ঈদের নামাজের সুযোগ পেতে অনশন করি

রকীবুল হক
প্রকাশ : ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১০: ২৯

পবিত্র রমজানে তারাবির নামাজে ইমামতি শেষে বেশ ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফেরেন মুফতি আলী হাসান উসামা। প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন পরিবারের সঙ্গে রাতের খাবারের। কিন্তু এমন মুহূর্তে জঙ্গি আস্তানার আদলে তার বাসা ঘিরে ফেলে অসংখ্য পুলিশ। আটক করে প্রথমে রাজবাড়ীর এসপি অফিসে কিছুক্ষণ রাখার পর তাকে নিয়ে ঢাকায় আসে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) একটি দল।

কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই তাকে জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়ানোর চেষ্টা করা হয়। একপর্যায়ে দেওয়া হয় জাতীয় সংসদে হামলার প্রস্তুতি-সংক্রান্ত একটি মামলা। রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে শীর্ষ আলেমদের বিরুদ্ধে মিথ্যা স্বীকারোক্তির চেষ্টায়ও ব্যর্থ হয় পুলিশ। একপর্যায়ে সেই মামলা থেকে তিনি অব্যাহতি পেলেও বিনা অপরাধে দীর্ঘ এক বছর পার করতে হয়েছে কারাগারে।

বিজ্ঞাপন

আওয়ামী লীগের স্বৈরশাসনে আলেম-ওলামাদের ওপর জুলুল-নির্যাতনের তরতাজা সাক্ষী তরুণ এই আলেম। মঞ্চে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওয়াজ ও ধর্মীয় আলোচনায় বেশ জনপ্রিয় মুখ তিনি। রাজধানীর মিরপুরে বায়তুস সালাত জামে মসজিদের খতিবের পাশাপাশি সিলেট জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়ার মহাপরিচালকের দায়িত্বে আছেন তিনি। আর এসব ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার কারণেই মূলত তিনি বিগত সরকারের রোষানলে পড়েছিলেন বলে মনে করেন এই আলেম।

মুফতি উসামা বলেন, বিগত দিনগুলোয় সবচেয়ে বেশি জুলুম-নির্যাতন হয়েছে ইসলামপন্থি ও ওলামায়ে কেরামের ওপর। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আলেমদের ওপর যে নির্যাতন করেছে, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আওয়ামী রেজিমের প্রতিবাদ করার কারণে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে ইন্তেকালের আগে তিন বছর গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল মুফতি আমিনীকে। তার ইন্তেকালের ছয় মাস পর ঐতিহাসিক শাপলা চত্বর ট্র্যাজেডি হয়। সেটাকে কেন্দ্র করে এত বড় জুলুল-নির্যাতন হয়, যার কোনো নজির আছে বলে জানা নেই। এরপর ২০১৬-১৭ সালের দিকে অসংখ্য আলেম-ওলামাকে টার্গেট করে করে ক্রসফায়ার দেওয়া হলো। কতজনকে গুম করে নেওয়া হলো, যার কোনো হদিসই পাওয়া যায়নি।

তিনি বলেন, ২০২১ সালে এতবেশি জুলুম-নির্যাতন হয়েছে, ব্রিটিশ আমলের পরে একসঙ্গে এতবেশি আলেম-ওলামা নির্যাতন কখনো হননি। একসঙ্গে তিন হাজারের বেশি আলেম-ওলামাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নির্যাতনের মাত্রাও এত বেশি ছিল যে, কেউ কেউ লাশ হয়ে কারাগার থেকে বের হয়েছেন। যারা জীবিত ছিলেন, তাদের একজনেরও অবস্থা এখন ভালো না। যারা কারাগারে যাননি তাদেরও দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে।

মুফতি উসামা বলেন, ‘আমরা যারা মাঠে-ময়দানে কাজ করি, এমন একটা সপ্তাহ যায়নি, যেটাতে ভোগান্তি পোহাতে হয়নি। কোনো মাহফিলের জন্য মাঝপথে যাওয়ার পর পুলিশের ফোন আসে যে, ওয়াজ করতে দেওয়া হবে না। এমনকি স্টেজে ওঠার সময় ঘোষণা আসছে, মাহফিল করা যাবে না। আর কমন দৃশ্য হচ্ছে- যেখানে করা যাবে সেখানেও বলে দেওয়া হতো যে, সরকারবিরোধী কোনো কথা বলা যাবে না।

বিনা অপরাধে গ্রেপ্তার ও জেল খেটেছেন এই আলেম। সেই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২০২১ সালের ৫ মে ২৩তম রমজানে রাজবাড়ী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে তারাবির নামাজ পড়িয়ে বাসায় ফিরি। তখনো রাতের খাবার খাইনি। কিছুক্ষণ পর দেখি বাসাটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমনভাবে ঘেরাও করেছে যেন কোনো তথাকথিত জঙ্গি আস্তানায় তারা এসেছে। এসপি সাহেব কথা বলতে চেয়েছেন, এমন অজুহাতে স্থানীয় থানার ওসি ও অন্যরা আমাকে আটক করে নিয়ে যান। এরপর আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে ফ্যামিলি কিছুই জানতে পারেনি, আমিও বুঝতে পারছিলাম না কোথায় যাচ্ছি।’

তিনি জানান, আটকের পর তাকে প্রথমে এসপি কার্যালয়ে এক-দেড় ঘণ্টা রাখা হয়। এ সময় পুলিশ তার বাড়িতে গিয়ে তল্লাশি চালায় এবং সেখানে বইপত্র, ডিভাইসÑ সবকিছু নিয়ে আসে। এমনকি তার মায়ের মোবাইলও নিয়ে যায়। তার মাদরাসা অফিসে হানা দেয়। মসজিদেও কয়েকবার গিয়ে তদন্ত করে। অবশেষে রাত দেড়টার দিকে তারা একটা গাড়িতে তুলে ঢাকার দিকে যাত্রা শুরু করে। এ সময় স্থানীয় এসপি তাদের লিখিত দিয়ে নিয়ে যেতে বলেন। তখন গাড়িতে থাকা কাউন্টার টেরোরিজমের একজন ইনস্পেক্টর মোবাইলে অন্য কাউকে বলেন, তাকে তো এখন গুম করা যাবে না। কারণ তাকে লিখিত দিয়ে নিতে হবে। এ ছাড়া এসপি থানার ওসিকে দিয়ে একটি জিডিও করান। এতে তিনি গুম হওয়ার আশঙ্কা থেকে কিছুটা স্বস্তি পান।

ওই রাতেই রাজবাড়ী থেকে ঢাকায় আনা হয় মুফতি উসামাকে। কাউন্টার টেরোরিজমের অফিসে যখন পৌঁছান, তখন সাহরির সময় শেষ। পরদিন তাকে কোর্টে ওঠানো হয়। তখনো তিনি জানেন না, তাকে কোন মামলায় জড়ানো হয়েছে। বারবার জিজ্ঞাসা করলেও পুলিশ কোনো জবাব দেয়নি। তখন প্রথম ধাপে তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ড দেয় আদালত। সেটি শেষ হলে আবার দুদিন রিমান্ড দেয়।

এ প্রসঙ্গে মুফতি উসামা বলেন, ‘রিমান্ডে শারীরিক টর্চার না করলেও মানসিক টর্চাসের কোনো কমতি ছিল না। জিজ্ঞাসাবাদের সময় চোখ ও হাত দুটো হাতকড়া দিয়ে পেছনে বেঁধে রাখা হতো। কারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে জানি না। রিমান্ডে এলোপাতাড়ি জিজ্ঞাসাবাদ করত। তারা আমাকে দিয়ে কয়েকজন শীর্ষ আলেমকে ফাঁসানোর টার্গেট করেছিল। সবচেয়ে বেশি করা হয়েছিল জুনায়েদ বাবুনগরীকে নিয়ে।’

তিনি বলেন, তার কয়েকটি বই বেস্ট সেলার হওয়ায় রকমারি ডটকমের সোহাগকেও জঙ্গি বানাতে চেয়েছিল পুলিশ, যাতে তাকে গ্রেপ্তার করে আনা যায়। এ ছাড়া হেফাজতের গ্রেপ্তার হওয়া নেতাদের দিয়েও তার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়। তাদের মূল টার্গেট ছিল- একজনকে দিয়ে আরেকজনকে ফাঁসানো।

মুফতি উসামা জানান, মানসিক প্রতিবন্ধী একটি ছেলেকে দিয়ে নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে পুলিশ স্বীকারোক্তি নেয় যে আমি, মুফতি হারুন ইজহার, মুফতি আমির হামজা এবং মুফতি মাহমুদুল হাসানের বক্তব্য শুনে উজ্জীবিত হয়ে তরবারি হাতে সংসদ ভবনে হামলা করতে গিয়েছি। যদিও তরবারির কোনো ফুটেজ তারা দেখাতে পারেনি। এ কারণে মামলায় আমাদের সবাইকে অব্যাহতি দেন বিচারক। কিন্তু এক বছর তো হয়রানির শিকার হয়েছি আমরা। তবে মামলা শেষ হলেও মাদরাসা ও বাসা থেকে প্রায় ৬ লাখ টাকা মূল্যের যে ডিভাইস নিয়ে এসেছিল, তা আজও ফিরিয়ে দেয়নি।’

কারাগারের কষ্টকর জীবনের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, সেখানে ছিল বৈষম্য। সেখানে অন্য চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ মামলার আসামিরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে। কেরানীগঞ্জ কারাগারে তো সব ধরনের সুবিধা যেমনÑ জিম, সেলুন, সুপারশপের মতো দোকান আছে এবং ফেরিওয়ালারা ঘোরাফেরা করেন। কিন্তু ২০২১ সালে মোদিবিরোধী আন্দোলনের পর আটক হওয়া আলেমদের ২৪ ঘণ্টা লকআপে রাখত। ফাঁসির আসামিদের রাখার জন্য ছোট রুমে সাত-আটজনকে রাখা হতো। এতে ঠিকমতো শোয়া তো দূরের কথা, সোজা হয়ে বসাও যেত না। করোনার কারণে আবার ফ্যামিলির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দিত না। অন্য আসামিদের বিকল্প হিসেবে সপ্তাহে এক দিন ১০ মিনিট ফোন করতে দিলেও আমাদের সেই সুযোগ দিত না। আমরা চিঠি লিখলেও তা আর পৌঁছাত না। ছয় মাস পর্যন্ত আমার পরিবার আমার সম্পর্কে কোনো খোঁজখবর জানতেই পারেনি। আমার বাবা পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছিলেন। মা কয়েকবার স্ট্রোক করার মতো অবস্থা হয়েছিল। ভাই, নিজের স্ত্রী-সন্তানরা সবাই দুশ্চিন্তায় ছিল যে, আদৌ কি ছাড়বে, কবে ছাড়বে?

মুফতি উসামা বলেন, বাসায় আমার দুটি ছোট বাচ্চা ছিল। তারা কী অবস্থায় আছে কিছুই জানি না। বাবা-মা কোন অবস্থায় আছে, মাদরাসা আছে, নাকি বন্ধ হয়ে গেছে, কিছুই জানতে পারছিলাম না। টানা ছয় মাস এভাবে বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে। আমার মামলার অবস্থাও জানতে পারিনি। কবে বের হব তা ছিল অজানা।

তিনি বলেন, ছয় মাস পর তাকে কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়। সেখানে অন্যরা হাউসের পানি নিতে পারলেও আমাদের বাথরুমের লাইনের পানি খেতে হতো। এতে শারীরিক সমস্যা হতো। আমার মাথার বাবরি চুল ঝরে যেত। শরীরে দাউদ হয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ত। চিকিৎসার জন্য অনুরোধ করেও কাজ হয়নি। থাকার জন্য যে দুটি কম্বল দেওয়া হতো, তা গায়ে দিলে কঠিন চর্মরোগ হতো। গায়ে সূর্যের আলো লাগত না। বাইরে থেকে দেখলে মনে হতো আমরা চিড়িয়াখানায় বন্দি আছি। চোর-ডাকাত-খুনি-ধর্ষকরা খেলাধুলা করছে, আড্ডা দিচ্ছে অথচ আমরা লকআপে দুই হাতে শিকলটা ধরে ওই দৃশ্য ফ্যালফ্যাল করে দেখছি। সবচেয়ে খারাপ লাগত, সবাই যখন লকআপে, তখন বিকালে টপটেরররা ব্যাডমিন্টন খেলত, জেলার ও অন্যরা দাঁড়িয়ে তা দেখতেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা খেলত। অথচ আমাদের চোখের পানি ঝরানো ছাড়া কিছুই ছিল না। অনশন করে আমরা ঈদের নামাজের সুযোগ করে নিই। এভাবে সবকিছুতে বৈষম্যের শিকার হই।

মুফতি উসামা বলেন, ‘আমাকে একটা মামলা দিলেও তা শুনানি হতে হতে দীর্ঘ এক বছর কেটে যায়। ২০২১ সালে ২২ রজমান আটক হয়ে পরবর্তী বছর এক রমজানে মুক্তি পাই কাশিমপুর কারাগার থেকে। বের হওয়ার পরও অবস্থা স্বাভাবিক ছিল না। নিয়মিত চাপে রাখা হতো। সে সময় দেশের পরিস্থিতি ছিল থমথমে। কেউ কিছু বলতে সাহস পেতেন না। আমি ঝুঁকি নিয়ে জেলখানার বিষয়গুলো মাহফিলে তুলে ধরি।’

নির্যাতিত এই আলেম বলেন, হাসিনার ফ্যাসিবাদের জুলুমের সবচেয়ে বড় দুটো হাতিয়ার ছিলÑ রাজাকার ও জঙ্গি। বয়স বেশি হলে রাজাকার আর বয়স কম হলে জঙ্গি বানানো হতো। আমাকে জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়াতে চেষ্টা করেছিল। আমার বিষয়ে ভারতের কারও সঙ্গে কথাও বলেছিলেন পুলিশ কর্মকর্তারা। তবে শেষ পর্যন্ত কোনো প্রমাণ না পেয়ে জড়াতে পারেনি। তিনি বলেন, সর্বযুগে কাফেরদের চেয়ে মুনাফিকরা বেশি ক্ষতিকর। আওয়ামী লীগের মধ্যে আমরা তার পূর্ণ বৈশিষ্ট্য দেখেছি। ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর জন্য তাদের চেয়ে বড় ক্ষতিকর আর কিছু হতে পারে না।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত