভিহিত করেন সংশ্লিষ্টরা। সবশেষ তিন দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৬ সালের জুনে শেষ করার গল্প শোনাচ্ছে সিডিএ।
সিডিএর প্রকল্প ছিনতাই
বহুকাল ধরে জলাবদ্ধতা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। কিন্তু যে কোনো প্রকল্প করতে গেলে মোট টাকার ২৫ শতাংশ ‘ম্যাচিং ফান্ড’ হিসেবে করপোরেশনকে জোগান দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। আর এ কারণেই এতবড় প্রকল্প নিতে ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করে প্রতিষ্ঠানটি। এদিকে ২০১৪ সালের সাজানো নির্বাচনের পর থেকেই বড় এই প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহী হয়ে ওঠেন শেখ হাসিনা। তার আগ্রহের কথা জানতে পেরে আলাদা আলাদা প্রজেক্ট প্রোফাইল রেডি করে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও চট্টগ্রাম ওয়াসা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাস্টারপ্ল্যানে একদিকে কর্ণফুলী নদী অন্যদিকে বঙ্গোপসাগর আর শেষে হালদা নদীকে বেজ ধরে পরিকল্পনা সাজায় তারা। আর নগরীর ৫৭টি খাল ধরে ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান নামের আলাদা প্রকল্প তৈরি করে চট্টগ্রাম ওয়াসা। এর মধ্যে ওয়াসার প্রকল্পটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ে কিছুটা ছোট আর সহজ হওয়ায় ওই প্রকল্পটিই গুরুত্ব পায়।
ওয়াসা তাদের প্রকল্পে প্রস্তাবনা যুক্ত করতে প্ল্যানের কপি সিডিএ, সিটি করপোরেশন, বুয়েট, চুয়েট, চট্টগ্রাম বন্দর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে কপিও পাঠায়। এরই মাঝে মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে নিজেরা প্রকল্প বাস্তবায়ন করার প্রক্রিয়া থেকে সরে এসে মাস্টারপ্ল্যানটি সিটি করপোরেশনকে হস্তান্তর করে ওয়াসা। সে অনুযায়ী ম্যাচিং ফান্ড মওকুফ করাসহ অন্যান্য শর্ত শিথিল করতে মন্ত্রণালয়ে তদবিরও শুরু করে সিটি করপোরেশন। কিন্তু সবার অগোচরে ওয়াসার ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানকে কাটছাঁট করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোকে বাদ রেখে ঢাকার ডিপিএম নামের একটি কনসালটেন্ট প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প নামের একটি থামরুল ডিপিপি বানিয়ে জমা দেন সিডিএর তৎকালীন চেয়ারম্যান ও নগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আব্দুচ ছালাম। ২০১৭ সালের আগস্টে একনেকের সভায় হঠাৎ করেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রকল্পটি পাস হয়। সভা থেকেই বড় এই প্রকল্পে ত্রুটি আছে জানানো হলেও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ও তার আত্মীয় খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে প্রধান করে ত্রুটি সংশোধনের জন্য কয়েকটি অনুশাসন দিয়ে প্রকল্পটি পাস করে দেন। কিন্তু নিয়মানুযায়ী একনেকের সভায় প্রকল্পের ত্রুটি ধরা পড়লে তা সংশোধনের জন্য ফেরত পাঠানো হয়।
চট্টগ্রাম ওয়াসার সাবেক এমডি ইঞ্জিনিয়ার ফজলুল্লাহ জানান, চট্টগ্রামবাসীর দুরবস্থা ও সিটি করপোরেশনের আর্থিক সংগতি না থাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা নামে একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজ শুরু করে ওয়াসা। অন্যদিকে সিটি করপোরেশনও প্রকল্পটি পাস করানোর জন্য তোড়জোড় চালাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই ওয়াসার করা খসড়া ড্রেনেজ প্ল্যানকে ভিত্তি ধরে ডিপিপি প্রণয়ন করে অত্যন্ত গোপনে একনেকে সাবমিট করে সিডিএ। হঠাৎ করেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব ক্ষমতায় প্রকল্পটি সিডিএকে বাস্তবায়ন করার অনুমতিও দেয়। কোনো ধরনের অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও সিডিএকে কীভাবে এত বড় ও জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সেই রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি বলে জানান ফজলুল্লাহ।
সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প
মূলত চট্টগ্রাম ওয়াসার খসরা ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানকে ভিত ধরে প্রকল্পটি পাস করিয়ে নেয় সিডিএ। পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রকল্প পাসের আট মাস পরও কাজ শুরু করতে পারেনি সিডিএ। বাধ্য হয়ে ২০১৮ সালের ৯ এপ্রিল প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। একই বছর ২৮ এপ্রিল নালা-নর্দমা পরিষ্কারের মাধ্যমে প্রকল্পের কাজ শুরু করে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেড।
১৯৯৫ সালের মাস্টারপ্ল্যানকে উপেক্ষা করে নেওয়া প্রকল্পে যথাযথ পরিকল্পনাও ছিল না। আর এই কারণেই খাতা কলমে ৭৬ শতাংশ কাজ শেষ হলেও সুফল পাচ্ছে না নগরবাসী। সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের চট্টগ্রাম জেলা সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী জানান, বড় এই প্রকল্পটি বাগিয়ে নিতে সিডিএ, সিটি করপোরেশন ও ওয়াসা তিনটি প্রতিষ্ঠানই ছিল আগ্রহী। এর মধ্যে আন্ডার টেবিল ডিলিংসে এগিয়ে যায় সিডিএ। তিনটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা ওই সময়ের সরকারের আস্থাভাজন থাকায় কাজ বাগিয়ে নিতে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো। অনেকটা চুপিসারে তড়িঘড়ি করে নেওয়া প্রকল্পটিতে বিশেষজ্ঞের মতামত ছিল না। সম্ভাব্যতা যাচাই না করায় প্রকল্পের কাজ শুরুর পর একাধিকবার ঘষামাজা করতে হয়েছে নকশায়। ফলে প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে কমপক্ষে ৫৪ শতাংশ। সক্ষমতা ও অভিজ্ঞতা না থাকার পরও সিডিএকে দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করানোর ফলে পদে পদে জটিলতা দেখা দিয়েছে।
নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার জানান, ১৯৯৫ সালের মাস্টারপ্ল্যানে চট্টগ্রামে শতাধিক খালের অস্তিত্ব ছিল। এর বাইরে বাকুলিয়া, অনন্যা, হালিশহরসহ বেশ কিছু এলাকায় মোট ২২টি রিটেনশন পন্ড বা বড় আকারের জলাধার তৈরি করার কথা ছিল। সবচেয়ে ছোট জলাধারের আয়তন প্রস্তাব করা হয়েছিল দুই হেক্টর আর বড় আকারের জলাধার ১০ হেক্টরজুড়ে করার কথা ছিল। বৃষ্টির পানি এসব জলাধারে ধারণ করার পরিকল্পনা ছিল। তবে ওয়াসার কথিত মাস্টারপ্ল্যানে ছোট আকারের কয়েকটি নামকাওয়াস্তে জলাধার থাকলেও শুরুতেই অর্ধেক খাল বাদ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি হাতিয়ে নেওয়ার পর সিডিএ তার থেকে আরও ২১টি খালকে বাদ দিয়ে মাত্র ৩৬টি খালের ওপর প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে। শতভাগ এলাকা টার্গেট করে কাজ করলেও ফলাফল ৮০ শতাংশের ওপরে পাওয়া যায় না। সেখানে মাত্র ৩০ শতাংশের কিছু বেশি টার্গেট করে কাজ করা হচ্ছে তাই সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ।
খাল বাছাই প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রণয়ন করা ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানে ৫৭টি খাল সংস্কারের কথা স্বীকার করেছে। কিন্তু সিডিএর ডিপিপিতে ৩৬টি খাল বাছাই করা হয়েছে। এসব খালগুলো হলো চাক্তাই খাল, মহেশ খাল, হিজড়া খাল, নোয়া খাল, রামপুর খাল, ডোমখালী খাল, মির্জা খাল, নাসির খাল, রাজাখালী খাল-১, রাজাখালী খাল-২, রাজাখালী খাল-৩, চাক্তাই ডাইভারশন খাল, মহেশখালী খাল, বির্জা খাল, বাকলিয়া খাল, মরিয়ম বিবি খাল, জামালখান খাল, ফিরিঙ্গিবাজার খাল, কলাবাগিচা খাল, সদরঘাট খাল-১, সদরঘাট খাল-২, বামন শাহী খাল, বদরখালী খাল, শীতল ঝর্ণা খাল, ত্রিপুরা খাল, নয়ারহাট খাল, মোঘলটুলি খাল, গুপ্তা খাল, রুবী সিমেন্ট ফ্যাক্টরি খাল, উত্তরা খাল, খন্দকিয়া খাল, টেকপাড়া খাল, আজব বাহার খাল, গয়না ছড়া খাল, চশমা খাল ও ১৫ নং ঘাট বিমানবন্দর খাল। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান সিডিএর তখনকার চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম দাবি করেছিলেন জলাবদ্ধতা প্রবণ এলাকাগুলোকে টার্গেট করে ওইসব এলাকার খালগুলোকেই প্রকল্পে বাছাই করা হয়েছে। কিন্তু সিডিএর প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে জানান, সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুচ ছালাম আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকলেও আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র আ জ ম নাছিরসহ প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে দূরত্ব ছিল। তাই ওইসব নেতার আধিপত্যসম্পন্ন এলাকাগুলোকে বাদ রাখা হয়েছে। এ ছাড়া বড় কোনো প্রতিষ্ঠান যেমন চট্টগ্রাম বন্দর সংলগ্ন বিশাল এলাকার মধ্যে শুধু মহেশখাল ছাড়া অন্য কোনো বড় বা সেকেন্ডারি খালগুলোকেও প্রকল্পের আওতায় রাখা হয়নি। কারণ, জমি অধিগ্রহণসহ নানা কারণে বন্দরের সঙ্গে বিরোধে জড়ানোর আশঙ্কাকে মাথায় রেখেছিলেন সিডিএর চেয়ারম্যান। অর্থাৎ জলাবদ্ধতা নিরসনের চেয়ে যেনতেনভাবে প্রকল্প সম্পন্ন করার টার্গেট নিয়েই প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
বৃষ্টি ছাড়াও জোয়ারের পানি নগরে প্রবেশ করা স্বাভাবিক ঘটনা। তাই শুধু বৃষ্টির পানিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতাই নয় জোয়ারের পানি আটকাতে প্রকল্পটির আওতায় সব খালের মুখে টাইডাল রেগুলেটার স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
প্রকল্প এখন মৃত্যুফাঁদ
২০২১ সাল থেকে গত চার বছরে কোনো ধরনের নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়া চলমান জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কারণে অন্তত ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর ওপর নতুন ঝুঁকি হিসেবে যুক্ত হয়েছে সিল ট্র্যাপ নামের নতুন ফাঁদ। বৃষ্টির পানির সঙ্গে নেমে আসা পাহাড়ি বালি ও পলি ঠেকাতে ২৭টি বড় খালের নির্দিষ্ট পয়েন্টে ২১ থেকে ২৪ ফুট গভীরতার ২০ থেকে ২৫ ফুট করে লম্বা ও চওড়া গর্ত করে রাখা হয়েছে। নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় বর্ষা মৌসুমে এসব সিল ট্রাপ আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, নালাগুলো অরক্ষিত থাকায় বৃষ্টি হলে কিংবা জোয়ারের পানি ঢুকে রাস্তাগুলো পানিতে তলিয়ে নালা-নর্দমার সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। এ সময় চলাচল করতে গিয়ে সেগুলো চোখে না পড়ায় সেখানে পড়ে মৃত্যু হচ্ছে নগরবাসীর। বৃষ্টির সময় নগরীর অন্তত ৭০ শতাংশ এলাকা পানিতে ডুবে থাকায় সময়মতো উদ্ধারকারী দলও পৌঁছতে পারে না ঘটনাস্থলে।
সামাজিক বিপর্যয়
খালের গভীরতা না বাড়িয়ে দিয়ে ক্রমাগতভাবে স্থানভেদে সড়ক ও কালভার্টের উচ্চতা বাড়ানো হয়েছে ৫-৮ ফুট পর্যন্ত। এতে করে চট্টগ্রামের বেশির ভাগ আবাসিক এলাকার ঘরবাড়ির নিচতলা রাস্তার নিচে চলে গেছে। তাই বর্ষার পানি ঘরে ঢুকে পড়ছে হরহামেশা। রাস্তা ও নালার উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে এলাকাগুলো জলমগ্ন হয়ে থাকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত। তাই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সম্পদ বণ্টন নিয়ে সারা বছর চলে পারিবারিক দ্বন্দ্ব।
বিশেষজ্ঞ মত
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সভাপতি ইস্ট ডেলটা ইউনিভার্সিটির সাবেক উপাচার্য মুহম্মদ সিকান্দার খান জানান, সেনাবাহিনীকে ডেকে কাজের ড্রয়িং ডিজাইন ধরিয়ে দিয়েছে তারা সে কাজটুকু করেছে। অনেক খালের দুই পাশের অবৈধ স্থাপনা ভাঙা হয়েছে দুপারে রিটেইনিং ওয়াল করে পানি চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও বিভিন্ন পয়েন্টে জলাবদ্ধতা হচ্ছে। কারণ, খালে পানি নামার ব্যবস্থাটা নিশ্চিত করা যায়নি। আর এটি করতে হলে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি টিম করে গবেষণা করে ভুক্তভোগীদের মতামতের ভিত্তিতে নতুন পরিকল্পনা নিতে হবে।
সিটি মেয়রের বক্তব্য
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নতুন মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন জানান, আগের সরকার শুধু ব্যবসাকে মাথায় রেখে লুটপাট করতেই এই প্রকল্পটি নিয়েছিল। ওয়াসার মাস্টারপ্ল্যান থেকে যে ২১টি খাল বাদ দেওয়া হয়েছে সেগুলো অন্তর্ভুক্ত না হলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। এই বিষয়টিতে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে বার্তা পাঠানো হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে সমাধানের পথ খুঁজতে সরকারের চারজন উপদেষ্টা শিগগিরি চট্টগ্রামে আসবেন। বাদ পড়া খালগুলো অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি সবপক্ষের সঙ্গে সমন্বয়ের উদ্যোগ নেবেন তারা। এটা কার্যকর করা গেলে সুফল পাওয়া যাবে বলেও জানান তিনি।
প্রকল্প ছেড়ে দিতে চান সিডিএর বর্তমান চেয়ারম্যান
সিডিএর চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল করিম জানান, জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব সিডিএর নয়। বিগত সরকার কোন কারণে এই প্রকল্পের কাজ সিডিএকে দিয়েছে, সিডিএ এই কাজ নিয়েছে কেন- সে বিষয়টিই একটি বড় রহস্য। অন্তর্বর্তী সরকার চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে আগ্রহী। তাই বাদ পড়া ২১টি খাল নিয়ে নতুন প্রকল্প তৈরি করার আগ্রহ আছে সরকারের কিন্তু সিডিএ আর এমন প্রকল্প নিতে আগ্রহী নয় বলে জানান তিনি। তবে যতটুকু কাজ হয়েছে তার সবটুকু কাজে লাগানো গেলে প্রকল্পের সুফল আসবে।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান প্রকৌশলী হাসান বিন শামস জানান, প্রতিদিন ৩২ লাখ টন ময়লা উৎপাদন হয় নগরীতে। এর মধ্যে ১০ লাখ টন সিটি করপোরেশন সংগ্রহ করে। বাকি প্রায় ২২ লাখ টন ময়লা নালা-নর্দমা হয়ে খালে পড়ে। ময়লা ফেলা বন্ধ না করতে পারলে লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেও কোনো লাভ হবে না।
সম্পাদনা: ইলিয়াস
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে বিভিন্ন মেরূকরণ। এ নির্বাচনে কোন দল ক্ষমতায় আসবে, কোন দল কার সঙ্গে সমঝোতা বা জোট করে ভোট করবেÑএসব বিষয় নিয়ে আলোচনা ও তৎপরতাও জোরদার হচ্ছে। বিশেষ করে ইসলামি দলগুলোকে নিয়ে সাধারণ ভোটারদের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মহলে বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
৬ ঘণ্টা আগেনীলের দেশখ্যাত নীলফামারী দীর্ঘদিন শোষণ করেছিল ইংরেজরা। তাদের স্থানীয় নিপীড়ক নীলকরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিলেন উত্তরের এই জেলার চাষিরা। ২০০ বছর পর সেই নিষ্ঠুর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করেন আওয়ামী ‘কসাই’খ্যাত আসাদুজ্জামান নূর।
১১ ঘণ্টা আগেআগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনায় জেলা প্রশাসকদেরই (ডিসি) রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ হিসেবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকার দুজন বিভাগীয় কমিশনার এবং ৬৪ জন ডিসিসহ ৬৬ জন রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে।
১ দিন আগেবছরের প্রায় ১০ মাস পার হলেও মাধ্যমিক স্তরের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ শুরু হয়নি। এমনকি পাঠ্যবইয়ের কনটেন্টও পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি; এখনো চলছে পরিবর্তন-পরিমার্জনের কাজ। এছাড়া ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনও মেলেনি এখনো।
১ দিন আগে