৪জি-৫জি বিস্তারে অচলাবস্থা বিপর্যয়ের মুখে টেলিকম খাত

আবু সুফিয়ান
প্রকাশ : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯: ২২

বিপর্যয়ের মুখে দেশের টেলিকম খাত। মোবাইল টেলিকম সেবার জন্য সবচেয়ে মূল্যবান ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ৭০০ মেগাহার্টজ স্পেকট্রাম গত ১৭ বছর ধরে অখ্যাত এক প্রতিষ্ঠান—‘অলওয়েজ অন বাংলাদেশ’ (এওএনবি)-এর নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছে। আন্তর্জাতিক টেলিকম সংস্থা (আইটিইউ) যেই ব্যান্ডকে বিশ্বব্যাপী ৪জি ও ৫জি সেবার মূল ভরসা হিসেবে চিহ্নিত করেছে, সেটিই জিম্মি করে রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। ফলে কল ড্রপ, ধীরগতির ইন্টারনেট, গ্রামীণ-শহুরে বৈষম্য এবং দুর্বল নেটওয়ার্ক কাভারেজ ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। অথচ এ ব্যান্ড ছাড়া দেশের সর্বত্র উচ্চগতির নেটওয়ার্ক বিস্তার অসম্ভব। এর মধ্যে এওএনবি এখন প্রায় এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করছে—যেখানে আগে দাবিটি ছিল ৮০০ কোটি টাকা।

অন্যদিকে এই ব্যান্ড নিলাম হলে সরকারের রাজস্ব আয় হতে পারে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের ডিজিটাল রূপান্তরে বড় গতি জোগাবে।

বিজ্ঞাপন

৭০০ মেগাহার্টজ স্পেকট্রামকে বলা হয় ৪জি ও ৫জি নেটওয়ার্কের ‘কভারেজ লেয়ার’। এর তরঙ্গ অনেক দূর পর্যন্ত ভ্রমণ করতে সক্ষম এবং ভবনের ভেতরে সহজে প্রবেশ করে। ফলে গ্রামাঞ্চল, হাইওয়ে কিংবা দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় স্থায়ী ও নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ নিশ্চিত করতে এটির বিকল্প নেই।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০১৭ সালে সিদ্ধান্ত নেয় যে, ২০২০ সালের মধ্যে সব সদস্য রাষ্ট্রকে ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ড মোবাইল সেবায় ব্যবহারযোগ্য করতে হবে। ভারতও ২০২১ সালে এ ব্যান্ড নিলামে তুলে ৪জি-৫জি সেবা বিস্তার করে। বিশ্ব মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন জিএসএমএ একে ‘ডিজিটাল বিভাজন দূর করার হাতিয়ার’ হিসেবে অভিহিত করেছে।

বাংলাদেশে এই ব্যান্ড না থাকায় গ্রামীণ ও শহুরে অঞ্চলের মধ্যে ডিজিটাল বৈষম্য বাড়ছে। মহাসড়ক, রেলপথ বা ফেরিতে নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পাশাপাশি ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) ও স্মার্ট প্রযুক্তি বাস্তবায়নও বড় বাধার সম্মুখীন। বিশেষজ্ঞদের মতে, যতদিন পর্যন্ত ৭০০ মেগাহার্টজ কার্যকর না করা হবে, ততদিন দেশের ডিজিটাল উন্নয়ন কাঙ্ক্ষিত গতিতে এগোবে না।

বিটিআরসির ভুল সিদ্ধান্ত

২০০৭ সালে বিটিআরসি এওএনবিকে আইএসপি সেবার লাইসেন্স দেয় এবং ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ড থেকে ১২ মেগাহার্টজ (৭০৪–৭১০ ও ৭৩৪–৭৪০) তরঙ্গ বিনামূল্যে বরাদ্দ করে। অথচ মোবাইল অপারেটররা কোটি কোটি টাকা দিয়ে স্পেকট্রাম কিনে থাকে। পরে একই বছরে আইটিইউ এ ব্যান্ডকে মোবাইল টেলিকম সেবার জন্য বৈশ্বিকভাবে বরাদ্দ ঘোষণা করে।

২০১০ সালে বিটিআরসি এওএনবি-কে ৬+৬ মেগাহার্টজ ওয়াইফাই ব্যান্ডে স্থানান্তর হতে নির্দেশ দেয়, যা তারা অমান্য করে। ২০১৪ সালে বরাদ্দ বাতিল করা হলেও এওএনবি আদালতে যায়। ২০২৩ সালে উচ্চ আদালত বাতিলাদেশকে অবৈধ ঘোষণা করে—যা বিশেষজ্ঞদের মতে রাজনৈতিক প্রভাবের ফল।

বর্তমানে এওএনবি কেবল স্পেকট্রাম আটকে রেখেই নয়, বরং এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণেরও দাবি তুলেছে।

মামলা ঘিরে অস্বচ্ছতা

বিটিআরসির সিনিয়র কর্মকর্তারা জানান, প্রাথমিকভাবে মামলাটির নম্বর ছিল ৩৫। কিন্তু শুনানি এখন ২৯ পর্যন্ত হয়েছে। পরে এটি ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন নম্বরে তালিকাভুক্ত হয় এবং শেষপর্যন্ত তালিকা থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সূত্র জানাচ্ছে, মামলার পেছনে রাজনীতিবিদ, প্রভাবশালী আইনজীবী ও লবিস্টদের একটি নেটওয়ার্ক সক্রিয় রয়েছে, যারা ক্ষতিপূরণ আদায়ের সুযোগকে ‘জ্যাকপট’ হিসেবে দেখছে।

অন্যদিকে মোবাইল অপারেটররা বলছে, ৪৫ মেগাহার্টজ ব্যান্ড নিলামে তুলতে হলে আগে মামলাটি নিষ্পত্তি করতে হবে। না হলে সুষমভাবে স্পেকট্রাম বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব নয়।

১২ হাজার কোটি টাকার সম্ভাব্য রাজস্ব

চলতি বছরের শুরুতে আবারও নিলামের চেষ্টা হয়। প্রতি হার্টজের মূল্য ধরা হয়েছিল ২৬৩ কোটি টাকা। পুরো ব্যান্ড নিলামে গেলে সরকারের আয় হতে পারত প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এ বরাদ্দ হলে সারা দেশে ৪জি ও ৫জি নেটওয়ার্ক বিস্তার সম্ভব হবে। কমবে দীর্ঘদিনের দুর্বল নেটওয়ার্ক, ধীর ইন্টারনেট ও কল ড্রপের সমস্যা।

বর্তমানে মামলাটি আপিল বিভাগে বিচারাধীন। চলতি বছরের ৩১ আগস্ট লিভ মঞ্জুর হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের কৌশলগত স্পেকট্রাম সম্পদ সুরক্ষায় প্রধান উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রীর জরুরি হস্তক্ষেপ জরুরি।

প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য

প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বিষয়ক বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদা) ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব আমার দেশকে বলেন, বরাদ্দ ও বাতিলের চিঠি বিটিআরসির ফাইলে সংরক্ষিত আছে। এওএনবি ২০০৭ সালে আবেদন করে জানায়, তারা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে অবদান রাখবে। তখন ৭০০ মেগাহার্টজ জাতীয় ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দ পরিকল্পনায় (এনএফএপি) সম্প্রচারের জন্য সংরক্ষিত ছিল, মোবাইল সেবার জন্য নয়।

তিনি জানান, এওএনবিকে শুধু ৬+৬ মেগাহার্টজ দেওয়া হয়েছিল। পুরো ব্যান্ডে ৪৫ মেগাহার্টজ আছে, কিন্তু এওএনবির কারণে ২০ মেগাহার্টজ ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে পুরো ব্যান্ড অকশন করা সম্ভব হচ্ছে না। এই ৪৫ মেগাহার্টজের ভিত্তিমূল্য ১২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। নিলামে প্রতিযোগিতা হলে দাম আরো বাড়তে পারে।

তৈয়্যব আরো বলেন, এওএনবি আদালতে দাবি করেছে, বরাদ্দ বাতিল করার কারণে তাদের ক্ষতি হয়েছে। ২০২০ সালে তারা ৮০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করে চিঠি দিয়েছিল, কিন্তু পরে সে দাবি বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৮০০ কোটি টাকায়।

এ বিষয়ে জানতে এওএনবির সিইও ড. রিয়াজ শহীদকে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত