মন্তব্য প্রতিবেদন

গাজায় মুসলিম উম্মাহর দাফন

প্রকাশ : ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮: ৩৯
আপডেট : ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯: ১৪

গাজার জনগণের ওপর টানা ১৫ মাস ইসরাইলি বাহিনী নির্বিচারে গণহত্যা চালানোর পর সেখানে গত রোববার সাময়িক যুদ্ধবিরতি হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি মদতে পরিচালিত গণহত্যায় এ যাবৎ প্রাপ্ত হিসাব অনুযায়ী প্যালেস্টাইনের ৪৭ হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু নিহত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি হবে।

গুরুতরভাবে আহত মানুষের সংখ্যা এক লাখের ওপরে। যারা নিহত হয়েছে তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশ শিশু ও নারী। প্যালেস্টাইনের এই এলাকাটির মোট জনসংখ্যা ২১ লাখ। ইজিপ্ট ও ইসরাইলের মধ্যবর্তী গাজা ৩৬০ বর্গকিলোমিটারের একটি ক্ষুদ্র ভূখণ্ড। ভূমধ্যসাগর-তীরবর্তী গাজার প্রস্থ মাত্র ৬ থেকে ১২ কিলোমিটার। এ রকম একটি ছোট্ট জায়গায় ইসরাইলি বাহিনী যে বোমা ফেলেছে, তার বিধ্বংসী ক্ষমতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ব্যবহার করা পারমাণবিক বোমার কয়েকটির সমান।

বিজ্ঞাপন

গাজায় কোনো হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মসজিদ আর অবশিষ্ট নেই। অবিশ্বাস্য জিঘাংসা নিয়ে সব স্থাপনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহকৃত মিসাইল ও বোমায় ধ্বংস করা হয়েছে। প্যালেস্টাইনিদের জাতিগতভাবে নির্মূল করার জন্য গাজায় মানুষের বসতিকে প্রায় অসম্ভব করার লক্ষ্য নিয়েই মাসের পর মাস হামলা চালিয়েছে বর্ণবাদী ইসরাইল।

গণহত্যার মাত্রা বোঝার জন্য একটি পরিসংখ্যান দেওয়া আবশ্যক। ইসরাইলের ১৫ মাসব্যাপী হামলায় গাজার সাত শতাংশ জনগণ হয় নিহত, অথবা আহত হয়েছে। বাংলাদেশে এই হারে নিহত অথবা আহত হলে তার সংখ্যা দাঁড়াত অন্তত এক কোটি বিশ লাখ। পাঠক গণহত্যার মাত্রা ও বীভৎসতা কি বুঝতে পারছেন?

এটা সবারই জানা যে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি ও ফ্রান্সের মতো পশ্চিমা দেশগুলোর রাজনীতিবিদ এবং অধিকাংশ পশ্চিমা মিডিয়ার কাছে প্যালেস্টাইনিদের প্রাণের কোনো মূল্য নেই। এসব পশ্চিমা দেশের আশকারায় বর্বর ইসরাইলি রাজনীতিবিদরা প্যালেস্টাইনের জনগণকে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সামনে প্রকাশ্যে হিউম্যান এনিমেল (Human Animal) নামে ডেকে তাদের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করতে বিন্দুমাত্র অস্বস্তি বোধ করে না। অপরদিকে সেই পশ্চিমা বিশ্বেরই স্পেন ও আয়ারল্যান্ডের জনগণ এবং সরকার সরাসরি প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়ে জায়নবাদী ইসরাইলের নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে।

স্পেনের প্রায় প্রতিটি শহরে প্যালেস্টাইনের পতাকা এবং তাদের স্বাধীনতার পক্ষে নানারকম গ্রাফিতি দেখতে পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক কোর্ট অব জাস্টিসে ইসরাইলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে মামলা করেছে নেলসন ম্যান্ডেলার দেশ সাউথ আফ্রিকা। মামলার প্রাথমিক রায়ে ইসরাইলকে গণহত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।

সেই মামলায় বাংলাদেশসহ বিশ্বের কয়েকটি মুসলমান দেশ পক্ষভুক্ত হলেও সৌদি আরবসহ জিসিসির ছয় দেশের একটিও অদ্যাবধি মামলায় কোনোরকম অংশগ্রহণ করেনি। কাজেই ইসরাইলের গণহত্যায় মদত দেওয়ার জন্য কোনো পশ্চিমা দেশকে সমালোচনার আগে প্রত্যেক মুসলমানের আত্মসমালোচনা করা প্রয়োজন।

বিশ্বে মুসলমানদের দুটি প্রধান সংগঠন রয়েছে—ওআইসি ও আরব লিগ। এর বাইরে জিসিসিভুক্ত ছয় দেশের সবগুলোই যেহেতু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র, কাজেই আঞ্চলিক হলেও জিসিসিও মুসলমানদেরই সংগঠন। গত ১৫ মাসে এই তিন সংগঠন কয়েকটি কাগুজে বিবৃতি এবং শীর্ষ বৈঠকের নামে অর্থহীন গলাবাজি ও খানাপিনা ছাড়া ইসরাইলের বর্বর গণহত্যার বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কোনোরকম পদক্ষেপ নেয়নি।

লাতিন আমেরিকার বলিভিয়া ও মধ্য আমেরিকার ক্ষুদ্র দেশ বেলিজ গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করলেও কোনো তথাকথিত ইসলামিক দেশ সেই নৈতিক পদক্ষেপ নেওয়ার সাহস করেনি। কেবল তুরস্ক, বাহরাইন ও জর্ডান তাদের রাষ্ট্রদূতদের ইসরাইল থেকে প্রত্যাহার করেছে। শুধু তা-ই নয়, তথাকথিত মুসলিম বিশ্বের অনেক মোড়ল দেশ তাদের জনগণকে গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে দেয়নি।

সেসব দেশে সরকারি নির্দেশনা না মেনে ইসরাইলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করার অভিযোগে অনেককে গ্রেপ্তার এবং নানা মেয়াদে কারাদণ্ড পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। এর কারণ হলো, অধিকাংশ মুসলিম দেশে বহু কাল ধরে রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্র চলছে। জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চালিয়ে যেতে হলে অনির্বাচিত শাসকদের পশ্চিমা দেশসমূহ বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আবশ্যক।

কাজেই মার্কিন মুরুব্বি ক্ষেপে যেতে পারে, এমন কোনো কাজ করার স্বাধীনতা কিংবা সাহস এসব মুসলিম দেশের শাসকদের নেই। আর পৃথিবীতে কে না জানে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল কেবল নামেই দুটি ভিন্ন দেশ, ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় দুই দেশ অবিভাজ্য। মার্কিন নীতি অনুযায়ী, ইসরাইলের বিরুদ্ধে যেকোনো পদক্ষেপ মার্কিন স্বার্থবিরোধী। ওয়াশিংটনের ইসরাইল ও মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে পরিবর্তন না আসা পর্যন্ত বিশ্বের সব দেশকে সেই বাস্তবতা মেনে নিয়েই নিজেদের ভূরাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।

গাজায় গত ১৫ মাসের গণহত্যায় কেবল প্যালেস্টাইনের জনগণের ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েনি, প্রকৃতপক্ষে মুসলিম উম্মাহরও সেখানে দাফন হয়ে গেছে। অথচ বিশ্বে প্রায় ২০০ কোটি মুসলমানের এক বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে। ওআইসির সদস্য ৫৭টি দেশ। বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতি ও সভ্যতা যে উপাদানের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল, সেই জ্বালানি তেলের বিশ্ব মজুতের সিংহভাগ মুসলমানদের দখলে।

এদের মধ্যে অন্তত একটি মুসলমান রাষ্ট্রঘোষিত পারমাণবিক শক্তি। তারপরও মুসলমানরা কেন এতটা হীনবল? আমি মনে করি, সৌদি আরব, ইরান, ইজিপ্ট, তুরস্ক, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া—মাত্র এই ছয়টি মুসলমান দেশ ঐক্যবদ্ধভাবে ইসরাইল ও তার পশ্চিমা মুরব্বিদের গাজায় যুদ্ধ বন্ধের আল্টিমেটাম দ্বন্দ্বের শুরুতেই দিতে পারলে যুদ্ধবাজ ইসরাইল তার নির্মম গণহত্যা অনেক আগেই বন্ধ করতে বাধ্য হতো।

সম্মিলিতভাবে এই ছয়টি দেশের হাতে যে জ্বালানি তেল, সামরিক শক্তি, পারমাণবিক শক্তি, জনশক্তি, কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান ও ভূরাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে, তাকে উপেক্ষা করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেও সম্ভব নয়। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে এই ছয় দেশের কোনো ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সম্ভাবনা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।

হাজার বছরের শিয়া-সুন্নি ও আরব-পারস্য দ্বন্দ্ব সৌদি আরব ও ইরানকে বহু কাল ধরে চিরশত্রু করে রেখেছে। উপরন্তু, সৌদি রাজতন্ত্র মার্কিন সমর্থনেই টিকে আছে। ইজিপ্টের স্বৈরশাসক সিসির ক্ষমতা মার্কিন, ইসরাইলি ও সৌদি সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল। পাকিস্তানে প্রকৃত গণতন্ত্র নেই। দেশটির অজনপ্রিয় সরকার সামরিক বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল।

বৃহত্তম মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়ায় গণতন্ত্র থাকলেও দেশটির রাজনীতিবিদরা বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারে আগ্রহী নন বলেই মনে হচ্ছে। আঞ্চলিক জোট আসিয়ানের বাইরে তাদের তেমন কোনো ভূমিকা নেই। একসময় বিশ্বের অন্যতম সামরিক শক্তি ওসমান খিলাফতের উত্তরাধিকারী একা তুরস্কের পক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচরণ করা সম্ভব নয়। অতএব, বাস্তবতা হলো, আমরা যতই উম্মাহর কথা বলি না কেন, প্যালেস্টাইনে সেই ১৯৪৮ সাল থেকে ইসরাইলি দখলদারিত্ব থেকে মুক্তিতে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখায় লজ্জাজনক ব্যর্থতা বিশ্বের ২০০ কোটি মুসলমানকে সম্মিলিতভাবে স্বীকার করে নিতে হবে। এই দায় আমাদের সবার।

বাংলাদেশের দিকে তাকালেও আমরা কি গত ১৫ মাসে প্রকৃত অর্থে প্যালেস্টাইনের নিপীড়িত ভাইবোনদের পাশে দাঁড়িয়েছি? হাসিনার ফ্যাসিস্ট ইসলামবিদ্বেষী আমলের কথা না হয় বাদই দিলাম। ৫ আগস্ট-পরবর্তী মুক্ত বাংলাদেশেই বা গাজায় ইসরাইলি গণহত্যার বিরুদ্ধে কয়টা বিক্ষোভ হয়েছে? কয়টি জাতীয় পত্রিকায়, কত দিন এ বিষয়ে সংবাদ ছাপা হয়েছে? বাংলাদেশের কোনো শহরে কি প্যালেস্টাইনি পতাকা উড়তে দেখা যায়? আমরাও প্যালেস্টাইনের পাশে দাঁড়িয়ে নিজের, নিজ দল অথবা গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষায় বর্তমান বিশ্বমোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অসন্তুষ্ট করার ঝুঁকি নেইনি।

আমরা ভুলেই গেছি যে, মক্কা ও মদিনার পর আল কুদস মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান। দখলদার ইসরাইল প্রতিদিন সেই আল কুদসের অমর্যাদা করে চলেছে। আর আমরা ইসলামের জন্য সর্বদা গলা ফাটালেও প্রকৃত ঈমানের পরিচয় দিতে পারছি না। এমনকি বাংলাদেশে এত যে ওয়াজ হয়, সেখানেও আমরা ফিলিস্তিন নিয়ে আলোচনা শুনতে পাই না বললেই চলে।

হার্ভার্ড ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্যালেস্টাইনের মুক্তি সংগ্রামের সমর্থনে লড়াকু ছেলেমেয়েরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জায়নবাদী প্রশাসনের সব চাপ উপেক্ষা করে ক্যাম্প স্থাপন ও বিশাল ব্যানার, পতাকা প্রভৃতি টানালেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটে অনুরূপ কোনো কার্যক্রম আমাদের ছাত্ররা নেয়নি।

আল্লাহর প্রতি ঈমান, আপন শক্তি ও ইসলামি আদর্শে বলীয়ান হয়ে মুসলিম বিশ্বকে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় চলমান জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হলে সর্বপ্রথম স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে জনগণকে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ ও সিরিয়ায় স্বৈরতন্ত্রের পতন আমাদের আশাবাদী করে তুলেছে।

আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ করে দেশে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে উম্মাহও ঐক্যবদ্ধ হবে। গণতান্ত্রিক মুসলিম বিশ্বে কোনো শাসককে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা অন্য কোনো হেজেমনিক রাষ্ট্রের দ্বারস্থ হতে হবে না। মহান আল্লাহ তায়ালা ও দেশের জনগণের সমর্থন হবে সেই শাসকের ক্ষমতার একমাত্র ভিত্তি।

বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবে তরুণরা কোনো বাইরের শক্তির তোয়াক্কা না করে কেবল অতুলনীয় সাহস ও আল্লাহর রহমতের সমন্বয়ে একবিংশ শতাব্দীর এক দানব ফ্যাসিস্ট শাসককে পরাভূত করে সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে মুক্তির এক নতুন দিশার সন্ধান দিয়েছে। নানা কারণে আরব বসন্তে মুসলিম দুনিয়ায় নিপীড়িত মানুষের মুক্তি আসেনি। আল্লাহ সহায় হলে বাংলাদেশের ‘বর্ষা বিপ্লব’ হয়তো সেই মুক্তি আনতে পারে। দলমত নির্বিশেষে বর্ষা বিপ্লবের সব শহীদ আমাদের স্মৃতিতে চির জাগরূক থাকুক।

এমবি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত