বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট এখন গলার কাঁটা

আল-আমিন
প্রকাশ : ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮: ৩৭
আপডেট : ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯: ১৮

অনেক হাঁকডাক ও বহু সুবিধার কথা বলে গাজীপুর থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প শুরু করে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকার। প্রথমে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। পরে পাঁচ দফা ব্যয় বাড়িয়ে চার হাজার ২৬৮ কোটি টাকায় নেওয়া হয়েছে।

প্রকল্পটি নেওয়ার সময় বলা হয়, এটির মাধ্যমে ওই পথে চলাচলকারী যাত্রীদের দ্রুত যাওয়া-আসা, যানজটের ভোগান্তি দূর, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো ও ফুটপাতে পথচারীদের নির্বিঘ্নে হাঁটাচলায় সুফল আসবে। কিন্তু সুফল তো দূরের কথা, বরং এটিই এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে যাত্রী ও পথচারীদের কাছে। যানজট তো কমেইনি, উলটো এই প্রকল্পের কারণে মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে।

বিজ্ঞাপন

এদিকে প্রকল্পের ঢাউস পিলারের কারণে নিচের সড়ক হয়ে গেছে আরো সংকীর্ণ। কমেছে ফুটপাতের প্রশস্ততা। যানজট শুরু হলে পথচারীদের মূল সড়ক দিয়ে হাঁটতে হয়। এতে ঘটছে দুর্ঘটনা। গাড়ি চলাচলের মাত্রা বাড়লেও নিচে যানজটের পাশাপাশি উড়াল সড়কের ওপরেও যানজট দেখা দেয়। স্টেশনের ভুল নকশার কারণে সড়কের একপাশে নেমে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রকল্পের মাঝের স্টেশনে যেতে হয় যাত্রীদের। এতে বাসগুলো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। ফ্লাইওভার থেকে নামার সময় ভুল স্থানে ইউটার্ন হওয়ায় যানজট বেড়েছে আরো। অগোছালো-অপরিকল্পিত ওই প্রকল্পের জন্য বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন উত্তরা ও টঙ্গীর বাসিন্দারা।

এদিকে প্রকল্পের সুফল না পাওয়ায় পুরো টাকাই জলে যাওয়ার আশঙ্কা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এটি সেবার জন্য নয়, বরং উন্নয়ন দেখানোর নামে জনগণকে ধোঁকা দেওয়া হয়েছে।

প্রকল্পের সুফল পাচ্ছে কি জনগণ-এমন প্রশ্ন শুনে গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্টের (বিআরটি, গাজীপুর-এয়ারপোর্ট) নামের এই প্রকল্পের সমন্বয়ক নাফিউল হাসান বলেন, ‘পরে যোগাযোগ করিয়েন।’ আর প্রকল্প পরিচালক আবুল হোসেনকে টানা দুই দিন ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। খুদে বার্তা পাঠালেও কোনো উত্তর দেননি তিনি।

প্রকল্পটির বিষয়ে বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক আমার দেশকে জানান, ‘টঙ্গীর বাস র‌্যাপিড ট্রানজিটের কারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক ধ্বংস হয়েছে। এটি আর উদ্ধার করা যাবে না। তবে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে এবং শাস্তি দিতে হবে। তিনি বলেন, শাস্তি এজন্য তাদের দিতে হবে, যাতে এই ভুল কাজের শাস্তি দৃষ্টান্ত হিসেবে থাকে এবং ভবিষ্যতে এমন সড়ক ও পরিবেশবিধ্বংসী প্রকল্প যেন কেউ হাতে না নেয়।

ড. শামসুল হক আরো বলেন, কোনো শিল্প এলাকার মধ্য দিয়ে বাস ট্রানজিট হয় না। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের যারা বিশেষজ্ঞ আছেন তারা বিষয়টি জানেন। তাদেরও বিষয়টি জিজ্ঞেস করতে হবে-কেন আপনারা এমন প্রকল্পে অর্থায়ন করেছেন। এই প্রকল্প উন্নয়নের নামে মানুষকে যন্ত্রণা দেওয়ার জন্য করা হয়েছে।

বিআরটি সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুর সিটি করপোরেশন ও ঢাকা সিটির মধ্যে যোগাযোগ দ্রুত করার জন্য এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ২০১০ সালে প্রকল্পের সমীক্ষা চালানো হয়। ২০১২ সালের ১ ডিসেম্বর একনেকে বিআরটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০১১ সালে গাজীপুর আওয়ামী লীগের নেতা আজমত উল্লাহ খান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি চিঠি লেখেন। আর একনেকে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব এম এ এন ছিদ্দিক।

সূত্র জানায়, শুরুতে ব্যয় ধরা হয় দুই হাজার ৩৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নকাল পাঁচবার বাড়িয়ে এর সর্বমোট ব্যয় হয়েছে চার হাজার ২৬৮ কোটি টাকা ৩২ লাখ টাকা। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ফরাসি দাতা সংস্থা (এএফডি), গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি (জিইএফ) ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান অস্ট্রেলিয়ার এসএমইসি ইন্টারন্যাশনাল প্রোপ্রাইটরি লিমিটেড। আর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়নার গ্যাঝুবা গ্রুপ করপোরেশন।

প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল যানজট কমিয়ে যাতায়াতের সুবিধা বাড়ানো এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানজট কমানো। কিন্তু সেখানে উলটোটি হয়েছে। প্রকল্প শুরুর পর নির্মাণকাজে ধীরগতি ও একাধিক দুর্ঘটনার কারণে বিভিন্ন সময় সমালোচিত হয়েছে অতি উৎসাহী প্রকল্পটি। পতিত সরকারের সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও প্রকল্পটিকে ‘গলার কাঁটা’ হিসেবে একাধিকবার উল্লেখ করেছেন।

গতকাল বিকালে উত্তরা ও টঙ্গী এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, প্রকল্পের কারণে পুরো সড়ক সংকুচিত হয়েছে। আগে সড়কটি ১০০ ফুট ছিল। সড়কের মধ্য দিয়ে আলাদা চার লেনের বিআরটি সড়ক তৈরি করার কারণে এতে দুই পাশে মাত্র ২২ ফুট করে সড়ক রয়েছে। কোনো মহাসড়ক এত কম প্রশস্ত হয় না। দুই পাশের সড়ক সংকীর্ণ হয়ে যাওয়ায় ওই এলাকায় যানজট লেগেই থাকে।

ওই পথে চলাচলকারী যাত্রীদের বাসে উঠতে দুই ধারের ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা অতিক্রম করে ৬৯টি সিঁড়ি বেয়ে উপরের স্টেশনে উঠতে হয়। বিমানবন্দর থেকে টঙ্গীর দিকে একটি পেট্রোল পাম্পের সামনে ভুল ইউটার্নের কারণে সেখানে জ্যাম লেগেই থাকে। এতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন যাত্রী ও পথচারীরা। প্রকল্পের সুফল না পাওয়ায় পুরো টাকা জলে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

টঙ্গীর স্থানীয় বাসিন্দা ও পোশাক কারখানার মালিক সবুজ জানান, টঙ্গীতে অনেক পোশাক কারখানা রয়েছে। এসব কারখানার শ্রমিকদের চলাচল করার জন্য পর্যাপ্ত ফুটপাত রাখা হয়নি। বয়স্ক লোকজন সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে পারেন না। টঙ্গী কলেজের শিক্ষার্থী রাকিব বলেন, বলা হয়েছিল প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে এই এলাকায় যানজট থাকবে না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, দিন দিন তা বাড়ছে। সরকার আমাদের মিথ্যা গল্প শুনিয়েছে।

বাসচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, সড়কে ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকে। কেউ পরিষ্কার করে না। সকালে যাত্রীর চাপ বেশি থাকে। কিন্তু ওই সময় বেশি যানজট দেখা যায়।

এমবি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত